এই পোস্টটি 14 বার দেখা হয়েছে
গত সংখ্যার পর
স্বচ্ছ রাতের আকাশে সাতটি উজ্জল নক্ষত্রের উপস্থিতি সত্যিই মনোমুগ্ধকর। আর সেই কারণেই হয়তোবা পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি সভ্যতায় এবং জাতিতে এই সপ্তর্ষিমণ্ডলের অস্তিত্বের নিদর্শন পাওয়া গেছে। তাই তো মহাকাশে দৃশ্যমান সপ্তর্ষিমণ্ডল বিজ্ঞানীদের কাছে পরিচিত হল “সেভেন বিগ ডিপার” এবং গ্রিকদের কাছে পরিচিত হল “সেভেন প্লেইডেস” নামে। এক্ষেত্রে বৈদিক পুরাণ ও গ্রীক পুরাণের মধ্যে অনেকাংশে মিল লক্ষ্য করা যায়। প্রাচীন বৈদিক তত্ত্বদর্শীরা “বৈদিক ক্যালেন্ডার” তৈরি করেছেন শতবর্ষপঞ্জী অনুযায়ী। সপ্তর্ষীগণ বা বিগ ডিপার প্রতিটি ১০০ বছরে ভিন্ন ভিন্ন নক্ষত্র প্রদক্ষিণ করে। এভাবে ২৭ টি নক্ষত্র প্রতি ১০০ বছরে প্রদক্ষিন করার পর সপ্তর্ষিমণ্ডলের তাঁর কক্ষপথে একবার ভ্রমণ সম্পূর্ণ হয়। অর্থাৎ সপ্তর্ষিমণ্ডল তার কক্ষপথে একবার ঘুরে আসতে ২৭০০ বছর সময় লাগে। ইতোমধ্যে বৈদিক বিজ্ঞানীগণ সেই ২৭ টি নক্ষত্র আবিষ্কার করেছেন এবং তাদের প্রত্যেকটির নামকরণ অনুসারে “সপ্তর্ষি ক্যালেন্ডার” তৈরি করা হয়েছে। সেই বিগ ডিপার আবার প্রতি ২৭০০ বছরে একবার মাত্র পোল স্টার প্রদক্ষিণ করে থাকেন। প্রতি ২৭০০ বছর পর পর সৌরমন্ডলের এক একটি গ্রহ আংশিক ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। একটি পোল স্টারকে কেন্দ্র করে সেভেন বিগ ডিপার ২৭ টি নক্ষত্রে প্রদক্ষিন করতে থাকে।
অমল পুরাণ শ্রীমদ্ভাগবতমে এই আশ্চর্যজনক ঘটনার পূর্ণ বিবরণ উল্লেখ আছে। যখন ধ্রুব মহারাজ কঠোর তপস্যা ও শুদ্ধ ভক্তির মাধ্যমে ভগবান বিষ্ণুকে সন্তুষ্ট ধ্রুবলোক প্রদান করেন , তখন ভগবান বিষ্ণু তাঁকে ধ্রুবলোক প্রদান করেন যা মৃত্যরহিত নক্ষত্র। ভগবান বিষ্ণু বর্ণনা করেছেন যে, সপ্তর্ষিমণ্ডল ২৬০০ বছরে ধ্রুবলোক পরিভ্রমন শেষ করে কিন্তু অন্যান্য তারা, সূর্য ধ্রুবলোক প্রদক্ষিণ করবে ২৬,০০০ বছরে। ভগবান ধ্রুবকে বর প্রদান করেছিলেন যে, ত্রিলোক ধ্বংস হলেও ধ্রুবলোক কখনো ধ্বংস হবে না।
শ্রীমদ্ভাগবতম ছাড়াও বিভিন্ন শাস্ত্রে সপ্ত ঋষির উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে রামায়ণে বিভিন্ন লীলায় তারা সকলেই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। যেমন বাল্মিকী ছিলেন রামায়নের রচয়িতা, বশিষ্ঠ ছিলেন ভগবান রামচন্দ্র ও তার ভাইদের শিক্ষক, বিশ্বামিত্র রাম ও লক্ষণকে রাক্ষস নিধন ও সাধু রক্ষার জন্য বিভিন্ন কৌশল শিক্ষা দিয়েছিলেন। রাবণের সাথে সর্বশেষ যুদ্ধ হওয়ার পূর্বদিন আগস্ত মুনী লঙ্কায় উপস্থিত থেকে ভগবান রামের সঙ্গী হয়েছিলেন। এছাড়া ভরদ্রাজ, গৌতম ও অত্রি ঋষিও রামায়নে ভূমিকা পালন করেন।
