কার্ত্তিক ব্রতের মহিমা

প্রকাশ: ৯ অক্টোবর ২০২১ | ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ৯ অক্টোবর ২০২১ | ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 283 বার দেখা হয়েছে

কার্ত্তিক ব্রতের মহিমা

শ্রীমৎ ভক্তিপুরুষোত্তম স্বামী

কার্ত্তিক ব্রত মাহাত্মের নানাবিধ বর্ণনা আছে ও কার্ত্তিক মাসে অনুসরণযোগ্য বিভিন্ন বিধিনিষেধও আছে। শ্রীল সনাতন গোস্বামী স্কন্দপুরাণ, পদ্মপুরাণ আদি বিভিন্ন পুরাণ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর ‘হরিভক্তিবিলাস’ গ্রন্থে কার্ত্তিক ব্রতের বর্ণনা দিয়েছেন। সেইসব বর্ণনার কিছু অংশ নিম্নে প্রদত্ত হল:-

কার্ত্তিক ব্রতের মহিমা

‘সকল তীর্থ, যজ্ঞ, দক্ষিণা, পুষ্করে, কুরুক্ষেত্রে ও হিমালয়ে বসবাসের পুণ্য ও মেরুসদৃশ স্বর্ণস্তুপ দানের পুণ্য এ সবই শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় কার্ত্তিক মাসের মধ্যে অবস্থান করে।’ ‘কার্ত্তিক মাসে শ্রীবিষ্ণুর যে সেবাই করা হয় তা সবই নিত্য। হে নারদ, আমি তোমাকে সত্য বলছি।’ ‘কার্ত্তিক হল সব মাসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, পুণ্যকর্মসমূহের মধ্যে পুণ্যতম, যা-কিছু শুদ্ধ করে তার মধ্যে সর্বাধিক বিশুদ্ধকারী।’ ‘কার্ত্তিকের তুল্য মাস নেই। সত্যযুগের ন্যায় যুগ নেই। বেদের সমান শাস্ত্র নেই। গঙ্গার ন্যায় পুণ্যস্থান নেই।’ ‘কার্ত্তিক মাস শ্রেষ্ঠ। কার্ত্তিক সর্বদা বৈষ্ণবগণের প্রিয়। হে মহর্ষি, যে বৈষ্ণব ভক্তিসহকারে কার্ত্তিকের পরিচর্য্যা করেন তিনি পূর্বপুরুষগণকে নরক থেকে উদ্ধার করেন।

পদ্মপুরাণে কথিত হয়েছে :

দ্বাদশ মাসের মধ্যে কার্ত্তিকই শ্রীহরির সর্বাধিক প্রিয়। এই সময়ে যিনি এমনকি শ্রীবিষ্ণুর সামান্য আরাধনাও করেন, কার্ত্তিকমাস তাঁকে শ্রীবিষ্ণুর অপ্রাকৃত ধামে বাস প্রদান করে। ‘সবাই জানে, ভগবান দামোদর তাঁর ভক্তগণকে ভালবাসেন। শ্রীদামোদর মাস, এই কার্ত্তিক মাসও ভক্তদের ভালবাসেন। কার্ত্তিকমাস সামান্যতম ভক্তিকেও প্রচুর ও গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান করেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কার্ত্তিক মাসে একটিমাত্র প্রদীপ নিবেদনেও প্রসন্ন হন। যারা দামোদরের উদ্দেশ্যে দীপদানের ব্যাপারে অন্যদেরকে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনে সাহায্য করেন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এমনকি তাঁদেরও মহিমান্বিত করেন।

