কৃষ্ণ কেন বাঁজি বাজায়?

প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৩ | ১:৪৪ অপরাহ্ণ আপডেট: ২২ মার্চ ২০২৩ | ১:৪৪ অপরাহ্ণ

এই পোস্টটি 86 বার দেখা হয়েছে

কৃষ্ণ কেন বাঁজি বাজায়?

যেখানে ভগবানের অন্যান্য অবতার ও দেব-দেবীরা পর্যন্ত বিভিন্ন অস্ত্র ধারণ করে সেখানে কৃষ্ণ কেবল বাঁশি বাজান। বৈদিক শাস্ত্রে কৃষ্ণের এই দিব্য বাঁশি ধারণের রহস্য তুলে ধরা হয়েছে।

অমর নাথ দাস

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চারটি মাধুরী শক্তি রয়েছে যেমন, রূপ মাধুরী, লীলা মাধুরী, গুণ মাধুরী ও বেণু মাধুরী। ‘বেণু মাধুরী’ অর্থ হলো কৃষ্ণ বেণু বাজিয়ে তাঁর মাধুরী প্রকাশ করেন। কৃষ্ণের এই বাঁশি চৈতন্যচরিতামৃতে বলা হয়েছে ত্রিজগৎ মনস আকর্ষি। অর্থাৎ কৃষ্ণের বাঁশি ধ্বনি এই ত্রিভুবনের যেকারো মনকে অবলীলায় আকর্ষণ করে। আপনি যদি এমনকি কোন জটিল কোনো চিত্রকর্ম দেখেন সেখানে কোনভাবে যদি ময়ূর পুচ্ছ ও বাঁশি দেখেন তবে তা কৃষ্ণকে স্মরণ করিয়ে দেয়। যদিও সেখানে পুরোপুরিভাবে তুলে ধরা হয়নি। অর্থাৎ, বাঁশি কৃষ্ণের এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমরা এখন শাস্ত্র থেকে বিভিন্ন কারণ অন্বেষণ করার চেষ্টা করব কেন কৃষ্ণ বাঁশি বাজান? শ্রীল রূপ গোস্বামী নিম্নোক্তভাবে প্রথম কারণটি ব্যাখ্যা করেছেন।

