“আমার ভক্তরা লন্ডন জয় করে নিল”

প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২১ | ১:৩২ অপরাহ্ণ আপডেট: ১৪ জুন ২০২১ | ১:৩২ অপরাহ্ণ

এই পোস্টটি 271 বার দেখা হয়েছে

“আমার ভক্তরা লন্ডন জয় করে নিল”

প্রাচীন রথযাত্রা উৎসব এখন লন্ডনের মর্যাদপূর্ণ উৎসব হিসেবে অচিরেই প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যেখানে প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি জনগণ অংশগ্রহণ করে।

তিক্ষিক্ষু দাস, অভিমন্যু দাস, কৃষ্ণ দাস, দামোদর কৃষ্ণ দাস, পরম কৃষ্ণ দাসের তথ্যচিত্র অবলম্বনে

৫০০০ বছর ধরে রথযাত্রা ভারতে উদযাপিত হয়ে আসছে যেখানে অংশগ্রহণ করে লক্ষ লক্ষ ভক্ত। ১৯৬৭ সালে এই অপ্রাকৃত উৎসবটি ভারত থেকে পশ্চিমা দেশে নিয়ে আসেন হরেকৃষ্ণ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীল এ. সি. ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ। বর্তমানে বিশ্বের ২০০ টি শহরে এ রথযাত্রা উৎসবটি উদ্যাপিত হয়।

প্রথম রথযাত্রা

লন্ডনে প্রথম রথযাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৯ সালে। তখন ঐ উৎসবটির মূল উদ্যোক্তা ছিল মূলত ৮ জন এবং সঙ্গে ছিল তাদের সহায়তাকারী অন্যান্য ভক্তবৃন্দ। শোভাযাত্রাটি মার্বেল আর্ট থেকে শুরু হয়ে বিখ্যাত ট্রাফালগার স্কয়ারে গিয়ে থামে। লন্ডনে প্রথম জগন্নাথের রথ তৈরি করেন শ্যামসুন্দর দাস। ঐ রথাযাত্রার পর লন্ডনের জাতীয় পত্রিকাগুলোতে উৎসবটি নিয়ে ফলাও করে ছাপানো হয়। এর মধ্যে একটি শিরোনাম ছিল “krishna chant startles London” অর্থাৎ “কৃষ্ণনাম জপ লন্ডনকে চমকে দিল।” রথযাত্রার বিগ্রহ জগন্নাথ, বলদেব, সুভদ্রা দেবীর বিগ্রহ তৈরির সময় শ্যামসুন্দরের উদ্দেশ্যে প্রভুপাদ নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, “বিগ্রহসমূহ এমন সুন্দরভাবে তৈরি কর যাতে প্রত্যেকে বিগ্রহের প্রতি আকর্ষিত হয়।” শ্রীল প্রভুপাদের প্রত্যক্ষ নির্দেশে শ্যামসুন্দর দাস জগন্নাথ, বলদেব ও সুভদ্রা দেবীর বিগ্রহ খোঁদাই করেন। আজও সেই বিগ্রহত্রয় লন্ডনে পূজিত হচ্ছে। বছরে একবার মন্দির থেকে বের হয়ে লন্ডনের রাস্তায় রথে চড়ে ট্রাফালগার স্কয়ারে যান।

“যা ইতোপূর্বে কখনো দেখেনি”

১৯৭০ সালে একটি নতুন একটি নতুন রথ ৫০ফুট উঁচু নতুন রথ রাজকীয়ভাবে রাস্তায় নেমে পড়ে, তখন রথের আশেপাশের লন্ডনবাসীরা মহাসুখে হরিনাম জপ ও নৃত্য করতে থাকে। যেন লন্ডনবাসীরা এখনও ১৯৬৯ সালে প্রথম পালিত রথযাত্রায় অপ্রাকৃত শব্দ তরঙ্গের প্রথম ধ্বনির সুর এখনও ভুলতে পারেনি। বিখ্যাত মিউজিক ব্যান্ড দ্যা রাধা কৃষ্ণ টেম্পল তা করতে দেয়নি। ভক্তরা হরেকৃষ্ণ কীর্তন ইংল্যান্ডের রেকর্ড, টেলিভিশন ও রেডিওতে প্রচার করতে লাগলেন। তখন ভক্তরা বিভিন্ন মুভি, জাতীয় সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিন গুলোতেও উঠে আসছিল। ভক্তরা প্রতিদিন অক্সফোর্ড স্ট্রিটে হরিনাম কীর্তন ও নৃত্য করতে লাগল ।
এটি একটি অদ্বিতীয় রথযাত্রা ছিল যেখানে সমগ্র ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে ভক্তরা অংশগ্রহণ করেছিল। ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সেই ভবিষ্যদ্বাণী, “পৃথিবীতে যত আছে নগরাদি গ্রাম, সর্বত্র প্রচার হবে মোর নাম,” এটি স্বার্থক করার প্রারম্ভিক যাত্রা ছিল এই রথযাত্রা।
তখন হরেকৃষ্ণ ভক্তরা পুরো লিচেষ্টার স্কয়ার আয়ত্ত করে নিয়েছিল। আশেপাশের বিশাল বিলবোর্ডগুলোতে প্রচার করা হয়েছিল, “পবিত্র ভগবান জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা” ১৯৭০ সালে সমস্ত সংবাদপত্রগুলোতে এ রথযাত্রার সংবাদে ছেয়ে গিযেছিল, যা লন্ডনবাসীরা ইতোপূর্বে দেখে নি । এ সমস্ত শিরোনামগুলো দেখে শ্রীল প্রভুপাদ বিবৃতি দিয়েছিলেন, “দেখ, আমার ভক্তরা লন্ডন জয় করে নিল।”

