এই পোস্টটি 28 বার দেখা হয়েছে
শ্রীমৎ রাধানাথ স্বামী মহারাজ
আজ সমগ্র ভারতে দীপাবলী উৎসব উদ্যাপিত হচ্ছে; অনেকের কাছে এটা নতুন বৎসর। সেই জন্যে অনেক উৎসব হচ্ছে। অনেকের কাছে দীপাবলী হল সেই সময়, যখন প্রচুর বাজী পোড়ানো হয়, যার ফলে বাতাসে প্রচুর শব্দ এবং ধোঁয়া উৎপন্ন হয়। জগতের প্রকৃতিই এই যে, অত্যন্ত পবিত্র কোন কিছুকে সম্পূর্ণ পার্থিব বস্তুতে পরিণত করা। আমরা যা বলছিলাম, এই জগত হল আমাদের চেতনার প্রতিফলন। এই চেতনা হল অ্যান্টেনার মতো, আমরা যেখানে যুক্ত থাকি সেখান থেকেই শক্তি সংগ্রহ করি।
সৎসঙ্গ কি?
যখন আমরা সাধুপুরুষের সঙ্গ করি অর্থাৎ সৎসঙ্গ, যেখানে আমরা চিন্ময় শব্দ মূর্ছনা শুনি, হরি কথা বা কীর্তন, ভগবৎ নামের মূর্ছনা, আমরা তখন ভগবানের দিব্য মহিমার চিন্ময় দিব্য শক্তির সঙ্গে যুক্ত হই, এই সৃষ্টিতে এবং সৃষ্টির উর্ধ্বে।
গোলোকের প্রেমধন হরিনাম সংকীর্তন
ভগবানের নাম আধ্যাত্মিক জগতের সর্বোচ্চ গ্রহ গোলোক থেকে নেমে এসেছে। একই সঙ্গে সেখানে এবং এখানে সর্বদা বর্তমান। সুতরাং বিনীত এবং অকপট চিত্তে যখন আমরা পবিত্র নামের সঙ্গে যুক্ত হই, প্রকৃতপক্ষে আমাদের হৃদয়ে আধ্যাত্মিক জগতের মহিমা আস্বাদন করি।
মহৎসেবাং দ্বারমাহুর্বিমুক্তে স্তমোদ্বারং যোষিতাং সঙ্গিসঙ্গম্
ভগবান ঋষভদেব শ্রীমদ্ভাগবতমে বলেছেন যে, আমরা যখন সাধুসঙ্গ করি তখন আমরাও সাধু হয়ে যাই। আমাদের জীবনের মুক্তির দ্বার অন্তর থেকে উন্মুক্ত হয়ে যায়। যখন আমরা লোভ, অহঙ্কার, স্বার্থপরতা, ঈর্ষা, ক্রোধ, মোহ দ্বারা আবদ্ধ লোকের সঙ্গ করি তখন সূক্ষ্মভাবে হলেও হৃদয়ের অন্তস্থলে এগুলির দ্বারা আমরা প্রভাবিত হই। আমাদের চিন্তায়, আমাদের বক্তব্যে এবং আমাদের কাজে এগুলি প্রস্ফুটিত হয়। সঙ্গ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সঙ্গের প্রভাবে আমরা শুধুমাত্র ধনাত্মক এবং ঋণাত্মকভাবে রূপান্তরিতই হই না, অ্যান্টেনারের মতো আমরা আমাদের চেতনা যেমনই হোক না কেন তা তাতে প্রেরণ করি। প্রকৃতির তিনটি গুণ আছে: সত্ত্বগুণ, রজোগুণ এবং তমোগুণ। এই গুণ অনুসারে আমরা সঙ্গ নির্বাচন করি, আমরা সেইমতো প্রভাবিত ও রূপান্তরিত হই এবং তারপর সেই শক্তি প্রেরণ করে অন্যদের প্রভাবিত করি। যখন হাজার হাজার লোক এক জায়গায় জড়ো হয় এবং প্রায় প্রত্যেকেই অকৃত্রিম হৃদয়ে উৎসুক হয়ে হরিকথা শুনতে চায়, আধ্যাত্মিক বিষয় সম্বন্ধে শুনতে চায় অর্থাৎ প্রত্যেকেই আধ্যাত্মিকভাবে পুষ্ট হওয়ার, পবিত্র