প্রথম কারণ

কৃষ্ণ বাঁশি বাজাতে ভালোবাসেন। কৃষ্ণ হলো সমস্ত রসের আধার। তিনি পূর্ণরূপে স্বাধীন, বিলাসী এজন্যেই তিনি বাঁশি বাজাতে ভালোবাসেন। তিনি বাঁশি বাজান গোপীদেরকে আকর্ষণ করে রাসনৃত্যে অংশগ্রহণ করার জন্য, গো বৎসদের আনন্দ বিধানের জন্য। কৃষ্ণ গো বৎসদের বাঁশির সুরে আকর্ষণ করে। যখন গো বৎসরা গোচারণ করেন তখন কোন দলবদ্ধ গাভীদের একই সাথে আকর্ষণ করেন। নির্দিষ্ট দলকে নির্দিষ্ট সুরে আকর্ষণ করেন। অর্থাৎ নির্দিষ্ট দলের নাম বা সংখ্যা ঐ নির্দিষ্ট সুরেই নিহিত থাকে। কোন গোবৎস যদি কোন কারণ বশত আসতে অসমর্থ হয় কৃষ্ণ তার জন্য নির্দিষ্ট একটি সুরে আকর্ষণ করেন। যদি কোন গো বৎসের নাম যদি সুরভী হয়ে থাকে তবে কৃষ্ণ তার বাঁশিতে সেই নামটি সুরের মাধ্যমে তুলে ধরেন। উল্লেখ্য যে, গো বৎস দল দেখতে লাল রঙের হয় তাদেরকে কুমকুমী, সাদা রঙের গো বৎস দলকে বলা হয় ধবলী বা সরস্বতী, কালো রঙের গো বস দলকে বলা হয় শ্যামা বা কৃষ্ণা, কোন গো বৎসের মুখ দেখতে মৃদঙ্গের মতো হলে সে দলকে মৃদঙ্গ মুখী বলা হয় আর সিংহের মতো মুখ হলে সে দলকে সিংহ মুখী বলা হয় ।
কৃষ্ণ এমনকি অসুরদের বধ করার জন্য বাঁশি বাজিয়ে থাকেন। তিনি বাঁশিতে এমন একটি রাগ সৃষ্টি করেন যার মাধ্যমে অসুররা মোহিত হয়ে যেতে পারে। আমরা জানি বিভিন্ন ধরনের সুর আমাদের চেতনাকে প্রভাবিত করতে পারে ঠিক তেমনি কৃষ্ণও রাক্ষসদের চেতনাকে প্রভাবিত করার জন্য নির্দিষ্ট সুর তৈরি করেন। এভাবে কৃষ্ণ বাঁশির সুরের মাধ্যমেও অসুরদের বধ করতে পারেন। কৃষ্ণের বিভিন্ন ধরনের বাঁশিও রয়েছে, কিছু বাঁশি রত্ন বা স্বর্ণ খচিত হয় আবার কিছু বাঁশি ফাঁপা বাশের মতো দেখতে হয়, কিংবা মার্বেল পাথর খচিত হয়। কৃষ্ণের বয়স যখন পাঁচ বছর ছিল তখন কৃষ্ণ পাতার বাঁশি বাজাতেন। নির্দিষ্ট পাতা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন বাঁশিতে তিনি বিভিন্ন সুর সৃষ্টি করতে পারতেন। বাঁশিগুলোর আকৃতিও হয় ৬, ৯, ১৫, ১৮ ইঞ্চি ইত্যাদি। বাঁশিগুলোর আকৃতি অনুসারে নির্দিষ্ট সংখ্যক ছিদ্র বিদ্যমান থাকে। কৃষ্ণের শুধু একটি বাঁশি না বরং অনেক প্রকার বাঁশি রয়েছে যেমন তাঁর বেণু নামক একটি বাঁশি রয়েছে আর এজন্যে তিনি বেণু কৃষ্ণ, বেণু মাধব, বেণু গোপাল ও বেণু গোবিন্দ ইত্যাদি নামে পরিচিত । আরেকটি বাঁশি রয়েছে যার নাম মুরলী এজন্যে তিনি মুরলীধর, মুরলী গোপাল ইত্যাদি নামে পরিচিত। তৃতীয় একটি বাঁশি রয়েছে তার নাম বংশী। এই বাঁশিগুলো বিভিন্ন আকৃতির হয়ে থাকে যেমন বেণু হচ্ছে ক্ষুদ্র আকৃতির, মুরলী একটু বড় এবং বংশী হল সবচেয়ে বড় বাঁশি।

