এই পোস্টটি 13 বার দেখা হয়েছে
শরতের স্নিগ্ধ প্রকৃতি অত্যন্ত মনোরম রূপ পরিগ্রহ করে। শরতের প্রকৃতিকে আরো রাঙ্গিয়ে তুলে দুর্গরূপ এই জগতের নিয়ন্ত্রক দেবী দুর্গার পূজা উৎসবে। আপন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অনুসারে বাঙালী মেতে ওঠে শারদ উৎসবে।
লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অনন্ত শক্তি- পরাস্য শক্তিবিবিধৈব শ্রুয়তে। তাঁর অনন্ত শক্তির মধ্যে চিৎ-শক্তি, জীবশক্তি ও মায়াশক্তি প্রধান। চিৎশক্তি ও জীবশক্তি উৎকৃষ্টা, কিন্তু মায়াশক্তি নিকৃষ্টা। এই মায়াশক্তির প্রতিমূর্তি হচ্ছেন দুর্গাদেবী। ব্রহ্মসংহিতায় (৫/৪৪) বলা হয়েছে-
সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়সাধনশক্তিরেকা
ছায়েব যস্য ভুবনানি বিভর্তি দুর্গা।
ইচ্ছানুরূপমপি যস্য চ চেষ্টতে সা
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি।
“স্বরূপশক্তি বা চিৎশক্তির ছায়াস্বরূপা প্রাপঞ্চিক জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় সাধনকারিনী মায়াশক্তিই ভুবন পুজিতা দুর্গা। তিনি যার ইচ্ছা অনুসারে চেষ্টা করেন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।”
দুর্গাপুজার উৎপত্তিঃ
যশোদার কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করা, দেবকীর গর্ভস্থ অনন্তদেবকে আকর্ষণ করে রোহিনীতে স্থাপন করা, কংসকে বিভ্রান্ত করা, এ সমস্তই ভগবানের নির্দেশে দেবী দুর্গা সম্পাদন করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। ভগবতী দুর্গাকে আশীর্বাদ করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বলেছিলেন, “জগতের ভোগাকাঙ্ক্ষী মানুষদের জড়বাসনা পূর্ণ করতে তোমার ক্ষমতা সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মানুষেরা পশুবলি দিয়ে এবং বিভিন্ন রকমের উপকরণ দিয়ে মহাসমারোহে তোমার পূজা করবে। পৃথিবীতে বিভিন্ন স্থানে লোকেরা তোমার দুর্গা, ভদ্রকালী, বিজয়া, বৈষ্ণবী, কুমুদা, চণ্ডিকা, কৃষ্ণা, মাধবী, কন্যকা, মায়াম, নারায়ণী, ঈষানী, শারদা, অম্বিকা প্রভৃতি নামকরণ করবে।” (শ্রীমদ্ভাগবত ১০/২/১০-১২) এভাবে মূলত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপায়, জগতে মহামায়ার পূজার প্রচলন হয়। লোকমুখে কিছু বিভ্রান্তি সম্পর্কে আলোকপাত করা হল:
কৃষ্ণ কালি আর কালি কৃষ্ণঃ