হওয়ার, ভগবানকে ভালবাসার, তাঁর মহিমার সঙ্গ করার প্রকৃত অভিলাষ রয়েছে। যা এই জগতের সমস্ত বাধা অতিক্রম করতে আমাদের সাহায্য করবে। বাধা সীমাহীন। কিন্তু একটি শক্তি আছে যা আমাদের সকল প্রকার বাধা অতিক্রম করিয়ে নিয়ে যায়। সেটি হল কৃপা, চিন্ময় মহিমা অথবা করুণা। সুতরাং যখন আমরা একত্রে শ্রবণ, কীর্তন করে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আকৃষ্ট হই সেটি একটি অভাবনীয় শক্তি। আমাদের চারপাশের সকলে প্রকৃতপক্ষে আমাদের সাহায্য করে আমাদের হৃদয় উন্মুক্ত করে শ্রীকৃষ্ণের মহিমা আস্বাদন করতে এবং তারপর ব্যাক্তিগতভাবে এবং সামগ্রিকভাবে আমরা শুধু অ্যান্টেনার মতোই নই বরং একটি সামগ্রিক শক্তিকেন্দ্রের মতো এই মহিমাময় শক্তি বিচ্ছুরিত করব। এই হল সৎসঙ্গ।
ছুটির প্রকৃত উপলব্ধি
যখন আমাদের প্রবণতাই হল আমাদেরকে কেন্দ্রে রেখে শ্রীকৃষ্ণ অথবা ভগবানকে বাইরে রাখা, যেমন আপনার কাছে একটি দূষিত ও নোংরা কাপড় আছে এবং আপনি পরিষ্কার জলে কাপড়টি ডোবালে জল নোংরা হয়ে যাবে। আমাদের চেতনাও এইরূপ, আমরা আমাদের স্বার্থপর জড় শক্তিকে বিশুদ্ধ ভক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারি আবার কোন অপবিত্র কিছু নিয়ে তাকে প্রকৃতপক্ষে দূর্যিত রূপে প্রদর্শন করতে পারি। যা পবিত্র তাকে আপনি দূষিত করতে পারেন না, কিন্তু তার মধ্যে অনেক অন্য বস্তু মেশাতে পারেন যার ফলে তা দেখাতে দূর্ষিত দেখায়। ঠিক যেমন জল। জল প্রকৃতপক্ষে কখনও দূষিত হয় না কারণ জল সর্বদা শুদ্ধ। কিন্তু যখন আপনি অন্য পদার্থ মেশান, বিভিন্ন শক্তি কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ নোংরা এবং অন্যান্য বস্তু তখন সেখানে প্রকৃত অর্থে জল বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না সুতরাং দীপাবলী এমনই একটি পবিত্র দিন। অন্য স্থানে ক্রিষ্টমাসও অন্যান্যদের কাছে পবিত্র। তারা এটিকে এক্সমাসে বা ইন্দ্রিয়তৃপ্তির দিনে পরিণত করেছে, অতএব তারা যীশুখ্রীষ্ট সম্পর্কে ভাবতে চায় না; তারা এক্স বা ইন্দ্রিয়তৃপ্তি সম্পর্কে ভাবতে চায়, অথচ তারা এটিকে বছরের পবিত্রতম দিন
