সরস্বতী দেবী কীভাবে দেবী, মাতা ও নদীশ্রেষ্ঠ?

প্রকাশ: ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ৯:০৩ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ৯:০৩ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 303 বার দেখা হয়েছে

সরস্বতী দেবী কীভাবে দেবী, মাতা ও নদীশ্রেষ্ঠ?

মিত্রগোপা কৃষ্ণ দাস

বেদে সরস্বতী সম্বন্ধে তিনটি সম্বোধন করা হয়েছে, “দেবীতমে”, “অম্বিতমে” ও “নদীতমে”। দেবী তমার অর্থ দেবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, অম্বিতমার অর্থ সকল মায়েদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং নদীতমার অর্থ সকল নদীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এদিক থেকে তাঁর মহিমা ত্রিবিধ-তিনি দেবী, তিনি মা, তিনি নদীরূপা। সকল দ্যোতনশীল (প্রকাশমান) বস্তুর মধ্যে ইনি শ্রেষ্ঠ, ইনি দিব্য ব্রহ্মজ্যোতিঃ স্বরূপিণী, তাই ইনি দেবীতমা, জ্ঞানরূপ পরম পীযূষদানে আমাদের মতো অবোধ, অজ্ঞান, অসহায় সন্তানকে নিত্য প্রতিপালন করেন, হাত ধরে আমাদিগকে তমসা থেকে আলোকদীপ্ত পথে যেতে শিক্ষা দেন, জননীর (মায়ের) ন্যায় আমাদের মূক (বোকা) কণ্ঠে ভাষা ফুটিয়ে তোলেন তিনিই, তাই তিনি অম্বিতমা বা মাতৃশ্রেষ্ঠা।
সন্তানের প্রতি বিগলিত বাৎসল্যে (মাতৃসুলভ ভালবাসায়) ইনিই পুনরায় জলময়ী এবং ইনিই ভুল সূক্ষ্মাদি সকল নাদের উৎসভূমি রূপে নিত্য নাদময়ী তথা শৃঙ্গার করুণ বীর শান্তাদি নব রসাত্মক বাক্যের ছন্দে ও অলঙ্কারে পরম রসময়ী কাব্য কলনাদিণী, তাই এই রসতমা সরস্বতী নদীতমা বা নদীশ্রেষ্ঠ।

সরস্বতীর বৈশিষ্ট্যসমূহ

পুরাণতন্ত্রানুসারে বর্ণিত ধ্যান মন্ত্রে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য রয়েছে: ১. দেবী শুভ্রবর্ণা, ২. চতুর্ভুজা, ৩. পর্যায়ক্রমে তাঁর হাতে পদ্ম, বীণা, পুস্তক, অক্ষমালা, সুধা কলস ও ব্যাখ্যান মুদ্রা, ৪. দেবী ত্রিনয়না, ৫. তাঁর ললাটে শশীকলা, ৬. তিনি শ্বেত পদ্মাসীনা, ৭. তিনি হংসারূঢ়া, ৮. তিনি সৌভাগ্য ও সম্পদদাত্রী প্রপঞ্চসারতন্ত্রে বাগদেবীর স্তবে দেবী শুভ্রদেহা, পুস্তক, জপমালা, বর ও অভয় মুদ্রা সমন্বিত হস্তা। পুরাণতন্ত্রের বর্ণনায় সরস্বতী চতুর্ভুজা। আধুনিককালে সরস্বতী প্রায় সর্বত্রই দ্বিভুজা। তাঁর হাতে বীণা অপরিহার্য আচার্য যোগেশচন্দ্র রায়ের মতে, “দ্বিভুজা বীণাপাণি সরস্বতী প্রতিমা গত ১৫০ বছরের মধ্যে কল্পিত হয়েছে”।

সরস্বতী দেবীর ভগবদ্বিমুখ
ব্যক্তির কাছে অবস্থান

সরস্বতী দেবী বললেন, যে সমস্ত ব্যক্তি ভগবদ্বিমুখ মানসিকতা নিয়ে থাকবে, তাদের জিহ্বায় আমি নিছক ছায়ারূপে বিরাজ করবো।

সরস্বতীর বাহন কেন শ্বেত হংস?

