এই পোস্টটি 187 বার দেখা হয়েছে
পুরুষোত্তম নিতাই দাস
চণ্ডীদাস দেবী দুর্গার একজন সাধক ও পুজারী ছিলেন, তার ভাই একজন শুদ্ধ বৈষ্ণব ছিলেন এবং তিনি শালগ্রাম পুজা করতেন। চণ্ডীদাস ধনী ব্যক্তি ছিলেন কিন্তু তার ভাই ছিলেন দরিদ্র। চণ্ডীদাসের একটি বৃহৎ ও চমৎকার বাগান ছিল এবং তিনি সেই বাগানের ফুল দেবী দুর্গাকে অর্পণ করতেন। তার ভাইও তার পুজিত শালগ্রামকে সুন্দর পুষ্প নিবেদন করার অভিলাষ করতেন। একদিন তিনি মানসিকভাবে সেই বাগানের একটি সুন্দর রঙিন পুষ্প তার শালগ্রামকে নিবেদন করলেন। ঘটনাচক্রে এ দিনই চণ্ডীদাস একই পুষ্প দেবী দুর্গাকে নিবেদন করলেন। যেই মুহূর্তে ঐ পুষ্পটি নিবেদিত হলো তৎক্ষণাৎ দুর্গাদেবী চণ্ডীদাসের সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে বললেন- “আমি তোমার প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছি, চণ্ডীদাস তুমি কি বর চাও?” চণ্ডীদাস বিস্মিত হয়ে বলেন, ‘আমি প্রতিদিন তোমার অর্চনা করি কিন্তু আজ আমার ওপর এত সন্তুষ্ট কেন? দেবী দুর্গা বলেন, “তুমি আমাকে যে পুষ্পটি নিবেদন করেছ সেটি পূর্বেই শালগ্রামকে নিবেদিত হওয়ায় সেটি ভগবানের মহাপ্রসাদ হল। এই প্রসাদী পুষ্পটি দেখে আমি অত্যন্ত প্রীত হয়েছি তাই আমি তোমার সম্মুখে আবির্ভূত হয়েছি।”
চণ্ডীদাস তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করলেন,‘তার অর্থ কি এই যে, কেউ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অর্চনা করলেই আপনি সন্তুষ্ট হও?’ দেবী দুর্গা অত্যন্ত সহানুভূতিশীল কণ্ঠে বললেন, ‘হ্যাঁ, পরমেশ্বর ভগবান হলেন সর্বকারণের কারণ এবং তিনিই প্রকৃতপক্ষে সকল সৃষ্টির উৎস। কেউ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অর্চনা করলেই আমি অত্যন্ত প্রীত হই। যদি তুমি আমাকে সন্তুষ্ট করতে চাও তাহলে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অর্চনা কর।’ চণ্ডীদাস পরম সত্যটি উপলব্ধি করে শ্রীকৃষ্ণের এক পরম ভক্তে পরিণত হলেন এবং এটি ভগবান শিবের পত্নী দেবী দুর্গাকে অত্যন্ত প্রীত করেছিল। পরবর্তীকালে চণ্ডীদাস শ্রীমতি রাধারাণী এবং শ্রীকৃষ্ণের বিরহের চিন্ময় ভাবের ওপর অসংখ্য গীত রচনা করেছিলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু চণ্ডীদাসের রচিত গীত শ্রবণ করে অত্যন্ত আনন্দ লাভ করতেন।
দেবী দুর্গা কে?
