আগুন:

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২২ | ২:০৮ অপরাহ্ণ আপডেট: ২৩ জুন ২০২২ | ২:০৮ অপরাহ্ণ

এই পোস্টটি 124 বার দেখা হয়েছে

আগুন:

একটি ধ্যানের বিষয়

আগুনের বৈশিষ্টগুলো চিন্তন বা ধ্যানের মাধ্যমে আমরা কৃষ্ণকে স্মরণ করতে পারি, যিনি হলেন সমস্ত শক্তির উৎস।
উর্মিলা দেবী দাসী

আড্রিয়াটিক সাগরের জল আমার পায়ে স্পর্শ করছে। সূর্যরশ্মি ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসছে, আকাশের রঙ গাঢ় নীল রং ধারণ করেছে। উপসাগরের পাশে রয়েছে তেল শোধনাগার কারখানা এবং কারখানার চিমনিতে অগ্নিশিখা জ্বলছে। আমি সেই অগ্নিশিখার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম কিভাবে আগুন কারো মনোযোগ আকর্ষণ করে। এটি আশ্চর্যজনক কিছু নয়, আমি গভীরভাবে চিন্তা করে বুঝতে পারলাম যে, আগুনও কৃষ্ণের শক্তির একটি অংশ। কৃষ্ণ মানে সর্বাকর্ষক। কৃষ্ণই একমাত্র ব্যক্তি যার থেকে সব কিছুর উৎপত্তি। অর্থাৎ, আগুনও কৃষ্ণের শক্তি। আগুনের বৈশিষ্ট্যগুলো বিবেচনা করলে সহজেই বুঝা যায় যে কৃষ্ণই সকল শক্তির উৎস। যদিও কৃষ্ণের শক্তির কিছু অংশ প্রকৃতিতে বিদ্যমান থাকায় আমরা আধ্যাত্মিক চেতনার সংস্পর্শে থাকতে পারি। আমি এ প্রতিবেদনের শুরুতে আগুনের তাপ তারপর এর আলো এবং এর সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করব। আগুনের সৌন্দর্য কৃষ্ণের সৌন্দর্যকে বোঝানো হয় এবং সবশেষে আগুনের সাথে কৃষ্ণের বিভিন্ন লীলা বিলাসের কাহিনি দিয়ে শেষ করব।

