বাস্তু শাস্ত্র: গৃহ নকশার বিজ্ঞান

প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০১৯ | ১০:৫৮ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ২১ মে ২০১৯ | ৫:৫৪ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 1315 বার দেখা হয়েছে

বাস্তু শাস্ত্র: গৃহ নকশার বিজ্ঞান

২০০৯ সালের চৈতন্য সন্দেশ এর মার্চ সংখ্যায় বাস্তু শাস্ত্র সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সেই বার এই শাস্ত্রের বিভিন্ন প্রাথমিক ধারণা প্রদান করা হয়েছিল। তবে এবারের প্রতিবেদনটি আরো বেশি তথ্যবহুল যা পাঠকদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় চার পর্বের ধারাবাহিক বঙ্গানুবাদ প্রতিবেদনের এটি হল প্রথম পর্ব, লিখেছেন একজন বিশেষজ্ঞ রাগ মঞ্জুরী দেবী দাসী। এবারের বিষয়: বাস্তু শাস্ত্রের উৎস ও প্রয়োজনীয়তা। ফেং গুই (স্থাপত্য নির্মাণের ক্ষেত্রে চাইনিজ পদ্ধতি) এর সুফল লাভের মাধ্যমে প্রাচীন ভারতীয় বাস্তু শাস্ত্রও বিশ্বব্যাপী দ্যুতি ছড়াচ্ছে। গৃহে এই সর্বোচ্চ কার্যকরী স্থাপত্য বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে সুস্বাস্থ্য, সুখ ও সমৃদ্ধি নিয়ে আসে। “যখন আমরা কার্যকলাপ ও আবাসস্থলী এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্তুতি হিসেবে দেখি, তখন আমরা সাহায্য নয় বরং আনন্দ ও সৌন্দর্য্যরে সাথে এমন গৃহ গড়ে তুলতে পারি যা সত্যিকার অর্থে ভালোবাসার সৃষ্টি।” [-জন আচার, দ্য হোম বিল্ডিং এক্সপেরিয়েন্স এর লেখক] একটি আরামদায়ক আবাসস্থলী তৈরি করার জন্য সহজ মানব প্রবৃত্তি প্রদান করে সামাজিক চাপ থেকে মুক্তি এবং সে সাথে বাইরের জগতের নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি “হোম সুইট হোম” বা “গৃহ মধুর গৃহ” এই প্রকার অনুভূতি আমাদেরকে নিজস্ব আভ্যন্তরীণ জগৎ ও বাহ্য জগতের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ মেলবন্ধন তৈরিতে সক্ষম করে। যারা অনিরাপদ ও অসুখী আবাসস্থলীতে বসবাস করে তাদের মধ্যে মানসিক ও শারীরিক ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে ব্রিটেনে গৃহহীন ব্যক্তিরা সাধারণ ব্রিটিশ নাগরিকদের চেয়ে গড় অনুপাতে ২০ বছর পূর্বে মারা যায়। যারা মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে হয় নিজের গৃহে আছেন, কিংবা ভাড়া গৃহে রয়েছে অথবা এখনো স্বপ্নের গৃহের সন্ধান করছেন তাদের সবার জন্য বাস্তু শাস্ত্রের নীতি একটি সচেতনতা হিসেবে কাজ করবে। কষ্টের উপার্জিত অর্থ অপচয় করে কেন আপনার জীবনে নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আসবেন? নতুন কোনো গৃহে যাওয়ার পর নতুন নতুন সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কোনো অভিজ্ঞতা কি আপনি প্রাপ্ত হয়েছেন? দারিদ্রতা, অসুস্থতা, সম্পর্কের অবনগি, ক্যারিয়ার সমস্যা ও মানসিক বিশৃঙ্খলার মত প্রতিবন্ধকতাগুলোর কারণ হতে পারে অযথাযথ নকশা তৈরি আপনার গৃহটি। একটি গৃহ বা এক খণ্ড ভূমি সব দিক দিয়ে আদর্শ মনে হলেও বাস্তু শাস্ত্রের বিধি না মানার ফলে এর মালিকের জন্য দুঃখ-দুর্দশা নেমে আসতে পারে। পক্ষান্তরে, যে গৃহে বাস্তু শাস্ত্রের বিধি মোতাবেক গড়া তার ফলে সেখানে ইতিবাচক উন্নতি বা অগ্রগতি সাধন হয়। বাস্তু শাস্ত্র কি? “স্থাপত্য নির্মাণের কৌশল সম্পর্কে আরো একনিষ্ঠ গবেষণার সত্যিকার ভিত্তি নিহিত রয়েছে সেই দালানগুলোতে যেগুলে সরল ও সহজাত। এগুলো নির্মাণের পরিকল্পনার পেছনে রয়েছে প্রাকৃতিক অনুভূতি। এর ফলাফল প্রায়ই সুন্দর ও সর্বদা সহজাত।” -ফ্র্যাঙ্ক লীয়ড রাইট, স্থপতি অধিক পরিবেশ বান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত গৃহ নির্মাণ সময়ের দাবি। স্থপতিরা এখন প্রাচীন স্থাপত্য ঐতিহ্য বাস্তু শাস্ত্র অনুসারে নকশা করছে। এর উদ্দেশ্য হলো হাজার বছরের পরীক্ষির পাণ্ডিত্যের আলোকে যথোপযুক্ত দালান বা গৃহ নির্মাণ করা। বাস্তু মানে হল আবাস বা পরিবেশ এবং শাস্ত্র মানে বিজ্ঞান বা পদ্ধতি। পরিবেশের সাথে সাম্যপূর্ণভাবে বসবাসের কৌশল এবং