শ্রীল প্রভুপাদ ও তাঁর শিষ্যদের মধ্যকার এই কথোপকথনটি হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর শ্রীধাম বৃন্দাবনে।
শ্রীল প্রভুপাদ : অনেক বড় বড় স্বামীজিরা বলছেন, হ্যা, তুমি মনোধর্ম প্রসূত যেকোনো ধর্ম ও পথের উদ্ভাবন কর না কেন, তা সবই ঠিক। তোমার যে উপায়ে ভাল লাগে এবং তোমার যা ভাল লাগে, তাই ঠিক। তখন তারা খুব সন্তুষ্ট থাকে। যদি কেউ বলে যে, তুমি আমার কাছে আত্মসমর্পণ কর, তখন তাদের কাছে আর ভাল লাগে না। যদি কেউ বলে যে, না, তোমার যেখানে ইচ্ছা, যার কাছে ইচ্ছা তার কাছে আত্মসমর্পণ কর, সেটাই তাদের কাছে খুব বেশি গ্রহণযোগ্য হয়।
ব্রহ্মানন্দ : তাহলে তার মানে হলো তারা কোনো নির্দিষ্ট কারো কাছে আত্মসমর্পণ করতে ইচ্ছুক নয়, তাদের যেখানে ইচ্ছা শুধুমাত্র সেখানেই আত্মসমর্পণ করতে চায়।
শ্রীল প্রভুপাদ : ‘হ্যাঁ’।
ব্রহ্মানন্দ : তখন তারা খুব সন্তুষ্ট থাকে । বাসুঘোষ : অনেক লোক বলে যে, আমরা আমাদের কর্ম করছি, তুমি তোমার কর্ম কর।
শ্রীল প্রভুপাদ : শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আত্মসমর্পণ, এটাই তোমার একমাত্র কর্ম ও দায়িত্ব।
বাসুঘোষ : তারা বলে যে, তাদের স্ত্রী আছে, পরিবার আছে, সন্তান আছে, চাকুরি আছে, এগুলোই তাদের সব।
ব্রহ্মানন্দ : অনেকে আরো হাস্যকর কথা বলে। যখন তাঁর (ভগবানের) ইচ্ছা হবে তখন আমি শুধুমাত্র তা করতে পারবো, তার আগে কখনই সম্ভব নয় । (হাসি…)
শ্রীল প্রভুপাদ : বেশ, যখন কৃষ্ণ বলছেন, “সর্ব প্রকার ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও, আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব। তুমি শোক করো না।” গীতা- ১৮/৬৬) তুমি এটি কর। তাঁর কথাই তাঁর ইচ্ছা কি প্রকাশ পায় না? তিনি আর কিভাবে বললে মূর্খগুলো বুঝতে পারবে?
বাসুঘোষ : তারা বলে, যখন তিনি আমাকে তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণের জন্য আমার মন প্রস্তুত করবেন, যখন তিনি তা আমার মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেবেন এবং যখন আমি আমার হৃদয় ও মনকে তাঁর জন্য উজাড় করে দিতে পারবো একমাত্র তখনই আমার দ্বারা এই কাজ করা সম্ভব, তার আগে নয়
শ্রীল প্রভুপাদ : তাহে তোমার হৃদয় বলে কিছুই নেই। তুমি একটা পাথর। (হাসি….) ভারতবর্ষের কিছু বৈষ্ণবকে এরূপ গাইতে শোনা যায়, আমার হৃদয় পাথরের চেয়ে কঠিন। কেননা আমি জানি যে, হরিনামে পাথর পর্যন্ত গলে যায়, সেখানে আমার হৃদয় গলছে না, তাহলে আমার মনে হয় আমার হৃদয় পাথরের চেয়েও কঠিন।
জনৈক ভারতীয় ব্যক্তি (২) : একবার জনৈক এক ব্যক্তি কলকাতায় প্রভুপাদ মহারাজকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আপনি কখন আমাকে কৃষ্ণ দেখাবেন?” প্রভুপাদ মহারাজ বলেছেন, “এখানেই কৃষ্ণ আছে, তোমার চোখগুলো পাথরের, তাই তুমি কৃষ্ণকে দেখতে পারছো না, যদি তোমার কাছে দেখার মতো চোখ থাকতো তবে তুমি দেখতে পেতে।”
শ্রীল প্রভুপাদ : আসলেই তাই।
জনৈক ভারতীয় ব্যক্তি (২) : ভক্তরা শিলাখণ্ডের পূজা করে না। তারা শিলাখণ্ডের মধ্যে কৃষ্ণকে দেখতে পায়। তাই এটিকে তারা নিজের মনের মতো করে সুসজ্জিত করে এবং মনের সকল আকুতি তাঁর কাছে নিবেদন করে কেননা তারা জানে এই শিলাখণ্ডের মধ্যে কৃষ্ণ বিরাজমান। লোকটিকে এভাবে বুঝাতে চেষ্টা করলাম।
শ্রীল প্রভুপাদ : হুম, তখন ঐ ব্যক্তি কি বলল?