তাপ

বাতাসের পর অধিকাংশ মানুষ মনে করেন খাদ্য ও পানীয় জল হচ্ছে মূল জৈবিক চাহিদা। কিন্তু আমরা সপ্তাহ বা মাসের পর মাস কোনো খাদ্য না খেয়ে হয়তো জীবিত থাকতে পারি এবং এমনকি জল ছাড়াও প্রায় এক সপ্তাহেরও বেশি টিকে থাকতে পারি। বাতাসের পর গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা হচ্ছে সঠিক তাপমাত্র । বেঁচে থাকার জন্য আমরা সূর্য হতে দুই ভাবে জীবন দানকারী তাপ পেয়ে থাকি। প্রথমটি, প্রত্যক্ষভাবে আমাদের শরীরের চর্মের মাধ্যমে এবং অন্যটি পরোক্ষভাবে খাদ্য হজমের মাধ্যমে। সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত খাদ্য এ হজম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সূর্যের শক্তিকে শরীরে অবমুক্ত করে। মানুষের মতো উষ্ণ রক্তের জীবদের জন্য শতকরা ৮০ ভাগ যেগুলো আমরা খেয়ে থাকি সেগুলো আভ্যন্তরীন তাপ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। তবুও আমরা ভুরে যায় যে, কিভাবে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীন এই তাপ আমাদের দেহগুলোকে বাঁচিয়ে রাখে। যদিও তাপ হলো অদৃশ্য তদ্রুপ বন্ধ আত্মাদের জন্য কৃষ্ণ অদৃশ্য থেকে যায়।
তিনি আমাদের হৃদয় অভ্যন্তর থেকে এবং আমাদের চারপাশ থেকে বাহ্যিকভাবে আমাদের প্রতিপালন করেন, কিন্তু আমরা তাঁকে দেখতে পায় না এবং আমরা যে তাঁর ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল সেটি ভুলে যায়। কোন সাধারণ ব্যক্তি হয়ত কোন কৃতজ্ঞতা বা স্বীকৃতি না পেলে কোন কিছু কাউকে দিতে চায় না। কিন্তু যদি কেউ কৃষ্ণকে ভুলেও যায় তবুও কৃষ্ণ তাকে তার জীবন ধারনের জন্য সবকিছু প্রদান করে।
অদৃশ্যভাবে যে তাপ আমাদের বাঁচিয়ে রাখে ঠিক তদ্রুপ একটি শ্লোক শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতায় প্রদত্ত রয়েছে, যেখানে কৃষ্ণ বলছেন, তিনি সেই অদৃশ্য সূতার মতো যাকে আশ্রয় করে মণিসমূহ গাঁথা থাকে। আমরা জানি সূত্র সেখানে রয়েছে কারণ মণিগুলো সারিবদ্ধভাবে ঝুলে রয়েছে। কিন্তু এসব মণিদের ভীড়ে সূত্র গুপ্ত বা অদৃশ্য রয়ে যায়। যদিও সূত্রের মতো কৃষ্ণ ভঙ্গুর নয়। বরং তার কাছ থেকে আগত সেই তাপ শক্তির কথা চিন্তা করিনি। সামান্যটুকু তাপমাত্রার পার্থক্য জীবন ধারণের পরিবর্তে মৃত্যু বা মারাত্মক স্বাস্থ্যহানী নিয়ে আসতে পারে। যারা আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করেন তাদেরকে অবশ্যই তা যথেষ্ট যত্ন ও শ্রদ্ধার সহিত করতে হবে। শৈশবে হয়ত এমন দিন গেছে যখন গাদাগাদি করে আগুনের সম্মুখে একটু উষ্ণতা লাভের জন্য বসতাম, কিন্তু আমরা এর খুব সন্নিকটে যেতাম না। ঠিক তদ্রুপ যদি কৃষ্ণের প্রতি পূর্ণ শুদ্ধ প্রেম নাও থাকে তবুও অপরাধের অগ্নিতে দগ্ধীভূত না হওয়ার জন্য আমরা কৃষ্ণকে সেবা-পূজার বিধিবদ্ধ নিয়মানুসারে সেবা করে থাকি।
মিচখান একজন অভিজ্ঞ দমকলকর্মী লিখেছেন, “অগ্নি হল একটি সজীব জিনিসের মত ধ্বংসের এক জীবন্ত ইঞ্জিন। আর এর প্রতিটি অগ্নিশিখার একটি স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব রয়েছে। একটি দাবানলের যে শব্দ ও গন্ধ রয়েছে তা কখনো ভোলার নয়। প্রজ্জ্বলিত বর্তিকা ও উত্তপ্ত বায়ু একটি জেট ইঞ্জিনের মত গর্জন করে। ঝলসানো ভূমির ঝাঁঝালো গন্ধ।” এক্ষেত্রে, তাপের ধ্বংসাত্মক শক্তির পরিপ্রেক্ষিতে শাস্ত্রে প্রদত্ত বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের বিনাশের সে পর্যায়ের বর্ণনা মনে করিয়ে দেয়। সে সময় ভগবান বদ্ধ জীবদের ভগবদ্বিমুখ নিরবচ্ছিন্ন কার্যকলাপের জন্য অখুশী হওয়ার কারণে অগণিত সূর্যের উত্তাপের চেয়েও এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডকে অধিক উত্তপ্ত করে তোলে।
