প্রকাশ: ৩০ মে ২০১৯ | ১:০৮ অপরাহ্ণ আপডেট: ৩১ মে ২০১৯ | ৭:৫১ পূর্বাহ্ণ
এই পোস্টটি 1750 বার দেখা হয়েছে
শ্রীমৎ ভক্তি পুরুষোত্তম স্বামী
অনন্তলীলাবারিধি পরম পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেন পুরীধামে দারুব্রক্ষ্মরুপে প্রকটিত হলেন, পুরাণসমূহে সেই তত্ত্ব ব্যাখা করা হয়েছে। মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন একবার মহাসুমদ্রে তিনটি বৃক্ষখন্ড, দারুখন্ড দেখতে পান। কাষ্ঠখন্ডগুলি খোদাই করে ভগবানের শ্রীমূর্তি নির্মাণের জন্য শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং শিল্পী বিশ্বকর্মার ছদ্মবেশে আগমন করেন। তিনি তাকে একুশ দিন একাকি একটি রুদ্ধদ্বার কক্ষে রেখে দেওয়ার জন্য রাজাকে বলেন। কিন্তু তিনি শর্ত দেন যে কেউ যদি একুশ দিন পূর্বে দ্বার উন্মোচন করে, তবে শ্রীমূর্তি নির্মাণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।পনের দিন অতিবাহিত হলো এবং ঐ কক্ষ থেকে তখন আর কোনো খোদাইয়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। মহারাণী গুন্ডিচাদেবী আশংকা করলেন যে, বৃদ্ধ ঐ সূত্রধর হয়তো অনশনে ক্লিষ্ট হয়ে কক্ষের মধ্যেই প্রাণত্যাগ করেছেন। তিনি রাজাকে দ্বার উন্মোচন করে তদন্ত করে দেখতে অনুরোধ করলেন। রাজা তাঁর এই প্রস্তাবে অসম্মত হলেন- তিনি সূত্রধরের নির্দেশ অনুসরন করতে চাইলেন। কিন্তু রাণীর অনুনয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি ঐ কক্ষের দরজা খুলে কক্ষে প্রবেশ করলেন। মর্মাহত হয়ে তিনি আবিস্কার করলেন যে, সূত্রধর অন্তর্হিত হয়েছেন, আর শ্রীমূর্তিসমূহের নির্মাণকার্য অসমাপ্ত রয়েছে। রাজা অত্যন্ত শোকবিষ্ট হলেন।
তখন একটি অদৃশ্য দৈববাণী হলোঃ “দুঃখ করো না। যেহেতু তুমি তোমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করনি আর একুশ দিন পূর্ণ হবার পূর্বেই দ্বার উন্মোচন করেছ, সেজন্য বিগ্রহসমূহ এই রূপেই বিরাজ করবে।তুমি বিগ্রহ সমূহের পূজা আরাধনা আরম্ভ করতে পারো। মূর্তিসমূহ প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রক্ষ্মলোক থেকে ব্রক্ষ্মাকে আমন্ত্রণ করো”।
এই বর্ণনা থেকে এমন মনে হতে পারে যে, এই বিগ্রহসমূহ ভগবানের অসম্পূর্ণ বা অসমাপ্ত মূর্তিরুপ। ভগবানের এই শ্রীমূর্তিসমূহের অনেক প্রকার ব্যাখা রয়েছে। কেউ কেউ বলেন যে পরম ব্রক্ষ্ম নিরাকার এবং জগন্নাথের এই হস্তপদহীন”অসম্পূর্ণ “রুপ সেটাই প্রমাণ করে। কেউ কেউ আবার একে ভৈরব- এর রুপও বলে থাকেন। কিছু ব্যক্তির কাছে এই রুপ অত্যন্ত ভয়ানক মনে