রূপে উদ্যাপন করে। ছুটির দিন ‘অর্থ পবিত্র দিন এবং সেই পবিত্র দিনগুলিতে তারা প্রাণী হত্যা করে। কিন্তু সারগ্রাহী অর্থাৎ একজন প্রকৃতপক্ষে আধ্যাত্মিক মানুষ যা শুধুমাত্র সারবস্তু প্রার্থনা করে। কেন এই দিনটি পবিত্র? এই দিনটি কেন? কেন ভগবান জগতকে এই দিনটি দিয়েছেন? সব পবিত্র দিনগুলি প্রকৃতপক্ষে আমাদের সমস্ত চেতনাকে জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্যের প্রতি নিবদ্ধ করতে সাহায্য করে। জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য শ্রীকৃষ্ণকে ভালোবাসা, ভগবানকে ভালোবাসা, ভগবানের মহিমার আবেগময় মাধ্যম হতে শেখা, যে ক্ষেত্রে তিনটি বিবেচনা প্রযোজ্য- আমাদের কাজ, আমাদের অস্তিত্ব এবং আমাদের সঙ্গ।
দীপাবলী উদ্যাপন করার কারণ
বিমাতা কৈকেয়ীর ঈর্ষার কারণে শ্রীরামচন্দ্রকে অযোধ্যা থেকে বনবাসে যেতে হয়েছিল। তিনি প্রকৃতপক্ষে একজন মহান ভক্ত ছিলেন। জীবনের অন্য সবকিছুর থেকে তিনি রামকে অধিক ভালোবাসতেন, কিন্তু তার ঈর্ষান্বিত দাসী মন্থরার সঙ্গে থেকে তিনি ধীরে ধীরে বুঝলেন যা মন্থরা ভাবছেন তাই সত্য। এই হল মানব চরিত্র। যখন আমরা জেদী, ঈর্ষান্বিত এবং লোভী, আমাদের যখন এই অনর্থগুলি আছে, মায়ার স্বভাবই হল আমাদেরকে বোঝানো যে, যা আমি বিশ্বাস করি তাই সত্য’। অন্যথায় কিভাবে আমরা এভাবে দৃঢ়চিত্তে এত অপরাধ করতে পারি বা অন্যদের প্রতি এত বিপত্তির কারণ হতে পারি? কৈকেয়ী বিশ্বাস করেছিলেন যে, শ্রীরাম প্রকৃতপক্ষে একজন অত্যন্ত খারাপ ব্যক্তি এবং মন্থরা এই মহান ভক্তকে, শ্রীরামচন্দ্রের একজন মাকে, বুঝিয়ে তাকে চৌদ্দ বৎসরের জন্য বনবাসে পাঠাল। তিনি এমনভাবে বিশ্বাস করেছিলেন যে, ঈর্ষার একটি ছোট স্ফুলিঙ্গকে মন্থরা এমন এক বিশাল অগ্নিতে পরিণত করেছিল যে, শ্রীরামের বিরহে তার স্বামী দশরথের মৃত্যু হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিরস্ত হননি। এটা যেন এরকমই। এরকম হতেই পারে, আমার পক্ষে যা সঠিক তা করতে গিয়ে কোন ক্ষতি হতে পারে তাতে কি?’ কিন্তু একদিন আগেও যিনি দশরথের জন্য লক্ষ বার জীবন দিতে পারতেন। সে যাই হোক, রামায়ণ আলোচনায় আর যাচ্ছি না কিন্তু চৌদ্দ বছর পর শ্রীরাম গভীর অমাবস্যার রাতে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করলেন। সেই রাত্রে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য হনুমান এবং ভরত অযোধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। সমস্ত অযোধ্যাবাসী শ্রীরামকে এত ভালোবাসতেন যে, তাদের কাছে চৌদ্দ বছর চৌদ্দ হাজার বছরের সমান ছিল। তারা তাদের ছাদে, দরজার সামনে, জানালায় নিজেদের হাতে প্রদীপ জ্বালিয়েছিল শ্রীরামের গৃহে প্রত্যাগমনকে স্বাগত জানাতে। সুতরাং দীপাবলী হল হৃদয়ের উৎসব। অমাবস্যার গভীর অন্ধকার রাতের মতো এতদিন তারা অন্ধকারে বাস করেছিল।
