যৌতুক : আশীর্বাদ না অভিশাপ?

প্রকাশ: ৫ জুন ২০১৮ | ৫:১৪ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ৬ জুন ২০১৮ | ১:৩৩ অপরাহ্ণ

এই পোস্টটি 1503 বার দেখা হয়েছে

যৌতুক : আশীর্বাদ না অভিশাপ?

  শ্রীল প্রভুপাদের শিক্ষা, শ্রীমৎ গৌর গোবিন্দ স্বামী ও শ্রীমান চৈতন্য চরণ দাসের প্রবচন অবলম্বনে 

 

চৈতন্য চরণ দাস: বর্তমান যুগে যে যৌতুক প্রথা প্রচলিত সেটি বৈদিক প্রথার সম্পূর্ণ বিপরীত। বর্তমান যুগের যৌতুক প্রথা হল যেন বিবাহ পূর্ববর্তী একটি দাবি, যে দাবি মেটানো না হলে মাঝে মাঝে স্বামীর পরিবার স্ত্রীর উপর নির্যাতন চালায় এবং অনেক ক্ষেত্রে সেটি ভয়াবহ হয়ে উঠে।
তবে এ প্রকার যৌতুক প্রথা আইনগতভাবে অবৈধ যা শান্তিযোগ্য, নৈতিকভাবে যা অগ্রহনীয়। শাস্ত্রীয় পরিপ্রেক্ষিতেও এভাবে যৌতুক দাবি পূরণের মাধ্যমে বৈবাহিক জীবন অস্থায়ী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। নৈতিকভাবে বলতে গেলে কিভাবে স্বামী স্ত্রী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর শুধুমাত্র কিছু অর্থের জন্য স্ত্রীর প্রতি নির্যাতন চালাতে পারে?
বৈদিক পদ্ধতি অনুসারে, নারীরা পৈত্রিক সম্পত্তি লাভ করতে পারত না, কিন্তু কন্যারা কিছু দ্রব্য বা অর্থ লাভ করত যা তার মাতার কন্যার জন্য দান করতেন। তবে এ ক্ষেত্রে ঐ যৌতুকের প্রতি স্বামীর কোন অধিকার থাকত না। সেই যৌতুক কন্যার একান্ত নিজস্ব সম্পত্তি হিসেবে সংরক্ষিত হত। যদি কোন কারণে পরিবারে ভরনপোষনের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে স্বামীর অর্থের প্রয়োজন হত তবে সেক্ষেত্রে স্বামী তার স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে সে অর্থ নিতেন। পরিশেষে স্ত্রী সেই অর্থ তার কন্যাকে বিবাহের সময় দান করতেন। এভাবে নারীর জন্য অর্থনৈতিক নিরাপত্তার এই পদ্ধতির প্রবচন ছিল। এক্ষেত্রে পিতা-মাতারা যখন এই অর্থ দেয় সেটি স্বামীর পরিবার থেকে কোন জোড় যবরদস্তি করে না বরং কন্যার প্রতি স্বতস্ফূর্ত ভালোবাসা বা স্নেহের তাগিদে প্রদান করা হত। অতএব, ভক্ত হিসেবে বর্তমান যুগে যে যৌতুক প্রথা প্রচলিত রয়েছে সেটি মেনে নেওয়া উচিত নয়। যখন এই ধরনের বিষয় আলোচনায় উঠে আসে তখন আমাদের উচিত এই সম্পর্কে স্বচ্ছ উপলব্ধি অর্জন করে অপরকে তা প্রদান করা। বর্তমান যুগে মানুষ অন্যভাবে নিতান্তই তথাকথিত ভদ্রতার সহিত মেয়ের পরিবারকে জিজ্ঞেস করে “বিয়ের সময় আপনার মেয়েকে কি উপহার দিতে যাচ্ছেন?” কিন্তু এই ধরনে ভদ্রোচিত প্রশ্নের আড়ালে যে বাস্তবতা রয়েছে সেটি প্রকৃতপক্ষে যৌতুকের দাবিকে তুলে ধরে, যেটি অনেকটা নিলামের মত বলে মনে হয়।

