ধূমপানের মর্মান্তিক ফাঁদ

প্রকাশ: ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | ৫:৩৮ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ২১ মে ২০১৯ | ৫:১৬ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 1274 বার দেখা হয়েছে

ধূমপানের মর্মান্তিক ফাঁদ

 

চৈতন্য চরণ দাস:  বড়শিতে কিছু পোকা মাকড় রেখে পুকুর, খালে, বিলে ছুড়ে ফেললে মাছেরা প্রলুব্ধ হয়, ইঁদুরের ফাঁদে পনির রাখার মাধ্যমে ইঁদুর প্রলুব্ধ হয় ঠিক সেরকম জীব প্রায়ই তার ভোগ বাসনার প্রভাবে প্রলুব্ধ হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে মাছ এবং ইঁদুরের অজুহাত রয়েছে যে, বড়শি ও পনির দেখতে মনে হয় যেন খাদ্যূ রয়েছে। এমনকি মাছ ও ইঁদুর জানেই না সেখানে ফাঁদ রয়েছে। মানুষের ক্ষেত্রে কোনো অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়। তারা যেভাবে প্রলুব্ধ হয় তা ভয়ঙ্কর জেনেই প্রলুব্ধ হয়। উদাহরণ স্বরূপ কেউ বেঁচে থাকার জন্য ধূমপান করে না এবং সব ধূমপায়ী এর ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত।
আ্যালকোহল ও অন্যান্য ক্ষতিকর কার্যকলাপ ওু আত্মহত্যা হল সমান ভীতিপ্রদ। অনেক লোকই তাদের আত্ম-ধ্বংসাত্মক মূলক আচার-আচরণের শিকার। ক্রোধ ও আবঞ্চিত শব্দের মাধ্যমে মানুষের হৃদয় ভেঙে যাওয়া ছাড়াও আরও কত কিছু ঘটছে।
এক্ষেত্রে একটি স্বাভাবিক প্রশ্নের অবতারণা ঘটে: কিবাবে মানুষের মত একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি এমন ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে? অধিকাংশ লোকই জানে যে, ধূমপান মানে বিপদ, কিন্তু মিডিয়া, বন্ধুচক্র ও ব্যবসায়ীরা তাদের প্ররোচনা করে যাতে একবারের জন্য হলেও তারা যেন এর অভিজ্ঞতা লাভ করে। বিকৃত আনন্দের একঘেঁয়েমী দৈনন্দিন জীবন থেকে একটু অবসর পাওয়ার জন্য তারা তখন এটি মেনে নেয় এবং অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। আর তখন হঠাৎ আনন্দের যে প্রভাব তা তার মনে বদ্ধ হয়ে পড়ে এবং ভবিষ্যতে যখনই সে কঠিন কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় তখন সে পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পেতে ধূমপানকে বেছে নেয়। এরপর ধূমপানের প্রত্যেক সফল অভিজ্ঞতা সেই ব্যক্তিকে দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত করে এবং বুদ্ধিমত্তা ও বিবেককে দুর্বল করে দেয়। এভাবে ধূমপান হয়ে উঠে একটি অপ্রতিরোধ্য চাহিদা, একটি অত্যাবশ্যক প্রয়োজন, একটি নেশা। ধূমপায়ীরা এভাবে অসহায় শিকারে পতিত হয় এবং কঠিন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রানের জন্য পুনঃ পুনঃ এটি গ্রহণ করে।

সাম্প্রতিক সমাধান: নেশা থেকে পরিত্রানের জন্য কিছু পদ্ধতি এখানে প্রদত্ত হল:
১. জ্ঞান: যদি বিপদ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে লোকেরা যথাযথভাবে অবগত হয়, তবে সেটি কি নেশা থেকে তাদের দূরে রাখবে না? মাঝে মাঝে হয়ত তাদের দূরে রাখে কিন্তু সবসময় নয়।
সিগারেট বিক্রি হ্রাস না পেয়ে বরং আরো বেড়েছে। ঐ সতর্কবার্তা বরং ধূমপায়ীদেরকে একটি ডানপিটে (যিনি বিপদকে উপভোগ করেন) মনোভাবের দিকে প্ররোচিত করে।
২. আবেগময় সহায়তা: কিছু কিছু লোক আছে যারা তাদের ভালোবাসার মানুষ কর্তৃক প্রতারিত বা হতাশ হয় তখন তারা প্রায়ই নেশার দিকে ঝুঁকে পড়ে। বিশেষত আবেগগতভাবে অবহেলিত কিশোররা নেশার দিকে ঝুঁকে পড়ে। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে আবেগময় সহায়তা প্রদান একটি কার্যকরী সমাধান হতে পারে কিন্তু পেশাধারী কাউন্সিলিং আবার প্রায়ই সেই কাউন্সিলরের ওপর দীর্ঘস্থায়ী নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে আবার, পেশাধারী কাউন্সিলর পাওয়ার বিষয়টিও বেশ ব্যয়বহুল হয়। এক্ষেত্রে বিকল্পস্বরূপ বন্ধ-পরিজন কাউন্সিলিং এর কাজটি করতে পারলেও ব্যস্ত আধুনিক জীবন-ধারায় কজনইবা সময় ও শক্তি ব্যয় করতে চায়।