দ্বিতীয় কারণ

আনন্দ বৃন্দাবন চম্পু গ্রন্থে কবি কর্ণপুর ব্যাখ্যা করেছেন যে, কৃষ্ণের বাঁশি সমস্ত ধরণের বিরুদ্ধপূর্ণ। কৃষ্ণ বিরুদ্ধপূর্ণ জিনিসগুলো একভাবে ভালোবাসেন ৷ বিষয়টি এরকম যে কৃষ্ণের দিব্য শরীর ত্রিভঙ্গী কিন্তু তিনি সোজা হতে চাইছেন (হাসি)। কিভাবে বাঁশি বিরুদ্ধপূর্ণ হতে পারে সে বিষয়ে পাঁচটি দৃষ্টান্ত নিম্নে প্রদর্শন করা হয়েছে।
প্রথম দৃষ্টান্তটি হল সাধারণভাবে এ জগতে যদি কোন বস্তুর রন্ধ্র বা ছিদ্র থেকে তাকে তবে সেটাকে ত্রুটিপূর্ণ বলে অভিহিত করা হয়। অথচ কৃষ্ণের বাঁশিতে ছয়টি বা তারো অধিক রন্ধ রয়েছে। তবুও সেটি অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে পূর্ণ ।
দ্বিতীয় দৃষ্টান্তটি হলো কৃষ্ণের বাঁশি ফাঁপা বা খোল আকৃতির হয়ে থাকে। অথচ সেই ফাঁপা বাঁশিটিই সমস্ত সুরের আধার ।
তৃতীয় বিরুদ্ধপূর্ণ দৃষ্টান্ত হলো এটি খুবই শক্ত হয় কিন্তু এই শক্ত বাঁশিটি শক্ত হৃদয়ের জীবকে কোমল হৃদয়ের করতে পারে।
চতুর্থ দৃষ্টান্তটি হলো ‘পর্ব’। বাঁশিটি একটি বৃক্ষের অংশ যেটিকে ‘পর্ব’ বলা হচ্ছে কিন্তু ‘পর্ব’ মানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিকেও বোঝানো হয়। এই বাঁশি থেকে সৃষ্টি হয়েছে সমস্ত উৎসবাদি বা ‘পর্ব’।
পঞ্চম দৃষ্টান্তটি হলো ‘বংশ’। বাঁশিকে বলা হয় ‘বংশী’। বংশ হলো পারিবারিক ঐতিহ্য । বাঁশি যেহেতু চিন্ময় বা উচ্চ পারিবারিক ঐতিহ্য থেকে উত্থিত হয়েছে তাই এই বাঁশিকে বলা হয় ‘বংশী’। একইভাবে কৃষ্ণ যখন বাঁশি বাজান তখন গোপীরা তাদের বংশ পরিচয় পরিত্যাগ করে কৃষ্ণের কাছে ছুটে আসেন। অর্থাৎ যদিও বাঁশি একটি উচ্চ পারিবারিক ঐতিহ্য বা বংশ থেকে আগত কিন্তু সেই বাঁশি অপরের বংশকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য করছে। যেটি আরেকটি বিরুদ্ধপূর্ণ দৃষ্টান্ত।
উপরোক্ত পাঁচটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়েছে আনন্দ বৃন্দাবন চম্পু গ্রন্থে যে, কেন কৃষ্ণ বাঁশি বাজায় ? কেননা কৃষ্ণ পরস্পর বিরুদ্ধপূর্ণ দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করতে ভালোবাসেন।