যদি আগুনের ভালো ও খারাপ দিকের সাথে তুলনা করে কৃষ্ণের কথা চিন্তা করি তবে আমরা ভুল করব। কেননা কৃষ্ণ হলেন সর্বকল্যাণময় এবং তার মাধ্যমে সংঘটিত তাপের ধ্বংসাত্মক কার্যও শুদ্ধতা ও শুচিতা নিয়ে আসে। কৃষকরা মাঝে মাঝে জমিতে আগুন ধরিয়ে দেয় আগাছা ও এর বীজ দূর করার জন্য এবং পরবর্তীতে অবশিষ্ট ছাই ভূমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। বিজ্ঞানী ও মেডিকেল ডাক্তাররা আগুনের ধ্বংসাত্মক শক্তি কাজে লাগিয়ে কোন কিছুর জীবাণুমুক্ত করে থাকে। ঠিক তদ্রুপ কৃষ্ণ আমাদের জন্য ভগবদ্‌গীতায় বলছেন যে, আত্মা ও ভগবান সম্পর্কিত গ্রন্থ অপ্রাকৃত বৈদিক জ্ঞান জীবের সমস্ত অজ্ঞানতা ও দুঃখদূর্দশা দগ্ধীভূত করে নিঃশেষ করে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে প্রেমময়ী সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমাদের সমস্ত জড় বাসনা যেগুলো আমাদেরকে কর্ম ও পুনঃজন্মের চক্রে বেঁধে রাখে। সেগুলো দূরীভূত হয়। যেরকম উচ্চ তাপে বীজ তার সমস্ত গজানো শক্তি হারিয়ে ফেলে।
সেরকম জড় কামনা-বাসনায় বীজ পুড়ে ছাই হয়ে যায় যখন ভক্ত ভগবানের সেবার ব্রত গ্রহণ করে। দীক্ষা অনুষ্ঠানের সময় যজ্ঞের অগ্নিতে শস্যাদি আহুতি দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে অগ্নিকে কৃষ্ণের জিহ্বা হিসেবে উপলব্ধি করা হয়: তিনি শস্যাদি আহার করেন এবং এর মাধ্যমে শস্য আহুতি প্রদানকারী পবিত্র হন। ভগবানের যজ্ঞের জিহ্বা থেকে উৎপন্ন প্রশান্তির উত্তাপ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, উষ্ণতা জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং এক্ষেত্রে ভগবান হলেন পরমেশ্বর, যিনি সমস্ত জীবনের উৎস। উষ্ণতা ভালোবাসার সঙ্গেও সম্পর্কিত-আমরা অনেক সময় উষ্ণ আলিঙ্গন বা শীতল দৃষ্টির কথা বলি। কৃষ্ণের উষ্ণতা হল সমস্ত জীবের প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ। যখন সূর্য, অগ্নির তাপ কিংবা গৃহের উনুনের তাপ আমরা অনুভব করি, তখন এর মাধ্যমে আমরা জীবন ও কৃষ্ণপ্রেম উভয়ই অনুভব করতে পারি।
জীবন ও ভালোবাসা প্রায়ই খাদ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাপ কাঁচা খাদ্যের আবরণ বা স্বাদ পরিবর্তন করে শক্ত শাক-সবজি থেকে রস বের করে আনে। ঠিক তদ্রুপ কৃষ্ণ শুষ্ক দার্শনিকদের ইস্পাত সদৃশ হৃদয় গলিয়ে ভালোবাসার মাখনে পরিণত করতে পারে। যেরকম তাপ রন্ধন হয়নি এরকম খাবারের গুপ্ত স্বাদকে বের করে আনতে পারে। সেরকম যখন একটি আত্মা কৃষ্ণকে সেবা করে তখন তার মধ্যে এক অপ্রাকৃত আনন্দের সঞ্চার হয়। গীতায় কৃষ্ণ প্রত্যক্ষভাবে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সে রাসায়নিক অগ্নি যেটি আমদের দেহে রয়েছে।
সেটি খাদ্যেক হজম করে দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও অন্যান্য পদ্ধতিগুলোকে পরিপুষ্ট করে তোলে। এভাবে এটি খাদ্য থেকে প্রয়োজনীয় উপাদানকে আলাদা করে। আয়ুর্বেদ অনুসারে, হজম অগ্নির ফলে শরীরের অপরিহার্যতা ও বল বৃদ্ধি পায়।