৩. প্রতিস্থাপন পক্রিয়া: প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া বলতে একটির পরিবর্তে অন্য আরেকটি সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম বিষয়কে প্রতিস্থাপন করা। উদাহরণস্বরূপ একজন নেশাসক্ত ব্যক্তি অ্যালকোহল বা মদ্য পানের পরিবর্তে গান-বাজনার আশ্রয় অনুসন্ধানের চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু এটি সম্ভব তখনই যখন গান-বাজনার প্রতি তার দৃঢ় প্রত্যয় সৃষ্টি হয় এবং সেসাথে নেশার চেয়েও এটি উপভোগ্য হয়।
এবার দেখা যাক বৈদিক প্রেক্ষাপট থেকে এই সমস্যাটির সমাধান কিভাবে প্রদান করা হয়েছে।

বৈদিক প্রেক্ষাপট
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (৩/৩৬) অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে প্রশ্ন করেন, “মানুষ কার দ্বারা চালিত হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেন বলপূর্বক নিয়োজিত হয়েই পাপাচরণে প্রবৃত্ত হয়?” তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ (৩/৩৭) উত্তর দিলেন, “হে অর্জুন! রজোগুণ থেকে সমুদ্ভূত কামই মানুষকে এই পাপে প্রবৃত্ত করে এবং এই কামই ক্রোধে পরিণত হয়। কাম সর্বগ্রাসী ও পাপাত্মক; কামকেই জীবের প্রধান শক্র বলে জানবে।”
এই কথোপকথনটি হল সমগ্র ভগবদ্গীতার মৌলিক শিক্ষা। জড় শরীরে জীবনী উৎস্য হল চিন্ময়। যেটি আত্মা নামে পরিচিত। আত্মার আবশ্যকীয় চাহিদা হল ভালোবাস আদান-প্রদান করা এবং এই প্রকার প্রেমময়ী আদান-প্রদানের মাধ্যমে অপরিসীম সুখ আস্বাদন করা যায়। চিন্ময় আত্মা হওয়ায় এটি চিন্ময় জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত। তার ভালোবাসার পূর্ণতা তখনই পাওয়া যায় যখন আত্মা পরমেশ্বর ভগবানের সাথে তার প্রেমময়ী সম্পর্ক গড়ে তোলে।
বৈদিক শাস্ত্রে উল্লেখ আছে: একো বহুশ্যাম। এই প্রেমময়ী আদান-প্রদানের উদ্দেশ্যে পরমেশ্বর ভগবান অনেক অনেক অধঃনস্তদের সৃষ্টি করেছেন। বেদান্ত সূত্র অনুসারে পরমেশ্বর ভগবান হলেও সমস্ত চিন্ময় ভালোবাসার আবেগের আধার।
শ্রীমদ্ভাগবত নিশ্চিত করে যে, এই পরম ব্যক্তি হলেন সর্ব আকর্ষক এবং যিনি কৃষ্ণ নামে পরিচিত। নিশ্চয় জগতে কৃষ্ণই হলেন সমস্ত সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু এবং আত্মা সেখানে তাঁর সাথে প্রেমময়ী সম্পর্কের মাধ্যমে চিন্ময় আনন্দে উদ্ভাসিত হয়।
এক্ষেত্রে ভালোবাসার স্বাধীনতা একটি আবশ্যকীয় ব্যাপার। যখন ভালোবাসার বিষয় মুক্তভাবে পছন্দ করা হয় তখনই জীবের কাছে স্বার্থক ভালোবাসা হিসেবে প্রতিপাদ্য হয়। এভাবে জীবকে একটি ক্ষুদ্র স্বাধীনতার অপব্যবহার করে অর্থাৎ, ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ভালোবাসতে অনিচ্ছুক হয়, তখন সে এর বিকল্প কিছুর প্রতি ভালোবাসা অর্পণ করে। এজন্যে জীব সুখী হতে পারে না। কিন্তু তবুও জীব যখন এখান থেকে সুখ লাভের জন্য জেদ করে তখন সে ভিন্ন কিছুর (ধূমপানের মত নেশা) উপভোগের আয়োজন করে।