                              বাধ্যবাধকতা নয়


বৈদিক যুগে যৌতুকের বাধ্যবাধকতা ছিল না। মহাভারতে আমরা দেখতে পাই যখন ভীষ্ম পরিবারের জ্যেষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে পাণ্ডুর ধৃতরাষ্ট্রের জন্য বিবাহের আয়োজন করছিলেন, তিনি রাজা শাল্বের কাছে যান এবং তার বোনের সঙ্গে পাণ্ডুর বিবাহের প্রস্তাব দেন। তখন শাল্ব বলেছিলেন আমাদের বংশের সংস্কৃতিতে একটি প্রথা প্রচলিত রয়েছে যে, বিবাহের সময় ছেলে পক্ষ মেয়ে পক্ষকে উপহার দেয়। এই পদ্ধতিটি বৈদিক পদ্ধতি ও বর্তমান প্রচলিত যৌতুক প্রথার বিপরীত। তখন পিতামহ ভীষ্ম বললেন, “হ্যাঁ আমি জানি আপনাদের ঐতিহ্য এরকমই এবং আমি সেই ঐতিহ্যকে সম্মান করি।” এজন্যে ভীষ্ম শাল্বের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন, তবে সেটি কোন ব্যবসায়ীক লেনদেনের মত নয় যে, কিছু স্বর্ণ ক্রয় করার পর আর্থিক লেনদেন হচ্ছে। বরং এর সবটুকুই হল সেই নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। এই প্রকার পদ্ধতি বা ঐতিহ্য অনেক দেশেই প্রচলিত রয়েছে। আমেরিকা ও আফ্রিকান সংস্কৃতিতে এটিকে বলা হয় ব্রাইড প্রাইস্ বা কনের পণ। অর্থাৎ, কন্যাকে ক্রয় করা নয়। এভাবে এর মাধ্যমে পুরুষ বা নারী কাউকে কোন পণ্যে পরিণত করা এই প্রথাগুলোর উদ্দেশ্য নয়, যেটি যৌতুকের দাবির ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। যখন অত্যধিক জড়বাদ বা বিষয়াসক্তি হৃদয়ে বিরাজ করে তখন এই ধরনের কন্যার পণ প্রদান পদ্ধতি একজন নারীকে পণ্য বা মুদ্রারূপে প্রচলন করে (Monetize), অর্থাৎ “ঠিক আছে এই ব্যক্তি যথেষ্ট শিক্ষিত, ভাল উপার্জন করে। এই ছেলেটিই হবে সবচেয়ে নিরাপদ। এজেন্যে তাকেই বিয়ে কর এবং এর জন্যে যথেষ্ট অর্থও ছেলের উদ্দেশ্যে প্রদান করা হবে।” এই প্রকার মুদ্রারূপে প্রচলন পদ্ধতি ও জড়বাদ সম্পূর্ণরূপে পারমার্থিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এবং আমাদের এটি ভাবা উচিত নয় যে, যৌতুক প্রথা বৈদিক সংস্কৃতির একটি অপরিহার্য অংশ। অতএব, বৈদিক শাস্ত্রানুসারে এটি উল্লেখ্য যে, যৌতুক দিতে ও নিতে হবে। পক্ষান্তরে এই সিদ্ধান্তটি নির্ভর করে ব্যক্তিগত যেটি স্থান, কাল ও পাত্র অনুসারে ঘটে থাকে। এই প্রথা সরাসরিভাবে এমনকি কৃষ্ণ ভক্তির সঙ্গেও সম্পর্কিত নয়। এ বিষয়ে শ্রীল প্রভুপাদ ব্যাখ্যা করেছেন, যৌতুক হল স্নেহের বহিঃপ্রকাশ মাত্র কিন্তু ভক্তদের বিবাহের ক্ষেত্রে বিবাহসহ সমস্ত সম্পর্ক পারমার্তিক সম্পর্কের সাথে জড়িত। তাই এই প্রকার যৌতুক কি অত্যধিক জড়বাদ বা পণ্যরূপে পরিগণিত হচ্ছে কিনা সেটি পরীক্ষা করতে হবে এবং সে অনুসারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভক্তদের যৌতুক দেওয়া ও নেওয়া নির্ভর করে স্থান, কাল ও পাত্র অনুসারে। কারোরই উচিত নয় বর্তমান বিকৃত যৌতুকপ্রথাকে সমর্থন করা, যেখানে বিবাহ কেবল মাত্র এক ধরনের নিলাম মাত্র এক ধরনের নিলাম মাত্র। তবে এক্ষেত্রে আবার সামগ্রিকভাবে বৈদিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে হওয়াও উচিত নয় এক্ষেত্রে আমাদের সমস্ত সম্পর্কগুলোর কেন্দ্র হওয়া উচিত পারমার্থিকতা। (সংকলিত)