ব্রহ্মসংহিতার (৫/৪৪) ব্যাখ্যা করছে, ভগবানের বহিরঙ্গা শক্তি মায়া যিনি কিনা চিৎশক্তির ছায়া-প্রকৃতি, তাঁকেই মানুষ দুর্গারূপে পূজা করে। তিনি এই পার্থিব জগতের সৃষ্টি, পালন এবং ধ্বংসের তত্ত্বাবধান করেন।‘ সমগ্র বিশে^র অধীশ্বরী দেবী এই দুর্গা। তিনি দশভূজারূপে দশ প্রকারের ফল প্রদান করেন। তিনি সিংহের ওপর আরোহণ করে তাঁর মহাশক্তির প্রদর্শন করেন। তিনি মহিষাসুরকে পদদলিত করেন যে মহিষাসুর সমস্ত পাপকার্যের প্রতিনিধি ছিল। তিনি কার্তিকেয় এবং গণেশ নামে দুই পুত্রের জননী, যারা যথাক্রমে সৌন্দর্য এবং সাফল্যকে সূচিত করে। তিনি লক্ষ্মী এবং সরস্বতীর মধ্যে অবস্থান করেন যাঁরা পার্থিব ঐশ্বর্য এবং পার্থিব জ্ঞানের প্রতীক। তিনি কুড়ি প্রকার অস্ত্রে সুসজ্জিত। এই অস্ত্রগুলি বেদে বর্ণিত পাপ দমনকারী বিভিন্ন পুণ্য কর্মকে সূচিত করে। তিনি হস্তে সর্প ধারণ করেন যেটি ধ্বংসের সৌন্দর্যকে সূচিত করে।
যতক্ষণ আমরা এই পার্থিব জগতে অবস্থান করি আমরা কারাগারেই অবস্থান করছি এবং এই কারাগারের কর্ত্রী হলেন দুর্গাদেবী। বন্দীদেরকে যেমন বিশেষ পোশাক দেওয়া হয়, অনুরূপভাবে আমাদেরও একটি পোশাক দেওয়া হয়েছে। মানবদেহ রূপী পোশাক, পশুরূপী পোশাক, বৃক্ষরূপী পোশাক ইত্যাদি। যতক্ষণ আমরা এই দেহে এই জড়জগতে বাস করব আমরা দুর্গাদেবীর নিয়ন্ত্রণাধীন। আমাদের বুঝতে হবে যে, দুর্গাদেবী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ অনুসারে কার্য করেন। সুতরাং তিনি স্বাধীন এবং পরম নিয়ন্তা নন, তিনি শুধু পরমেশ্বর ভগবানের আদেশ অনুযায়ী কার্য করছেন যেমনভাবে ছায়া কোন বস্তুকে অনুসরণ করে।
কেন দুর্গাদেবী জীবকে শাস্তি প্রদান করেন ?
যখন জীব শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তার নিত্য সম্বন্ধ বিস্মৃত হয় সে তখন দুর্গাদেবীর রাজ্যে নিক্ষিপ্ত হয় এবং বিদ্রোহী জীবদের শাস্তি প্রদানের যন্ত্র স্বরূপ কর্মবন্ধনকে ব্যবহার করা হয়। দুর্গাদেবীর কাজই হলো সমস্ত বিদ্রোহী জীবকুলকে শাস্তি প্রদান করা। এটি প্রকৃতপক্ষে শাস্তি নয়। এটি রূপান্তরকরণের মাধ্যম মাত্র। এই জড় জগতেও যখন কেউ কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয় তখন তা সত্যিকারে শাস্তির জন্য নয় তা রূপান্তরের জন্য। তাই দেবী দুর্গার কাছে ত্রিশূল আছে। ত্রিশূল জড়জাগতিক ত্রিতাপ ক্লেশকে প্রকাশ করে – আধ্যাত্মিক ক্লেশ (আমাদের শরীর এবং মনের ক্লেশ), আধি ভৌতিক ক্লেশ (অন্য জীব দ্বারা প্রাপ্ত ক্লেশ) এবং আধিদৈবিক ক্লেশ (প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে প্রাপ্ত ক্লেশ)। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে প্রত্যেকেই এই তিন প্রকারের ক্লেশের কোন না কোন একটিতে পীড়িত হচ্ছে। সুতরাং এই ক্লেশ আর কিছুই নয়, এটি দেবী দুর্গার ত্রিশূল। তিনি প্রতিনিয়ত তাঁর ত্রিশূল দিয়ে জীবকে বিদ্ধ করে চলেছেন। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবকুলকে সচেতন করা, শাস্তি প্রদান করা নয়।
‘কেন আমি এই জড় জগতে এত কষ্ট পাচ্ছি ? কেন আমি গর্ভে নয় মাস উপুড় হয়ে ছিলাম যেখানে অন্ধকারে কৃমি কীটেরা প্রতিমুহূর্তে আমাকে দংশন করত। জন্মগ্রহণের পরে কেন আমি পুনরায় জরা ও ব্যাধি দ্বারা তাড়িত হব এবং পরিশেষে মৃত্যু এসে আমার সব নিয়ে নেবে’। জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলির উপরেই সদাসর্বদা চিন্তা-ভাবনা করা উচিত এবং দেবী দুর্গা বারবার চেষ্টা করেন আমাদেরকে বোঝাতে যে, কারাগার রূপী এই পৃথিবী দুঃখে পরিপূর্ণ, দুঃখালয়ম (গীতা ৮/১৫)।
