বাস্তু শাস্ত্র (পর্ব-৪)

প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২১ | ৮:৫৯ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২১ | ৯:০৮ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 379 বার দেখা হয়েছে

বাস্তু শাস্ত্র (পর্ব-৪)

রঙের সৌন্দর্য ও কল্যাণবার্তা

সুরেন্দ্র কাপুর

স্বাস্থ্য ও মনের ওপর রঙের প্রভাব প্রচণ্ড। আকর্ষক রঙের পরিবেশে মনও থাকে আনন্দে পরিপূর্ণ। একঘেঁয়ে ভাব কেটে যায়। নৈরাশ্য দূর হয়। বিভিন্ন ধর্মীয় কার্যাদিতে লাল বর্ণের প্রতীক স্বরূপ সিঁদুর, পীত বর্ণের প্রতীক স্বরূপ হলুদ, সবুজ বর্ণের প্রতীক স্বরূপ পত্র, সাদা বর্ণের প্রতীক স্বরূপ আটা ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। এগুলি সবই স্বাস্থ্য, স্ফূর্তি ও কল্যাণের জন্য। সূর্যরশ্মিতে সকল রঙের সংমিশ্রণ থাকে। সূর্যের রশ্মি থেকে রামধনুর সাতটি রং আমাদের পরিবেশ ও মনকে প্রভাবিত করে। সূর্যের ছত্রছায়ায় নানা বনস্পতি এবং জীব যেরকমভাবে লালিতপালিত হয়, সেভাবে সবুজ, লাল ও নীল রঙ মানুষকে সুস্থ, সবল, যশস্বী ও গৌরবান্বিত তৈরি করে। লাল রঙ সৌভাগ্যের চিহ্ন আর সবুজ রঙ ব্যক্ত করে শুভেচ্ছা।

লাল রঙ :

সনাতন ধর্মে ধর্মীয় রঙ হল লাল। এই লাল রঙকে সব থেকে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রায় প্রতিটি মাঙ্গলিক কাজে লাল রঙের ব্যবহার হয়ে থাকে। প্রায় সকল দেব-দেবীর মূর্তিতে লাল সিঁদুরের তিলক পরানো হয়। লাল তিলক শৌর্য ও বিজয়ের প্রতীক। লাল তিলক লাগালে ব্যক্তির মধ্যে তেজস্বিতা, পরাক্রম, গৌরব ও যশের অস্তিত্ব আছে বলে মনে করা হয়। গৌরবের রঙ হল লাল। সুস্বাস্থ্য ও শক্তি মানুষের শরীরের গোলাপি আভা থেকেই প্রকাশিত হয়। প্রাচীনকাল থেকেই লাল রঙের বিশিষ্ট স্থান রয়েছে ভারতীয় নারীর জীবন ও শৃঙ্গারে। সধবা মহিলারা মাথায় সিঁদুর বা লাল টিপ পরেন। নারীর গৌরব, সম্মান সৌভাগ্য এবং স্নেহ লাল রঙ থেকেই বিকশিত হয়। লাল রঙ শক্তি, উৎসাহ, স্ফূর্তি ও পরাক্রমের প্রতীক। আনন্দ প্রকাশের রঙও লাল। বিবাহ, জন্ম ও উৎসবে আনন্দের মনোভাব ব্যক্ত হয় লাল রঙ দিয়েই। ধনদাত্রী দেবী লক্ষ্মীও পরেন লাল বস্ত্র। লাল রঙ ধনসম্পদ, বিপুল সম্পদ সমৃদ্ধির শুভ প্রকাশ করে। মা লক্ষ্মীকে লাল পদ্মফুলের ওপর বসানো হয়। এই লাল পদ্ম হলো সমৃদ্ধির প্রতীক।

গেরুয়া রঙ :

গেরুয়া হলো আধ্যাত্মিক প্রকাশের রঙ। এটি জ্ঞান, ত্যাগ, তপস্যা ও বৈরাগ্যের প্রতীকও বটে। হিন্দু যোগী, তপস্বী, সাধু, বৈরাগী সকলেই গেরুয়া বস্তু পরেন। মনে হয় তাঁরাও যেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে, মৃত্যু থেকে অমৃতের দিকে এবং অজ্ঞানতা থেকে জ্ঞানের দিকে অগ্রসর হয়ে চলেছেন। যেমন অগ্নি থেকে জ্যোতির প্রকাশ তেমনই গেরুয়া বস্ত্রধারী যোগীও আধ্যাত্মিক জ্যোতির মাধ্যমে প্রজ্বলিত হয়ে ওঠেন। গেরুয়া বস্ত্রধারী সাধু দেবতাদের গুণগুলিকে নিজের মধ্যে বিকশিত করতে চান। এই রঙ শুভ সংকল্পের সূচক।

সবুজ রঙ

সবুজ রঙ সমগ্র প্রকৃতির মধ্যে ব্যাপ্ত রয়েছে। আমাদের জীবনে এই সবুজ রঙটি অধ্যাত্ম প্রেরণাদায়ী পরিবেশের প্রতীক। এটি গাছপালা, শস্য সুশোভিত খেত, কেয়ারি, পার্বত্য অঞ্চল আচ্ছাদনকারী মধু রঙ। সবুজ মনকে শান্তি দেয় এবং হৃদয়কে করে শীতল। মানুষকে সুখ, শান্তি, স্ফূর্তি দেয় এই সবুজ রঙ। মুনিঋষিরা নিজেদের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য উঁচু সবুজ পর্বত শীর্ষে, লম্বা ঘাসের সবুজ মাঠের মধ্যে শান্ত, সুখী পরিবেশকে আপন করে নিয়েছিলেন।

