বাস্তু শাস্ত্র (শেষ পর্ব)

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২১ | ১০:৫০ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২১ | ১০:৫০ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 223 বার দেখা হয়েছে

বাস্তু শাস্ত্র (শেষ পর্ব)

মন্দির নির্মাণের মৌল সিদ্ধান্ত

সুরেন্দ্র কাপুর

চিরকালই বিশ্বের নানা সম্রাট, রাজা, সাধু সন্তগণ, ধনীব্যক্তি, ব্যবসায়ী এবং এমনকি সাধারণ মানুষ মন্দির অথবা প্রার্থনা-কক্ষ নির্মাণ করেছেন। এই মন্দির ও প্রার্থনালয়গুলিতে বহু মানুষের সমাগম ঘটে। সুতরাং মন্দির ও প্রার্থনালয়গুলি নির্মাণের ক্ষেত্রে বাস্তুসিদ্ধান্ত মেনে চলা উচিত।
বিজ্ঞানের যে কোনও শাখায় উন্নতি সাধন হয়েছে। ক্রমাগত অধ্যয়ন ও গবেষণার ফলে এটা সম্ভব হয়েছে। সেই রকমই বাস্তুবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। আমাদের পূর্ব পুরুষদের নিরলস প্রচেষ্টা ও সেই সময়ের মহান ব্যক্তিদের আত্মত্যাগ, গবেষণা ও ক্রমাগত অধ্যয়ণ বাস্তুবিজ্ঞানের উন্নতিসাধনে সহায়ক হয়েছে। বাস্তুবিজ্ঞানের
উন্নতির জন্য তাদের অবদান মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যে এক বিশেষ পদক্ষেপ। এ  ক্ষেত্রে পরীক্ষা করে যেটা জানা গিয়েছে তা হল বাস্তুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যে সব মন্দির তৈরি হয়েছে তা এখনও ভাল অবস্থায় ও আড়ম্বরপূর্ণ রয়েছে। আর যে সব মন্দির বাস্তুবিজ্ঞান মেনে তৈরি হয়নি সেগুলি হয় ভেঙে পড়েছে অথবা ইতিমধ্যেই ভগ্ন অবস্থায় পরিণত হয়েছে। “সমরাঙ্গন-সূত্রধার” অনুসারে ৬৪ রকমের মন্দিরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অগ্নিপুরাণ, গরুড়পুরাণ ও প্রয়োগ মঞ্জরী অনুসারে ৪ রকমের মন্দিরের কথা বলা হয়েছে। বরাহমিহির ২০ ধরনের মন্দিরের কথা বলেছেন। এই ২০ রকমের মন্দির ও প্রাসাদ হল ১. মেরু, ২. মন্দার, ৩. কৈলাস, ৪. বিমানচন্দ, ৫.নন্দন, ৬. সমুক্ষগ, ৭. পদ্ম, ৮. গরুড়, ৯. নন্দীবর্ধন, ১০. কুঞ্জর, ১১.গুহারাজ, ১২. বৃষ, ১৩. হংস, ১৪. সর্বতোভদ্র, ১৫. ঘট, ১৬. সিংহ, ১৭. বৃত্ত, ১৮. চতুষ্কোণ, ১৯. ষোড়শশ্রী এবং ২০. অষ্টশ্রী।
ভবিষ্য পুরাণে বলা হয়েছে-

বনোপান্তনদীশৈল নির্ঝরোপান্তভূমিষু ।
রমন্তে দেবতা নিত্যং পুরেষুদ্যানবৎসুচ ॥

অর্থাৎ নদী, পাহাড়, বৃক্ষ, ঝর্না ও এমন শহর যেখানে বাগান আছে সেখানেই ভগবান চিরকাল লীলাঙ্গন হন।