আলোর মাধ্যমে অভিবাদন জানানোর ব্যাপারটিও মানবজাতির প্রাচীন রীতি। তদ্রুপ কৃষ্ণের মন্দিরগুলোতে আরতির সময় বিগ্রহের উদ্দেশ্যে প্রদীপ নিবেদন করা হয়। ভক্তরা ভালোবাসার সহিত প্রদীপের আলো আরতির সময় নিবেদন করে। তদ্রুপ কৃষ্ণ আমাদেরকে তার আলোক দ্যুতির মাধ্যমে স্বাগত জানিয়ে তাঁর গৃহে আমন্ত্রণ জানান।

তদ্রুপ কৃষ্ণকে সেবা করায় শুদ্ধতার সর্বশেষ স্তরগুলোতে আত্মা তার পারমার্থিক শক্তির শুদ্ধতার স্তরে উপনীত হয়, যেখানে দেহাত্মবুদ্ধির মত জড় অনাকাঙ্ক্ষিত কামনা বাসনা সম্পূর্ণরূপে নিঃশেষিত হয়ে যায়।
অতিরিক্ত তাপে রান্না করলে খাদ্যের বাইরে আবরণ পুড়ে যেতে পারে এবং সে সাথে ভেতরের অংশটি কাঁচা রয়ে যেতে পারে। এজন্য ধৈর্যের সহিত রান্না করলে খাদ্যটি যথাযথভাবে স্বাদ প্রদান করে। তদ্রুপ অভিজ্ঞ ভক্তের তত্ত্বাবধানে হরিনাম, জপ-কীর্তন, শ্রবণ ও সেবা নিবেদনের মাধ্যমে কৃষ্ণের সাথে যথাযথভাবে সম্পর্ক স্থাপন করা প্রয়োজন। অসহিষ্ণু ভক্তিযোগীগণ হয়তো চরম অনুশীলনে ব্রত গ্রহণ করতে পারে। তবে তার মাধ্যমে অনেক সময় তারা অনুৎসাহিতও হতে পারে। কেননা এই প্রকার অনুশীলন তাদের হৃদয় স্পর্শ করেনি। কিন্তু যারা উৎসাহী, আত্মবিশ্বাসী ও সহিষ্ণু তারা দেখে ভক্তিযোগের মাধ্যমে তাদের ভাবনা ও অনুভূতির পরিবর্তন হচ্ছে এবং সে সাথে হৃদয়ও নির্মল হয়।