নেলসন স্তম্ভের প্রতিদ্বন্ধী

১৯৭৩ সালের বছরটি ছিল বিশেষ একটি বছর। কেননা এ রথযাত্রায় ইস্কন প্রতিষ্ঠাতা ও আচার্য শ্রীল প্রভুপাদ স্বয়ং অংশগ্রহণ করেন।
যদিও শ্রীল প্রভুপাদের বয়স ছিল তখন ৭৪, কিন্তু ঐ অবস্থায়ও তিনি রথযাত্রার সারাটি পথ জুড়ে নৃত্য-কীর্তন করেছিলেন, এমনকি রথের ওপর তাঁর জন্য নিবেদিত আসন পর্যন্ত পরিত্যাগ করেছিলেন।
এ ঘটনাটি সমবেত ভক্তদেরকে অনেক উৎফুল্ল করে, ঐ উৎসবটি ছিল শ্রীল প্রভুপাদের জয়োল্লাসিত (triumphant) মুহূর্ত। তিনি ট্রাফালগার স্কয়ার পার্কে হাজার হাজার ভক্তের হরিনাম কীর্তন পর্যবেক্ষণ করছিলেন। ১৯৭৩ সালের এ রথযাত্রা উৎসবটি আয়োজিত হয়। তখনকার নবীন সন্ন্যাসী শ্রীমৎ মহাবিষ্ণু স্বামীর মাধ্যমে। তিনি ১০,০০০ পাউন্ড দান করেছিলেন এটি আয়োজন করার জন্য। এই অর্থ পাবলিক বাসগুলোতে প্রচার প্রচারণা ও ছোট ফিল্ম তৈরি সেবাতেও ব্যয় হয়েছিল।
পুলিশ উৎসবটি নিয়ে মন্তব্য করেছিল এভাবে, “এটি সবচেয়ে আনন্দদায়ক জনতার প্রদর্শনী ছিল যে, ইতোপূর্বে তারা কখনো দেখেনি, প্রত্যেকে যথাযথ স্বভাববিশিষ্ট ছিল।” পরদিন দ্যা গার্ডিয়ান পত্রিকায় সামনের পৃষ্ঠায় শিরোনাম আসে “ইসকন রথযাত্রা নেলসন স্তম্ভের (column) প্রতিদ্বন্ধী” (রথের উচ্চতার সঙ্গে নেলসন স্তম্ভের তুলনা করে)। শ্রীল প্রভুপাদ চৈতন্য চরিতামৃতে লিখেছেন, “যেরকম পুরীর বাসিন্দারা রথযাত্রার রথকে সুমেরু পর্বতের সঙ্গে তুলনা করে, তেমনি লন্ডনের বাসীন্দারা রথকে নেলসন স্তম্ভের প্রতিদ্বন্ধী হিসেবে বিবেচনা করে।”

হোমস্ নদীর পাড়ে উৎসবমুখর পরিবেশ

১৯৮৫ সালে, লন্ডন রথযাত্রা আরো অগ্রসর হল। এখন মার্বেল আর্ট থেকে বাটারসি পার্ক পর্যন্ত অগ্রসর হবে, যার মাধ্যমে শোভাযাত্রাটি একটি বিশাল উৎসবে রূপ নিল। এ বছরটির আকর্ষণ ছিল মঞ্চ প্রদর্শনী, নৃত্য ও অপ্রাকৃত কীর্তন। হোমস্ নদীর তীরে অবস্থিত পার্কটি একটি পারিবারিক উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করে।

