এই পোস্টটি 430 বার দেখা হয়েছে
শ্রীমৎ সুভগ স্বামী মহারাজ
শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ একদিন এক প্রশ্ন করেছিলেন ভারতের কোন এক প্রদেশের শিক্ষামন্ত্রীকে। দুর্ভাগ্যবশতঃ তার কাছ থেকে কোন উত্তর পাননি তিনি। তখন সাক্ষাৎকার প্রার্থী ঐ ব্যক্তির কাছে আত্মতত্ত্ব বিশ্লেষণ করছিলেন এইভাবে, শ্রীকৃষ্ণ আজ থেকে প্রায় ৫০০০ বছর আগে যে শিক্ষা অর্জুনকে দিয়েছিলেন, তা হচ্ছেÑ (গীতা ২/১৩) ‘দেহ’ ও ‘দেহী’-দুটি কথা আছে এখানে। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা, এই দেহকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। কিন্তু স্বরূপতঃ আমরা কি এই দেহ? ভগবান কৃষ্ণের শিক্ষা থেকে আমরা জানতে পারি যে, আমরা দেহ নই, দেহের ভেতরে যে আছে সে-ই হচ্ছি আমি, আমি হচ্ছি দেহী। দেহস্থিত সচেতন সত্তা। মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর প্রথমে আমার একটি শিশুর দেহ ছিল। সেই দেহটি এখন নেই, তা ধ্বংস হয়ে গেছে। তারপর আমার বালকের দেহ ছিল, তারপর আমি এক কিশোরের দেহ পেয়েছিলাম, সেই দেহটির বিনাশ হয়েছে। কিন্তু আমি তখনও ছিলাম, তারপর আমি যুবক দেহ পেলাম। বর্তমান যুগের চিকিৎসা বিজ্ঞান স্বীকার করে নিয়েছেন যে, প্রতিমুহূর্তে আমাদের দেহের কোষগুলি ধ্বংস হচ্ছে এবং আমরা নতুন দেহ পাচ্ছি। প্রতি সাত বছর পর আমাদের দেহের আমূল পরিবর্তন ঘটছে, তখন আমি এক সম্পূর্ণ নতুন দেহ লাভ করছি। কানাডার ‘মণ্ট্রিল গেজেট‘ নামে পত্রিকায় ‘আত্মা সম্বন্ধে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের জিজ্ঞাসা’ এই শিরোনামে সংবাদ বের হয়। এই প্রবন্ধে বিশ্ববিখ্যাত ডাক্তার উইল ফ্রেড.জি. বিগোলো সুশৃঙ্খলভাবে আত্মার স্বরূপ ও তার উৎস সম্বন্ধে গবেষণা করার জন্য অনুরোধ করেছেন বিজ্ঞানীদের কাছে। শ্রীল এ.সি. ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ তাকে এই বিষয়ে একটি চিঠি লেখেন এবং আত্মতত্ত্ব সম্পর্কে বৈদিক শাস্ত্রের অভ্রান্ত প্রমাণ দেন।
কার্যকর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই চিৎকণা আত্মাকে জানা যায়। এই চেতন কণাটি আমাদের দেহকে জীবন দান করে এবং বস্তুতঃ এই চিৎকণার অস্তিত্বের জন্য আবার আমরা অন্য দেহে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখি। এসব তথ্য তিনি বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর ঐ চিঠিতে। ড. বিগোলো টরেন্টো ছিলেন জেনারেল হাসপাতালের হৃদরোগের শল্যচিকিৎসা বিভাগের প্রধান। তিনি তার বহু অভিজ্ঞতা থেকে জানাচ্ছেন যে, কোন কোন ক্ষেত্রে রোগী এক জীবন্ত অবস্থা থেকে প্রাণহীন, নির্জীব অবস্থায় যাওয়ার সময় রোগীর মধ্যে এক রহস্যময় পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়। সেই দৃশ্যটির বিজ্ঞান-ভিত্তিক প্রমাণ খুবই কঠিন।সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় যে ঐ অবস্থায় রোগীর চোখে ঔজ্জ্বল্যের অভাব দেখা যায়। তার চোখের মধ্যে এক প্রাণহীনতার ভাব ফুঠে উঠে। দীঘ ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি নিশ্চিত যে ‘আত্মা’ বলে কিছু একটি দেহের মধ্যে রয়েছে। বহুকাল থেকেই পৃথিবীর বহু বিখ্যাত দার্শনিক, কবি, সাহিত্যিকেরা এই সচেতন সত্তার বা আত্মার অস্তিত্ব সম্বন্ধে তাদের বিশ্বাসের কথা জানিয়েছেন। যেমন: গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস ভবিষ্যতের জীবনের অস্তিত্ব সম্বন্ধে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাসের কথা ব্যক্ত করেছেন। দেহের বিনাশের পর চেতন সত্তা, আত্মা বিরাজিত থাকে বলে, তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এই প্রসঙ্গে তাঁর জীবনের একটি ঘটনা বিশষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তখনকার দিনে গ্রীকদেশে তাঁর দার্শনিক মতাবাদ জনমানসে বিশেষতঃ যুবসমাজে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। প্রাচীন পন্থী সমাজনেতাদের চক্রান্তে দেশের কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তাঁকে বিষপান করতে দেওয়া হয়। বিষপান করার আগে আত্মতত্ত্বে বিশ্বাসী দার্শনিক সক্রেটিস এইসব মূঢ় বিষদাতাদের বলেছিলেন ‘আগে আমি কে?’ তাকে ধরবার চেষ্টা কর।’ কিন্তু ঐ মূর্খরা তার কথার গূঢ় অর্থ বুঝতে পারে নি। তিনি আত্মার কথা বলেছিলেন। তিনি তো ‘দেহ’ নন, তিনি একটি চেতন সত্তা, একটি চিৎকণা জীবাত্ম-এসব তত্ত্ব মূর্খ লোকগুলো জানতো না। তাই দার্শনিক সক্রেটিসকে তারা বুঝতে অসমর্থ হয়ে পাগল ভেবেছিল।
শুধু সক্রেটিসই নয়, তলস্তয়, হারমন হেস, এমারসন্ আদি বিশ্বের অনেক দার্শনিক, কবি, বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক আত্মা ও তার কার্যাবলীতে দৃঢ় বিশ্বাস প্রকাশ করেছেন। আর বিশ্বের সবচেয়ে পুরানো শাস্ত্র গ্রন্থাবলী অর্থাৎ, বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, ‘অহম্ ব্রহ্মাস্মি‘ অর্থাৎ, ”আমি জড় দেহ নই, আমি ব্রহ্ম, আমি এক চেতন সত্ত্বা।” আত্মার কথা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বৈদিক শাস্ত্রে আত্মার অস্তিত্বের বিবরণ সবচেয়ে বিস্তৃতভাবে দেওয়া হয়েছে।
নিচের ছবিতে ক্লিক করে চৈতন্য সন্দেশ অনলাইন সম্মেলনের জন্য রেজিষ্ট্রেশন করুনঃ
স্মরণাতীত কাল থেকে ভারতে আত্মতত্ত্ব চর্চা চলে আসছে তাই ব্রহ্মসূত্র থেকে শুরু হয়েছে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা। সেখানে বলা হয়েছে ‘অথাতো ব্রহ্মজিজ্ঞাসা’। জড় জাগতিক বিচারে একজন বিরাট পণ্ডিত হলেও, তাঁর পূর্ব আশ্রমে বাংলার নবাবের মন্ত্রী শ্রীল সনাতন গোস্বামী মহাপ্রভুকে প্রশ্ন করেছিলেন, “কে আমি?” এটি যথার্থ বুদ্ধিমানের প্রশ্ন।