অপরদিকে অধিকাংশ বেদস্তুতি রচয়িতা সপ্তঋষির অস্তিত্ব প্রাচীন দ্রাবিড় সভ্যতায় পাওয়া যায়। বিখ্যাত আর্কিওলজিস্ট ফ্র্যাক হিয়ারস ও স্যার জন মার্শাল মহেঞ্জাদারো ও হরাপ্পা এলাকায় গবেষণা করতে গিয়ে সেখানের উত্তরে গভীরে অতি উন্নত প্রাচীন দ্রাবিড় সভ্যতার অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। এছাড়া দ্রাবিড় সভ্যতার ঐতিহাসিক প্রমাণ হিসেবে প্রায় ১২,০০০ বছরের পুরাতন তামিল শাস্ত্রলিপি পাওয়া যায়। দ্রাবিড় সভ্যতার অস্তিত্ব আবিষ্কার হয়েছে উত্তর ভারতে। এখন প্রশ্ন হল সপ্তঋষির উপস্থিতি একই সাথে উত্তর ভারত এবং প্রাচীন লঙ্কায় থাকা সম্ভব কিভাবে? এই বিষয়টির সমাধান পাওয়া যায় জার্মান ভূতত্ববিদ ওয়েগনার এবং স্যার টি. ডবলু হোলডারনেসের গবেষণা থেকে। গবেষণামতে, বর্তমান শ্রীলঙ্কার ভূপ্লেট অর্থাৎ রাবণের লঙ্কা একসময় লেমুরিয়া নামক স্থানের অংশ ছিল যেটি আবার কুমারী কদম নামেও পরিচিত। এই বিশাল স্থানটি উত্তর ভারত, সীলন দ্বীপ ও মাদাগাস্কার দ্বীপ সংলগ্ন এবং প্রায় ৩৫০০ বছর পূর্বে এই স্থানটি ভারত মহাসাগরে বিলীন হয়। অতএব, এই থেকে প্রমাণিত হয় যে, সপ্তঋষিগণ বিভিন্ন কল্পে পৃথিবীতে অবস্থান করে ভগবানের বিভিন্ন লীলায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। সপ্তর্ষিমণ্ডলের গতিবিধি, চন্দ্র, সূর্য ও অন্যান্য গ্রহ নক্ষত্রাদির অবস্থান অনুসারে সপ্তর্ষি এরা নামক সংগঠন একটি “স্টার চার্ট” সফটওয়্যার তৈরি করে। এই সফটওয়্যারের বিশেষত্ব হচ্ছে এটি দিয়ে অতি প্রাচীন কোন ঘটনার সুনির্দিষ্ট সময়কাল নির্ণয় করা যায়। সপ্ত ঋষিগণ হচ্ছেন মানবজাতীর তত্ত্বদ্রষ্টা ও পথপ্রদর্শক। তাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে এই ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত জীবকে প্রকৃত পারমার্থিক শিক্ষা দিয়ে ভগবদধামে প্রেরণ করা। অনন্ত মহাকাশের বুকে উজ্জ্বল দীপ্তি ছড়িয়ে সপ্তঋষিগণ কি আমাদের জীবনের সেই পরম উদ্দেশ্য সাধনের আহবান জানাচ্ছেন?
হরে কৃষ্ণ।
মাসিক চৈতন্য সন্দেশ, সেপ্টেম্বর – ২০১০ ইং
পর্ব – ০১ এর লিংকঃ
বৈদিক জগতের বিষ্ময় ‘সপ্তর্ষিমণ্ডল’