তৃতীয় কারণ

বৃন্দাবনে এই বাঁশি বাজানোর মাধ্যমে কৃষ্ণ ভক্তদের আনন্দ প্রদানের মাধ্যমে প্রীতি বিনিময় করেন। প্রাতঃকালে যখন তিনি বাঁশি বাজান তখন এর মাধ্যমে তার সমস্ত সখাদের মাঝে এক ধরনের চিন্ময় উত্তেজনা সৃষ্টি করেন গোবর্ধনের উদ্দেশ্যে গমনের জন্য । বিকালের দিকে যখন বনের মধ্যে কৃষ্ণ বাঁশি বাজান তখন তিনি বনের বিভিন্ন পশু ও প্রকৃতির সঙ্গে বাঁশির সুরে প্রীতি বিনিময় করেন। তিনি নদী, পর্বত, পশু, পক্ষী সবার সাথে এই বাঁশির সুরের মাধ্যমে লীলা বিলাস করেন। এর মাধ্যমে তিনি বার্তা প্রদান করেন যে, এত দূর থেকে তিনি এই বনে এসেছেন শুধুমাত্র তাদের সাথে প্রীতি বিনিময় বা লীলা বিলাস করার জন্য। এমনকি কৃষ্ণের বাঁশির সুরে পাথর পর্য গলে যায়, নদীর স্রোতের স্বাভাবিক ধারাও বিপরীত দিকে প্রবাহমান হয়, নির্জীব সজীব হয়ে যায়, আবার সজীব নির্জীব হয়ে যায়, গাভীরা জল পান করতে ভুলে যায়, হরিণরা ঘাস খেতে ভুলে যায়। অনেকটা অঙ্কিত চিত্রের মতো স্তব্ধ ও অবাক হয়ে সবার কৃষ্ণের বাঁশির সুরে মোহিত হয়ে যায়। শ্রীল শুকদেব গোস্বামী সেই দৃশ্যগুলোকে অঙ্কিত স্থির চিত্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রকৃতি ও পশু-পক্ষীর যে সহজ সরল স্বাভাবিক আচরণ তা করা কঠিন হয়ে পড়ে যখন কৃষ্ণ তাঁর বাঁশিতে নির্দিষ্ট সুর ধ্বনিত করেন। সন্ধ্যাকালে কৃষ্ণ মহা আনন্দের সহিত বাঁশি বাজান কেননা কৃষ্ণ গোচারণ ভূমি থেকে সখা ও গোবৎসদের নিয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করছেন। এটি মহা আনন্দের ব্যাপার বৃন্দাবনবাসীদের জন্য কেননা তারা এর মাধ্যমে। জানতে পারে যে, আমাদের প্রিয় কৃষ্ণ গৃহে প্রত্যাবর্তন করছে। তারা কৃষ্ণের বাঁশির সুরে এভাবে এই তথ্যটি লাভ করেন। যখন কৃষ্ণ তার বাঁশিতে প্রত্যাবর্তন সুর সৃষ্টি করে এবং সে সাথে তাদের পদ স্পর্শে ব্রজের ধূলিকণা শূন্যে উত্থিত হয় তখন বৃন্দাবনবাসীরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। কিন্তু বিষয়টি বনের জন্য দুঃখদায়ক কেননা কৃষ্ণ গ্রামে ফিরে যাচ্ছে, বনের সমস্ত বাসীন্দারা সুদীর্ঘ বারো ঘন্টা ধরে কৃষ্ণের পুনরাগমনের প্রতিক্ষা করে সারা রাত ধরে ক্রন্দন করতে থাকে। পক্ষীরা অপেক্ষা করে থাকে কখন কৃষ্ণ আসবে আর আমরা মহানন্দে ডানা মেলে উড়তে পারব। বলা হয় যে, পক্ষীরা কৃষ্ণকে অত্যন্ত ভালোবাসে। শাস্ত্রে বর্ণনা রয়েছে একবার এক পাখি বৃক্ষের শাখায় বসে কৃষ্ণ স্মরণ করে করে কান্না করছিল। চোখের কোণ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রুপাত হচ্ছিল এবং কৃষ্ণ নাম জপ করছিল। হঠাৎ পাখিটি অবচেতন মনে শাখার উপরিভাগ থেকে নিম্নভাগে উল্টে যায় তখনো ঐ অবস্থায়ও অঝোর ধারায় অশ্রুপাত হচ্ছিল এবং অবিরত ভগবানের নাম কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ… জপ করছিল। একসময় পায়ের মুষ্টি শাখা থেকে ছুটে গেলে পাখিটি এমন একটি স্থানে পতিত হয় যেটি তার চোখের জলে সৃষ্ট ছোট্ট একটি কুণ্ডের মতো। এভাবে পাখিরা পর্যন্ত কৃষ্ণকে অনুভব করে থাকে। রূপ গোস্বামী বর্ণনা করেছেন, ‘যখন কৃষ্ণ বন