এই কারণেই শাস্ত্র সমূহ এবং ভগবানের শুদ্ধ ভক্তরা ক্রমান্বয়ে আমাদের স্মরণ করাতে থাকেন যে, এই পৃথিবীর অনিত্য আনন্দের পিছনে আমাদের কখনোই ছোটা উচিত নয় বরং এই কারাগার থেকে মুক্তির জন্য আমাদের কঠোর প্রচেষ্টা করা উচিত এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ধামে ফিরে যাওয়া উচিত।
দুর্গাদেবীকে সন্তুষ্ট করার সর্বোত্তম উপায়
দুর্গা হলেন পরমেশ্বর ভগবানের শক্তি। তাঁকে পরাজিত অথবা বিভ্রান্ত করা যায় না। তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং যখন তিনি তাঁর ত্রিশূল দিয়ে আঘাত হানেন তখন কোন কিছুই আমাদের রক্ষা করতে পারে না। দুর্গাদেবী আমাদের পার্থিব বর প্রদান করতে পারেন কিন্তু তাঁর সঙ্গে আছে শক্তিশালী ত্রিশূল এবং আমরা এই পৃথিবীতে যন্ত্রণা ভোগ করি।
দুর্গাদেবীর শক্তিশালী ত্রিশূলের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রেমময় ভক্তিযোগ অভ্যাস করা। যখন আমরা দিব্যনাম জপ করে হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আশ্রয় নিই তখন দেবী দুর্গা তাঁর ত্রিশূল প্রত্যাহার করেন। আমাদের শরীরে যে সমস্ত দেবদেবী অবস্থান করেন তাঁরা আমাদের দেহের বিভিন্ন কার্য নিয়ন্ত্রণ করেন। কিন্তু যখন দেবীদুর্গা দেখেন যে, আমরা কৃষ্ণভাবনামৃতে অগ্রসর হচ্ছি তিনি তখন সেই সমস্ত দেবদেবীদের আদেশ করেন আমাদের রাস্তা পরিষ্কার করতে যাতে করে আমরা এই জড় জগত অতিক্রম করে চিন্ময় জগতে ফিরে যেতে পারি। তিনি আমাদেরকে এই জড় জগতে চিরকালের জন্য রাখতে চান না। তিনি ভগবানের প্রতি আমাদের আত্মনিবেদন এর পরীক্ষা গ্রহণ করেন এবং যখন দেখেন যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রেমভক্তিতে আমাদের হৃদয় পরিপূর্ণ হয়েছে, তিনি তৎক্ষণাৎ আমাদেরকে এই কারাগার থেকে মুক্তি প্রদান করেন। এটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, কলিযুগে পরমেশ্বর ভগবান তাঁর সমগ্র শক্তি এবং সমগ্র ঐশ্বর্য সমন্বিত হয়ে তাঁর দিব্য নাম রূপে অবতীর্ণ হয়েছেন,‘কলিকালে নামরূপে কৃষ্ণ অবতার’। তাই কৃষ্ণের দিব্য নামকে ভগবান কৃষ্ণরূপে অনুভব করা উচিত এবং শ্রদ্ধা-ভক্তির সঙ্গে তাঁর দিব্য নাম হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে জপ করা উচিত। দুর্গাদেবী মায়ারূপে হরিদাস ঠাকুরের কৃষ্ণভক্তির পরীক্ষা নিয়েছিলেন। হরিদাস ঠাকুর অবলীলাক্রমে সেই পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হন, কারণ তিনি পরিপূর্ণভাবে “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে” মহামন্ত্র জপে নিমগ্ন হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, প্রত্যহ তিনি তিন লক্ষ বার মহামন্ত্র জপ করবেন।
দুর্গাপুজো-সিনেমার গান বাজানো বা তার সঙ্গে নৃত্য করা নয়। এটি সুস্বাদু খাবার খাওয়া বা মজা করাও নয়। এটি উদ্যাপনের প্রকৃষ্ট পন্থা হলো এটি জানা যে, দেবীদুর্গা কে এবং তিনি কিসে খুশী হন। তাঁকে সন্তুষ্ট করার সর্বোত্তম উপায় হলো চণ্ডীদাসের পদাঙ্ক অনুসরণ করা।
লেখক পরিচিতি: পুরুষোত্তম নিতাই দাস ইস্কন কোলকাতার ভক্তিবৃক্ষের একজন সদস্য। বর্তমানে তিনি টেক মহিন্দ্রায় কর্মরত।