                                অন্তত ফুল ও ফল প্রদান


শ্রীল প্রভুপাদের শ্রীমদ্ভাগবতের ৩/২২/২৩নং শ্লোকের তাৎপর্যে উল্লেখ করেছেন, “যৌতুক সহ কন্যাদের সম্প্রদান করার প্রথা আজও ভারতবর্ষে প্রচলিত আছে। উপহার সমূহ দেওয়া হয় কন্যার পিতার অবস্থা অনুসারে। পারিবর্হান্ মহাধনান্ মানে হচ্ছে বিবাহের সময় বরকে যৌতুক দান করা অবশ্য কতব্য। এখানে মহাধনান্ শব্দটির অর্থ হচ্ছে সম্রাজ্ঞীর যৌতুকের উপযুক্ত মহা মূল্যবান উপহার সমূহ। এখানে ভূষাবাসঃ পরিচ্ছদান্  শব্দগুলির প্রয়োগ হয়েছে। ভূষা  মানে ‘অলঙ্কার, বাসঃ মানে ‘বসন’ এবং পরিচ্ছদান্ মানে ‘গৃহের বিধিধ উপকরণ’। সম্রাটের কন্যার বিবাহের উপযুক্ত সবকিছু কর্দম মুনিকে দান করা হয়েছিল, যিনি তখনও পর্যন্ত ব্রতধারী ব্রহ্মচারী ছিলেন। কন্যা দেবহূতি অত্যন্ত মূল্যবান অলঙ্কার এবং বেশভূষায় সজ্জিতা ছিলেন। এইভাবে পূর্ণ ঐশ্বর্য সহকারে গুণান্বিতা পত্নীর সঙ্গে কর্দম মনির বিবাহ হয়েছিল এবং গৃহস্থালির সমস্ত আবশ্যকীয় উপকরণগুলি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। বৈদিক প্রথায় কন্যার পিতা জামাতাকে আজও এইভাবে যৌতুক-স্বরূপ শত-সহস্র টাকা ব্যয় করে। যৌতুক দেওয়ার প্রথা অবৈধ নয়, যা অনেক প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে। যৌতুক হচ্ছে পিতার সদিচ্ছার প্রতীক-স্বরূপ কন্যাকে প্রদত্ত দান, যা অনিবার্য। পিতা যদি যৌতুক দানে সম্পূর্ণ অক্ষমও হয়, তা হলেও অন্তত কিছু ফল এবং ফুল দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। ভগবদ্‌গীতায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, ফল এবং ফুল দান করলে ভগবানও প্রসন্ন হন। আর্থিক অক্ষমতার জন্য যৌতুক না দিতে পাললে, অন্য কোন উপায়ে যৌতুক সংগ্রহ করার প্রশ্ন উঠে না, তখন জামাতার প্রসন্নতার জন্য তাঁকে ফল এবং ফুল দেওয়া যেতে পারে।”