কার্ত্তিকে কৃত কিছু নির্দিষ্ট
পুণ্যকর্মের মাহাত্ম্য

স্কন্দপুরাণে কথিত হয়েছে : ‘কার্ত্তিক মাসে দান, যজ্ঞ, জপ ও তপস্যা করা হলে, হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ, তা অক্ষয় ফল প্রদান করে।’ অধিকন্তু বলা হয়েছে : ‘হে নারদ, আমি স্বয়ং দেখেছি যে কোন ব্যক্তি কার্ত্তিক মাসে মহানন্দে ভগবদ্গীতা পাঠ করলে তিনি জন্ম মৃত্যুময় এই পৃথিবীতে আর প্রত্যাবর্তন করেন না।’ ‘যে ব্যক্তি কার্ত্তিক মাসে শ্রীবিষ্ণু সহস্রনাম ও গজেন্দ্র মোক্ষণ লীলা পাঠ করেন, তাঁর পুনর্জন্ম হয় না।’ ‘হে মহর্ষি, অনুগ্রহপূর্বক অন্য সমস্ত ধর্মাচরণ পরিত্যাগপূর্বক কার্ত্তিকমাসে কেবলমাত্র ভগবান কেশবের বিগ্রহের সমক্ষে পবিত্র শাস্ত্রসমূহ শ্রবণ করুন।’
পদ্মপুরাণে কথিত হয়েছে : কার্ত্তিক মাসে ভূমিতে শয়ন, ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন, পলাশপত্রের উপর হবিষ্যান্ন আহার ও শ্রীদামোদরের আরাধনা করা কর্তব্য। এইরূপে সর্বপাপমুক্ত হয়ে ভগবদ্ধামে সারূপ্যমুক্তি লাভ করে শ্রীহরির সাক্ষাৎ সেবানন্দ লাভ হয়।’
অধিকন্তু বলা হয়েছে : ‘যে ব্যক্তি সমগ্র কার্ত্তিকমাস ব্যাপী প্রত্যুষে ওঠেন, স্নান করেন, ইন্দ্রিয় সংযত রাখেন, শান্ত থাকেন, জপ করেন ও শুধুমাত্র হবিষ্যান্ন গ্রহণ করেন, তিনি সর্বপাপমুক্ত হন।’
‘যে ব্যক্তি সমগ্র কার্ত্তিক মাসে দিনে একবার মাত্র আহার করেন, তিনি অতি বিখ্যাত, শক্তিশালী ও নায়কোচিত হয়ে ওঠেন।’ ‘যে ব্যক্তি কার্ত্তিক মাসে পলাশপত্রের উপর ভোজন করেন তিনি সর্বপাপমুক্ত হন। যে জন শ্রীহরির প্রসাদভোজী হন তাঁর মোক্ষলাভ হয়। যে ব্যক্তি যোগ্য ব্রাহ্মণ নন, তার পক্ষে পলাশ বৃক্ষের মাঝখানের পাতায় ভোজন করা উচিত নয়।’
আরো বলা হয়েছে : কার্ত্তিকমাসে যিনি সর্বশক্তিমান ভগবান শ্রীহরির আরাধনা করেন, শ্রীভগবান তাঁর সহস্র-সহস্র অপরাধ ও বহু ভয়াবহ পাপকর্ম মার্জনা করেন।’ ‘যে ব্যক্তি শ্রীবিষ্ণুকে ঘৃত ও শর্করাযুক্ত সুস্বাদু পরমান্ন নিবেদন করে সেই প্রসাদ গ্রহণ করেন, তিনি দৈনিক মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠানের ফল প্রাপ্ত হন।’
শ্রীকৃষ্ণ সত্যভামাকে ব্যাখ্যা করে বলছেন :
“যারা কার্ত্তিক মাসে স্নান, রাত্রি জাগরণ, দীপদান ও তুলসীবন সংরক্ষণ করেন তাঁরা শ্রীবিষ্ণুর ন্যায় দিব্যদেহ লাভ করেন।”
যারা তিনদিবস মাত্র এসকল পুণ্যকর্ম করেন, দেবগণও তাঁদের সর্বপ্রকারে সম্মানিত করেন। যারা সমগ্র জীবন এইসকল পুণ্যকর্মের অনুষ্ঠান করে এসেছেন তাঁদের আর কি কথা?

আকাশদীপের মহিমা

পদ্মপুরাণে উক্ত হয়েছে :‘যে ব্যক্তি কার্ত্তিক মাসে উচ্চাকাশে মহাদীপ প্রদান করেন তিনি সমস্ত কুটুম্বগণসহ বিষ্ণুলোকে গমন করেন।’

আকাশে দীপদানের মন্ত্র

‘নমোহনস্তায় বেধসে ’ (পরমস্রষ্টা অনন্তদেবকে প্রণাম করি) মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে ভক্তগণ আকাশে ভগবান দামোদর ও সৌভাগ্যদেবীকে দীপ-নিবেদন করেন।