হলুদ রঙ

এই রঙ সুখ, শান্তি, অধ্যয়ন, জ্ঞান, যোগ্যতা, একাগ্রতা এবং মানসিক ও বৌদ্ধিক উন্নতিরও প্রতীক। হলুদ বা বাসন্তী রঙ মস্তিষ্ককে প্রফুল্ল ও উত্তেজিত করে। জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ আনে। মানুষের মনে নতুন নতুন সুস্থ চিন্তাধারা তৈরি করে এই বাসন্তী রঙ। বসন্ত ঋতু মনের আনন্দদানকারী জ্ঞানবর্ধক ঋতু। ভগবান শ্রীবিষ্ণুর পোশাকের রঙ হলুদ, তাঁর শীতবস্ত্র অসীম জ্ঞানের দ্যোতক। ভগবান শ্রীগণেশের ধুতিও হলুদ রঙের। সকল মঙ্গল কার্যে হলুদ ধুতি পরা গণেশ বিঘ্ননাশকারী বলে গণ্য হন।

সাদা রঙ

শ্বেত রঙের সৃষ্টি সাতটি বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণে। সূর্যের সাদা রশ্মিকে ভেঙে দিলে তা থেকে সকল রকমের রঙ বেরিয়ে আসে। এতে সকল রকমের রঙের কিছুটা ছায়া থাকে। শ্বেত রঙ পবিত্রতা, শুদ্ধতা, বিদ্যা ও শান্তির প্রতীক। এর দ্বারা মানসিক, বৌদ্ধিক ও নৈতিক স্বচ্ছতা বিকশিত হয়। জ্ঞান ও বিদ্যার রঙ সাদা। বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর সাদা রঙ সব থেকে প্রিয়।

রঙ, গ্রহ ও ব্যক্তিত্ব

সূর্যরশ্মির রঙ মানুষ, পশু, পাখি ইত্যাদির মন ও হৃদয়ে প্রভাব সৃষ্টি করে। সব রঙ সবার ভাল লাগে না। মানুষের শরীর ও মনে রঙের প্রভাব সম্পর্কে কয়েকটি কথা এখানে বলা দরকার। মানুষ যে সব রঙ ভালবাসে এবং ব্যবহার করে তার থেকে কিছু প্রভাব সৃষ্টি হয়। যেমন-নীল রঙ-ভাবাবেগ, শান্তি, হালকা মেজাজ এবং অন্যদের ভাবাবেগকে শ্রদ্ধা করে।
সূর্যরশ্মি ও রামধনুর রঙিন ছটা চিরকালই সৌন্দর্যের এক অসাধারণ প্রতিফলন। এরকম রঙের খেলা যে কতটা দৃষ্টিনন্দন তা আমরা সকলেই জানি। যুগ যুগ ধরে রঙধনুর সাতটি রঙ মানুষের কাছে এক বিরল অভিজ্ঞতা। প্রকৃতপক্ষে গ্রহজগতের সঙ্গে এই জগতের এক আশ্চর্য সেতুবন্ধন ঘটায় রামধনু। এই সেতুবন্ধনের মাধ্যমেই আমাদের জীবনে শাসনের ক্ষমতা প্রবেশ করে। প্রকৃতপক্ষে সূর্যকিরণ ও প্রকাশের মাধ্যমেই গ্রহশক্তি কাজ করে।

রামধনুর সাত রঙ

বেগুনি : সর্বদা হাসিখুশি থাকার মনোভাব। সামাজিক হওয়ার প্রবণতা।
নীল : মাঝারি-কঠোর পরিশ্রমী, নিজের কাজে বেশী উদ্যোগী।
গাঢ়- অপরের চোখে স্বার্থপর কিন্তু নিজেদের জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পায়।
আসমানি : পরিপূর্ণতার জন্য সংগ্রামী মনোভাবের পরিচায়ক।
সবুজ : প্রভাব বিস্তারকারী হওয়ার প্রবণতা এবং অন্যদের কাছে সুপরিচিত হওয়ার গভীর ইচ্ছা।
হলুদ : অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হওয়ার প্রবণতা। প্রতিযোগিতায় অন্যদের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্ব লাভের ইচ্ছা।
কমলা : সামাজিকভাবে সকলকে নিয়ে চলার প্রচেষ্টা। ত্যাগের প্রতীক। জ্ঞানপিপাসু । গাম্ভীর্যপূর্ণ চালচলন।
লাল : স্বভাবগতভাবেই সাহসী, জীবন উপভোগ করার অনুভূতি । স্পষ্টবাদী । রামধনুর এই সাতটি রঙের বাইরেও আরও বেশ কিছু রঙ আছে যেগুলি প্রকৃতপক্ষে এই সাতটি রঙেরই সমাহার। সেই রঙগুলির কয়েকটি সম্পর্কে নীচে বলা হলো।
কালো : বেআইনি কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। কখনও কখনও পরিণতির কথা না ভেবেই ওইসব কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়া।
বিভিন্ন মানুষের ব্যক্তিত্ব বিভিন্ন রকম। তবে রঙের ব্যবহারের ও তার অনেকটাই সম্পর্ক রয়েছে। রঙের ব্যবহারের ওপর মানুষের গুণাগুণেরও তারতম্য ঘটে।

বাস্তু শাস্ত্র: গৃহ নকশার বিজ্ঞান (পর্ব-১)

বাস্তু শাস্ত্র (পর্ব-২)

বাস্তু শাস্ত্র (পর্ব-৩)

বাস্তু শাস্ত্র (পর্ব-৪)


 

চৈতন্য সন্দেশ মার্চ – ২০১৭ প্রকাশিত
সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।