একবার বংশীবটে রাধারাণী ও শ্রীকৃষ্ণ যখন তাঁদের আনন্দপূর্ণ লীলাবিলাস করছিলেন, তখন কুটিলা কুঞ্জে উপস্থিত হয়ে চুপিসারে রাধাকৃষ্ণকে অবলোকন করলেন। কুটিলা সবসময় রাধারাণীর দোষত্রুটি বের করতে উৎসুক ছিলেন। এরপর দ্রুতপায়ে কুটিলা গোচারণভূমির দিকে চলল, সেখানে অভিমন্যুর দেখা পেলেন। অভিমন্যু সব শুনে অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে কুঞ্জের দিকে চলল। কুঞ্জের দ্বাররক্ষক বৃন্দাদেবী একথা রাধারাণীকে জানালেন। রাধারাণী তখন কৃষ্ণকে বললেন, হে প্রাণনাথ। দেখ, কুটিলা ও আমার স্বামী উভয়ে এই কুঞ্জের দিকে আসছে।…. আমি এখন কোথায় যাব? আমি তোমার পাদপদ্ম স্মরণ করতে করতে দেহত্যাগ করব। আমি তোমার পাদপদ্মে আশ্রয় গ্রহণ করছি।” কৃষ্ণ রাধারাণীকে শান্ত করে বললেন, “উদ্বিগ্ন হয়ো না, তুমি কি কখনো শুনেছ যে কৃষ্ণচরণ অনুধ্যান করায় কারও অকালমৃত্যু হয়েছে? অভিমন্যু কালীভক্ত, আমি এখনই কালীরূপ ধারণ করব. তুমি আমার পূজা করার ভান কর।” কৃষ্ণ তখন নিজ-রূপ পরিবর্তন করে চতুর্ভুজ শ্যামকালীর রূপ ধারণ করলেন। যখন অভিমন্যু কুঞ্জে এসে দেবীকালীকে ও সেবারত রাধাকে দেখলেন, তখন তিনি অত্যন্ত প্রীত হয়ে কুটিলাকে ভৎর্সনা করলেন অহেতুক সন্দেহ করার জন্য। তাঁরা চলে গেলে কৃষ্ণ পুনরায় নিজরূপ ধারণ করলেন। আর একবার অভিমন্যুকে ফাঁকি দেয়ার জন্য কৃষ্ণ দুর্গারূপ ধারণ করেছিলেন।
এই দিব্য লীলা স্মরণ করে অনেকেই বলে থাকেন যে, যেই কালী সেই কৃষ্ণ, দু’জনই এক। কিন্তু এ সিদ্ধান্তটি ঠিক নয়। দুধ যেমন দই এ রূপান্তরিত হতে পারে কিন্তু দই আর দুধ হতে পারে না। তেমনি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কালী তথা যেকোন দেবদেবীর রূপ পরিগ্রহ করতে পারলেও ভগবতী কালী কৃষ্ণ হতে পারেন না। পরম বৈষ্ণবী কালী কৃষ্ণের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। অতএব, কালীরূপ ধারণ করে ভগবান যেমনী অভিমন্যু ও কুটিলাকে ঠকিয়েছিলেন তেমনী যারা কৃষ্ণ কালী একই মতবাদ পোষণ করেন তাদেরকে চিরদিন এভাবেই ঠকতে হবে।
রামচন্দ্র কি দূর্গাপূজা করেছিলেন?
বাল্মিকী রচিত মূল রামায়ণে কোথাও শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গাপূজার কথা উল্লেখ নেই। পঞ্চদশ শতাব্দীতে রাজশাহী জেলার তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণের সভাকবি ছিলেন কৃত্তিবাস ওঝা। তিনিই বাংলা পয়ারে রামায়নের অল্পকিছু বর্ণনা দিয়েই তাতে দুর্গাপূজা বিষয়টি যুক্ত করে দিয়েছেন। অর্থাৎ যে স্থানে যে দেব দেবীর পূজা বেশি প্রচলিত সেই স্থানের সেই রামায়ণে ভগবান রামকে দিয়ে সেই দেব দেবীর কাল্পনিক পূজা করাচ্ছেন সভাকবি তথা ভণ্ড রামায়ণ লেখকগণ। ঠিক যেমন মুম্বাইয়ে প্রচলিত হিন্দি রামায়ণে রামচন্দ্র কর্তৃক গণেশ পূজার উল্লেখ আছে।
বৃন্দাবনে গোপীদের কাত্যায়নী পূজা:
বৃন্দাবনের গোপীরা কাত্যয়নী পূজা করেছিলেন শুধুমাত্র ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে লাভ করার উদ্দেশ্য, কোন জাগতিক কামনা বাসনা চরিতার্থ করার জন্য নয়। তাই আমাদের উচিত শুধুমাত্র কৃষ্ণভক্তি লাভের উদ্দেশ্য দুর্গাপূজা করা।
দুর্গাদেবী কৃষ্ণবিদ্বেষীদের শত্রু:
পরম কৃষ্ণ তথা বিষ্ণুভক্ত হওয়ার কারণে দুর্গাদেবী আর এক নাম দেবী বৈষ্ণবী। দেবীর একমাত্র অভিলাষ হচ্ছে তার সন্তান জীবগন যাতে কৃষ্ণভক্তি অনুশীলন করে দুঃখময় এই জড় জগত অতিক্রম করে ভগবদ্ধামে ফিরে যেতে পারে। তাই তিনি বহু সাধকগণকে কৃষ্ণভজনের নির্দেশ দিয়েছিলেন যেমন তুলসীদাস। এছাড়া দেবী কৃষ্ণভক্তকে রক্ষার জন্য নিজভক্তকে নিধন করেছিলেন। শ্রীমদ্ভাগবতে এই ঘটনার উল্লেখ আছে। দেবী কৃষ্ণভক্ত ভরত মহারাজকে রক্ষার জন্য জন্য বিগ্রহ ফেটে বের হয়ে অসুর নিধন করেছিলেন।
শ্রীদুর্গাদেবী সর্বক্ষণ কৃষ্ণনাম করেন:
প্রাচীন শাস্ত্র ‘শ্রীনারদপঞ্চরাত্রম্‘ গ্রন্থে শ্রীমহাদেব নারদমুনিকে বলছেন-
পঞ্চবক্রেণ সততং তন্নামগুণকীর্তনম্ ॥
করোমি ভার্যয়া সার্ধং পুত্রাভ্যাঞ্চাপি নারদ।
তদ্দিনং দুর্দিনং মন্যে মেঘাচ্ছন্নং ন দুর্দিনম্ ॥
যদ্দিনং কৃষ্ণসংাপকথাপীযূষবর্জিতম্।
তং ক্ষণং নিস্ফলং মন্যে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনং বিনা ॥
“হে নারদ! আমি, পার্বতী, কার্তিক ও গণেশের সঙ্গে সর্বদা কৃষ্ণনাম কীর্তন করি। মেঘাচ্ছন্ন দিনকে আমি দুর্দিন বলে মনে করি না। যেদিন কৃষ্ণকথা হয় না, আমি সেই দিনকে দুর্দিন বলে থাকি। যেই মুহূর্তটি কৃষ্ণনাম বা কৃষ্ণকথা ছাড়া অতিবাহিত হয় সেই মুহূর্তটি বৃথা গেল বলে মনে করি।”
সাধারণত মানুষেরা দুর্গাপুজা করে থাকেন ধন- ঐশ্বর্য, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা প্রাপ্তি, নীরোগ দেহ, ভাল চাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি লাভের জন্য। যদিও দুর্গাদেবী মায়াগ্রস্থ জীবদের এই সমস্ত জড় বাসনা খুব সহজেই পূরণ করে থাকেন, কিন্তু সেটি দুর্গাদেবীর কপট কৃপা। তিনি সহজেই এই জড় জগতের বন্ধনদশা থেকে মুক্তি দান করেন না। কোনও ভাগ্যক্রমে কৃষ্ণভক্ত সাধুসঙ্গের কৃপা বলে জীব যখন কৃষ্ণোন্মুখ হয়, অর্থাৎ ভগবৎ-ভক্তি পরায়ণ হয়, তখন দুর্গাদেবী তাকে এই জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত করে দেন, তখন সে চিন্ময় জগতে প্রবেশের অধিকার লাভ করে। এভাবেই দুর্গাদেবী শোধন-প্রণালীর মাধ্যমে বদ্ধ জীবদের কামনা-বাসনার বন্ধন থেকে মুক্তি দান করে ভগবৎধামে যাওয়ার রাস্তা উন্মুক্ত করে দেন, সেটি দুর্গাদেবীর যথার্থ কৃপা।
হরে কৃষ্ণ।
মাসিক চৈতন্য সন্দেশ, অক্টোবর – ২০১০ ইং