কিছু সুনির্দিষ্ট স্থানে কার্ত্তিকব্রত পালনের মাহাত্ম্য

পদ্মপুরাণে বলা হয়েছে: ‘কেউ যে স্থানেই থাকুন না কেন, কার্ত্তিকমাসে স্নান, দান ও বিশেষতঃ শ্রীভগবানের আরাধনার মাধ্যমে অগ্নিহোত্র যজ্ঞানুষ্ঠানের ফললাভ করবেন।’
কার্ত্তিক ব্রত পালনের ফল দশলক্ষ গুণ বর্ধিত হয় যখন তা কুরুক্ষেত্রে বা গঙ্গাতটে অনুষ্ঠিত হয়। পুষ্কর তীর্থে তার ফল আরো অধিক। কার্ত্তিক মাসে দ্বারকায় স্নান ও ভগবৎ আরাধনার ফলে কৃষ্ণলোকপ্রাপ্তি ঘটে।’ ‘হে মুনিগণ, অন্যান্য তীর্থনগরীও অনুরূপ ফলপ্রদান করে। মথুরামণ্ডলের কথা ভিন্ন কারণ শ্রীকৃষ্ণ মথুরামণ্ডলেই দামোদরলীলা প্রকাশ করেছিলেন।’
‘মথুরায় কার্ত্তিকব্রত পালনের ফলে কৃষ্ণপ্রেম লাভ হয়। এইরূপে মথুরায় সর্বোত্তম ফললাভ হয়। যেরূপ মাঘমাসে প্রয়াগের সেবা ও বৈশাখমাসে গঙ্গার সেবা করণীয়, তদ্রুপ কার্ত্তিকমাসে মথুরায় সেবা কর্তব্য। কার্ত্তিকে মথুরার সেবা অপেক্ষা কিছুই অধিক উত্তম নয়।’ যাঁরা কার্ত্তিক মাসে মথুরায় স্নানপূর্বক দামোদরের আরাধনা করেন, তাঁরা শ্রীকৃষ্ণের ন্যায় চিদ্দেহ লাভ করেন। এই বিষয় সন্দেহাতীত।’
‘হে ব্রাহ্মণ, মথুরায় কার্ত্তিকমাস অতিবাহিত করার ভাগ্য অতি দুর্লভ। যারা কার্ত্তিকে মথুরায় দামোদরের আরাধনা করেন, শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের নিকট স্বীয় অপ্রাকৃতরূপ প্রকাশ করেন।’
‘যে সকল ভক্তগণ অন্যত্র তাঁর আরাধনা করেন, শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের সুখ ও মোক্ষপ্রদান করেন বটে, কিন্তু ভক্তিপ্রদান করেন না, কারণ ভক্তি তাঁকে তাঁর ভক্তের ভৃত্যে পরিণত করে।’
তথাপি কার্ত্তিক মাসে মথুরায় একবার মাত্র দামোদর আরাধিত হলে অনায়াসে সেই ভক্তি লাভ করা যায়।’

কার্ত্তিকমাসে করণীয় কর্তব্যসমূহ

কার্ত্তিক মাহাত্ম্যে শ্রীকৃষ্ণ সত্যভামাকে বলছেন: ‘আশ্বিনমাসের শুক্লা একাদশী থেকে শুরু হওয়া কার্ত্তিকব্রত কঠোরভাবে পালনীয়।’ ‘এই ব্রতানুসারে শেষরাত্রিতে জাগ্রত হয়ে স্তবদ্বারা বিগ্রহকে জাগ্রত করে আরতি নিবেদন করা উচিত।’
‘প্রাতে বৈষ্ণবসঙ্গে পরমানন্দে শ্রীবিষ্ণুভক্তি বিষয়ক ধর্মকথা শ্রবণ ও বিষ্ণুর গুণকীর্ত্তন করে শ্রীবিষ্ণুকে আরতি নিবেদন করা কর্তব্য।’ ‘অতঃপর নদী বা অন্য জলাশয়ে গমন করে আচমনপূর্বক সঙ্কল্পমন্ত্র ও প্রার্থনামন্ত্র উচ্চারণ করে যথাযথভাবে শ্রীভগবানকে অর্ঘ্যপ্রদান করা উচিত।’ ‘হে শ্রীদামোদর, হে ভক্তগণের দুর্দশা বিনাশকারী প্রভু, হে সর্বেশ্বরেশ্বর, আপনাকে ও রাধারাণীকে প্রসন্ন করার জন্য আমি কার্ত্তিকমাসে প্রতিদিবস প্রাতঃস্নান করব।’ ‘কার্ত্তিকব্রতের অংশগুলি হল: (১) শ্রীহরির প্রীতার্থে রাত্রিজাগরণ, (২) প্রাতঃস্নান, (৩) তুলসী-সেবা, (৪) যথাযথরূপে ব্রত সমাপন ও (৫) দীপদান।’ ‘যে ব্যক্তি কার্ত্তিকমাসে এই পঞ্চব্রত অনুসরণ করেন, তিনি এই গ্রন্থে ইতিপূর্বে বর্ণিত সুখ ও মোক্ষরূপ পূর্ণফল লাভ করেন।’

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।