এই পোস্টটি 35 বার দেখা হয়েছে
বিশ্বে যে কয়টি প্রতীক খুবই জনপ্রিয় সেগুলোর মধ্যে ‘স্বস্তিকা’ নামক চিহ্নটি অন্যতম। এটি এতটাই জনপ্রিয় যে, বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। অনেকেই হয়ত চিহ্নটির সঙ্গে পরিচিত, বিশেষত ভারতবর্ষে এর ব্যবহার লক্ষ্য করার মত। মহাভারতে এই পবিত্র চিহ্নের কথা উল্লেখ রয়েছে। বিশ্বনাথ চত্রবর্তী ঠাকুরের রূপ চিত্রামনি গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, “আমি ভগবান শ্রী হরির বন্দনা করি যার পাদপদ্মে ১৯ টি মহা ঐশ্বর্য বিদ্যমান, যার ডান পাদপদ্মে আট দিক বিশিষ্ট তারকা, স্বস্তিকা, চক্র, ধ্বজ, ছত্র, যব, পদ্ম রেখা, জাম্বু ফল, বজ্র, হস্তী-অঙ্কুশ।” অর্থাৎ স্বস্তিকা’ একটি অতি পবিত্র চিহ্ন যা ভগবানের পাদপদ্মে নিত্য বিরাজমান। সংস্কৃতি শব্দ ‘স্বস্তিকা’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ ‘শুভ লক্ষণ’ অথবা ভাগ্য। গনেশ এবং ওঁম এর সঙ্গেও এই স্বস্তিকা’ সম্পর্কিত। শুধুই যে সনাতন ধর্মে এই চিহ্নের ব্যবহার হয় তাই নয় বৌদ্ধ ধর্মে , জৈন ধর্মে গৌতম বুদ্ধের বুকে এই চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। আবার জৈন ধর্মে সাত আহাত বা ঋষির জন্য প্রতীক হিসেবে এই চিহ্ন ব্যবহার করা হয় ভগবান কৃষ্ণের অবতার ভগবান ঋষবদেবের জন্যও এ চিহ্ন ব্যবহার করা হয়।
এর উৎস সনাতন ধর্মে হলেও বিশ্বে এর ব্যবহার খুবই জনপ্রিয়তা পায়। জনপ্রিয়তা বলতে, যেহেতু এটি শুভলক্ষণের প্রতীক তাই লোকেরা গৃহস্থালীর বিভিন্ন পবিত্র জিনিসের সঙ্গে সঙ্গে সরকারী উচ্চবিভাগে যথার্থ শ্রদ্ধা সহকারে এটি ব্যবহার করে আসছে। ইউরোপ, আফ্রিকাসহ সারাবিশ্বে এর প্রচলন খুবই প্রাচীন।
তবে এই মাঙ্গলিক চিহ্ন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে শুধুমাত্র জার্মানিতেই। কেননা নাৎসি জার্মান বাহিনীর হয়ে হিটলার এটিকে ব্যবহার করত অপরাধীদের জন্য। তিনি এটি ব্যবহার করে হাজার হাজার নিরীহ লোককে হত্যা করে। ফলে শুধুমাত্র হিটলারের মাধ্যমেই এর অপব্যবহার ঘটে। যদিও বর্তমানে আপনি যদি জার্মানিতে যান তবে এ স্বস্তিকা চিহ্ন ব্যবহার করলে আপনাকে জেলে প্রেরণ করা হতে পারে। সে যাই হোক অত্যন্ত পবিত্র জিনিসের অপব্যবহার নিশ্চিতভাবে দুঃখজনক এ জন্যে অবশ্য আন্দোলনও হয়েছে। জার্মানরাই এর সঠিক ব্যবহারের গুরুত্ব উপলব্ধি করছে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।
বিস্ময়করভাবে এই চিহ্নের ব্যবহার খ্রিষ্টান ধর্মেও লক্ষ্য করা যায়। রোমানস্কিউতে এবং গোথিকে যেসব চার্চ তৈরি করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ এই চিহ্ন দ্বারা সুসজ্জিত।
তাছাড়া ইউক্রেনের সেন্ট সোফিরা চার্চে মিলানের সেন্ট অ্যামক্রেমের গম্বুজে এর ব্যবহার দেখা যায়।