                                                      স্ত্রী ধন


শ্রীল প্রভুপাদ কথোপকথন, প্রাতঃ ভ্রমণ, ৩০ এপ্রিল,১৯৭৩ লস্এঞ্জেলস্‌

প্রভুপাদ:… স্ত্রী-ধন। স্বামী সেটি স্পর্শ করবে না। যদি করে সেটি অপরাধ। এক্ষেত্রে বিবাহের সময় যখন স্ত্রীকে স্বর্ণালঙ্কার দেওয়া হয় সেটি স্ত্রী চাইলে অর্থে রূপান্তর করতে পারে। মাঝে মাঝে এজন্যে স্বামীর সাথে মতবিরোধ হতে পারে। যাহোক সে কিছু জিনিস সঞ্চয়ের জন্য পায়। পিতা কল্যাকে কিছু অলঙ্কার দেয়। শ্বশুর ও আত্মীয় স্বজনরাও তাকে বিবাহের সময় কিছু স্বর্ণালঙ্কার উপহার হিসেবে দিয়ে থাকে। যদি এভাবে সে শত তোলা স্বর্ণ পায় তার মূল্য অন্তত পাঁচশ…?
করন্ধর: প্রায় পাঁচ হাজার ডলার প্রভুপাদ ।
প্রভুপাদ: এভাবে সে কিছু সম্পদ লাভ করে। এটিকেই বলা হয় “স্ত্রী-ধন”। স্ত্রী ধন মানে হল “নারীর সম্পত্তি”। সে সম্পত্তি কেউ স্পর্শ করে না। মনুসংহিতার আইন অনুসারে এই ‘স্ত্রী ধন’ প্রথা প্রচলিত…। বর্তমানে অনেকে সে প্রথা পরিবর্তন করছে। এই স্ত্রী ধন পুত্র বা স্বামী কেউই স্পর্শ করতে পারে না। কেউই না। কিন্তু তার মৃত্যুর পর কন্যারা সেই অর্থ ব্যবহার করতে পারে। কারণ তখনকার দিনে কন্যারা পিতার সম্পত্তি ভাগ পেত না। শুধুমাত্র বিবাহের সময় পিতা কর্তক প্রদত্ত যৌতুকই পেত। একটুকুই কিন্তু কন্যা পিতার সম্পত্তির দাবিদার হতে পারত না। অতএব, বিবাহের সময় যৌতুক হিসেে স্বর্ণালঙ্কার, বস্ত্রাদিপ্রদান করা হত। যদি কেউ ধনী হত তখন তিনি শত শত বেনারসি শাড়ি প্রদান করত। নারীদের প্রকৃতিই হল যদি সে ভাল স্বর্ণালঙ্কার, শাড়ি, ভালো খাবার পায় তবে সে সন্তুষ্ট হয়। এর বাইরে সে অন্যকিছু চায় না। এভাবে সে তার স্বামীর প্রতি কখনো বিশ্বাসহীন হয় না। এখনকার যুগে এই সমস্ত বিষয়গুলো বিলুপ্ত হচ্ছে।

মনুসংহিতা ৩/৫২
স্ত্রীধনানি তু যে মোহাদ ভুপজীবন্তি বান্ধবাঃ।
নারীযাননি বস্ত্রং বা তা পাপা যান্ত্যধোগতিম্॥
অনুবাদ: কণ্যার পিতা, ভ্রাতা, পতি প্রভৃতি আত্মীয়-স্বজন মোহবশতঃ (বা অজ্ঞতাবশতঃ ) স্ত্রীধন (কন্যাদানা করার সময় প্রদত্ত ‘বর’ দ্রব্য; যথা, সোনা, রূপা প্রভৃতি), স্ত্রীযান (অর্থাৎ অশ্ব, রথ প্রভৃতি স্ত্রীলোকের গমনোপরণ). এবং স্ত্রীলোকের বস্ত্রীদি উপভোগ করে, সেই পাপাচরণকারী আত্মীয়গণ-(শাস্ত্রনিষিদ্ধ কাজ করে ব’বে অধোগতি লাভ করে।