কৃষ্ণ সূর্যসম; মায়া হয় অন্ধকার
কৃষ্ণ হলেন আলোক, মায়া অন্ধকার। আমাদের কৃতজ্ঞতার প্রদীপে, আমাদের ভালোবাসার প্রদীপে আমরা আমাদের ভালোবাসার ভগবানের গৃহে পুনরাগমনকে স্বাগত জানাই আমাদের হৃদয়ে, এই হল দীপাবলী। আমাদের জীবনে ভগবানের আগমন, ভগবানের মহিমা উদ্যাপনই হল আমাদের জীবনের মূল লক্ষ্য এবং সেই লক্ষ্যের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করার এই হল প্রকৃত সময়। ব্যক্তিগতভাবে এবং সামগ্রিকভাবে আমাদের ভালোবাসার প্রদীপ নিবেদন করার অর্থই তার সন্তুষ্টির জন্য জীবন নিবেদন করা। যদি সেই চেতনায় আপনি বাজী পোড়ান তাহলে সেই বাজীগুলিও চিন্ময় হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা জানি না কয়জন লোক এমন মনে করেন, অন্যথায় এগুলি শুধু তমোগুণের বিস্ফোরণ। বৃন্দাবনে দীপাবলীতে অন্য একটি মধুর লীলা হয়। এটি সেই দিন যখন শ্রীকৃষ্ণ সমগ্র জগতকে দেখিয়েছিলেন তাঁর ভক্তদের ভালোবাসা কত শক্তিশালী এবং কিভাবে তিনি তার ভক্তদের প্রেমের বন্ধনে বাঁধা পড়েছিলেন ও পরাজিত হয়েছিলেন।
দীপাবলী হল প্রকৃত দিন যেদিন দামোদর বন্ধন লীলা হয়েছিল। যখন কৃষ্ণ মাখন চুরি করায় পুত্রস্নেহে দাম বন্ধনে যশোদা মাতা তাকে বেঁধেছিলেন। প্রথমে বন্ধন করা, পরে বন্ধন মুক্ত করা এবং যশোদা মাতার সাথে অধিক অন্তরঙ্গ বন্ধনে চিরকালের জন্য বাঁধা পড়া। গোপীরা এইদিন থেকে কৃষ্ণকে প্রেমময় দামোদর নামে ডাকলেন। এর অর্থ যার মায়ের ভালোবাসার রজ্জুবন্ধনে তাঁর উদর আবদ্ধ হয়েছিল।
এই পবিত্র দিবসে আসুন আমরা ভক্তির সেই রজ্জুর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। শ্রীরাধা হলেন ভক্তির প্রকৃত উৎস। তিনিই সেই রজ্জু যা দিয়ে যশোদামাতা শ্রীকৃষ্ণকে বেঁধেছিলেন। এটি তারই শক্তি। শ্রীশ্রী রাধাদামোদর সমগ্র আধ্যাত্মিক জগত, সমগ্র জড় জগতকে জানাতে চেয়েছিলেন যে, তিনি চিরকালের জন্য তাঁর ভক্তদের প্রেমের বাঁধনে বাঁধা পড়েছেন। (শ্রীমৎ রাধানাথ স্বামী মহারাজ শ্রীল প্রভুপাদের একজন সন্ন্যাসী শিষ্য এবং বর্তমানে ইসকন গভর্নিং বডির কমিশনার। তিনি নিয়মিত ভাবে সমগ্র বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন শিল্পোদ্যোগী, রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তির সাথে যুক্ত বিভিন্ন পেশাদারদের এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্গদর্শন প্রদান করেন।)
ব্যাক টু গডহেড অক্টোবর – ডিসেম্বর ২০১৮ হতে প্রকাশিত