থেকে প্রস্থান করতেন তখন বৃক্ষরা কৃষ্ণ বিরহের জ্বলন্ত অগ্নিতে প্রায় দন্ধিভূত হতেন। তারা কৃষ্ণকে এত ভালোবাসতেন। এভাবে বনের জীবরা দিবার জন্য ক্রন্দন করতেন অপর দিকে ব্রজবাসীরা ক্রন্দন করতেন সন্ধ্যাকালের জন্য। এভাবে উভয়ই কৃষ্ণের উপস্থিতি কামনা করত। প্রকৃতপক্ষে এটি এমন একটি উপহার যেটি গোবর্ধন পর্বত দুই পক্ষকেই দান করেছিলেন। কেননা গোবর্ধন লীলায় উভয় পক্ষই সমবেত হয়েছিল সাতদিন সাতরাত্র ধরে গোবর্ধনের ছত্রছায়ায়। এজন্য গিরিরাজ হলেন হন্তায়মদ্রিরবলা হরিদাসবর্ষো অর্থাৎ, ভক্তগণের মধ্যে গোবর্ধন পর্বত শ্রেষ্ঠ । আপনি যদি বৃন্দাবনে যান তখন স্মরণ করবেন যে “হে গিরিরাজ, কেবল মাত্র আপনার জন্যই বৃন্দাবনের সমস্ত বাসীন্দারা কৃষ্ণকে প্রাপ্ত হয়েছিল।” এভাবে কৃষ্ণ যখন প্রত্যাবর্তন করছিলেন তিনি বাঁশি বাজাচ্ছিলেন এবং কিছু নিদর্শন প্রদর্শন করছিলেন। পরিশেষে রাত্রিতে কৃষ্ণ যমুনার তীরে রাসস্থলীতে বাঁশি বাজান। শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর ব্যাখ্যা করেছেন, কৃষ্ণ যখন নন্দ গ্রামে টের কদম্ব বৃক্ষে উঠে বাঁশি বাজাতেন তিনি মাঝে মাঝে নিজের জন্য বাঁশি বাজাতেন । তখন তিনি স্বয়ং নিজের বাঁশির ধ্বনিতে আকর্ষিত হতেন। কৃষ্ণের বাঁশির সুর এতই মনোহর যে যিনি সর্বাকর্ষক তাকে পর্যন্ত আকর্ষণ করে। শ্রীল প্রভুপাদ তার এক ভাষ্যে ব্যাখ্যা করেছেন যে, কৃষ্ণ স্বয়ং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু রূপে কলিযুগে আবির্ভূত হয়েছেন, কৃষ্ণের বাঁশি আবির্ভূত হয়েছেন মৃদঙ্গ রূপে এবং কৃষ্ণের সেই বাঁশির সুর আবির্ভূত হয়েছেন হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র রূপে । অর্থাৎ কৃষ্ণের বাঁশির সুরের যে শক্তি সেটি এই হরিনামের মধ্যে নিহিত রয়েছে।
কৃষ্ণের বাঁশির স্বরের আটটি প্রতিক্রিয়া নিন্মোক্ত অংশটি উদ্ধৃত করেছেন শ্রীল রূপ গোস্বামী তাঁর বিদগ্ধ মাধব গ্রন্থে। তিনি আটটি প্রতিক্রিয়ার কথা ব্যক্ত করেন যেগুলো কৃষ্ণের বাঁশির আটটি স্বরের প্রতিক্রিয়া।
১ম স্বর: দেবাদিদেব মহাদেব যখন তাঁর উম্বুক বাজাচ্ছিলেন কৈলাস পর্বতে তখন ভগবানের বাঁশির সুরের প্রথম স্বরে শিব অনেকটা অদ্ভুতভাবে নৃত্য শুরু করলেন যা দেখে সকলেই হতবাক হন। ব্রহ্মার পুত্র চতুঙ্কুমারগণ যখন ধ্যানস্থ হলেন তখন এই সুরের মুর্ছনায় তাদের ধ্যান ভঙ্গ হয়। যাদের কাছ থেকে কুমার সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হয়েছে তারাই ভগবানের বাঁশির সুরের প্রথম ছন্দে বিমোহিত হন। ব্রহ্মা যখন সৃষ্টি লীলা নিয়ে ব্যস্ত তখন এই সুরের স্বরে তিনি নিজেকেই বিস্তৃত হন এবং তার কি করণীয় কর্তব্য সেটিও বিস্তৃত হন। ইন্দ্রের রাজ প্রাসাদে গন্ধর্বদের প্রধান তুম্বুরু তারাও এই সুরের মাধ্যমে বিস্মিত হয়ে গান গাওয়া বিস্মৃত হন। অনন্ত শেষ যিনি বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড মস্তকে ধারণ করে রয়েছেন তিনিও প্রথম স্বরে মোহিত হন এবং এজন্যে সমস্ত বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড প্রায় পতিত হওয়ার উপক্রম হয়। কৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলরাম উদ্ধৃত করেছেন যে ইন্দ্র তার ঐরাবত থেকে পতিত হন। আর পতিত হয়ে সেই বাঁশির স্বরকে প্রণাম করেন। তিনি পরম আনন্দে ক্রন্দন করতে থাকেন অথবা হতবাক হয়ে যান।