শত্রু আমাদের মধ্যেই
যেইমাত্র জীবাত্মা জগজগতের সংস্পর্শে আসে তখন কৃষ্ণের প্রতি তার ভালোবাসা বিকৃতি হয়ে কামে পর্যবসিত হয়। কামই জীবকে প্ররোচিত করে বিভিন্ন জড় বিষয়ের প্রতি তার ভালোবাসা অর্পনের জন্য। কাম জীবাত্মার এই জড়শরীরে সঙ্গে ভ্রান্ত পরিচয় প্রদান করে। আধুনিক মিডিয়া, সামাজিক পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, সংস্কৃতি ও অন্যান্য মাধ্যমে কামকে প্রসারিত করে।
তাই কামই হচ্ছে জীবের পরম শক্র। যা সমস্ত আত্ম-ধ্বংসাত্মক কার্যকালাপের মূল কারণ। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৮/৩৯ এ জড় বিকৃত আনন্দের প্রকৃতি সম্পর্কে তুলে ধরে যে, এই প্রকার আনন্দ প্রথমে অমৃত বলে মনে হয় কিন্তু অন্তিমে তা বিষ স্বরূপ। শ্রীল প্রভুপাদ ভাষ্য দিয়েছেন, “যখন কেউ ইন্দ্রিয় তৃপ্তিতে নিয়োজিত হয়, তখন মনে হয় যেন সুখ অনুভূত হচ্ছে কিন্তু এরূপ তথাকথিত সুখ প্রকৃতপক্ষে ইন্দ্রিয় উপভোগকারীর জন্য শক্র স্বরূপ।” কেননা এটি এই মোহ প্রদান করে যে, প্রকৃত সুখ এই জগতেই প্রাপ্ত হওয়া যাবে।
কাম কমবেশি সর্বত্র বিদ্যমান। এই কারণে কেউ জাগতিকভাবে যত সফলই হোক না কেন তার আত্ম-ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের প্রবণতা রয়েছে।
কামকে জয় করার একমাত্র উপায়
কামকে জয় করার কৌশল সম্পর্কে ভগবদ্গীতায় (৩/৪৩) কৃষ্ণ অর্জুনকে ব্যক্ত করেছেন, “হে মহাবীর অর্জুন! নিজেকে জড় ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধির অতীত জেনে নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধির দ্বারা মনকে স্থির কর এবং এভাবেই চিৎ-শক্তির দ্বারা কামরূপ দুর্জয় শক্রকে জয় কর।”
জড় চেতনা থেকে কৃষ্ণ চেতনায় রূপান্তরের সবচেয়ে সহজ ও কার্যকরী পন্থা হল, চিন্ময় শব্দ তরঙ্গ এবং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পবিত্র নামের মধ্যে তা পূর্ণরূপে বিরাজমান। এই পবিত্র নাম জপ-কীর্তনের মাধ্যমে ভগবানের সাথে সম্পর্কিত হওয়া যায় এবং তখন বিকৃত জড় জড় আনন্দ অর্থাৎ ধূমপান, ড্রাগস, আ্যলকোহল ইত্যাদির মাধ্যমে প্রাপ্ত আনন্দ পরিত্যাগ করে চিন্ময় আনন্দে উদ্ভাসিত হওয়া যায়।
এর দশকে শ্রীল প্রভুপাদ এই হরিনামের প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে হাজার হাজার নেশা আসক্ত জীবের জীবন পবরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।। এই পবিত্র মহামন্ত্র জপ কীর্তনের মাধ্যমে আমরা নিন্মতর আনন্দের উৎস সমস্ত মন্দ অভ্যাস পরিত্যাগ করে উচ্চতর চিন্ময় আনন্দের দিকে ধাবিত হতে পারি।
হরেকৃষ্ণ (সংকলিত) (মাসিক চৈতন্য সন্দেশ জানুয়ারি ২০১৭ প্রকাশিত)

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।