এই পোস্টটি 1525 বার দেখা হয়েছে
১৬/১১/১৮ রোজ শুক্রবার পবিত্র গোপাষ্টমী তিথি
প্রাণনাথ গোবিন্দ দাস: ঋতুচক্রের আবর্তনে ধরায় হেমন্তের আগমন। হেমন্ত ঋতুর এই প্রথম মাসটিকে নবান্নের আবাহন-এর প্রতীক ভাবা হয়। শীত বুড়ির জড়তার আগে কৃষকের মনে আনে নব উদ্যম। ধরায় প্রথম হিমেল বাতাসের স্পর্শে পুলকিত হয়ে ওঠে প্রকৃতি। কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের অস্ঠমী তিথি এই বিশেষ দিনটিতে গ্রহ নক্ষত্রের শুভ যোগে এক মাহেন্দ্র ক্ষণে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর কর্তব্যকর্ম শুরু করেছিলেন। এই দিনটিই পবিত্র “গোপাষ্টমী” তিথি রূপে পরিচিত। তখনকার দিনে ৬ বৎসরের আগে পর্যন্ত সময়কে কৌমার বলা হয় ৬-১০ বছর পর্যন্তকে পৌগন্ড সময়কে কৌমার বলা হত। সেই সময় নন্দ মহারাজ-এর সন্দিধানে সমস্ত গোপেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করলেন যে, যে সমস্ত বালকের বয়স ৫ বৎসর অতিক্রান্ত হয়েছে তাদের উপর গোচারণে ভার দেওয়া হোক।
এই সময় শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কৌমার লীলাবিলাস করে পৌগন্ডে পদার্পন করলেন। এই সময়ে কৃষ্ণ ও বলরাম গাভীসমূহের দায়িত্ব ভার লাভ করে বৃন্দাবনের সর্বত্র ঘুরে বেড়াতে লাগলেন এবং তাঁদের পাদষ্পর্শে বৃন্দাবনের ধূলিকণা পবিত্র হল। এ থেকে কৃষ্ণ নিজে দায়িত্ব গ্রহণ করে মনুষ্য সমাজকে শিক্ষা দিয়েছেন যেন প্রত্যেকে তাঁর বর্ণ ও আশ্রম অনুসারে কর্তব্য পালনে দৃঢ়বর্ত হয়। যেমন- গৃহস্থ তার কর্তব্য অনুসারে দান, তপস্যা করা, ব্রহ্মচারী অধ্যয়ন করা এভাবে প্রত্যেকটি বর্ণ এবং আশ্রম যাতে তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব কর্তব্য সম্পাদন করে সেজন্য কৃষ্ণ নিজে আচারণ করে শিক্ষা দিয়েছেন। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভগবদগীতায় বলেছেন-
যদি হ্যহং ন বর্তেয়ং জাতু কর্মণ্যতন্দ্রিতঃ।
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।। (গীতা ৩/২৩)
“হে পার্থ! আমি যদি অনলস হয়ে কর্তব্যকর্মে প্রবৃত্ত না হই, তবে আমার অনুবর্তী হয়ে সমস্ত মানুষই কর্ম ত্যাগ করবে।”
এদিকে ব্রজগোপিকারা কৃষ্ণের রূপ দর্শন করতে করতে এতই বিমূহিত হয়ে পড়েছেন যে, কৃষ্ণকে একমুহূর্ত দর্শন না করে থাকাটা তাদের কাছে এক যুগের মত মনো হত। তাই তারা কৃষ্ণ গোচারণে যাওয়ার এবং তাঁর দর্শন না পাওয়া ব্যাপারটা মেনে নিতে পারলেন না। তাই রাধারাণী ও গোপীরা বেপরোয়া হয়ে উঠে মাথায় পাগড়ী হাতে লাঠি, ধুতি পরিহিত লোপ বালকের চদ্মবেশ নিলেন।
কৃষ্ণসখা সুবলের সঙ্গে রাধারাণী চেহারার মিল ছিল বলে রাধারাণী সুবলের মতো বেশ ধারণ করে ছদ্মবেশে গোচারণে কৃষ্ণসান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। কৃষ্ণ তাঁর বাঁশী বাজাতে বাজাতে সেই গোপিকাদের দেহকান্তি ও হাস্যোজ্জ্বল সুন্দর মুখ দর্শন করে পরম আনন্দ উপভোগ করতে লাগলেন। কার্তিন মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথি। এই বিশেষ দিনটিতেই গোচারণে গোপবেশে রাধারাণী, কৃষ্ণষান্নিধ্য লাভ করেছিলেন বলে, ভক্তগণ শ্রীরাধারাণী ও অন্যান্য গোপীগণের শ্রীপাদপদ্ম দর্শনের সুযোগ লাভ করেন।
এই তিথিতে দুলর্ভ প্রাপ্তি এই যে শ্রীমতীরাধারাণী এবং গোপীকাদের চরণ দর্শন। আর শ্রীমতীরাধারাণী হচ্ছেন মূর্তিমান ভক্তি। আর এই ভক্তি লাভের অবিলাষ করে শ্রীমন মহাপ্রভু তার শিক্ষাষ্টকম চতুর্থ শ্লোকে বলেছেন-
ন ধনং ন জনং ন সুন্দরীং কবিতাং বা জগদীশ কাময়ে।
মম জন্মনি জন্মনীশ্বরে ভবতাদ্ভক্তিরহৈতুকী ত্বয়ি।।
“হে জগদীশ! আমি ধন, জন বা সুন্দরী রমণী কামনা করি না; আমি কেবল এই কামনা করি যে, জন্মে-জন্মে তোমাতেই আমার অহৈতুকী ভক্তি হোক।”
উক্ত শ্লোক থেকে আমারা সাধারণ বুঝতে পারি ধন, জন, সুন্দরী রমণী ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাইও ভক্তি কাছে তুচ্ছ তৃণ তুল্য, যা রূপগোস্বামী পাদও তার ভক্তিরসামৃত সিন্ধু গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তিনি সেখানে বলছেন শুদ্ধ ভক্তি কৃষ্ণ আকর্ষণী অর্থাৎ যেটা কৃষ্ণকে আকর্ষণ করে। তাই শ্রীমতীরাধারাণীর আর এক নাম হচ্ছে মদনমোহনমোহিনী। আর মদনকে যিনি মোহিত করেন তিনি হচ্ছেন মদনমোহন এবং এই মদনমোহনকে যিনি মোহিত করেন তিনি হচ্ছে মদনমোহনমোহিনী। এতে করে আমরা বুঝতে পাচ্ছি শ্রীমতী রাধারাণী কত গুরুত্বপূর্ণ। আর ওনার করুণা হচ্ছে ওনার শ্রীচরণকমল। আর এই শ্রীচরণকমল শুধু মাত্র গোপাষ্টমী তিথিতেই দর্শন মিলে। তাই এটি ভক্ত সমাজে অত্যন্ত সমাদৃত তিথি। হরেকৃষ্ণ!
(মাসিক চৈতন্য সন্দেশ পত্রিকা নভেম্বর ২০১৮ সালে প্রকাশিত)