২য় স্বর: শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির সুরের ২য় স্বরের কারণে যমুনা যেটি নির্দিষ্ট দিকে প্রবাহিত হচ্ছিল সেটি বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়। তিনি তার প্রবাহের দিক পর্যন্ত বিস্তৃত হন।
৩য় স্বর; এই সুরের মাধ্যমে চন্দ্র তার গতি বিধি সম্পর্কে বিস্তৃত হয়ে এক স্থানে স্থিত হয়ে যান। তিনি হতবাক হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান।
৪র্থ স্বর: বৃন্দাবনের গো বৎসরা স্থির হয়ে যান এবং তাদের কর্ণ ঊর্ধ্বমুখী হয়ে যায়। কৃষ্ণের বাঁশির সুর এতই বিমোহিত কর যে, তাদের কর্ণ কুহরে সেই অমৃত নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্রহণ করার জন্য আকুল হয়ে উঠে। তারা ঘাস চর্বন করতে, বাছুরকে দুগ্ধ দান করতে, দুগ্ধ গ্রহণ করতে এবং এমনকি সেটি পান করতে বিস্তৃত হন। তাদের চক্ষু দিয়ে ভগবানকে তখন দর্শন করে, নাসাগ্র দিয়ে ভগবানের দিব্য দেহের আঘ্রাণ গ্রহণ করে, জিহ্বা দিয়ে ভগবানের শ্রীপাদপদ্ম লেহন করে, মন দিয়ে তারা কৃষ্ণকে স্মরণ করে এবং হৃদয় দিয়ে ভগবানকে আলিঙ্গন করে।
৫ম স্বর: কৃষ্ণ ব্রজ গোপিকাদের আহ্বান করেন। এটি বিখ্যাত একটি স্বর যার মাধ্যমে সর্ব আকর্ষক পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্রজ গোপিকাদের আকর্ষণ করেন।
৬ষ্ঠ স্বর: এ স্বরের ধ্বনিতে ষড় ঋতুদের আবির্ভাব ঘটে। বৃন্দাবন কৃষ্ণকে একই সাথে ষড় ঋতুর মাধ্যমে আহ্বান করেন। কৃষ্ণ যখন বৃন্দাবনে প্রবেশ করেন তখন বৃন্দাদেবী কৃষ্ণের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য সবকিছু সুসজ্জ্বিত করে রাখেন। শরৎ ঋতুতে সমস্ত ফুল ও ফল সতেজ থাকে এবং বৃক্ষের শাখাগুলো নিম্নদিকে ধাবিত হয়ে কৃষ্ণকে ফল ও ফুল নেওয়ার জন্য আহ্বান করেন। এভাবে বৃক্ষরা পর্যন্ত কৃষ্ণের সেবা করার মাধ্যমে অত্যন্ত প্রসন্ন হন। এই ষষ্ঠ স্বরের মাধ্যমে পাথর পর্যন্ত গলে যায়। বৃন্দাবনে ‘চরণ পাহাড়ী’ নামে একটি স্থান রয়েছে যেখানে কৃষ্ণ তার চরণ পদ্ম স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে পাথরটি গলে যায়। গিরি গোবর্ধন যখন উত্তপ্ত হয় তখন কৃষ্ণের পাদ স্পর্শে শীতল হয়ে যায়। মাঝে মাঝে পাথর গলে এমন কোমল হয় যা কৃষ্ণের পাদপদ্মকে প্রসন্ন করে। এভাবে শুধুমাত্র এই ষষ্ঠ স্বরের মাধ্যমে এই প্রকার লীলা সংঘটিত হয়।
৭ম স্বর: ষড় ঋতুদের মধ্যে বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শিশির ভেজা শীতকালকে একত্রে আহ্বান করে কৃষ্ণ বাঁশির এই স্বরের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ঋতুদের ব্যবহার করতে পারেন ।
৮ম স্বর: এটি বিশেষভাবে শ্রীমতী রাধারাণীর জন্য। কৃষ্ণ যখন এই স্বর সৃষ্টি করেন তখন রাধারাণীর অধরের সজ্জ্বা আখিঁ যুগলের সজ্জায় চলে যায় আর কাজল চলে আসে অধরে ।