                        যৌতুকের দাবিতে অত্যাচার

শ্রীমৎ গৌরগোবিন্দ স্বামীর সাধুসঙ্গ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত:
যৌতুক দাবী করা হচ্ছে এবং যৌতুক ধন নিয়ে পারিবারিক অশান্তি, সেজন্য মহিলাদের আত্মহত্যা তথা মেয়েদের উপর অত্যাচার হচ্ছে কেন? তার প্রকৃত কারণ যদি আমরা নির্ণয় করতে পারি এবং তা দূর করার জন্য আমরা যদি প্রকৃত ব্যবস্থা করতে পারি, তাহলে সমস্যার সমাধান হতে পারে। চিন্তাশীল ব্যক্তি যদি তা’র কারণ নির্ণয়ের জন্য চিন্তা করেন, তাহলে এক সুস্পষ্ট কারণ দেখতে পাবেন। তা হচ্ছে উপভোগের কামনা। পুরুষ স্ত্রীকে তার নিজের উপভোগের সামগ্রী বলে মনে করে। পুরুষ বিয়ে করে পত্নী গ্রহণ করছে কেন? কি উদ্দেশ্যে? তা এক সাধারণ কথা এই যে, স্ত্রী জিহ্বা এবং উপস্থ ইন্দ্রিয়দ্বয়কে আনন্দ প্রদান করবে। স্ত্রী অতি সুন্দর খাদ্য খেতে দেবে, কাছে বসে সুমিষ্ট আলাপ করবে এবং রাত্রে উপস্থ ইন্দ্রিয় বা জননেন্দ্রিয়কে আনন্দ প্রদান করবে। জিহ্বা এবং উপস্থ ইন্দ্রিয়ের সুখটাকে সবাই বহুমানন করে এবং তা সমস্ত প্রকার সুখের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সুখ বলে এ সংসারে বিবেচিত হয়। এ সংসারে প্রায় প্রত্যেক পুরুষ স্ত্রীর কাছ থেকে কিভাবে অধিক থেকে অধিকতর সুখ লাভ করতে পারবে, সেই কামনা পোষণ করে থাকে। এইজন্য যৌতুক ধনের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। সাধারণঃ যে কন্যা দান করে , কন্যার পিতা কিছু যৌতুক দেয়। তা অবিস্মরণীয় কাল হতে প্রচলিত আছে। শ্রীমদ্ভাগবতে (১০/১/৩১-৩২) বর্ণিত আছে যে, “দেবকীর পিতা দেবক তাঁর কন্যাকে অত্যন্ত ভাল ভালবাসতেন। তিনি জামাতা ও কন্যার গৃহগমনকালে কন্যাকে সুবর্ণমালায় বিভূষিত চারিশত হস্তী, দশসহস্র অশ্ব, অষ্টাদশ মত রথ এবং সেই সাথে বিবিধ অলঙ্কারে সমলঙ্কৃত দুইশত নবযৌবনা দাসী যৌতুক সরূপ প্রদান করেছিলেন।”(দেবকী ও বসুদেবের বিবাহ প্রসঙ্গে)
দেবকীর পিতা দেবক তাঁর কন্যা দেবকীকে বসুদেবের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার সময় যৌতুক প্রদান করেছিলেন। তাই এই যৌতুক প্রদানের বিধি এক অবিস্মরণীয় কাল থেকে প্রচলিত আছে। বৈদিক শাস্ত্রে যেহেতু এটির বর্ণনা আছে, তাই এটি বেদ-বিধি। কিন্তু একটি কথা, তা হচ্ছে যৌতুক দাবী করা যায় না। কন্যার পিতা স্বেচ্ছাক্রমে তা প্রদান করে। তা হচ্ছে সন্তান-বাৎসল্যের নিদর্শন। কিন্তু আজকাল যে যৌতুক দাবী করা হচ্ছে এবং তাই নিয়ে কন্যার উপর যে অত্যাচার করা হচ্ছে তা নিন্দনীয়। স্ত্রীর প্রতি পুরুষের আকর্ষণ এবং পুরুষের প্রতি স্ত্রীর আকর্ষণ স্বাভাবিক। জীব মাত্রেই তা রয়েছে । কিন্তু জীব যখন মানব যোনি লাভ করে, তখন সে উন্নত চেতনার স্তরে আসে। সেজন্য মানব জন্মটা সুদুর্লভ জন্ম বলে অভিহিত করা হয়েছে। স্ত্রী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ এক স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। কেবলমাত্র মানব জন্মেই প্রবৃত্তি থেকে নিবৃত্তি মার্গে অবলম্বন করার জন্য নির্দেশ বেদেতে দেওয়া হয়েছে। মনু বলেছেন ‘‘প্রবৃত্তিরেষা ভূতানাং নিবৃত্তিস্তু মহাফলা ।” অর্থাৎ“প্রাণীদের এরকম প্রবৃত্তি হলেও নিবৃত্তি মার্গই মহাফলদায়ক।” এজন্য বেদে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বিবাহ দ্বারা স্ত্রী-সঙ্গ । ইতর প্রাণীদের মধ্যে বিবাহ সম্পর্ক নেই ; কিন্তু মানুষেদের মধ্যে আছে। কেন আছে? কারণ মানুষই প্রবৃত্তি মার্গ থেকে নিবৃত্তি মার্গে আসবে। তাই বিধান দেওয়া হয়েছে “এবং ব্যবায়ঃ প্রজায়ানরত্যৈ” অর্থাৎ “উপযুক্ত সন্তান উৎপাদনের জন্য বিবাহের ব্যবস্থা, মৈথুন-সুখ বা ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য নয়।”