গুগল আর্থে গিয়ে পর্যবেক্ষণের সময় ২০০৮ – সালে ইসরাইলি আমেরিকান গবেষক – আব্রাহাম সেগল ক্যালোফোর্নিয়াতে অবস্থিত ইউ এস নেভি সেনানিবাসের বিল্ডিং কাঠামো দেখতে পান যেটির নকশা সম্পূর্ণ ‘স্বস্তিকা’ চিহ্নের আঙ্গিকে তৈরি। ইউ. এস সেনাবাহিনীরাও এই চিহ্নকে গ্রহণ করেছে সফলতা ও শুভ লক্ষণের প্রতীক হিসেবে যেটি দেখা যায় আমেরিকায় বয় স্কাউট বইয়েও। হকি, বাস্কেট দলের বিভিন্ন লোগো হিসেবে কিংক অফিসিয়াল জার্সিতে এমনকি কোকাকোলার লোগো পর্যন্ত তৈরি হয়েছিল স্বস্তিকা আকৃতিতে।
সারাবিশ্বে স্বস্তিকা চিহ্নের ব্যবহারের একটি ক্ষুদ্র উল্লেখযোগ্য ব্যবহার তুলে ধরা হল।
বয় স্কাউট গুড লাক, কয়েন, আমেরিকান ইন্ডিয়ান কম্বলে, ইউ.এস সেনাবাহিনীর বিমানে, আরিজোনা রোেড মাইনে, সৈনিকদের বেষ্ঠ উইশেস এবং গুড লাক কার্ডে, সদ্য জন্ম নেয়া নবজাত শিশুর জন্য, ঔষুধ, নিউ ম্যাক্সিমকোর, স্বস্তিকা হোটেলে, ফার্স্ট মিলেনিয়াম ইরানিয়ান স্বস্তিকা জুয়েলারীতে, ইন্দাস ভ্যােল স্বস্তিকা সীলে, সামুরাই স্বস্তিকা পতাকা, রোমান মোজাইক স্বস্তিকা, গ্রীক স্বস্তিকা, আরো অনেক ক্ষেত্রে এর ব্যবহার রয়েছে যা পূর্ণাঙ্গভাবে তুলে ধরলে বিশাল একটি তালিকাতে পরিণত হবে। ১৯ শতকে স্বস্তিকা ছিল রাশিয়ান সাম্রাজ্যের প্রতীক। এমনকি রাশিয়ান কয়েনের উপর ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে স্বস্তিকার ব্যবহৃত হত।
১৯০১ সালে কোপেনহেগেনে কোম্পানির হেডকোয়ার্টারগুলোর প্রবেশ দ্বারে হাতির উপর স্বস্তিকা চিহ্ন খোদাই করা হয় যা আজও দেখতে পাওয়া যায়।
ফিনল্যান্ডের এয়ার ফোর্সগুলোতেও ১৯১৮ সাল থেকে স্বস্তিকার ব্যবহার শুরু হয়েছিল। এমনকি ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্টরা যে পোশাক পরে সেখানেও একটি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন হিসেবে এটি ব্যবহার করা হয়। জাপান সহ কোরিয়ার মানচিত্রে মন্দির সনাক্তকরনের ক্ষেত্রে এই চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। পূর্বে জার্মান নাৎসি বাহিনীর পতাকায়, ব্যাচ আর্ম ব্যান্ডেও এটি ব্যবহৃত হত।
এভাবে একদিকে যেমন বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের অধিবাসীরা এ চিহ্নকে সর্ব সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে এবং অন্যদিকে কলঙ্কৃত এডলফ হিটলার এই পবিত্র চিহ্নকে করেছে অপব্যবহার। সে যাই হোক বৈদিক শাস্ত্রসহ বিভিন্ন ধর্মে এই চিহ্ন একটি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে কতিপয় লোক এর অপব্যবহার করলেও বিশ্বের কাছে এ চিহ্ন এখনও চির মহিমান্বিত।
এক্ষেত্রে ‘স্বস্তিকা’ নিয়ে এ প্রতিবেদন লেখার একমাত্র উদ্দেশ্য হল কিভাবে হাজার হাজার বছরেরও পুরাতন বৈদিক সংস্কৃতি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর অর্থ দাঁড়ায়, সনাতন ধর্ম কোন মনগড়া ধর্ম নয় বৈদিক শাস্ত্রও নয় বরঞ্চ এটি চিরসত্য এবং প্রামাণিক। উপরের আলোচনা থেকে আরেকটি বিষয় ফুটে উঠেছে তা হল পূর্বে একসময় বৈদিক শাস্ত্র অনুযায়ী এই পৃথিবী সনাতনি সংস্কৃতি বিরাজমান ছিল। যার প্রমাণ ব্রোঞ্জ যুগেরও পূর্বে এবং আরিয়্যান সভ্যতায় স্বস্তিকার ব্যবহার। সুতরাং বৈদিক শাস্ত্রের প্রামাণিকতা অবিশ্বাস করার কোন উপায় নেই।
হরে কৃষ্ণ।
মাসিক চৈতন্য সন্দেশ , নভেম্বর – ২০১০ ইং