বাস্তু শাস্ত্র (পর্ব-৫)

প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২১ | ১১:২৮ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২১ | ১১:৩১ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 346 বার দেখা হয়েছে

বাস্তু শাস্ত্র (পর্ব-৫)

বহুতল ফ্ল্যাট

সুরেন্দ্র কাপুর

আগেকার দিনে সাধারণত নিজের ব্যক্তিগত পৃথক বাড়ি বা বাংলো বাড়ি করার ঝোঁক ছিল বেশি । কিন্তু এখন পরিস্থিতি একেবারে বদলে গিয়েছে। এখন আড়াআড়ি বাড়ির চেয়ে উঁচু খাড়া বাড়ি বেশি পছন্দের। কারণ আড়াআড়ি বাড়ি তৈরি অনেক ব্যয়সাপেক্ষ। ভূমির দামও আকাশচুম্বি। এই সঙ্গে লিফ্‌টের সুযোগ-সুবিধা মানুষকে বহুতল বাড়ির প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া দূষণের বিষয়টিও আছে। যত উঁচুতে মানুষ থাকবে দূষণ তাকে স্পর্শ করবে তত কম। এটাও বহুতল বাড়ির আর এক আকর্ষণ। উঁচু উঁচু বহুতল বাড়িতে অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হচ্ছে। মানষ তার ক্ষমতার মধ্যে এই সব ফ্ল্যাট পাচ্ছেন। সারা দুনিয়ার মহানগরীগুলিতে বসবাসের জন্য এ ধরনের বাড়ি তৈরি হচ্ছে। এরকম ফ্ল্যাটবাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্টের নকশা তৈরি করার সময় আর্কিটেককে তাঁর অসাধারণ কর্মকুশলতার পরিচয় দিতে হয়। বাস্তুশাস্ত্র মেনে সাধারণ দেওয়াল, আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা, প্রবেশ দরজা, রান্নাঘর, বাথরুম ও অন্যান্য ঘর তৈরি করতে হয়। পৃথক স্বাধীন বাড়ির নকশা তৈরি সহজ হলেও শহরের আইনকানুন মেনে সব দিক চিন্তা করে বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্টের নকশা করা অনেক জটিল। কিন্তু একজন আর্কিটেক্ট ও ভবন নির্মাতার যোগ্যতা যাচাই হবে তখনই যখন তিনি প্রতিটি ফ্ল্যাট বাস্তু সিদ্ধান্ত মেনে তৈরি করবেন। ফ্ল্যাটের প্রবেশদ্বার থেকে শুরু করে শৌচাগার, রান্নাঘর, বৈঠক ঘর, শয়ন কক্ষ, ভগবানের কক্ষ, আলমারি, ফ্রিজ রাখার জায়গা সব কিছু এমনভাবে বাস্তুসম্মত তৈরি করবেন যাতে তার বাসিন্দারা সব দিক্ থেকে লাভবান হবেন। আর এটাই তাঁর কৃতিত্ব। আর্থিক লাভের সঙ্গে সঙ্গে এই কৃতিত্বও রীতিমত উল্লেখযোগ্য, বিশেষ করে বাস্তুশাস্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে। বহুতল বিশিষ্ট ফ্ল্যাটবাড়ি নির্মাণে বাস্তুশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত কিভাবে পালন করা সম্ভব, সে বিষয়ে কিছু আলোচনা প্রয়োজন।

জমি সংক্রান্ত:

এখন বহুতল বাড়ির নির্মাণে বাস্তুশাস্ত্রকে কীভাবে অনুসরণ করা যায় তা নিয়েই এখানে কয়েকটি কথা বলা হচ্ছে।
১. জমি চৌকো অথবা আয়তাকার হলে সব থেকে ভাল হয়। কোনো অবস্থাতেই যেন বেখাপ্পা আকারের জমি না হয়।
২. জমির স্তর যেন দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে এবং উত্তর-পূর্ব দিকে নিচু অথবা ঢালু হয়। যদি উত্তর-পূর্ব অত্যন্ত নিচু হয় তা হলেও সেই জমি খুব ভাল।
৩. বৃষ্টির জল যেন উত্তর, উত্তর-পূর্ব অথবা পূর্ব দিকে চলে যায় ।
৪. জমির চারপাশে রাস্তা অথবা বাইলেন থাকলে সেই জমিটি হচ্ছে আদর্শ জমি।
৫. জমির পূর্ব এবং উত্তর দিকে যদি রাস্তা থাকে তা হলে জমিটি তুলনামূলকভাবে ভাল । উত্তর ও পূর্ব দিকে রাস্তা থাকরে ওই দিকেই অর্থাৎ উত্তর ও পূর্ব দিকে বাড়ির প্রধান ফটক তৈরি করা দরকার।
৬. জমির উত্তর-পশ্চিম দিকের কোণ যদি ৯০ ডিগ্রি হয় তা হবে খুবই ভাল ।
৭. জমি যদি উত্তর-পূর্ব দিকে সামান্য প্রসারিত থাকে সেটি হচ্ছে স্বাস্থ্যকর ও আনন্দদায়ী । দক্ষিণ এবং পশ্চিম দিকের চেয়ে বাড়ির পূর্ব ও উত্তর দিকে বেশি খোলা বা ফাঁকা থাকবে।