জনৈক ভারতীয় ব্যক্তি (২) : প্রভুপাদ, তখন সে খুব শীঘ্রই তা মেনে নিল।
শ্রীল প্রভুপাদ : ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সেই ভক্তরা দেখেন যারা “প্রেমাঞ্জনচ্ছুরিতভক্তিবিলোচনেন সন্তঃ সদৈব হৃদয়েষু বিলোকয়ন্তি।”
(ব্রহ্মসিংহতা ৫/৩৮)
যদিও সবকিছু কৃষ্ণ হতে প্রকটিত হয়েছে, কিন্তু কৃষ্ণ কোনো কিছুর মধ্যে অবস্থান করে না। অর্থাৎ সবকিছুই কৃষ্ণের শক্তি, কোনো কিছুই কৃষ্ণ নয়, তারা সবকিছুই গ্রহণ করে এই জগৎ হতে যা কৃষ্ণের শক্তির প্রকাশ। আবার সেই জগৎকেই তারা অস্তিত্বহীন বলে । এটা হচ্ছে মায়াবাদ তত্ত্বের সাথে প্রধান পার্থক্য।
সন্তঃ সদৈব হৃদয়েষু : যে ব্যক্তির হৃদয় ভগবানের জন্য দিব্য প্রেমে পূর্ণ সে ২৪ ঘণ্টা শুধুমাত্র ভগবানকেই দর্শন করেন। সে ভগবান ছাড়া আর কিছুই দেখে না।
হরিসৌরি: শ্রীল প্রভুপাদ, গত রাতে আমার সাথে এক মায়াবাদীর কথা হয়েছিল। সে বলল সবকিছুর মধ্যে যদি পরমাত্মারূপে ভগবান থেকে থাকে, তবে যিনি আধ্যাত্মিক দিকে উন্নত, তিনি সবকিছুর মধ্যে পরমাত্মাকে দর্শন করতে পারেন। আর সবকিছুই যদি পরমাত্মা হয়, তাহলে আমরা এখন বর্তমানে যা করছি তা তো একই জিনিস করছি, কেননা সবকিছুই তো ভগবান ।
শ্রীল প্রভুপাদ : না, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, সবকিছুই আমার শক্তি, কিন্তু আমি সবকিছুর মধ্যে অবস্থান করি না। “মৎস্থানি সর্বভূতানি ন চাহং তেম্ববস্থিতা” (গীতা ৯/৪) সমস্ত জীব আমাতেই অবস্থিত কিন্তু আমি তাতে অবস্থিত নয়।
জনৈক ভারতীয় ব্যক্তি : ভগবানের শক্তি সেখানে বিরাজমান কিন্তু সেটি অপ্রাকৃত নয়।
শ্রীল প্রভুপাদ : না, এটি অপ্রাকৃত। কিন্তু, যেহেতু আমি কৃষ্ণকে জানি না, অথবা আমি কৃষ্ণকে এর মধ্যে দর্শন করতে পারছি না সেহেতু আমি একে জাগতিক বস্তু হিসেবেই দর্শন করব। যেমন ধরুন এই মাইক্রোফোনটি যেহেতু এটি কৃষ্ণের সেবায় ব্যবহৃত হচ্ছে সেহেতু এটি অপ্রাকৃত হয়ে গেছে। যদি জাগতিক কোনো বস্তুকে কৃষ্ণের সেবায় লাগানো হয় তবে তা জাগতিক হলেও চিয়ত্ব প্রাপ্ত হয়। আর এভাবেই আমরা সকল জাগতিক বস্তুকে চিন্ময় বস্তুতে রূপান্তরিত করতে পারি।
জনৈক ভক্ত : শ্রীল প্রভুপাদ, যদি এটি চিন্ময় বস্তু হয় তবে এটি চিরন্তন ও অবিনশ্বর হবে। আমি এটি ছুড়ে ফেললে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।