আলোক

যেরকম উষ্ণতা নিবিড়ভাবে আমাদের জীবন ও ভালোবাসা প্রকাশের সাথে সম্পর্কিত, তেমনি আলোকও সম্পর্কিত। যখন প্রিয় কারো সাথে দেখা হয় তখন লোকেদের চোখে মুখে যেন আলোক দ্যুতি প্রকাশ পায়। একজন ব্যক্তির সফল জীবনকে বর্ণনা করা হয় আলোকজ্জ্বল হিসেবে। এভাবে আলো আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, কৃষ্ণ হল সবার প্রাণ বা জীবন এবং তিনি সবার সুহৃদ।
প্রজ্জ্বলিত মোমবাতি, রঙিন আলোর বাল্ব ও আতশবাজির ঝলকানি তখনই ব্যবহার করা হয় . যখন বন্ধু-বান্ধব, পরিবার ও কোন সম্প্রদায় ছুটির দিনে উৎসবাদি বা কোন উদ্‌যাপনে সামিল হন। এরকম. আলোক দর্শনের মাধ্যমে আমরা ধ্যান করতে পারি যে কিভাবে চিন্ময় জগতে এ এক একটি দিন এক একটি উৎসব। সমস্ত আনন্দের আধার শ্রীকৃষ্ণ এরকম নিজ অপ্রাকৃত আয়োজনগুলোর মাধ্যমে উৎফুল্ল হন।
কোন পার্টিতে গেলে কিংবা নিজের গৃহে প্রবেশ করলে, আলো আমাদের স্বাগত জানায়। যখন আলো থাকে তখন আমরা বুঝতে পারি কেউ গৃহে রয়েছে কিংবা আমাদের আগমনের প্রতিক্ষা করছে। আলোর মাধ্যমে অভিবাদন জানানোর ব্যাপারটিও মানবজাতির প্রাচীন রীতি। তদ্রুপ কৃষ্ণের মন্দিরগুলোতে আরতির সময় বিগ্রহের উদ্দেশ্যে প্রদীপ নিবেদন করা হয়। ভক্তরা ভালোবাসার সহিত প্রদীপের আলো আরতির সময় নিবেদন করে। তদ্রুপ কৃষ্ণ আমাদেরকে তার আলোক দ্যুতির মাধ্যমে স্বাগত জানিয়ে তাঁর গৃহে আমন্ত্রণ জানান।
কৃষ্ণের এই আমন্ত্রণ আমাদের হৃদয়কে আলোকিত করে। প্রকৃত সত্য ও মোহ কি সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা প্রদান করে এবং এভাবে তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এরকম জ্ঞান অর্জনকে সম্বোধন করা হয় ‘আলোকিত জ্ঞান’ হিসেবে। সাধারণত, আমাদের অধিকাংশ জাগতিক জ্ঞান আসে দূরদর্শিতার মাধ্যমে, যার জন্য প্রয়োজন আলো। যখনই আমরা কোন আলো দর্শন করি, তখন আমাদের স্মরণে পড়ে কিভাবে কৃষ্ণ হল পারমার্থিক ও জাগতিক উভয় ক্ষেত্রের প্রতিটি স্তরের জ্ঞানের উৎস।
শাস্ত্রকে অনেক সময় সূর্যের আলোর সঙ্গে তুলনা করা হয়, যেটিকে মাঝে মাঝে কৃষ্ণের অস্ত্র সুদর্শনের সঙ্গে তুলনা করা হয়। সূর্যালোক বা সুদর্শন হল ভগবানের চোখ। আমাদের চোখে আলো প্রবেশ করলেই আমরা দেখতে পাই কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চোখ থেকে আলোক নিঃসৃত হয়। আমরা মাঝে মাঝে চোখের ইশারাতেও পরস্পরের সঙ্গ যোগাযোগ করে থাকি।
খাদ্য শৃঙ্খলের নিম্নভাগে হল বৃক্ষরাজি যারা সালোক সংশ্লেষনের মাধ্যমে আলোককে সুগার ও স্টার্চ এ পরিণত করে। এই প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত আলো হল আমাদের খাদ্য যা পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি জীবের শরীরকে পুষ্ঠি প্রদান করে। যে খাদ্য আমরা খেয়ে থাকি তা হল প্রকৃতপক্ষে সূর্যের শক্তি এবং সে শক্তিই প্রকৃতপক্ষে কৃষ্ণ, এ বিষয়টি যদি আমরা ধ্যান করি তখন আমরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে প্রতিটি কিছুর সম্পর্ক সম্বন্ধে অনুধাবন করতে পারব।
সূর্যের উত্তপ্ত আলো ছাড়াও, রয়েছে চন্দ্রের স্নিগ্ধ আলো, যা প্রতিদিনের কর্মের পর আমাদেরকে স্নিগ্ধতা ও সতেজতা প্রদান করে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আশ্রয় গ্রহণকে প্রশান্তি ও পরিত্রাণের জন্য চন্দ্রালোকের সুবিধা গ্রহণের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এমনকি চন্দ্র সাধারণ লোকদের রোমান্টিক ভালোবাসায় অনুপ্রাণিত করে, পক্ষান্তরে পারমার্থিক অনুশীলনকারী তা গোপীকাদের সাথে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুদ্ধ প্রেমের নৃত্যের ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেয়।