যৌতুকের দাবিতে অত্যাচার কিভাবে দূর হবে?


পুরুষ স্ত্রীর প্রতি উপভোগ কামনা পোষণ করা ও স্ত্রী পুরুষের প্রতি উপভোগ কামনা পোষণ করা নিন্দনীয় কথা; কারণ কেউ উপভোগকারী নন্। একমাত্র উপভোগকারী হচ্ছেন কৃষ্ণ, তাই গীতায় কৃষ্ণ বলেছেন “অহংহি সর্বযজ্ঞানাং ভোক্তা” তাই গীতায় (৯/২০) অর্থাৎ কৃষ্ণই হচ্ছেন একমাত্র উপভোগকারী। স্ত্রী উপভোগকারী নয় কি পুরুষ উপভোগকারী নয়। উপভোগ কামনা দূর হবে কেবল কৃষ্ণচেতনা লাভের দ্বারা। তাই উপভোগের কামনা যে-পর্যন্ত দূর না হচ্ছে, সে পর্যন্ত যৌতুক দাবীকারী ব্যক্তি যৌতুক নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। যৌতুক না নেওয়ার ফলে শপথ করেও প্রকারান্তরে যৌতুকের বদলে চাকরিজীবি স্ত্রী অন্বেষণই হচ্ছে আর এক রকম উপভোগের কামনা। যার ফলে পুরুষ স্ত্রীর কাছ থেকে এক রকম রীতিমত আয়ের আশা করে। যখন তার কামনার বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখন স্ত্রীর ওপর অত্যাচার শুরু হয় । তাই এই উপভোগের কামনা বা প্রবৃত্তির জন্যই উক্ত ধরণের বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে। তাই পুরুষ ও স্ত্রীর একথা ভালোভাবে জেনে রাখা উচিত যে, কৃষ্ণ হচ্ছেন একমাত্র উপভোগকারী, আর কেউ উপভোগকারী নয়। পুরুষ কৃষ্ণদাস ও স্ত্রী কৃষ্ণদাসী। কৃষ্ণের উপভোগ ও পীতি বিধানের জন্য আমরা পুরুষ ও স্ত্রী পতি-পত্নী সম্বন্ধে সম্বন্ধীত হয়েছি। কৃষ্ণ সম্বন্ধে যদি আমরা সন্বন্ধীত না হই তাহলে সে-সম্বন্ধে নিশ্চয় দুঃখের কারণ হবে। পতি-পত্নীর সম্বন্ধের মধ্যে প্রেম বা প্রীতি থাকা আবশ্যক এবং সেটা অবশ্যই বিশুদ্ধ প্রেম বা প্রীতি হওয়া উচিত। কৃষ্ণ প্রেমের ওপর আধারিত হলে পতি-পত্নীর প্রেম বা প্রীতি বিশুদ্ধ হবে। প্রীতির প্রকৃত পাত্র হচ্ছেন কৃষ্ণ। তাই প্রীতির প্রকৃত পাত্রে যদি প্রীতি হয় তাহলে সব ঠিক হবে। তা না হয়ে দেহ সুখ বা ইন্দ্রিয় সুখের উপর প্রীতি যদি আধারিত হয়, তাহলে তা নিশ্চিতভাবে দুঃখ- জনক বা দুখের উৎপাদক হবে। তাই যৌতুক নিরোধ করে বিবাহ করে দিলে যে দাম্প্যত্য জীবন বা পারিবারিক জীবন সুখময় হবে,তা কল্পনা করা তোমাদের ভ্রম। পতির পত্নীর প্রতি আদর, পত্নীর পতির প্রতি আদর, স্নেহে বা প্রীতি যদি কৃষ্ণ ও কৃষ্ণভক্তের প্রতি প্রীতি বৃদ্ধি না করে, তাহলে তা নিশ্চিতভাবে দুঃখপ্রদ হবে। তাই বলা যেতে পারে, পতির পত্নীর প্রতি আদর খারাপ নয়, যদি তা কৃষ্ণপ্রীতির উপর আধারিত হয়। সেই আদরের নিন্দা নেই, যদি তা কৃষ্ণপ্রীতির উপর আধারিত হয়। সেই আদরের নিন্দা নেই, যদি তা অপরকে কৃষ্ণের প্রতি বা কৃষ্ণভক্তের প্রতি আদরের চেষ্টায় থাকে। সেজন্য শ্রীমদ্‌ভাগবতাদি বৈদিক শাস্ত্রগুলিতে গৃহস্থাশ্রম সম্বন্ধে বহু কথা সব বলা হয়েছে কিভাবে গৃহস্থ জীবন সফলময়, আনন্দময় ও বিশুদ্ধ প্রীতিময় হবে। স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের পক্ষে গৃহাসক্তি নিন্দনীয়। কৃষ্ণাসক্তিই জীবমাত্রেরই ধর্ম। যদি কোন স্ত্রী মনে করে, আমার স্বামী কত সুন্দর এবং স্বামীর শরীর উপভোগ করে আমি আনন্দ পাবো, তাহলে সেই স্ত্রী বিমূঢ়া। ভগবানের পাদপদ্মের মকরন্দ পান না করে যে সুখ পেতেচায়, সে মূর্খ। তাই ভাগবতে (১০/৬০/৪৫) উল্লেখ আছে-

