গ্রন্থ অধ্যয়নে যখন বিড়ম্বনা (পর্ব-১)

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২১ | ৮:৫০ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২১ | ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 182 বার দেখা হয়েছে

গ্রন্থ অধ্যয়নে যখন বিড়ম্বনা (পর্ব-১)

রাধিকা বল্লভ দাস : একজন ভক্ত তার মামাতো ভাইকে শ্রীল প্রভুপাদ লীলামৃত নামে একটি গ্রন্থ উপহার দিয়েছিল । গ্রন্থটি আকারে বড় না হলেও সেটি পড়তে নারাজ ছিল। পরবর্তীতে ভক্তটি দেখে অবাক হয় যে, তার সে ভাইটি ঐ একই আকারে একটি গ্রন্থ পড়ছিল। গ্রন্থটি ছিল ইংরেজি ব্যাকরনের ওপর। শ্রীল প্রভুপাদ লিখেছেন, “মানুষের স্বভাবতই সাহিত্য অধ্যয়নের প্রতি রুচি রয়েছে, তারা ঊর্ধ্বতনদের কাছ থেকে অজানা কিছু সম্পর্কে শুনতে ও পড়তে চায়। কিন্তু তাদের সেই রুচি কিছু অপসাহিত্যের কারণে নষ্ট হয়ে যায়। কেননা ঐ সমস্ত সাহিত্যে বর্ণিত হয় জাগতিক ইন্দ্রিয়তৃপ্তির সমস্ত বিষয়।” গ্রন্থ অধ্যয়নের প্রবণতার প্রকৃত স্বার্থকতা হলো পারমার্থিক সাহিত্য অধ্যয়নের প্রতি আকর্ষণ বর্ধিত করা। শ্রীল প্রভুপাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো তাঁর গ্রন্থ সম্ভার। চলুন কিছু বিষয় অবলোকন করা যাক যার মাধ্যমে তার দিব্য গ্রন্থ সমূহ অধ্যয়নের প্রতি আমরা অনুপ্রাণিত হতে পারি।

ভক্তিমূলক সেবার যোগ্যতা

ভক্তিরসামৃতসিন্ধু গ্রন্থে শ্রীল রূপ গোস্বামী বলেছেন যে, “ভক্তিমূলক সেবার যোগ্যতা হলো এর প্রতি উত্তরোত্তর আকর্ষণ বা ‘রুচি’ লাভ করা।” শ্রীল জীব গোস্বামী ‘রুচি’ শব্দটিকে ব্যাখ্যা করেন বিশেষত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, শ্রীমদ্ভাগবত আদি শাস্ত্র গ্রন্থ অধ্যয়ন প্রসঙ্গে শ্রীল প্রভুপাদ ভক্তিরসামৃতসিন্ধু গ্রন্থে লিখেছেন,
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, শ্রীমদ্ভাগবত উপলব্ধির জন্য যাদের স্বাভাবিক রুচি রয়েছে তাদের ভক্তিমূলক সেবা সেই সব মনোগত জল্পনা কল্পনাকারী ও তার্কিক ব্যক্তিদের চেয়ে অনেক সহজতর হয়।” এভাবে কৃষ্ণভাবনামূলক প্রচার লোকেদের আগ্রহী করে তুলে এবং এক্ষেত্রে পরবর্তী পদক্ষেপে গ্রন্থ অধ্যয়ন তাদের সেই আগ্রহকে আরো বর্ধিত করে তোলে।
কলিযুগে কৃষ্ণভাবনামৃতে যোগদান করা অত্যন্ত বিরল ও অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু তার চেয়েও কঠিন হলো কৃষ্ণভাবনামৃতে টিকে থাকা এবং তার চেয়েও বিরল হলো কৃষ্ণভাবনায় সুখী থাকা। কৃষ্ণভাবনায় সুখী থাকার জন্য শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থসমূহ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অধ্যয়ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আত্ম পরিশুদ্ধির জন্য