মন্দির ও প্রার্থনালয়ের জমি

গ্রাম, ছোট শহর অথবা বড় শহর সর্বত্রই মন্দির বা প্রার্থনা কক্ষ নির্মাণের ক্ষেত্রে এরকম জমি ঠিক করতে হবে যা লোকালয়ের খুব একটা দূরে হবে না, মানুষ যাতে সেখানে সহজেই পৌঁছতে পারে। জমির মাপ হবে বেশ বড় ধরনের। এ ক্ষেত্রেও বাস্তুবিজ্ঞানকে অনুসরণ করা দরকার উদাহরণ হিসেবে এমন একটা জায়গা, যেখানে দক্ষিণ বা পশ্চিম দিকে অথবা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে উঁচু পাহাড় আছে অথবা পাহাড়ি এলাকা। জমিটা চৌকো অথবা আয়তাকার। মন্দির বা প্রার্থনালয়ের জন্য এরূপ জমি খুবই ভাল। যে জমির পাশে গভীর নদী আছে, যার জল উত্তরাংশে এবং পূর্বাংশের পূর্ব, উত্তর অথবা উত্তর-পূর্ব দিকে বয়ে চলেছে, এরকম জমিও বেশ ভাল। যে জমির দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে উঁচু পাহাড় এবং পূর্ব, উত্তর অথবা উত্তর-পূর্ব দিকে জল সেখানে যদি মন্দির করা যায় তা হলে সেই মন্দির খুব অল্প সময়ে শক্তি লাভ করবে। এর ফলে এই শক্তির আকর্ষণেই দর্শনার্থীরা ছুটে যাবেন। শুধু দর্শনার্থীই নয় এই ধরনের মন্দির প্রচুর ধনসম্পদও লাভ করবে। এরূপ জমিতে মন্দির নির্মাণ সব দিক থেকে ভাল । যদি পূর্ব, উত্তর অথবা উত্তর-পূর্ব দিকে জলাশয় থাকে তা হলে মন্দির ফলপ্রসূ হবে। মন্দিরের মুখ্যদ্বার গোপুরমের বিপরীত দিকে যদি রাস্তা থাকে এবং এই রাস্তাটি দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে ঢালু থাকে অথবা পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে থাকে তা হলে মন্দির হবে খুব ভাল । রাস্তাসহ যে সব জমি উত্তর-পূর্ব দিকে থাকে তা হলে মন্দির হবে খুব ভাল । রাস্তাসহ যে সব জমি উত্তর-পূর্ব অথবা পূর্বাংশের উত্তর-পূর্ব অথবা পূর্ব বা দক্ষিণাংশের দক্ষিণ-পূর্ব অথবা পশ্চিমাংশে উত্তর-পশ্চিম দিক্ উন্নত থাকে অথবা এগিয়ে থাকে সে সব জমি মন্দির নির্মাণের পক্ষে খুবই ভাল । জমির দু দিক্ অথবা তিন দিকে রাস্তা থাকলে সে জমিতেও মন্দির নির্মাণ করা ভাল। এই সব মন্দির অত্যন্ত শুভ। এ ধরনের জমিতে মন্দির করলে তা হবে শক্তিশালী এবং দর্শনার্থী ভক্তরা এরকম মন্দিরের প্রতি আকর্ষিত হবেন। বৈভব ও সম্পদেও ভরে উঠবে এ ধরনের মন্দির। পূর্ব দিকে মুখ করা মন্দির খুবই ভাল । সুতরাং, মন্দিরের জন্য পূর্ব অথবা উত্তর পূর্ব দিকে জমি নির্ধারণ করা উচিত। যদি মন্দিরের জমির পাশে কোনও রাস্তা না থাকে তা হলে পূর্বমুখী মন্দির তৈরি করে তার পর রাস্তা তৈরি করতে হবে। তবে দক্ষিণমুখী মন্দির কখনও করা উচিত নয়, কারণ এ ধরনের মন্দির বাস্তু-বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ প্রতিকূল ।

