কুম্ভমেলার উদ্ভাবন কিভাবে হল

প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ | ১২:৪৯ অপরাহ্ণ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ | ১২:৪৯ অপরাহ্ণ

এই পোস্টটি 98 বার দেখা হয়েছে

কুম্ভমেলার উদ্ভাবন কিভাবে হল

শ্রীমৎ ভক্তিচারু স্বামী ও শ্রীমান তারকব্রহ্ম দাস

এলাহাবাদে প্রতি বারো বছর অন্তর কুম্ভমেলা হয়। গঙ্গা, যমুনা এবং সরস্বতী নদীর সঙ্গমস্থলে অনুষ্ঠিত এই মেলাটি পৃথিবীর সবচাইতে বড় ধর্মীয় মেলা। কুম্ভমেলার সময় সেখানে কোটি কোটি তীর্থ যাত্রীর সমাগম হয়।


তীর্থ বলতে কি বুঝায়?

“তীর্থ” শব্দ কর্ণে প্রবিষ্ট হলেই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে যে, তীর্থ বলতে কি বুঝায়। যার দ্বারা উত্তীর্ণ হওয়া যায় তাই তীর্থ। অমরকোষ অভিধানে বলা হয়েছে-তীর্থ শব্দে নিদান (আদি কারণ), নিপান (জলাশয়, নদীপারের স্থান), শাস্ত্র, মুনি-ঋষি সেবিত জল এবং শ্রেষ্ঠ গুণীজনদের বুঝায়।
তীর্থ প্রধানতঃ ত্রিবিধ-জঙ্গম, মানস ও ভৌম। শতাতপ স্মৃতিশাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, সাধু-সজ্জনগণই শ্রেষ্ঠ জঙ্গম তীর্থ।

ব্রাহ্মণা জঙ্গমং তীর্থং নির্মলং সার্বকালিকম্।
যেষাং বাক্যোদকেনৈব শুধ্যন্তি মলিনা জনাঃ॥