বাহন দেবতা পরিবহনের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে, তাঁকে বহন করে নিয়ে যায়, তাঁরই বশীভূত থেকে তাঁর আবশ্যকীয় সেবা করে। সুতরাং, প্রত্যেকটি বাহন তার নিজ নিজ দেবতার বিশিষ্টভাবেই ভাবান্বিত, দেবতার শিক্ষাতেই সুশিক্ষিত। সেজন্য কেবল বাইরের দিক থেকে বিচার করলেই চলে না। ভিতরের দিক থেকেও দেবতার সহিত দেবতার বাহনের যৌক্তিকতা ও সহধর্মিতা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর বাহন কেন হংস? প্রথম বিষয় জলে, স্থলে ও অন্তরীক্ষে সর্বত্রই হংসের সমান গতি। চিন্ময়ী বা জ্ঞানময়ী দেবী সরস্বতীর স্থলে, জলে, অনলে, অনিলে সর্বত্রই তাঁর সমান প্রকাশ।
এজন্যই চিন্ময়ী বা জ্ঞানময়ী দেবী সরস্বতীর বাহন হয়েছে ত্রিচর হংস। এমনকি অসীম, মুক্ত নীলাকাশে হংসের আছে একই সময়ে দ্রুতা ও নিশ্চলা গতি।
অর্থাৎ, আকাশমার্গে হংস অত্যন্ত বেগেই উড্ডয়নশীল, কিন্তু নিম্নভূমি থেকে উর্ধ্বে দৃষ্টিপাতে মনে হয়, যেন সে একই স্থানে স্থির ও নিশ্চল হয়ে আছে। হংসের জল ও দুগ্ধকে পৃথক করার ক্ষমতা রয়েছে, অর্থাৎ জল ও দুগ্ধ একত্র মিশ্রিত করে দিলেও হংস শুধু সারভূত দুগ্ধ বা ক্ষীরটুকুই গ্রহণ করে, অসার জলভাগ পড়ে থাকে। এমনকি এ পক্ষীর “পর” ও “পালক” এমন উপাদানে তৈরি এবং এমন সুকৌশলে সন্নিবিষ্ট যে, জলে বিচরণ করা সত্ত্বেও একবিন্দু জলও তার গায়ে লাগে না। তাই এ সমস্ত বৈশিষ্ট্যের কারণে বিদ্যা দেবীর বাহন শ্বেত হংসই যুক্তিযুক্ত।

মাতা সরস্বতীর হস্তে ধারণকৃত
বিষয়সমূহের তাৎপর্য কী?

বীণা বর দণ্ডমণ্ডিত ভুজা বা বীণা হস্তে ধারণকারী বীণা (এক বিশেষ সুরযন্ত্র)। এতে বাজে সঙ্গীত, এতে ধ্বনিত হয় নাদ। সকল সঙ্গীত ও সকল নাদের জননী বাক্‌ দেবতার শ্রীহস্তে নিজের স্বরূপ ও স্বভাবের দ্যোতক কোনো প্রতীক থাকা অবশ্যই বাঞ্ছনীয়। বীণা সেই উদ্দেশ্যেরই পরিপোষকতা করছে। দেবীর ব্রহ্ম বীণায় সাধা রয়েছে চতুর্বেদ। চতুর্বেদ ছন্দোময়ী মূর্ছনা। দেবীর এই বরবীণার দিব্য সংলাপ যা ভগবানের মহিমাকে সতত কীর্তন করে তাঁর সাথে সাধকের জীবনের আচরণ মানের সুর সমন্বয় সাধন করে। ভগবৎ ভাবনা ও ভগবৎ নির্দেশের সেই সুরের সঙ্গে যখন সাধকের জীবনাচরণ মেলে না, তখনই জীবন হয় ছন্দোহীন, এলোমেলো নানা বেসুরের পুঞ্জীভূত আবর্জনা। তখন জীবনকে ভারাক্রান্ত, গন্ধময় ও দুঃখপূর্ণ করে তোলে, অবিদ্যা জীবকে এসে ঘিরে ধরে, জীবনের আলো নিভে যায়, সঙ্গীত স্তব্ধ হয়ে জীব মোহান্ধকারের অতল তলে নিজের সত্যিকারের পরিচয় হারিয়ে ফেলে। দেবী তাঁর বীণার মাধ্যমে ভগবানের নাম কীর্তন করে থাকেন।