বাড়ির বাইরে যে নিয়ম মানতে হবে:

১. কুয়ো, গভীর নলকূপ ও ভূগর্ভস্থ জলাধার ইত্যাদি ব্লক বা কমপ্লেক্সের উত্তর-পূর্ব দিকে থাকবে। কারণ বাস্তুশাস্ত্র অনুসারে উত্তর-পূর্ব দিক হল জলীয় অঞ্চল ।
২. বাড়ির সিঁড়ি হবে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ।
দক্ষিণ অথবা পশ্চিম দিকে সিঁড়ি হলেও তি নেই। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই যেন উত্তর পূর্ব দিকে সিঁড়ি না হয় ।
৩. বাড়ির ছাদে ওভারহেড জলের ট্যাঙ্ক বসাতে হবে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অথবা পশ্চিম দিকে।
৪. সেপটিক ট্যাঙ্ক তৈরি করতে হবে উত্তর পশ্চম দিকে। উত্তর-পূর্ব দিকে। এছাড়া জেনারেটর অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের দক্ষিণ পূর্ব কোণায় রাখা যেতে পারে।
৫. কমপ্লেক্সের সীমানা প্রাচীর উত্তর এবং পূর্ব দিকের চেয়ে দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে বেশি উঁচু হবে।
৬. কার পার্কিং অথাব মোটর গাড়ি রাখার জায়গা থাকবে পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব দিকে। এই একই দিকে বেসমেন্ট থাকলে গাড়ি রাখার ব্যাবস্থা করা যেতে পারে।

ফ্ল্যাটের অন্যান্য নিয়ম

১. প্রতিটি ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টের মুখ্য প্রবেশদ্বার পূর্ব, উত্তর, উত্তর-পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে হওয়া উচিত।
২. যতখনি সম্ভব ফ্ল্যাটের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে রান্নাঘর হওয়া উচিত। তা না হলে উত্তর পশ্চিম কোণায় করতে হবে। রান্না করার উঁচু স্থান অর্থাৎ প্ল্যাটফর্মটা এরকম দিকে বসাতে হবে যাতে রান্না করার সময় যে রান্না করবে তার মুখ যেন পূর্ব দিকে হয়। উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে যেন রান্নার ঘর না থাকে। দক্ষিণ-পশ্চিম দিক ভাড়া ঘর করা ভাল।
৩. পূর্বদিকে যেন স্নানাগার তৈরি করা হয়। উত্তর-পূর্ব অথবা দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে কখনও শৌচাগার করা উচিত নয়। এ ছাড়া বাথরুম বা শৌচাগার কখনও যেন রান্নাঘর বা খাওয়ার জায়গার বিপরীত দিকে না হয়। স্নানাগার, রান্নাঘর ও উপাসনা কক্ষ যেন এক দেওয়াল সংলগ্ন বা মুখোমুখি না হয়। এ ছাড়া শৌচাগারে কমোড এমনভাবে বসাতে হবে যাতে কমোড ব্যবহারকারীর মুখ দক্ষিণ দিকে হয়। দক্ষিণ বা উত্তরে হওয়া উত্তম।
৪. উপাসনালয় যেন উত্তর-পূর্ব দিকে হওয়া উত্তম। এ কথা সব সময় মনে রাখতে হবে যে স্বামী-স্ত্রী এবং বিবাহিত লোকেরা কখনোই যেন এই ঘরটি শয়ন কক্ষ হিসেবে ব্যবহার না করেন।
৫. ভোজন কক্ষ অথবা ডাইনিং রুম বা ডাইনিং স্পেস যেন পশ্চিম দিকে থাকে। প্রধান শয়ন কক্ষ দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে হবে। অন্যান্য শয়ন কক্ষ উত্তর-পশ্চিম, উত্তর বা পূর্ব দিকে হওয়া উচিত।
৬. বারান্দা বা ব্যালকনি পূর্ব বা উত্তর দিকে হওয়া উচিত। উত্তর বা পূর্ব দিকে যদি বেশি জানালা বসানো যায় তা হলে সেটা হবে অত্যন্ত ভাল ও স্বাস্থ্যকর।
৭. চিলেকোঠা বাড়ির ছাদে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে হওয়া উচিত। পূর্ব বা উত্তর দিকে চিলেকোঠা কখনও করা উচিত নয়।
৮. উত্তর, উত্তর-পূর্ব অথবা পূর্ব দিকে ফাঁকা জমি রাখা উচিত। এই জমিতে সুন্দর ঘাসের লন করা যেতে পারে। তবে কোন অবস্থাতেই এই ফাঁকা জায়গায় গাছ লাগনো উচিত নয়। এই জায়গায় জলের ফোয়ারাও করা যেতে পারে। বাড়ির দক্ষিণ বা পশ্চিমে উঁচু বা বড় গাছপালা, পাতাবাহার গাছ ইত্যাদি লাগানো যেতে পারে।