মানস তীর্থ বলতে সত্য, ক্ষমা, ইন্দ্রিয়, নিগ্রহ, দয়া, সরলতা, ব্রহ্মচর্য প্রভৃতি বুঝায়। মনের শুদ্ধতাই সর্বোত্তম তীর্থ। ভৌম তীর্থ বলতে পৃথিবীর মধ্যে বিশেষ মাহাত্ম্যপূর্ণ স্থানসমূহকে বুঝায়। যথা-গঙ্গা-যমুনা, নবদ্বীপ-বৃন্দাবন, জগন্নাথক্ষেত্রাদি। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে বলা হয়েছে যে, ভূমির অদ্ভুত প্রভাব, জলের গুণ এবং সাধুগণের সমাশ্রয়- এই তিনটিই ভূমি বিশেষের পবিত্রতার কারণ।
শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে, “ভাগবতগণই স্বয়ং মহাতীর্থ।” স্কন্দপুরাণে দ্বারকা মাহাত্ম্যে প্রহ্লাদ মহারাজ বলেছেন-“শ্রীভগবানের নামই সর্বোত্তম তীর্থ। যিনি প্রত্যহ ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ উচ্চারণ করেন তিনি অযুত যজ্ঞের ফল ও কোটি তীর্থের পুণ্য প্রাপ্ত হন।” ভগবানের লীলাকথা শ্রবণই তীর্থফলপ্রদ। তাই শাস্ত্র বলে- “যেখানে পরম উদার শ্রীকৃষ্ণকথার প্রসঙ্গ হয়, সেখানে গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, সিন্ধু, সরস্বতী-সর্ব তীর্থই অবস্থান করেন। যাঁর গৃহে নিত্য ভাগবত কথা আলোচনা হয়, তার গৃহই পাপ নাশন তীর্থরূপে বিরাজমান।”
ভগবান শ্রীরামচন্দ্র, প্রভু বলরাম, শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু, শ্রীমন্মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব তীর্থ পর্যটন করে তীর্থ সমূহকে মহাতীর্থে পরিণত করেছেন। তাঁদের অনুগামী সাধু-সজ্জনগণ তীর্থযাত্রা করে তীর্থসমূহে স্বচরণ রেণু রেখে গিয়েছেন, আমরাও তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ ক্রমে তীর্থ ভ্রমণ করে তাঁদের পদরজঃকণার স্পর্শে নিশ্চই পরম অভীষ্ট পথে অগ্রসর হতে পারব। এখানে গোমুখ থেকে সাগর সঙ্গম পর্যন্ত প্রধান তীর্থসমূহের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হলো।
শ্রীল প্রভুপাদের লেখনীর মাধ্যমে কুম্ভমেলা সম্বন্ধে জানার চেষ্টা করেছিলাম। শ্রীমদ্ভাগবতের অনুবাদে শ্রীল প্রভুপাদ বর্ণনা করেছেন যে, কিভাবে দেবতা ও দানবদের যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে ক্ষীরসাগর মন্থন করে অমৃত লাভের ভিত্তিতে এই উৎসবের সূচনা হয়েছিল। দুর্বাসা মুনির অভিশাপের ফলে দেবতারা যখন দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তখন দানবেরা তাদের পরাজিত করে এবং তার ফলে তাদের স্বর্গলোক ত্যাগ করে চলে যেতে হয়। তারা যখন ব্রহ্মার কাছে গিয়ে তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা নিবেদন করে, ব্রহ্মা তখন তাদের নিয়ে ক্ষীরসমুদ্রের তীরে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর কাছে যান এবং তাঁকে তাদের প্রার্থনা নিবেদন করেন। ভগবান শ্রীবিষ্ণু তখন তাদের দর্শন দান করে উপদেশ দেন দানবদের সঙ্গে মিলিত হয়ে অমৃত লাভের জন্য ক্ষীরসমুদ্র মন্থন করতে। ভগবানের সেই নির্দেশ অনুসারে দেবতারা দানবদের রাজা বলি মহারাজের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করে এবং সম্মিলিতভাবে ক্ষীরসমুদ্র মন্থনে নিয়োজিত হয়। তারা স্থির করেছিল যে, সমুদ্র মন্থনের ফলে যখন অমৃত উত্থিত হবে, তখন সেটা তারা ভাগ করে নেবে।
সেই সমুদ্র মন্থনের জন্য তারা মন্দার পর্বতকে মন্থন-দন্ডরূপে এবং নাগরাজ বাসুকিকে মন্থন-রজ্জুরূপে ব্যবহার করে। দেবতারা এবং দানবেরা সম্মিলিতভাবে মন্দর পর্বতকে বহন করে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছু দূর বহন করার পরেই তারা পরিশ্রান্ত হয়ে সেই কার্যে বিরত হয়। ভগবান শ্রীবিষ্ণু তখন তাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তাঁর বাহন গরুড়ের পিঠে চড়ে সেখানে উপস্থিত হন এবং অনায়াসে সেই পর্বতটিকে গরুড়ের পিঠে করে ক্ষীরসমুদ্রে নিয়ে আসেন। দেবতা ও দানবেরা সম্মিলিতভাবে যে কাজটি করতে সক্ষম হয়নি, ভগবানের বাহন গরুড় সেটি অনায়াসে একাই সম্পাদন করেছিলেন।