হয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও বহু মানুষ ভগবানের এই মূর্তির সৌন্দর্য, বিশেষত বিগ্রহের স্মিতহাস্যেউদ্ভাসিত মুখকমলের সৌন্দর্যের জয়গান করেন। এই সমস্ত দাবীই সত্য,কেননা তিনিই সবকিছু। ভগবানের এই শ্রীমূর্তিসমূহের আকৃতি এমন কেন তার একটি নিগুঢ় রহস্যময় কারণ রয়েছে। বস্তুতঃ শ্রীজগন্নাথ,শ্রীবলদেব এবং সুভদ্রাদেবীর এই রুপ আদৌ বিকৃত বা অসম্পূর্ণ নয়। বরং এই রুপগুলি নিত্য,শাশ্বত। এই রুপগুলি পরমেশ্বর ভগবানের পরম পূর্ণরুপ। এমন নয় যে রানী মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্নকে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে দ্বার খুলতে বাধ্য করেছিলেন বলে ভগবান এমন রুপে প্রকটিত হয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে,ভগবান ইতোপূর্বে তাঁর ভক্তগণের কাছে তাঁর এই দিব্যসুন্দর সর্বোত্তম রুপ প্রকট করেছিলেন। শ্রীজগন্নাথ করুণাপরবশ হয়ে ব্রক্ষ্মান্ডের সকল জীবকে উদ্ধার করার জন্য প্রত্যেককে তাঁর দর্শন প্রদান করেন। ভগবান ও তার ভক্তের মধ্যে এই প্রীতিবিনিময়, প্রেম বৈষ্ণবগণ উপলব্ধি এবং উপভোগ করেন এবং তারা নিম্নোক্ত ভগবৎ লীলা-আস্বাদন করেন, এখানে ভগবান কেন জগন্নাথ রুপে প্রকটিত হলেন তার প্রকৃত কারণ বর্ণনা করা হয়েছে।
মথুরা ত্যাগ করে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ১৬,১০৮ জন পত্নীসহ দ্বারকায় নিবাস করতে থাকেন। এইসব মহিষীগণের সকলেই ছিলেন পরমা সুন্দরী এবং তারা পরম প্রীতি এবং যত্ন সহকারে ভগবানের সেবা করতে থাকেন। যদিও মহিষীগন তাদের প্রভুকে সর্বপ্রযত্নে যথাসাধ্য সেবা করতেন, তবুও শ্রীকৃষ্ণ সর্বদাই বৃন্দাবনের অনুধ্যান করতেন। বৃন্দাবন বিরহে কখনো কখনো শ্রীকৃষ্ণকে সবকিছুর প্রতি উদাসীন মনে হতো। এটি তাঁর মহিষীদেরকে অত্যন্ত বিব্রত এবং উৎকন্ঠিত করতো। দ্বারকায় রাণীরা ভাবতেন,”কেন এমন হচ্ছে? আমরা এতো সুন্দরভাবে প্রভুর সেবা করা সত্ত্বেও কেন তিনি সর্বদাই বৃন্দাবনের কথা বলেন এবং নিরন্তন বৃন্দাবন স্মরণ করেন?” তাঁরা দেখছেন,প্রভু শ্রীকৃষ্ণ প্রায় তাঁর নিদ্রিত অবস্থায় সরবে, ” রাধে,রাধে! গোপী! গোপী!”বলে উঠছেন। মহিষীগণ ভগবানের বৃন্দাবন লীলা জানার জন্য কৌতুহলী হয়ে উঠলেন। কি এমন সেখানে হয়েছিল যে প্রভু তা ভুলতে পারছেন না?