চতুর্থ কারণ

ব্রহ্মাকে দীক্ষা প্রদানের জন্য কৃষ্ণ বাঁশি বাজান ৷ কৃষ্ণ এভাবে দীক্ষা প্রদানের মাধ্যমে বাঁশির সুরে সৃষ্টি কার্য সূচনার সমস্ত দিক নির্দেশনা ব্রহ্মাকে প্রদান করেন। যেটি শ্রীমদ্ভাগবত (১/১/১) বলা রয়েছে
জন্মাদ্যস্য যতোহৰয়াদিতরতশ্চার্থেস্বভিজ্ঞঃ স্বরাট
তেন ব্ৰহ্ম হৃদা য আদিকবয়ে মুহ্যন্তি যৎসূরয়ঃ ॥
“হে বসুদেব তনয় শ্রীকৃষ্ণ, হে সৰ্বব্যাপ্ত পরমেশ্বর ভগবান, আমি আপনাকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি । আমি শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করি, কেননা তিনি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সব কিছু সম্বন্ধে অবগত এবং তিনি সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন, কেননা তাঁর অতীত আর কোনও কারণ নেই। তিনিই আদি কবি ব্রহ্মার হৃদয়ে সর্বপ্রথম বৈদিক জ্ঞান প্রদান করেছিলেন।”
ব্রহ্মা যখন সৃষ্টির প্রারম্ভে তার কর্তব্য সম্পর্কে বিভ্রান্ত ছিলেন তখন কৃষ্ণ বাঁশির সুরে কর্ণ কুহরে প্রবেশ করে হৃদয় অভ্যন্তরে কি করতে হবে সে বিষয়ে দিক নির্দেশনা প্রদান করেন ।

পঞ্চম কারণ

শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অন্তরঙ্গ পার্ষদদের আনন্দ প্রদানের জন্য বাঁশি বাজান । এটি অনুষ্ঠিত হয় ব্রজে নতুবা বিভিন্ন বনে কৃষ্ণ নন্দ মহারাজ সহ অন্যান্য ব্ৰজ বাসীদের মধ্যখানে বসে বাঁশিতে সুমধুর সুর সৃষ্টি করেন।