৮ হাজারেরও বেশি ভক্ত

১৯৯৬ বছরটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ছিল, কেননা এটি ছিল শ্রীল প্রভুপাদের আবির্ভাবের শত বছর উদযাপনের বছর। সেবারের রথযাত্রায় ৮ হাজারেরও বেশি লোক অংশগ্রহণ করে।
উৎসবের তাৎপর্য আরো বাড়িয়ে দেয় যখন এক দশক সংগ্রামের পর ভক্তিবেদান্ত মেনর সাধারণ জনগণের আরাধনার জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

আরো অগ্রসরতা

১৯৯৯ সালে ট্রাফালগার স্কয়ারকে যানবাহন চলাচল মুক্ত। করে নতুনত্ব আনা হয়। ইস্কনের দশ জন সন্ন্যাসী অংশগ্রহণ করে এবং এটি আন্তর্জাতিক টিভি সিরিজ ‘অভয় চরণ’ এর জন্য চলচ্চিত্রায়িত করা হয়।

নতুন রথ, নতুন রূপে ট্রাফালগার
স্কয়ার পার্ক

অনেক বছর ধরে রথযাত্রা উৎসব সফলভাবে পালিত হওয়ার পর, ২০০০ সালে ইস্কন ভক্ত তিতিক্ষু দাস স্থানীয় কর্তৃপক্ষদের অনুমতি অর্জন করে নতুন আরো দুটি রথ লন্ডন রথযাত্রায় অংশগ্রহণ করার জন্য। ঐ বছর থেকে এখনও পর্যন্ত তিনটি সুবিশাল রথ বর্ণিল শোভাযাত্রা সহকারে অংশগ্রহণ করে যা আরো দৃষ্টিনন্দন করে তোলে।
এ বছরে অলৌকিকভাবে ট্রাফালগার স্কয়ার পার্ক নতুনভাবে নকশাকৃত করা হয়, যারা ফলে ওপরের চত্বরটি খুলে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে নতুন তিনটি রথ প্রদর্শনীর মাধ্যমে তিনটি রথের ওপরে উপবিষ্ট পৃথকভাবে ভগবানকে দর্শন করার পথ সুগম হয়। এর ফলে এ উৎসবটি পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় শহর হিসেবে লন্ডনের মর্যাদার আঙ্গিকে উপযোগী হিসেবে গড়ে উঠে।

চিরস্থায়ীরূপে রথযাত্রা

যে রথটি গত ২৬ বছর যাবৎ জগন্নাথের সেবায় নিয়োজিত হয়েছিল তা ২০০৮ সালে নতুন রূপে নির্মাণ করা হয়। ব্রিটেনের রানির হুইলরাইট (চাকাওয়ালা গাড়ির প্রস্তুতকারক) ঐতিহ্যবাহী ভঙ্গিতে রথের বিশাল কাঠের চাকা তৈরি করেন।
রথের ওপর বিভিন্ন নকশার কাজ করেন নিবেদিত সেচ্ছাসেবকগণ। এই রথসমূহ অন্তত যেন পঁচিশ বছর টিকে থাকতে পারে সেভাবে নির্মাণ করা হয়। রথসমূহ তৈরি করা হয়েছে স্থায়ীভাবে, কেননা এই রথযাত্রা উৎসব এখন লন্ডনে স্থায়ী। ১৯৬৯ সালে রথযাত্রা লন্ডনের আগমনের পর উৎসবমুখরভাবে কেটে গেছে ৪৪ বছর। এখন ঐ দিনে ৩০ হাজারেরও বেশি ভক্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসবে অংশগ্রহণ করতে থাকে। এভাবে যতই বছর গড়াচ্ছে রথযাত্রা উৎসব লন্ডনের একটি মর্যাদাপূর্ণ উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠছে ৷


তিতিক্ষু দাস বর্তমানে উৎসবের সংগঠক। অভিম, দাস, ট্রাফালগার স্কয়ারে পরিকাঠামোর দায়িত্বে নিযুক্ত। কৃষ্ণ দাস, ট্রাফালগার স্কয়ারের প্রসাদ সেবার সহ-সমন্বয়কারী । দামোদর কৃষ্ণ দাস, শোভাযাত্রার সংগঠক। পরম করুণা দাস, ট্রাফালগার স্কয়ার সহ-সমন্বয়কারী এবং অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের পরিচালনার সেবায় রয়েছেন।


 

ত্রৈমাসিক ব্যাক টু গডহেড, জুলাই – সেপ্টেম্বর ২০১৪

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।