আবাসস্থলীর গঠনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করাই হলো বাস্তু শাস্ত্রের উদ্দেশ্য। এটি হল স্থাপত্য কলা এবং ইঞ্জিনিয়ারিং, আর্ট, জ্যোতিষবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যার সম্মেলন বর্তমান সময়ে দক্ষিণ ভারতের কেরেলা রাজ্য অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক ও তামিলনাড়–তে অবস্থিত গৃহ, হোটেল, অফিস ও মন্দিরগুলো হলো বাস্তু শাস্ত্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। ভারতের বড় বড় স্বীকৃত ব্যবসায়ীরা এবং তাজ গ্রুপের মতো কোম্পানিগুলো নিয়োগ দিচ্ছে বাস্তু স্থপতিদের যাতে করে সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধি অর্জিত হয়। বিখ্যাত বাস্তুশাস্ত্রবিদ ভি.গণপতি স্থপতি উল্লেখ করেছেন মধ্য আমেরিকার মায়ান গ্রামগুলো, তিব্বত, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার অনেক স্থাপত্য নিদর্শন বাস্তু শাস্ত্রের নীতির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। বাস্তু শাস্ত্রের দুটি প্রধান শাখা রয়েছে, মন্দির নকশা ও নির্মাণ (দেব শিল্প) এবং অন্যান্য ধরনের দালান নকশা ও নির্মাণ (মানব শিল্প)। এই প্রবন্ধটি আবাসস্থলীর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ও প্রাথমিক স্থাপত্য নীতিগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করবে। বাস্তু শাস্ত্রের ভিত্তি ভারতীয় সব বিজ্ঞানগুলোর মধ্যে সাধারণ একটি মতবাদ হলো যে, এই মহাজগৎ বা বিশ্বব্রাহ্মা- গঠিত হয়েছে প্রধান পাঁচটি উপাদানের সমন্বয়ে, যেগুলো হল আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল ও ভূমি। আত্মার শক্তি প্রবাহের মাধ্যমে এই উপাদানগুলো মানব শরীরে ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মিথস্ক্রিয়া সাধন করে। যেরকম জীবন ধারণের জন্য এই উপাদানগুলোর বিশ্লেষণ করা হয়, তেমনি বাস্তু শাস্ত্র একটি দালান বা গৃহকে দেখে জীবনি শক্তি হিসেবে সেটি যথাযথভাবে তৈরি করা হলে পাঁচটি উপাদানের ছন্দময় সুফল লাভ করা যায়। গৃহের মধ্যে পাঁচটি উপাদানের প্রবাহ ইতিবাচক শক্তি, দীর্ঘ জীবন বহন করে এবং সে সাথে এর বাসিন্দাদের মধ্যে সঞ্চার করে গভীর সুখ-শক্তি। পক্ষান্তরে, একটি গৃহ যদি এ উপাদানগুলোর সমন্বয়ে গোলযোগ বা বিশৃঙ্খলা হয় তবে এর বাসিন্দাদের মাঝে নেমে আসে রোগ-ব্যাধি ও দুর্ভাগ্য। বাস্তু শাস্ত্র অনুসারে মানুষ গ্রহ-নক্ষত্র, পারমার্থিক শক্তি, চৌম্বকীয় ও মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের দ্বারাও প্রভাবিত হয়। সমস্ত প্রভাবগুলো বিবেচনা করে এই শাস্ত্র পরিবেশ ও বাসিন্দাদের সাথে সমন্বয় সাধন করে গৃহ নির্মাণ, নকশা ও সংস্কার বিষয়ে দিক-নির্দেশনা প্রদান করে। প্রাচীন উৎস বাস্তু শাস্ত্রের স্থাপত্য বিজ্ঞান সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে ৫০০০ বছরের, প্রাচীন শাস্ত্র অথর্ব বেদের একটি বিভাগ স্থাপত্য বিদ্যা। সমস্ত প্রাচীন সংস্কৃতি অনুসারে বাস্তু প্রমাণ করে যে, যে ভূস্থানটি পবিত্র পারমার্থিকতার মর্যাদা বহন করে সেটিকে শোষণ নয় বরং দিব্য উপহার হিসেবে সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে। পারমার্থিকতা ও ভূমি কর্তৃক জড় সহায়তা প্রদানের কৃতজ্ঞতার প্রদর্শন প্রাকৃতিক পরিবেশমত সংবেদনশীলতার স্তরে উপনীত করে। মৎস্য পুরাণ অনুসারে বাস্তু ছিলেন একজন নিয়ন্তা যিনি শিবের ঘাম থেকে সৃষ্টি হয়েছিলেন। কথিত হয় তিনি ভূমির ওপর ৬৪ বা ৮১ বর্গক্ষেত্রের গ্রীডের ওপর উত্তর পূর্ব দিকে মন্তব্য রেখে দক্ষিণ পশ্চিমে চরণ রেখে শুয়ে থাকেন যেটি বাস্তুমণ্ডল নামে পরিচিত। সৃষ্টির আদিপিতা ব্রহ্মা বলেছেন, যদি কেউ ভূমির ওপর দালান তৈরি করতে চায় তবে প্রথমে বাস্তুকে তা নিবেদন করতে হবে যাতে করে বসবাসের জন্য সুস্ভাস্থ্য ও ছন্দ প্রদানের জন্য তিনি আশির্বাদ প্রদান করেন। অবশ্য এক্ষেত্রে যে স্থানে দালান ও প্লট নির্মাণ কমা হয় সেখানে বিভিন্ন দিকে দেব-দেবীদের অধিষ্ঠানও রয়েছে। আটটি দিক সমূহ:

দিক নিয়ন্তা গ্রহ
১। পূর্ব ইন্দ্র আবহাওয়ার দেবতা সূর্য- আলো চেতনা বুদ্ধিমত্তা
২। পশ্চিম বরুণ জলের দেবতা শনি-দীর্ঘায়ু সমৃদ্ধি, প্রতিবন্ধকতা
৩। উত্তর বিষ্ণু পরমেশ্বর ভগবান বুধ- বৃদ্ধিদীপ্ততা চেতনা, বৃত্তি
৪। দক্ষিণ যম মৃত্যুর দেবতা মঙ্গল- শক্তি যুক্তি, বন্ধু, শক্রতা
৫। উত্তর পূর্ব ব্রহ্মা সৃষ্টির দেবতা বৃহস্পতি- শিক্ষক পতি, কর্তব্য, সম্পদ
৬। দক্ষিণ পূর্ব অগ্নি অগ্নির দেবতা শুক্র- সৌন্দর্য পত্মী, আরাম, মনোরমতা
৭। দক্ষিণ পশ্চিম দূর্গা ধ্বংসের দেবী রাহু- রোগ-ব্যাধি পূঞ্জিভূত মন্দ কর্ম
৮। উত্তর পশ্চিম বায়ু বায়ূর দেবতা চন্দ্র ব্যক্তিত্ব সামাজিক জীবন, আবেগ

[আগামীপর্ব থেকে গৃহ নির্মাণ বা অবস্থানের প্রতিটি অংশ ও শুভ অশুভ লক্ষণ সম্পর্কে বাস্তু শাস্ত্রের নির্দেশনা বিস্তৃতভাবে তুলে ধরা হবে]

(মাসিক চৈতন্য সন্দেশ ২০১৪ ডিসেম্বর সালে প্রকাশিত)

এরকম চমৎকার ও শিক্ষণীয় প্রবন্ধ পড়তে চোখ রাখুন ‘চৈতন্য সন্দেশ’‘ব্যাক টু গডহেড’
যোগাযোগ: ০১৮৩৮-১৪৪৬৯৯

Stay Connected:

fb.com/monthlycaitanyasandesh

youtube.com/caitanyasandeh
সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।