ষষ্ঠ কারণ

কৃষ্ণের বাঁশির ছয়টি রন্ধ্র বা ছিদ্র রয়েছে। এ বিষয়ে এক মহান বৈষ্ণব তিনটি বিবৃতি দিয়েছেন।
১ম বিবৃতি: জীবের ছয়টি অনর্থ (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য) দূর করার জন্য কৃষ্ণ বাঁশির ছয়টি রন্ধ্র ধারন করেন। আমাদের হৃদয় যখন আমিত্বে ভরে যায় তখন কৃষ্ণ তার মধুরামৃত প্রবেশ করানোর সুযোগ পান না। শ্রীমৎ রাধানাথ স্বামী এ বিষয়ে বলেছেন, “শুধুমাত্র একটি খালি পাত্রেই কোন কিছু দিয়ে পূর্ণ করা যায়। যদি সেটি পূর্ব থেকেই পূর্ণ থাকে তবে নতুন কোন কিছু দিলে তা কেবলমাত্র উপচে পড়বে।” অর্থাৎ আমাদের হৃদয় যদি জাগতিক কামনা-বাসনায় পূর্ণ থাকে তবে কৃষ্ণের বাঁশির সুর আমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। কিন্তু যদি এটি অপূর্ণ থাকে এবং সেই হৃদয় যদি কৃষ্ণকে অর্পণ করা হয় তবেই কৃষ্ণ তার বাঁশির সুরের মাধ্যমে মধুরামৃত প্রবেশ করাতে পারে।
২য় বিবৃতি: বাঁশির মধ্যে যাই (বায়ু) প্রবেশ করে তা পুনরায় ফিরে আসে। অর্থাৎ কৃষ্ণের বাঁশি হল অত্যন্ত সরল। আমাদের তিনটি মুখ রয়েছে। একটি মুখ বাইরের লোকেরা দেখতে পারে অপরটি হল ব্যক্তিগত যেটি শুধুমাত্র পরিবারের সদস্যরা দেখতে পারে এবং আমাদের গুপ্ত মুখটি রয়েছে সেটি কেবলমাত্র পরমাত্মা ও আত্মা বা ব্যক্তি স্বয়ং জানে বা দেখতে পারে। এমনকি আমাদের যে গুপ্ত সম্পর্কে মুখটি আমাদের পত্নী, মাতা, পিতা ইত্যাদি ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরাও জানতে পারে না। কৃষ্ণের বাঁশি এতই স্বচ্ছ ও সরল যে, যেকেউ বাঁশির মধ্যে বায়ুর প্রবেশ ও নির্গমন উপলব্ধি করতে পারে।
৩য় বিবৃতি: কৃষ্ণের বাঁশি হল অত্যন্ত সোজা এটি বাকানো যায় না। এটি নির্দেশ করে যে, ভক্তকে কৃষ্ণের বাঁশির মতোই সহজ সরল বা সোজা সাপ্টা হতে হবে। যদি উপরোক্ত ত্রুটিগুলো যদি সংশোধন করা হয় তবে আমাদের হৃদয় কৃষ্ণের বাঁশির সুর প্রবেশের জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠবে। এভাবে এই বৈষ্ণব কৃষ্ণের বাঁশির সুর বাদনের ৬৪টি কারণ উল্লেখ করেছেন যার তিনটি এখানে আলোচনা করা হয়। (সংকলিত)লেখক পরিচিতি : শ্রীমান অমরনাথ দাস শ্রীল প্রভুপাদের শিষ্য শ্রীমৎ রাধাগোবিন্দ দাস গোস্বামী মহারাজের একজন শিষ্য। তিনি সারা বিশ্বের বিভিন্ন শহর, বিশ্ববিদ্যালয়, মন্দির, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইউটিউব, হোয়াটস অ্যাপস ও ফেইসবুকে কৃষ্ণভাবনামৃত নিরলসভাবে প্রচার করে চলেছেন। বিশেষত বিজ্ঞান ও পারমার্থিকতার সম্মিলনে তার প্রবচনগুলো ছাত্র সমাজের জন্য বেশ বিখ্যাত। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তিনি ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ওপর মাষ্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন এবং সেসাথে মায়াপুরে ভক্তিশাস্ত্রী ডিগ্রি লাভ করেন। তার জীবনের আমূল পরিবর্তনের জন্য বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ শ্রীল প্রভুপাদের শিষ্য শ্রীমৎ ভক্তিস্বরূপ দামোদর গোস্বামীর কাছে। তিনি তাঁকে এবং তার পরিবারকে কৃষ্ণভাবনা পালনের জন্য উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। বর্তমানে তিনি আমেরিকার ইস্কন বোস্টনে নিয়মিত কৃষ্ণভাবনামৃতের ওপর প্রবচন প্রদান করেন।


 

ব্যাক টু গডহেড জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৮ হতে প্রকাশিত

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।