এই আত্মার বিষয়ে অনেকে যা বলে তা আশ্চর্যজনক; কিন্তু গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে ভগবান কৃষ্ণ আত্মা সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করেছেন, ‘দেহী নিত্যমবধ্যোহয়ম্‘, অর্থাৎ, এই দেহে বসবাসকারী বা দেহী নিত্য ও অবধ্য। এইভাবে আত্মার অবিনশ্বরতার কথা বলা হয়েছে। অন্যত্র বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে, আত্মা জ্ঞানময় ও আনন্দপূর্ণ। ভগবদ্গীতায় এই দেহকে একটি যন্ত্র বলা হয়েছে। জীব এই যন্ত্রে আরোহণ করে (যন্ত্ররূঢ়ানি) বহুকাল ভ্রমণ করে চলেছে ৮৪ লক্ষ রকম জীবদেহের মধ্যে দিয়ে। ৯ লক্ষ জল যোনি, ১১ লক্ষ ক্রিমি যোনি, ১০ লক্ষ পক্ষী যোনি, ২০ লক্ষ বৃক্ষ যোনি, ৩০ লক্ষ পশু যোনি এবং ৪ লক্ষ মনুষ্য যোনি আছে। এইসব তথ্য বৈদিক শাস্ত্রে রয়েছে। ভগবদ্গীতা জীবকে ভগবান কৃষ্ণ ‘সর্বগত‘ বলেছেন তাই সে ব্রহ্মলোক থেকে পাতাললোক পর্যন্ত বিভিন্ন জীবদেহ লাভ করে জন্ম-মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আবর্তিত হয়ে চলেছে।
শ্রীমদ্ভাগবতে ভগবান ব্যাসদেব বলেছেন, ‘লব্ধা সুদুর্লভং ইদং বহু সম্ভবন্তে’- বহু বহু জন্মের পর জীব এই অত্যন্ত দুর্লভ মনুষ্য জন্ম, মানবদেহ লাভ করে। মানবদেহ অনিশ্চিত (অধ্রুবম্) কিন্তু সেই সঙ্গে ‘অর্থদম্‘ এই মানবদেহেই একজন জীবনের অর্থ প্রাপ্তি হয়। তাই এই দেহের মূল্য অপরিসীম। কেননা, এই জীবনেই একজন তত্ত্ব জিজ্ঞাসু হতে পারে। উপযুক্ত সদ্গুরু, শুদ্ধবৈষ্ণবের কাছ থেকে শিক্ষা প্রাপ্ত হয়ে সে পরম-তত্ত্ব লাভ করতে পারে এবং ভগবদ্ধামে ফিরে যেতে পারে।
জীব জগতের বৈচিত্র্যের বিশেষ ব্যাখ্যা আমরা একমাত্র বৈদিক শাস্ত্রে সুন্দরভাবে দেখতে পাই। ‘কর্মণা দৈবনেত্রেন অন্তর্দেহোপপদ্যেতে‘- প্রত্যেক মানবের সমস্ত কর্ম দেবতারা দেখেন (কর্মণা দৈবনেত্রেন)। এখানকার সমস্ত বিচার করেন তাঁরা এবং মানবের কর্ম ও আসক্তি অনুযায়ী প্রকৃতি তাদের বিভিন্ন জীবদেহ দান করে। এমন একটি দেহ দেয় যা দ্বারা সে তার কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে পারে ও তার কর্মফল ভোগ করতে পারে। মনুষ্যেতর জীবকুল নিম্নযোনি থেকে উত্তরোত্তর উচ্চযোনি প্রাপ্ত হয়। কেননা; মানুষের মত তাদের চেতনা উন্নত স্তরের নয়, তাই তাদের কর্মফল নেই।
বৈদিক শাস্ত্রে জীবের বিভিন্ন জীবদেহ লাভের বা পুনর্জন্মের বহু উদাহরণ রয়েছে। রাজা নৃগ ব্রাহ্মণদের অসন্তোষের কারণ হওয়ায় পরবর্তী জন্মে গিরগিটি দেহ প্রাপ্ত হন, রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য অগস্ত্য মুনিকে অভ্যর্থনা করতে অবহেলা করায়, তাঁর অভিশাপে হস্তীদেহ লাভ করেন, রাজা ভরত একটি হরিণশাবকের প্রতি আসক্ত হওয়ার ফলে পরবর্তী জীবনে হরিণ দেহ প্রাপ্ত হন।
দেবরাজ ইন্দ্র দেবগুরু বৃহস্পতির নিকট অপরাধের ফলে শূকর দেহ প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং নারদ মুনির সঙ্গে দুর্ব্যবহারের জন্য নলকুবের ও মণিগ্রীব বৃক্ষযোনি প্রাপ্ত হন। এই রকম দেহান্তর প্রাপ্তির বহু বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় বৈদিক শাস্ত্রে। এক সময় স্বর্গের ধনভাণ্ডার রক্ষক কুবেরের দুই পুত্র- নলকুবের ও মণিগ্রীব, কৈলাসে মন্দাকিনীর জলে সুন্দরী অপ্সরাদের নিয়ে জলক্রীড়া উপভোগ করছিল। তারা স্বর্গীয় মদিরা