জিহ্বাকে পরিশুদ্ধির জন্য এবং সর্বোপরি পরমেশ্বর ভগবানের গুণ মহিমা কীর্তনের জন্য আমাদের বৈদিক শাস্ত্র অধ্যয়ন করা উচিত। এক্ষেত্রে শ্রীমদ্ভাগবতে মৈত্রীয় ঋষির মনোভাব উল্লেখযোগ্য। মৈত্রীয় ঋষি উল্লেখ করেছেন (শ্রীমদ্ভাগবত ৩/৬/৩৬) “আমার অযোগ্যতা সত্ত্বেও, আমার গুরুদেবের শ্রীমুখ থেকে আমি যতটা শ্রবণ করতে পেরেছি এবং আমি নিজে যা বুঝতে পেরেছি, তার দ্বারা আমি বিশুদ্ধ বাণীর মাধ্যমে ভগবানের মহিমা কীর্তন করছি । যদি আমি তা না করি, তাহলে আমার বাক্শক্তি অসত্য থেকে যাবে।” এভাবে শাস্ত্র অধ্যয়নের মাধ্যমে ও অন্যদের প্রচার করার মাধ্যমে আমরা ভগবানের সাথে সম্বন্ধযুক্ত হই এবং কৃষ্ণভাবনা থেকে বিচ্যুত হইনা।
সূত গোস্বামী শ্রীমদ্ভাগবতে (১/১৮/১৮) উল্লেখ করেছেন যে, “মহাত্মাদের সঙ্গে কেবল বার্তালাপ করার ফলেই নিম্নকুলে জন্মজনিত অযোগ্যতা অচিরেই বিদুরিত হয়ে যায়।” শ্রীল প্রভুপাদ তাৎপর্যে লিখেছেন, মহাত্মাদের বাণী সম্বলিত একটি গ্রন্থও অধ্যয়ন তাদের সঙ্গে বার্তালাপের সমতুল্য।
এমনকি কেউ যদি শ্রীল প্রভুপাদের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্য লাভের সুযোগ নাও পাই এবং এমনকি কোনো ব্যক্তি যদি নিম্নকুলোদ্ভূতও হয় তবে তার দিব্য গ্রন্থ অধ্যয়নের মাধ্যমে তার দিব্য সান্নিধ্য লাভের সমস্ত যোগ্যতা প্রাপ্ত হতে পারে।

স্বল্প সম্পদ নিয়েও বেঁচে থাকা

মাঝে মাঝে একজন ভক্তের জীবনে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে, তিনি তার গুরুদেবের সান্নিধ্য লাভ করতে পারেন না, কিংবা পেলেও তা কিয়ৎ স্বল্প পরিমাণে কিংবা এমন কোনো জ্যেষ্ঠ ভক্ত যার মাধ্যমে সে অনুপ্রাণিত হয় তার সান্নিধ্য প্রাপ্ত হওয়ার সুযোগ থাকে না। যদি তিনি শাস্ত্রের মাধ্যমে অনুপ্রেরণার অনুসন্ধান করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন তবে তিনি এগুলোর মাধ্যমে বিচলিত হবেন না। তিনি পারমার্থিকভাবে সর্বদা পরিপুষ্ট থাকবেন।
শ্রীমৎ ভক্তিতীর্থ স্বামী মহারাজ লিখেছেন, “আমাদের উচিত সাধু, গুরু ও শাস্ত্রের মধ্যকার সুন্দর আন্ত সম্পর্কের অনুসন্ধান করা। আমাদের উচিত এই তিনটির কোনো একটির প্রতি অত্যন্ত নির্ভরশীলতা কিংবা কোনো একটি থেকে দূরে সরে যাওয়ার প্রবণতা পরিহার করা। সাধারণত আমরা গুরু ও সাধুর প্রতি অত্যন্ত আসক্ত হয়ে পড়ি, শাস্ত্রের প্রতি ততটা আসক্ত হই না। কিন্তু শাস্ত্র আমাদের জন্য সর্বদা বিরাজমান এবং এর শরণ গ্রহণ করার মাধ্যমে আমরা লাভবান হতে পারি।