মন্দির নির্মাণ

মন্দির নির্মাণ সম্পর্কে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হল: প্রথমেই বৈদিক নিয়মে মন্দির নির্মাণের জমিটিকে পবিত্র করে নিতে হবে। একটি চৌকো পুকুর জমির উত্তর পূর্ব দিকের উত্তরে খুঁড়তে হবে। এটি পুষ্করিণী ।
মন্দিরের উচ্চতা হবে চওড়ার দ্বিগুণ। মন্দিরের দরজার উচ্চতাও চওড়ার দ্বিগুণ হবে। দরজার দুটি পাল্লা হবে। পাদদেশ সহ বিগ্রহের উচ্চতা মন্দিরের দরজার উচ্চতার ৮/১ অংশের চেয়েও কম হবে। পাদদেশের উচ্চতার চেয়ে বিগ্রহের উচ্চতা হবে দ্বিগুণ। আর প্রতিটি মন্দিরের বিগ্রহকে পূজো, আরতি ও ভোগ নিবেদন করতেই হবে।

মন্দিরের গর্ভগৃহ নির্মাণ

দক্ষিণও পশ্চিম দিকে যথেষ্ট ফাঁকা জমি ছেড়ে মন্দিরের গর্ভগৃহ তৈরি করা উচিত। মন্দিরের মুখ্য চত্বর ধরেই গর্ভগৃহ নির্মাণ করা উচিত। তবে গর্ভগৃহের পূর্ব দিকে ফাঁকা জায়গা দক্ষিণের ফাঁকা জায়গা থেকে যেন দ্বিগুণের কম থাকে। চারটি দিকে সমান ফাঁকা জায়গা রেখেও বা মন্দির নির্মাণ করা যেতে পারে।

মন্দির সংলগ্ন ছোট মন্দির

সাধারণত মুখ্য বিগ্রহের সঙ্গে সম্পর্কিত অপেক্ষাকৃত ছোট বিগ্রহ স্থাপন করা হয় এই সহায়ক মন্দিরগুলিতে। মূল মন্দিরের মধ্যেই এই সহায়ক মন্দিরগুলি তৈরি করা হয়ে থাকে। এ ধরনের মন্দির দক্ষিণ-পশ্চিম, দক্ষিণ-পূর্ব, উত্তর-পশ্চিম অথবা উত্তর-পূর্ব দিক ঘেঁষে তৈরি করা উচিত নয়। অন্যান্য মন্দিরও শিখর মুখ্য মন্দিরের মধ্যেই বাস্তু সিদ্ধান্ত অনুসারে দক্ষিণও পশ্চিম দিকে তৈরি করা উচিত। কোন অবস্থাতেই তা যেন সীমানা প্রাচীরকে স্পর্শ না করে এবং মন্দির পরিক্রমার জন্য জায়গা রাখতে হবে। ভুল করেও যেন দক্ষিণ-পূর্ব, উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব কোণ বন্ধ না করা হয়। মন্দির পূর্বমুখী হলে বিগ্রহ যেন উত্তরমুখী হয়। মুখ্য বিগ্রহের সঙ্গীকে পূর্ব অথবা উত্তরমুখী রাখতে হবে। বৃষ্টির জল এবং ব্যবহৃত জল পূর্বাংশের উত্তর-পূর্ব অথবা উত্তরাংশের উত্তর-পূর্ব দিক্ দিয়ে বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।“ সমরাঙ্গন সূত্রধার”-এ বলা হয়েছে-
সব দিক থেকে যথার্থভাবে ভগবানকে স্থাপিত করার পর তাঁকে পূজো করা উচিত। এই নিয়ম সম্পূর্ণরূপে মেনে মন্দির তৈরি করলে সেই মন্দির অল্প সময়ের মধ্যেই অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।
“ময়মতম্” অনুসারে-যদি মন্দিরের পরিমাপ সব দিক দিয়ে ঠিক হয় তা হলে সমগ্র বিশ্বও পরম উৎকর্ষ লাভ করবে। হরে কৃষ্ণ!

বাস্তু শাস্ত্র: গৃহ নকশার বিজ্ঞান

বাস্তু শাস্ত্র: গৃহ নকশার বিজ্ঞান (পর্ব-১)

বাস্তু শাস্ত্র (পর্ব-২)

বাস্তু শাস্ত্র (পর্ব-৩)

বাস্তু শাস্ত্র (পর্ব-৪)

বাস্তু শাস্ত্র (পর্ব-৫)


 

চৈতন্য সন্দেশ মে – ২০১৭ প্রকাশিত
সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।