পান করেছিল। তাই উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল। এই রকম অবস্থায় তাদের সামাজিক বিধিনিষেধ জ্ঞান ছিল না। তাই তারা ও অপ্সরারা বসনহীন অবস্থায় পরস্পর সঙ্গ উপভোগ করছিল। হঠাৎ নারদ মুনি সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। নারদ মুনিকে দেখে অপ্সরারা নিজ নিজ বসন পরেছিল, কিন্তু মদিরায় আচ্ছন্ন কুবেরের পুত্র দুটি মুনির প্রতি অসস্মান যাতে না হয় তা ভাবল তারা তাদের পোষাক-পরিচ্ছদ পরল না। তখন নারদ মুনি তাদের এই দুর্ব্যবহারে দুঃখিত হলেন। তাই তাদের দু’জনকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার জন্য বৃক্ষযোনি লাভ করবার অভিশাপ দিলেন। এইভাবে তারা দুটি অর্জুন বৃক্ষরূপে বহুকাল বৃন্দাবনে অবস্থান করেছিল। ভগবান কৃষ্ণ তাদের এই বৃক্ষযোনি থেকে উদ্ধার করেছিলেন।
আর একসময় মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন ভগবৎ চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন সেই সময় শিষ্যদের নিয়ে অগস্ত্য মুনি সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। মুনিকে সাদর অভ্যর্থনা না করায় তিনি ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর জড়তা লক্ষ্য করে অগস্ত্য মুনি মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্নকে হস্তীযোনি লাভের অভিশাপ দেন। ফলে ইন্দ্রদ্যুম্ন হস্তীদেহ লাভ করে ও পরবর্তীকালে ভগবান শ্রীবিষ্ণু হস্তীযোনি থেকে মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্নকে উদ্ধার করেন।
শ্রীমদ্ভাগবতে রাজা চিত্রকেতু ও তার সন্তানের কাহিনী থেকে আত্মার নিত্যতা ও পুনর্জন্মের বৈদিক ইতিহাসের বর্ণনা পাওয়া যায়। বহুকাল আগে চিত্রকেতু নামে এক রাজা ছিলেন। তার বহু সুন্দরী পত্নী ছিল। কিন্তু তারা সকলেই ছিল বন্ধ্যা। তাই রাজার কোন সন্তান ছিল না। তার মনে শান্তিও ছিল না। একদিন অঙ্গিরা ঋষি রাজার প্রাসাদে যান। রাজা সসম্মানে ঋষিকে গ্রহণ করেন। চিত্রকেতু পুত্রহীন, তাই বিশাল সাম্রাজ্য ও অতুল সম্পদের অধিকারী হলেও প্রকৃত সম্পদ সন্তান না থাকায় সে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিল। পুত্রলাভে সাহায্য করে প্রকৃত সুখী করবার জন্য রাজা অঙ্গিরা ঋষিকে অনুরোধ করলেন। ঋষি রাজার প্রতি সদয় হলেন ও তাঁকে দেবতাদের উদ্দেশ্যে এক বিশেষ যজ্ঞ করতে নির্দেশ দিলেন। যজ্ঞের অবশিষ্ট প্রসাদ প্রধানা মহিষী কৃতদ্যুতিকে দেওয়া হল। ঋষি বললেন, ‘মহারাজ, এই বার আপনি এক পুত্র লাভ করবেন, এই পুত্র আপনার আনন্দ ও দুঃখ উভয়ের কারণ হবে।’ রাজার কাছে কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই ঋষি অন্তর্হিত হলেন।
কালক্রমে রাণী কৃতদ্যুতি গর্ভবতী হলেন, তার এক পুত্র হল। রাজ্যের সকলেই আনন্দে উৎফুল্ল হল রাজা চিত্রকেতুর আনন্দের শেষ নেই পুত্রও মহারাণীর চোখের মণি হয়ে উঠল।