এক নজরে ফ্ল্যাটবাড়ির বিশেষ নির্দেশ

১. যত ওপরে ওঠা যায় বায়ু চলাচল তত বেশি পরিমাণে সহজে হয়।
২. যত বেশি উঁচু, দূষণের হারও তত কম।
৩. যত বেশি ওপরে যাওয়া যায় মহাজাগতিক রশ্মির (কসমিক এনার্জি) তীব্রতা তত বেশি।
৪. যত বেশি উপরে ওঠা যায় ঋণাত্মক বিকিরণের হার দ্রুত কমতে থাকে। আর চার/ পাঁচতলার পরে তা প্রায় নেই বললেই চলে।
৫. দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে ঢালুভাব বাড়াতে হবে।
৬. বহুতল বাড়ির প্রবেশ পথ যে দিকেই থাকুক না কেন কেবলমাত্র উত্তর-পূর্বদিকে নলকূপ এবং বর্জ্য জল ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে।
৭. প্রবেশদ্বারের উচ্চতা থেকে প্রধান প্রবেশদ্বারে উচ্চতা অবশ্যই বেশি হতে হবে।
৮. উত্তর এবং পূর্বদিকে বেশি খোলামেলা রাখতে হবে।
৯. বহুতলের ফ্ল্যাট চৌম্বকীয় অক্ষের উত্তর বা দক্ষিণ দিক অনুসারী থাকলে ভাল।
১০. সর্বনিম্ন তলের উচ্চতা যেন উপরস্থ তলগুলির থেকে বেশি হয়।
১১. বহুতল বাড়ি তৈরির সময় স্লাব, বিম, কলাম ইত্যাদির অংশের পলেস্তরা পুরু করতে হবে যাতে চৌম্বকীয় শক্তি হ্রাস পায় ।
১২. বহুতলের ফ্লাটের সর্বশেষ তলের ছাদ যেন সমতল না থাকে। অবতল রাখা সবদিক থেকেই ভল। এতে ছাদে জল জমতে পারে না। আর সূর্যরশ্মিও খাড়া না পড়ে কাত হয়ে পড়ায় ছাদও কম উত্তপ্ত হবে।
১৩. বহুতলের ফ্ল্যাটের অ্যাক্রিলিক রং, সিন্থেটিক ভিনাইল ফ্লোরিং ব্যবহার পরিহার করা ভাল। এগুলি ঋণাত্মক বস্তু। এগুলি মানবদেহের পক্ষে ক্ষতিকারক। কেননা ঋণাত্মক শক্তি মানবদেহে সিরোটিনি ও হিস্টামাইন উৎপন্ন করে। ফলে অসুস্থতা সৃষ্টি হয় এবং জীবনীশক্তি কমিয়ে হতাশা বাড়ায় । তাই প্রাকৃতিক বস্তু ব্যবহার শুভদায়ক ও স্বাস্থ্যাবর্ধক । সিন্থেটিক রঙ থেকে চুনকাম বা ডিসটেম্পার ব্যবহার উত্তম। কেননা এগুলি বাতাসকে শোষণ করতে সক্ষম।
১৪. বহুতল ফ্ল্যাটের মূল কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে শুধুমাত্র ধনাত্মক বস্তু সকল-পিতল, ক্রিস্টাল, চিনামটি, সিরামিক, পাথর, সুরকি, কাঠ ইত্যাদির ব্যবহার বাড়ালে ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সুখসমৃদ্ধি বৃদ্ধি হবে।
১৫. বহুতলের ভূমিতল জমির স্তর থেকে কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচফুট উঁচু করা ভাল। কেননা ভূমিতল কম থাকলে মাটির মধ্যে অবস্থিত ঋণাত্মক বস্তু থেকে বিচ্ছুরিত ঋণাত্মক শক্তি সহজে আসতে সক্ষম হবে। কিন্তু ভূমিতলের উচ্চতা বেশি হলে ঋণাত্মক শক্তির প্রভাব কম হবে। এ ছাড়াও বহুতলের ভূমিতল বেশি উঁচু হলে জলও জমতে পারে না।

বাস্তু শাস্ত্র: গৃহ নকশার বিজ্ঞান (পর্ব-১)

বাস্তু শাস্ত্র (পর্ব-২)

বাস্তু শাস্ত্র (পর্ব-৩)

বাস্তু শাস্ত্র (পর্ব-৪)


 

চৈতন্য সন্দেশ এপ্রিল – ২০১৭ প্রকাশিত
সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।