-” কিন্তু আমাদের প্রিয় স্বামীর শৈশব লীলা -যখন তিনি শিশুরুপে বৃন্দাবনে লীলা করেছেন সে লীলাকথা কে আমাদের বলতে পারে?” তারা জানতে পারলেন যে, মাতা রোহিনী ভগবানের বৃন্দাবন লীলা প্রত্যক্ষভাবে দর্শন করেছিলেন এবং তাঁদের মহা সৌভাগ্য যে তিনি এখন দ্বারকায় বাস করছেন। একদিন সকল মহিষীগণ কৌতূহলচিত্তে রোহিনীদেবীর কাছে গিয়ে কৃপাপূর্বক ভগবানের কৈশোর-যৌবন লীলা তাদেরকে বলার জন্য রোহিনীদেবীকে আহ্বান করলেন। মাতা রোহিনী উপলব্ধি করলেন যে, রাণীগণ ভগবানের ব্রজলীলা শ্রবণের জন্য আগ্রহী হয়েছে। তিনি বললেন,”বাস্তবিকই, শ্রীকৃষ্ণের ব্রজবিলাস লীলা,অনন্য,অনুপম এতই বিশিষ্ট এই লীলা যে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণও এই লীলামহিমা শ্রবণ করে এর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। আমি আপনাদের কাছে ঐসব অপূর্ব বিষ্ময়কর ব্রজলীলা বর্ণণা করতে পারি। কিন্তু একটি শর্তেঃ আমি যখন সেইসব লীলাকাহিনী বর্ণনা করব ,তখন কৃষ্ণ- বলরাম যেন শ্রবণ করতে না পারে। যদি তারা শ্রবণ করে, তাহলে বড় আকারের সমস্যা হবে”।
একবার কৃষ্ণ ও বলরাম দ্বারকায় সুধর্ম সভাগৃহে একটি সভায় যোগদানের জন্য গমন করলেন। তখন শ্রীকৃষ্ণের সকল মহিষীগণ তাঁদের অনুপস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করলেন। তাঁরা সকলে একটি প্রশস্ত কক্ষে সমবেত হয়ে রোহিণী মাতাকে শ্রীকৃষ্ণের শৈশবলীলা বর্ণনা করার অনুরোধ করলেন। ঐ দুই ভাই, কৃষ্ণ-বলরাম যাতে এই বর্ণনা শ্রবণ করতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করার জন্য মাতা রোহিণী সুভদ্রাদেবীকে দ্বাররক্ষীর সেবা গ্রহণ করতে বললেন। ঠিক হলো তিনি ওখানে কৃষ্ণ-বলরামের আগমন হলে রোহিণীমাতাকে ইঙ্গিতে জানিয়ে দেবেন। এখন সবকিছুই প্রস্তুত।সমস্ত মহিষীগণ প্রবল আগ্রহ ও উত্তেজনায় সেখানে রোহিনীমাতাকে ঘিরে সমবেত। সুভদ্রা সেই প্রশস্ত কক্ষের দ্বারে তাঁর দুই হাত বিস্তার করে দ্বার রোধ করে দাঁড়িয়ে আছেন, যাতে কেউ ভিতরে প্রবেশ করতে না পারেন। বিশেষত কৃষ্ণ- বলরাম। রোহিণীমাতা আনন্দিত অন্তরে ব্রজবৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের শৈশবলীলা বর্ণনা আরম্ভ করলেন।
সেই বর্ণনা ছিল পরম প্রীতিকর, শ্রবণরম্য এবং দিব্য ভাবোচ্ছাসপূর্ণ। মহিষীগণ অবিচ্ছিন্ন মনযোগে শ্রবণ করতে লাগলেন। তাঁরা রোহিণীমাতার মুখনিঃসৃত ব্রজবিলাসকথারুপ সুধামৃতধারা তাঁদের কর্ণের দ্বারা পানে এতই নিমগ্ন হয়ে পড়লেন তাঁদের বাহ্যজ্ঞান বিলুপ্ত হয়ে গেল। সুভদ্রা যদিও দ্বাররক্ষীর দায়িত্বে নিয়োজিত হয়েছিলেন, তিনি শ্রীকৃষ্ণের অনুগম লীলাবিলাস-কথা শ্রবণের সুযোগটি অপচয় করতে চাইলেন না। আর এইভাবে শ্রবণে নিমগ্ন হওয়ায় দ্বারকার মহিষীদের মতো তাঁরও বাহ্যজ্ঞান লোপ পেল। কৃষ্ণ-বলরাম সভায় যোগদান করে সেখানে ব্যস্ত থাকলেও তাঁরা বুঝতে পারলেন যে, মাতা