অগ্নি ও কৃষ্ণের সৌন্দর্য

কৃষ্ণ বলেছেন, তিনি হলেন আগুনের দ্যুতি। আগুন সুন্দর, পূর্ণরূপে রাজকীয়। কোন এক স্বচ্ছ দিবসে সরোবরের জলরাশির তরঙ্গে সূর্যের আলোর ঝলকানি, কোন এক হাঁড় কাপানো শীতল রাতে চারদিকে আগুন উৎসব, স্বর্গের উজ্জ্বল তারকারাজি, আলোকজ্বল ঝাড়বাতি, নিয়ন আলো, গঙ্গা নদীর জলরশির ওপর ভাসমান মাটির পাত্রে তুলার সলিতাতে ক্ষুদ্র আলোকদ্যুতি এ সব আগুন নিশ্চিতভাবেই চমৎকার । শুধু আগুনই সুন্দর নয়, বরং এ জগতের যে কোনো কিছুর সৌন্দর্যের অস্থিত্বের কারণ হল আগুনের আলোকের মাধ্যমে বস্তুর জ্যোতির্ময়তা। আলো ছাড়া সৌন্দর্যের কোন অর্থই নেই, কেননা এটিকে ধরে রাখার ক্ষমতা কারো নেই।
কৃষ্ণ আগুন গ্রাস করলেন তার নিত্য শাশ্বত জগতের প্রকৃতি ও কার্যকলাপ প্রদর্শনের জন্য কৃষ্ণ ৫০০০ বছর পূর্বে এ গ্রহে তাঁর দীপ্তিময় রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। শৈশবে তিনি দু’বার ভয়ংকর দাবানল গ্রাস করার মাধ্যমে তার সখা ও জীবজন্তুদের রক্ষা করেছিলেন। প্রথম লীলাতে কৃষ্ণ যখন যমুনার জল দূষণকারী বিষধর কালীয় নাগকে হত্যা করেন তখন অধিকাংশ বৃন্দাবনবাসী যমুনা নদীর নিকটে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সে সময় হঠাৎ আগুন লেগে যায় এবং সে আগুন প্রত্যেককে প্রায় দগ্ধীভূত করছিল। এমতাবস্থায় কৃষ্ণ সেই আগুন গ্রাস করে তাদেরকে রক্ষা করেন।
আরেকদিন কৃষ্ণ এবং গোপ সখারা গাভী, মহিষ ও ছাগলদের যমুনার তীরে একটি বিশাল বটবৃক্ষের কাছে চারণ করাচ্ছিল। ক্রীড়ারত অবস্থায় বালকরা লক্ষ্য করেনি যে, ঐ সমস্ত পশুরা রসালো ঘাস খাওয়ার জন্য অন্যদিকে গমন করেছেন। গোপবালকরা এই সমস্ত পশুদের আহার করা ঘাস ও পা দিয়ে মাড়ানো ঘাস অনুসরণ করতে করতে খোঁজ করছিল। এক সময় সেই সমস্ত পশুরা অনেক দূরে গমন করে একটি দাবানলের মুখোমুখি হয়ে পালানোর চেষ্টা করলে একটি আখক্ষেতে আটকা পড়ে। আখের দাড়ালো পত্র ও শক্ত কাণ্ড তাদেরকে আটকে রাখে এবং যার কারণে ভয়ে চিৎকার করতে থাকে । এদিকে কৃষ্ণ তখন নাম ধরে প্রত্যেক পশুকে ডাকছিলেন। গোপবালকরা অবশেষে সেই আখক্ষেতে পশুদের দেখতে পেয়ে তাদের উদ্ধার করে।
কিন্তু যখন তারা বটবৃক্ষের কাছে ফিরে যায় তখন তারা দেখে বাতাসে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে এবং তাদের চতুর্দিকে ছেয়ে গেছে। বালকরা তখন কৃষ্ণের শরণাপন্ন হয়। কৃষ্ণ তাদেরকে ভীত না হওয়ার জন্য বললেন এবং চোখ বন্ধ রাখার জন্য বললেন। তিনি আগুনের জন্য তৃষ্ণার্ত অনুভব করছিলেন (মাঝে মাঝে অনেক লোক যেমন ঝাল খাবার পছন্দ করে)। তাই তিনি সেই বৃহদাকার অগ্নি গলাধকরণ করেছিলেন। ধীরে ধীরে যখন গোপবালক ও পশুরা চোখ উন্মোচন করল তখন তারা দেখে আশ্চর্যান্বিত হয় যে শুধু আগুনই অদৃশ্য হয় নি বরং তারা বৃক্ষের নিকটে সেই শুরুর স্থানে অবস্থান করছেন। নদীর নিকটে থাকায় তারা সবাই কৃতজ্ঞ অনুভব করছিল। কেননা আগুনের উত্তাপের সন্নিকটে থাকার পর তারা এখন পূর্ণতৃপ্তি সহকারে যমুনার জল পান করতে পারবে।