শ্রীল প্রভুপাদ : বেশ, তোমার কথাটি যৌক্তিক। কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে যদি বিচার করি তবে আমরা কি জানতে পারি, শক্তি হলো অবিনশ্বর। আপাতদৃষ্টিতে যদিও মনে হয় যে, শক্তির বিনাশ হয়েছে। আসলে তা অন্য একটি শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে মাত্র। তুমি অবশ্যই মাইক্রোফোনটির উপাদানগুলো কোনোভাবে আবার আরেকটি মাইক্রোফোন তৈরিতে ব্যবহার হবে। অর্থাৎ বস্তুটির যে শক্তি তাকে তুমি কোনোভাবেই বিনাশ করতে পারবে না। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার (৮/১৯) শ্লোকে ভগবান বলছেন, “ভূত্বা ভূত্বা প্রলীয়তে”। অর্থাৎ সেই ভূতসমুহ (জীব সমষ্টি) কিছু সময় ধ্বংস হয় এবং আবার সৃষ্টি হয় কিন্তু শক্তি সেখানে থাকে।
জনৈক ভারতীয় ভক্ত : অবশ্যই তা ভিন্ন রূপে।
শ্রীল প্রভুপাদ : যেকোনো রূপেই হতে পারে। ঠিক এই মাটির মতো। তুমি এখন এই মাটি দিয়ে হাজার হাজার মাটির পাত্র ও পুতুল তৈরি করতে পার। যখন সেগুলো নষ্ট হয়ে যাবে আবার তা মাটিতেই পরিণত হবে। যখন তুমি মাটিকে অন্য একটি রূপ দিচ্ছ তখন তুমি তাকে হয়তো অন্যরূপে দেখছো কিন্তু তা মাটিই। আর যখন তাকে কোনো রূপ দিচ্ছ না তখন তা সাধারণ মাটিই। তাই সবকিছু যেহেতু কৃষ্ণের শক্তি হতে প্রকাশিত হয়েছে সেই অর্থে সবকিছুই অপ্রাকৃত। কৃষ্ণ বলছেন (গীতা ৭/৪),
ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ।
অহঙ্কার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা ॥
“ভূমি, জল, বায়ু, অগ্নি, আকাশ, মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার—এই আট প্রকারে আমার ভিন্না জড়া প্রকৃতি বিভক্ত।”
তাহলে কিভাবে কৃষ্ণের শক্তি জাগতিক হতে পারে? কারণ আমি কৃষ্ণকে ভুলে গেছি, তাই সবকিছুই আমাদের কাছে জড় বলে মনে হচ্ছে। মহাপ্রভু পুরীতে জগন্নাথের মন্দিরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই অচৈতন্য হয়ে গেলেন। তিনি কি কাষ্ঠময় জগন্নাথকে দেখে মূর্ছা গিয়েছিলেন? না, এখানে প্রশ্ন হচ্ছে দেখার।
হরিসৌরি : কৃষ্ণের শক্তি চিন্ময়, তাহলে ভগবদ্গীতায় তিনি কেন পার্থক্য সৃষ্টি করেছেন। এই বলে যে, আমার প্রকৃতি আমার থেকে ভিন্ন। কেন তিনি বললেন ভিন্ন কথাটি?
শ্রীল প্রভুপাদ : বেশ, যখন আমি তোমাকে কোনো উত্তর দিচ্ছি। তখন আমার শব্দটি তোমার কাছে যাচ্ছে, আমার শব্দ ও আমি এক জিনিস নয়। আমি এই শব্দের মধ্যে নেই। তাই যদি তুমি এই প্রকৃতি শক্তিকে কৃষ্ণভাবনামৃতের মাধ্যমে এর যথার্থ ব্যবহার কর, তবে এটি তোমাকে সাহায্য করবে। অন্যথায় নয়, যেমন ধর বিগ্রহ, সবাই জানে ও দেখছে এটি একটি শিলাখণ্ড। তবে কেন আমরা এটিকে পূজা করছি?