পুত্রবতী হওয়ায়, কৃতদ্যুতির প্রতি মহারাজ চিত্রকেতুর অনুরাগ দিন দিন বেড়েই চলল। এদিকে বন্ধ্যা হওয়ায়, অন্যান্য রাণীদের প্রতি মহারাজ উদাসীন হয়ে পড়ল। ফলে অন্য রাণীরা ক্রমে ক্রমে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল, পরে তারা ভীষণ ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে উঠল। কৃতদ্যুতির অনুপস্থিতিতে তারা সকলে পূর্ব পরিকল্পনা মত রাজপুত্রকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করে। পুত্রশোকে রাণী মূর্ছিত হয়ে পড়ল। রাজাও ক্রন্দন করে পাগলের মত হয়ে উঠল। রাজ্যের সকলেই যখন শোকাকুল, তখন বন্ধু নারদমুনিকে সঙ্গে নিয়ে অঙ্গিরা ঋষি রাজা চিত্রকেতুর কাছে গেলেন। ঋষি রাজাকে উপদেশ দিলেন, ‘মোহ ত্যাগ কর, তুমি তো অজ্ঞানের অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আছ, আত্মা কর্ম অনুযায়ী জীবদেহ লাভ করে, সমুদ্র-উপকূলের বালুকণা যেমন বায়ু তাড়িত হয়ে পরস্পর মিলিত হয়, আবার কখনো কখনো সেগুলি বিছিন্ন হয়ে যায়, বিভিন্ন জীবাত্মাও এইভাবে পরম্পর মিলিত হয় ও একদিন তাদের মধ্যে বিচ্ছেদও ঘটে। সেই রকম এই মৃত পুত্রের সঙ্গে তোমার দৈহিক সম্বন্ধও ক্ষনিক ও অনিত্য-
যদিও আমি তোমাকে প্রথমে দিব্য জ্ঞান দিতে এসেছিলাম, তোমার জড় অভিনিবেশ দেখে, তোমাকে এক পুত্র দান করেছি। এই পুত্র তোমার আনন্দ ও দুঃখের কারণ হয়েছে। এই স্ত্রী, পুত্র ও সম্পদ সবই স্বপ্নের মত- প্রায় অলীক। তোমার স্বরূপ কি? কোথা থেকে তুমি এলে? দেহাবসানে কোথায় তুমি যাবে? তুমি শোকাভিভূত হচ্ছ কেন? এই সব চিন্তা কর ও বুঝবার চেষ্টা কর।’ তখন নারদ মুনি যোগ বলে সকলের সামনেই মৃত রাজকুমারের আত্মাকে সেখানে আহ্বান করলেন। মৃত পুত্রটিকে তখন প্রাণবন্ত দেখা গেল। নারদ মুনি ঐ শিশুকে উদ্দেশ্য করে তত্ত্বকথা বললেন, ‘হে জীব, তোমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হোক, তোমার অকাল মৃত্যুতে স্বজনরা সকলেই শোকাকুল, তোমার অবশিষ্ট জীবনকাল এই দেহে প্রবেশ করে স্বজন-বন্ধুদের সান্নিধ্যে জীবন উপভোগ কর, পরে পিতৃদত্ত সিংহাসন ও রাজৈশ্বর্য ভোগ কর।’
তখন সেই শিশুদেহধারী জীব একজন মুক্তাত্মা জ্ঞানীর মত বলতে লাগল, ‘আমরা কর্মফল অনুযায়ী এক জীবদেহ ত্যাগ করে অন্য জীব দেহ গ্রহণ করি। এইভাবে কখনও দেবদেহ, কখনও ইতর পশু-দেহ, কখনও গুল্ম-লতা দেহ, কখনও বা মানব দেহ লাভ করি। কোনো জন্মে এরা দু’জন আমার পিতা-মাতা ছিলেন? আমি লক্ষ লক্ষ বার জন্মগ্রহণ করেছি। এদের দুজনকে কিভাবে আমি একা পিতামাতা রূপে গ্রহণ করি?’
এই সব কথা বলতে বলতে এক সময় শুদ্ধ আত্মা সেই দেহত্যাগ করল। তখন হতবাক্ চিত্রকেতু পুত্র-স্নেহ ত্যাগ করল, তার শোক, মোহ দূর হল। সে জন্মান্তর জ্ঞান লাভ করল এবং আত্মতত্ত্ব¡বিদ্ হল।
জন্মে জন্মে জীব বহু পিতা-মাতা লাভ করে, তারা সকলেই অনিত্য। নিত্যকালের নিত্য-পিতা, সদ্্গুরুর সন্ধান করা কর্তব্য। তাঁর চরণাশ্রয় করে, কৃষ্ণানুশীলন করে, জন্মান্তরের আবর্ত থেকে মুক্ত হয়ে ভগবদ্ধামে ফিরে যাওয়াই প্রত্যেক মানুষের একমাত্র কর্তব্য।
মাসিক চৈতন্য সন্দেশ, জানুয়ারি ২০২১ সংখ্যা