ত্বক্‌শ্মশ্রুরোমনখকেশপিনদ্বমন্ত-
মাংসাস্থিরক্তকৃমিবিট্‌কফপিত্তবাতম্‌। 
জীবচ্ছবং ভজতি কান্তমতির্বিমূঢ়া
যা তে পদাব্জমকরন্দমজিঘ্রতী স্ত্রী॥
অর্থাৎ “যে বিমূঢ়া স্ত্রীলোক কখনই আপনার (ভগবানের) পাদপদ্মের মকরন্দ আঘ্রাণ করেনি, সেই রমণীই উপরে চর্ম, শ্মশ্রু, রোম, নখ ও কেশাচ্ছন্ন, এবং অভ্যন্তরে মাংস, অস্থি, রক্ত, কৃমি, বিষ্ঠা, কফ, পিত্ত ও বায়ু পরিপূরিত জীবিত শবতুল্য শরীরধারী পুরুষাধমকে , এই অমার স্বামী এরূপ জ্ঞানে সেবা করে থাকে।” সে মূর্খ রমণী। ঠিক অনুরূপ যে পুরুষ তার স্ত্রীকে সেরকম মনে করে, সেও মূর্খ পুরুষ। রক্ত মাংসের শরীরের প্রতি যে পুরুষ বা যে স্ত্রীলোকের প্রীতি থাকে তা দুঃখদায়ক। তাই বৈদিক বিবাহ বিধির উদ্দেশ্য হচ্ছে কৃষ্ণভক্ত পুত্র উৎপাদন করা বা কৃষ্ণ প্রীতি বিধান করা। জননেন্দ্রিয় সুখ বিধানের জন্য নয়। তাই যৌতুক না নেওয়ার শপথ করে বিবাহ করলে যে সব ঠিক হয়ে যাবে তা নয়। শরীর প্রীতি ত্যাগ করে কৃষ্ণ প্রীতিতে সম্বন্ধীত হলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তাহলে এই অত্যাচার ও দুঃখ দূর হবে। অবৈধ স্ত্রীসঙ্গই হচ্ছে শাস্ত্র নিষিদ্ধ ও পাপ। এটির তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, বিবাহিত পুরুষ বা স্ত্রীর মধ্যে যদি অধিক শারীরিক আসক্তি থাকে, তাহলে তাও পাপ বলে শাস্ত্রে পরিগণিত হয়েছে। হরে কৃষ্ণ!

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।