পুস্তক ধারণকারী

পুস্তক জ্ঞানের আধার। দেবী যে পুস্তক ধারণ করে আছেন তা ইঙ্গিত করে যথার্থ জ্ঞান একমাত্র বৈদিক শাস্ত্র দান করতে পারে এবং শাস্ত্র ব্যতীত মনোকল্পিত ধ্যান-ধারণা বা অসাধু ব্যাখ্যাকারেরা যে জ্ঞান বিতরণের প্রচেষ্টা করে থাকে তা পরিহার করা উচিত। দেবী সরস্বতী সেই শুদ্ধ জ্ঞানের ধারক ও বাহক। যারা যথার্থ বৈদিক জ্ঞান লাভ করতে আগ্রহী বা বিদ্যার্থী তাদের কর্তব্য হচ্ছে ভগবৎ প্রদত্ত বৈদিক জ্ঞানের অনুসন্ধানে ব্রতী হওয়া এবং মাতা সরস্বতীর কাছে সেই জ্ঞানের জন্য প্রার্থনা জানানো, তাহলে দেবী সরস্বতীর কৃপায় এই জগতের অবিদ্যার অন্ধকারে নিমজ্জমান হয়ে আমরা যারা হাবুডুবু খাচ্ছি, তারা প্রকৃত কৃপায় জ্ঞানালোক প্রাপ্ত হয়ে ভববন্ধন মোচনের অপার কৃপা লাভে সক্ষম হবো। পুস্তক দিব্য জ্ঞান বা বেদকে নির্দেশ করে থাকে।

মালা ধারণকারী

মাতা সরস্বতী যে মালা ধারণ করে আছেন, তা জপমালা। তিনি জপমালা ধারণ করে আছেন এই কারণে যে, যিনি তাঁর জীবনের রহস্য, তাঁর কী ক্ষমতা রয়েছে এবং সেই ক্ষমতার ব্যবহারে কীভাবে লক্ষ্য অর্জন করা যাবে তা জানতে হলে জপমালার মাধ্যমে ভগবানের নাম করতে হবে, তা হলেই অবিদ্যার অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়ে বিদ্যা লাভ সম্ভব হবে। শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থে বলা হয়েছে

সাধ্য সাধন তত্ত্ব যা কিছু সকল।
হরিনাম সংকীর্তনে মিলিবে সকল ॥

কেননা, এই জগতের জীব আমরা জানি না জীবনের লক্ষ্য কী? এই জীবন কেন প্রাপ্ত হয়েছি? আমার স্রষ্টা আমাকে কেন সৃষ্টি করেছেন? কোন্ উদ্দেশ্য নিয়ে আমি সৃষ্টি হয়েছি? নাকি এমনিতেই কোনো উদ্দেশ্যবিহীনভাবে আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে? এইসব বিষয় না জেনে যদি নিজেকে আমি জ্ঞানী বা বিদ্বান ভাবি, তা নিতান্তই হাস্যকর। এমনকি এ জগতে আমাদের চাহিদা বাড়ছে; কিন্তু কোনো চাহিদা পূরণই আমাদের সন্তুষ্ট করছে না। তার মানে আমাদের তৃপ্ত হতে হলেও দেবী সরস্বতী মায়ের প্রদর্শিত পন্থা ভগবৎ নামের আশ্রয় তথা ভগবানের দিব্যনাম জপ করার মাধ্যমে প্রকৃত বিদ্যা আমাদের লাভ হবে।

সরস্বতী দেবীর বিভিন্ন নাম

বৈদিক শাস্ত্রে সরস্বতী দেবীকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়।
১. ব্রাহ্মণী (জ্ঞান বিজ্ঞানের দেবী), ২. বাণী বাচী (বাদ্যগীত এবং বচনের দেবী), ৩. কবি জিহ্বাগ্রবাসিনী (যিনি কবিগণের জিহ্বাগ্রে অবস্থান করেন), ৪. ভারতী (বাগ্মী, মহাবিদ্যা, অপরিসীম জ্ঞান), ৫. বাক্ (বাণী, মহাবাণী, অনুপম বাণী), ৬. আর্যা (মানবী শ্রেষ্ঠা, ব্রাহ্মী, অসীম ক্ষমতাসম্পন্না), ৭. কামধেনু (অলৌকিক গাভী), ৮. বীজগর্ভা (বীজের গর্ভ বা বাণী তত্ত্বের গর্ভ), ৯. ধনেশ্বরী (ধনের দেবী)
১০. বীণাপাণি (বীণা যিনি হাত বা পাণিতে ধারণ করেন), ১১. সারদা (সৌভাগ্যদায়িনী), ১২. বাগেশ্বরী (বাচনের দেবী), ১৩. ব্রাহ্মী (ব্রহ্মা থেকে এসেছেন বলে), সূত্র: দেবী সরস্বতী;


 

চৈতন্য সন্দেশ ফেব্রুয়ারী -২০২২ প্রকাশিত
সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।