হরিসৌরি : কারণ, এটি কৃষ্ণ।
শ্রীল প্রভুপাদ : হ্যাঁ, এটি কৃষ্ণ হতে অভিন্ন। তাই আমরা কোনো শিলাখণ্ডকে পূজা করি না। আমরা পূজা করি স্বয়ং কৃষ্ণকে ৷
জনৈক ভারতীয় ব্যক্তি (২) : যারা এর পূজা করছে, তাদের মনে কখনোই কি আসে না যে এটি শিলাখণ্ড ?
শ্রীল প্রভুপাদ : না, কখনোই না, এটি হলো একটি বিশেষ যোগ্যতা, যা অর্জন করলে আপনি নিজেই এর চিন্ময়ত্ব অনুধাবন করতে পারবেন।
বাসুঘোষ : এমন অনেক অনেক ধর্ম আছে বিশেষত আমি যেখানে জন্মগ্রহণ করেছিলাম তারা প্রচার করে যে, তুমি কখনোই ভগবান এমনকি ভগবানের দিব্য শক্তিকে দর্শন করতে পার না।
শ্রীল প্রভুপাদ : হুম।
বাসুঘোষ : তারা আরো বলে যে, “তোমার কখনই ভগবানের মূর্তি দর্শন করা উচিত নয়।”
শ্রীল প্রভুপাদ : এটাই স্বাভাবিক, যেহেতু তুমি ভগবানকে সর্বত্র দর্শন করার উপযুক্ত নও।
বাসুঘোষ : না, তারা বলে …… ব্রহ্মানন্দ : তারা নিষেধ করে।
বাসুঘোষ : তারা বিগ্রহ অর্ধন করতে নিষেধ করে। তারা বলে যে, ভগবান কখনোই জড় বস্তু দ্বারা তৈরি হতে পারে না।
ব্রহ্মানন্দ : তারা বলে যে, এটা হলো ভগবানকে খাটো করে দেখা। ভগবানকে কিভাবে তৈরি করা সম্ভব?
শ্রীল প্রভুপাদ : ভগবান চিন্ময়, চিন্ময় বস্তুকে দেখতে হলে, তোমার চিন্ময় চোখের প্রয়োজন হবে। কিন্তু তোমার তো চিন্ময় চোখ নেই। তাহলে তুমি কিভাবে ভগবানকে দেখবে? যেহেতু তোমার চোখ এখনও জড়, তাই তুমি জড়বস্তুকে অনায়াসেই দেখতে পার, তাই ভগবান তোমার প্রতি কৃপাপরবশ হয়ে নিজেকে জড় বস্তু হতে প্রকটিত করেছেন, যাতে তুমি তাকে দেখতে পার, তার সেবা করতে পার।
ব্রহ্মানন্দ : অনেকে আবার এই রকমও বলে যে, জগৎটা মিথ্যা।
শ্রীল প্রভুপাদ : না, তা কখনোই হতে পারে না। যদিও সবকিছু কৃষ্ণ হতে প্রকটিত হয়েছে কিন্তু কৃষ্ণ কোনো কিছুর মধ্যে অবস্থান করে না। অর্থাৎ সবকিছুই কৃষ্ণের শক্তি, কোনো কিছুই কৃষ্ণ নয়, তারা সবকিছুই গ্রহণ করে এই জগৎ হতে যা কৃষ্ণের শক্তির প্রকাশ। আবার সেই জগৎকেই তারা অস্তিত্বহীন বলে। এটা হচ্ছে মায়াবাদ তত্ত্বের সাথে প্রধান পার্থক্য।
ব্রহ্মানন্দ : এমন অনেক ধর্মমত আছে যারা বলে যে, ভগবানকে একটা নির্দিষ্ট নামে ডাকা উচিত নয়। এটা এক ধরনের অপরাধ। তারা বলে যে, এর মাধ্যমে অসীম এবং সসীম এক গণ্ডীর মধ্যে চলে আসে।