পূর্ণ সারবস্তু

আজকাল লোকেরা একে অপরের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। তারা অনেক আত্ম সহায়তামূলক গ্রন্থ অধ্যয়ন করে থাকে। তারা মনে করে এর মাধ্যমে গ্রন্থগুলো তাদেরকে প্রয়োজনীয় ফর্মুলা বা দিক নির্দেশনা প্রদান করবে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই গ্রন্থগুলো পুরাতন মদ নতুন বোতলজাতকরণের মতো হয়। পক্ষান্তরে শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থগুলো একজন ব্যক্তিকে এমনভাবে আলোকিত করতে পারে যে তিনি প্রতিবারেই একই গ্রন্থ পুনঃ পুনঃ অধ্যয়নের মাধ্যমে নতুন আলোকে উদ্ভাসিত হতে পারে। শ্রীমদ্ভাগবতে (১/১৫/২৭) অর্জুন উল্লেখ করেছেন, “পরমেশ্বর ভগবান গোবিন্দ প্রদত্ত উপদেশগুলির প্রতি এখন আমি আকৃষ্ট হচ্ছি। কেননা, এগুলি দেশ এবং কালের সমস্ত পরিস্থিতিতে হৃদয়ের তাপ প্রশমিত করার সারগর্ভ উপদেশে পূর্ণ।” যখন অর্জুন সামান্য রাখালদের কাছে পরাস্ত হন তখন তিনি এক দুঃসহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে এই শ্লোকটি বলেছিলেন। একজন সম্মানিত ক্ষত্রিয় হওয়ায় তার কাছে অসম্মান ছিল মৃত্যুর চেয়েও শোচনীয়। এই শ্লোকে অর্জুন কৃষ্ণকে ‘গোবিন্দ’ নামে সম্বোধন করেছেন। শ্রীল প্রভুপাদ এই ‘গোবিন্দ’ শব্দটির অনুবাদ করেছেন, “সর্ব আনন্দের বিধানকারী পরমেশ্বর ভগবান”। এর অর্থ হলো এই যে, অর্জুন এরকম দুঃসহ মুহূর্তে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সেই অমীয় বাণীসমূহ স্মরণ করতে করতে মহানন্দ ও পরিত্রাণ অনুভব করছিলেন। এ জন্যেই তিনি কৃষ্ণকে বিশেষভাবে গোবিন্দ নামে স্মরণ করছিলেন, “সর্ব আনন্দের বিধানকারী পরমেশ্বর ভগবান”। এটি অতি সুন্দরভাবে অর্জুনের মনে প্রতিপলিত হয়েছিল। অতএব, যদি শাস্ত্রের প্রতিটি শব্দ এমন গভীর অর্থ প্রদান করতে পারে, তবে এর তাৎপর্যের কথা বলাই বাহুল্য। এজন্যেই শ্রীল প্রভুপাদ ভক্তদের উৎসাহিত করেছেন তাঁর গ্রন্থের প্রতিটি শব্দ অধ্যয়নের জন্য। শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীমদ্ভাগবতের (৪/১২/৪৪) টীকায় লিখেছেন, “নিষ্ঠাপরায়ণ ভক্ত শ্রীমদ্ভাগবতের প্রতিটি অধ্যায় এবং প্রতিটি শব্দ পাঠ করবেন, কারণ প্রথম দিকের শ্লোকগুলি বর্ণনা করেছে যে, শ্রীমদ্ভাগবত হচ্ছে বৈদিক শাস্ত্রেও সুপক্ক ফল। শ্রীমদ্ভাগবতের একটি শব্দও ভগবদ্ভক্তের এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়।” হরে কৃষ্ণ।

গ্রন্থ অধ্যয়নে যখন বিড়ম্বনা (শেষ পর্ব)


 

মাসিক চৈতন্য সন্দেশ মে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।