দেবতা এবং দানবেরা মন্দার পর্বতকে মন্থন দণ্ড করে এবং নাগরাজ বাসুকিকে মন্থন- রজ্জু করে ক্ষীরসমুদ্র মন্থনের প্রয়াস করে। কিন্তু যখন তারা মন্দর পর্বত ক্ষীরসমুদ্রে স্থাপন করে তখন মন্দর পর্বত সেই গভীর সাগরে ডুবে যায়। দেবতা ও দানবদের এই কার্যে অক্ষমতাজনিত নৈরাশ্য দর্শন করে ভগবান আবার সেখানে এসে উপস্থিত হন এবং কূর্মরূপ ধারণ করে মন্দর পর্বতকে তাঁর পিঠে রেখে সেই মন্থন কার্যে তাদের সাহায্য করেন।
ক্ষীরসমুদ্র মন্থনের ফলে প্রথমে এক ভয়ঙ্কর বিষ উত্থিত হয়। ব্রহ্মাণ্ডের আদি প্রজাপতিরা সেই বিষের ভয়ঙ্কর প্রভাবের ফলে সমগ্র সৃষ্টি যে ধ্বংসোন্মুখ হচ্ছে, তা বুঝতে পেরে দেবাদিদেব মহাদেবকে তা পান করতে অনুরোধ করেন। শিব সেই বিষ গ্রহণ করে তা পান করেন। এই বিষ পানের ফলে তাঁর কোন ক্ষতি হয়নি কিন্তু সেই বিষ কণ্ঠে ধারণ করার ফলে তাঁর কন্ঠ নীল বর্ণ ধারণ করে। তাই তিনি নীলকণ্ঠ নাম প্রাপ্ত হন।
সেই বিষের কয়েক ফোঁটা শিবের অঞ্জলি থেকে মাটিতে পড়ে এবং সেগুলি গ্রহণ করার ফলে সাপ, বিছা, বিষাক্ত গাছপালা এবং অন্যান্য বিষাক্ত বস্তুর উদ্ভব হয়। সমুদ্র মন্থনের ফলে তারপর সুরভী গাভী, স্বর্গীয় অশ^ উচ্চৈঃশ্রবা এবং অপূর্ব সুন্দর হস্তী ঐরাবত আবির্ভূত হয়। এছাড়াও কৌস্তভ মণি আদি মঙ্গলসূচক বহু দ্রব্য উত্থিত হয় এবং তারপর সৌভাগ্যের অধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মীদেবী আবির্ভূতা হন এবং ভগবান শ্রীবিষ্ণুুকে তাঁর পতিরূপে গ্রহণ করেন। অবশেষে ভগবানের অবতার ধন্বন্তরি অমৃতভাণ্ড নিয়ে আবির্ভূত হন।
দানবেরা তৎক্ষণাৎ সেই অমৃতভাণ্ড কেড়ে নিয়ে প্রথমে কে সেই অমৃত পান করবে, তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিবাদ করতে শুরু করে। তারা যখন এইভাবে অমৃতভাণ্ড নিয়ে কাড়াকাড়ি করছিল, তখন তার কয়েক ফোঁটা অমৃত প্রয়াগ, হরিদ্বার, নাসিক এবং উজ্জয়িনীতে পতিত হয়। তখন থেকে সেই চারটি পবিত্র স্থানে কুম্ভমেলার অনুষ্ঠান শুরু হয়, যেখানে প্রতি বারো বছর অন্তর সেই নদীগুলির জল অমৃততে পরিণত হয়।
গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী আদি সেই স্থানে নদীগুলি যখন কুম্ভমেলার সময় অমৃতে পরিণত হয়, তখন যদি কেউ সেখানে স্নান করে, তাহলে সে জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুুক্ত হয়ে অমৃতত্ত্ব লাভ করে।
ভারতের বিভিন্ন স্থান এবং সারা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে সাধুরা সেই সময় সেখানে স্নান করতে আসেন। যোগীরা ধ্যান বন্ধ করে হিমালয়ের গুহা থেকে সেখানে নেমে আসেন। শ্রীল প্রভুপাদ বলেছিলেন যে, সেই সময় স্বর্গের দেবতারাও তাঁদের পরিচয় গোপন করে জনসাধারণের মধ্যে মিশে গিয়ে সেখানে স্নান করতে আসে। কুম্ভমেলা সর্বদাই লক্ষ লক্ষ মানুষকে আকর্ষণ করে; কিন্তু সেই বছরটা ছিল এক বিশেষ পূর্ণ কুম্ভমেলা, যখন একশ চুয়াল্লিশ বছর পর অমৃতকুম্ভ পূর্ণরূপে অমৃতে ভরে গিয়েছিল।
গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গমস্থলে বিশাল কুম্ভমেলার ক্ষেত্রে ইস্্কন একটা বড় জায়গা পেয়েছিল এবং সেখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই সমস্ত অনুষ্ঠানের জন্য এবং ভক্তদের থাকার জন্য অনেক তাঁবু তৈরী করা হয়েছিল।
অন্যান্য জায়গায় বিভিন্ন যোগীরা তাদের সিদ্ধি এবং ভেল্কিবাজি প্রদর্শন করছিল। একজন যোগী একটা তালাবদ্ধ ট্রাঙ্কের মধ্যে মাটির নিচে কয়েকদিন থেকে তার যোগসিদ্ধি প্রদর্শন করেছিল। তার সেই অদ্ভুুত সিদ্ধি কুম্ভমেলায় এক অদ্ভুত আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। প্রতিদিন হাজার হাজার লোক সেখানে যাচ্ছিল তাঁকে দেখার জন্য।

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।