রোহিণী তাঁদের বৃন্দাবন লীলাকথা বর্ণনা করছেন। ঐ কথা শ্রবণে সুতীব্র লালসায় অভিভূত হয়ে তারা হঠাৎই সভাগৃহ পরিত্যাগ করে সেই স্থানের দিকে ধাবিত হলেন, যেখানে রোহিণীদেবী এবং রাণীগণ সমবেত হয়েছিলেন। যখন তাঁরা দ্বারে পৌঁছালেন,তখন তাঁরা দেখলেন যে সুভদ্রা কক্ষদ্বার পাহারার দায়িত্বে সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কৃষ্ণ- বলরাম সুভদ্রার উভয়পাশে দাঁড়ালেন এবং তৎক্ষনাৎ তাঁরা মাতা রোহিণীর বর্ণনা শ্রবণে নিমগ্ন হলেন। সুভদ্রা ব্রজকথা শ্রবণে সম্পূর্ণ তন্ময় হওয়ায় তাঁর বাহ্যচেতনা বিলুপ্ত হয়েছিল, সেজন্য তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীবলরামের উপস্থিতি লক্ষ্য করলেন না। তাঁরা তিনজন এইভাবে লীলাশ্রবণের দ্বারা ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়লেন, তখন তাঁদের দিব্য দেহে মহা ভাববিকার- লক্ষণ প্রকটিত হতে শুরু করল।” কি পরমাদ্ভুত,দিব্যসুন্দর লীলা। ব্রজবাসীগণের কি অবর্ণনীয় স্নেহ- প্রেম!”ব্রজবাসীদের অদ্ভুত প্রেম-প্রীতি- বিরহ শ্রবণে বিন্ময়াভিভূত হওয়ায় তাদের দিব্য অঙ্গ ভাবতরঙ্গে আপ্লুত হলো।ভাবাতিশয্যবশতঃ তাদের নয়ন ক্রমশঃ বড়,বিস্ফোরিত হতে শুরু করলো,তাঁদের হস্ত,পদ তাঁদের দেহের মধ্যে সংকুচিত হলো। এইভাবে হস্ত- পদাদির সংকোচন হওয়ায় কৃষ্ণ- বলরাম এবং সুভদ্রার কলেবর কুমাকৃর্তি ধারণ করল। ঠিক সেই সময়ে নারদমণি উপস্থিত হলেন। অনেক দূর থেকে তিনি কৃষ্ণ- বলরাম এবং সুভদ্রার এই অদ্ভুত ভাবমন্ডিত রুপ দর্শন করতে পারছিলেন। যখন তিনি তাঁদের নিকটবর্তী হলেন, তখন কৃষ্ণ-বলরাম এবং তাঁদের ভগ্নী সুভদ্রার বাহ্য চেতনা ফিরে এল। তাঁদের দেহ স্বাভাবিক আকার ধারণ করল। তাঁরা তাঁদের মহাভাব সংবরণ করলেন, যা তাঁদের এই বিশেষ রুপে অভিব্যক্ত হয়েছিল। নারদ মুনি দিব্য আনন্দোল্লাসে দুবাহু তুলে নৃত্য করতে লাগলেন। তিনি বললেন,” আমি দর্শন করছি!আমি দর্শন করেছি!আপনারা আমার কাছ থেকে এটি সংগোপন করার চেষ্টা করছেন। হে প্রিয় প্রভু,আমি আপনার অনেক আশ্চর্যজনক দিব্যরুপ দর্শন করেছি। কিন্তু এমন অনুপম- সুন্দর রুপ কখনো দর্শন করিনি! আমি বিনীতভাবে প্রার্থনা করছি যে আপনাদের এই দিব্য শুভ রুপ এই ধরণীতে কোথাও প্রকট করুন যাতে প্রত্যেকেই আপনার এই সবচেয়ে বিশিষ্ট, সর্বোত্তম মহাভাব-প্রকাশ রূপ দর্শন করতে পারে।”তাঁর পরম ভক্ত নারদ মুনির অভিলাষ পূর্ন করার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই রূপ প্রকটিত করেছেন এবং এইরূপে তিনি নিত্যকাল শ্রীক্ষেত্র,পুরুষোত্তম ধামে বিরাজ করছেন। হরে কৃষ্ণ।