আর একটি লীলায় বানাসুরের সাথে যুদ্ধে শিব জ্বরকে (অগ্নির প্রবল উত্তাপ জনিত) পরাস্ত করার জন্য কৃষ্ণ নারায়ণ জ্বর (প্রচণ্ড শীতল জনিত) ব্যবহার করেছিলেন। আবার কুরুক্ষেত্রে রণাঙ্গনে কৃষ্ণ যখন বিশ্বরূপ প্রদর্শন করেন তার মুখ থেকে অগ্নি বেরিয়ে আসছিল ।
আমার এই ধ্যানটির রচনা শেষ করতে না করতেই সূর্য উত্তর ক্যালিফোর্নিয়াতে অস্ত যাচ্ছিল। গৃহের কক্ষগুলিও সেসাথে অন্ধকারময় হয়ে উঠেছিল। যদিও সূর্যের আলো এখনো বৈদ্যুতিক আলোকে অতিক্রম করেছিল। আমার কম্পিউটারের মনিটর থেকেও আলো আমার মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ছিল এবং আমার শরীর উষ্ণ অনুভব করছিল। কেননা আমি যা খেয়েছিলাম সেখান থেকে উষ্ণতা নিসৃত হচ্ছিল। ভগবানের বেদীতে একটি মোমবাতি জ্বলছে এভাবে আমাদের চারপাশে কোনো না কোনোভাবে আগুনের রূপ রয়েছে। যখন আমরা তার অগ্নিশক্তির মাঝে কৃষ্ণকে খোঁজার প্রচেষ্টা করি তার মাধ্যমে আমরা তাকে উৎফুল্ল করি। কেননা এর মাধ্যমে আমরা তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করছি এবং এজন্য তিনিও অনেক ভাবে নিজেকে আমাদের কাছে প্রকাশ করেন। “হে পরমেশ্বর ভগবান, আপনি বায়ু, পৃথিবী, আগুন, আকাশ, জল, তন্মাত্র, প্রাণবায়ু, পঞ্চেন্দ্রিয়, মন, চেতনা এবং অহঙ্কার। বস্তুতপক্ষে, সূক্ষ্ম এবং স্থুল সব কিছুই আপনি। মন এবং বাক্যের দ্বারা প্রকাশিত কোনো বস্তুই আপনার থেকে ভিন্ন নয়।” (শ্রীমদ্ভাগবত-৭/৯/৪৮)

লেখক পরিচিতি : ড. এডিথ ই. বেস্ট (উর্মিলা দেবী দাসী) আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনা ইউনিভার্সিটি থেকে এডুকেশনাল লিডারশীপ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি শ্রীল প্রভুপাদের শিষ্যা। তিনি বর্তমানে আন্তর্জাতিক ব্যাক টু গডহেড ম্যাগাজিনের সহ সম্পাদক রূপে সেবা করছেন। এছাড়াও তিনি ইস্‌কন শিক্ষা বিভাগের উন্নয়নে নিরলস কাজ করে চলেছেন। অনন্ত বল্লভ দাস ও তার পরিবার ব্যাঙ্গালোরে, ইস্কন শ্রী জগন্নাথ মন্দিরের ভক্ত গোষ্ঠিদের সঙ্গে কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন করেন। উল্লেখ্য, তিনি Vaikuntha Choldren: a guide to Krishna Consious Education for Children গ্রন্থের লেখক।


 

জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৭ ব্যাক টু গডহেড
সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।