এই পোস্টটি 24 বার দেখা হয়েছে
(এক মায়ের আত্মকাহিনী একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
২০০২ সালের ১৮ আগস্ট আমার জীবনে এক নতুন সাংঘাতিক মোড় এল। আমার পায়ের নাছোড়বান্দা ব্যথার উপসর্গ থেকে ধরা পড়ল যে, আমার ‘মেলিগন্যান্ট টারমিনাল ব্রেস্ট ক্যান্সার’ হয়েছে, যেটি ধীরে ধীরে আমার সমস্ত দেহে ছড়িয়ে পড়ে। তখন পর্যন্ত আমার জীবনটা ছিল অন্যান্য সাধারণ এক ভারতীয় হিন্দু গৃহিনীর মত। পশ্চিম ভারতের একটি প্রদেশ মহারাষ্ট্রের এক ধার্মিক পরিবারে আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা। আমার বিয়ে হয় একজন সম্মানিত স্কুল শিক্ষকের সাথে যার নাম ছিল ভগবান মালওয়াদকার। আমার তিনটি ছেলেই সুশিক্ষিত এবং স্বপ্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে, তাদের সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যতে অপেক্ষা করছিল।
এর মধ্যে আমার জীবনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রবেশ করে। আমার দুই ছেলে সিদ্ধার্থ ও সন্তোষের সাক্ষাৎ হলো পুনে ইস্কন ইয়ুথ ফোরামের ভক্তদের সাথে সময়টা ছিল ১৯৯৭ সালের মাঝামাঝি। ভক্তসঙ্গ পেয়ে অত্যন্ত আগ্রহের সাথে তারা কৃষ্ণভাবনামৃত অনুশীলন করতে লাগল। তাদের এই দ্রুত পরিবর্তনে আমি যদিও খুবই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম কিন্তু তাদের শিক্ষাগুরু গৌরাঙ্গ দাসের সাথে সাক্ষাতের পর আমি তার সরলতা এবং গভীর জ্ঞান অবরোকন করে সত্যিই অবিভূত হয়েছিলাম পুনের কথরুডে আমাদের বাসায়। আমি আর আমার স্বামী তাকে নিমন্ত্রণ করলাম সাপ্তাহিক শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা শিক্ষা অনুষ্ঠানের আয়োজন করার জন্য এবং তিনি তাতে রাজি হলেন আমি কৃষ্ণভাবনার দিকে অগ্রসর হতে লাগলাম। ২০০০ সালের মাঝামাঝিতে আমার ভক্ত সন্তানগণ ইস্কনে যোগদান করে আজীবন ব্রহ্মচারী ব্রত ধারণ করল। আমি এতে হতভম্ব হলাম এই ভেবে যে তাদের জন্ম থেকে দেখা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের যে স্বপ্ন আমার ছিল তা ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল। কিন্তু আমি ভক্তি অনুশীলন চালিয়ে গেলাম এবং ধীরে ধীরে এটি ভগবানের ইচ্ছারূপে মেনে নিলাম। এর মধ্যে মাঝে মাঝে আমার স্বাস্থ্য ভঙ্গুর হচ্ছিল কিন্তু মারাত্মক ক্যান্সার ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত সবকিছু ঠিক ছিল। ক্যান্সার ধরা পড়ার সাথে সাথে আমার অনেকগুলো সার্জারির মধ্যে যেতে হল।
কিন্তু এই সকল চিকিৎসার কোন মূল্যই নেই কেননা রোগ ইতোমধ্যে সারাদেহে ছড়িয়ে পড়েছে।
এমনিতে রোগের যন্ত্রণা ও ব্যথা ছিল অকল্পনীয় তার উপর চিকিৎসা পদ্ধতিও ছিল অসহনীয়। আমার ব্যথা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছল যে, আমার পক্ষে তা সহ্য করার কোন ক্ষমতা ছিল না, তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, এই প্রচণ্ড ব্যথা সহ্য করার চেয়ে নিজেকে হত্যা করা খুবই সহজ কাজ হবে।
আমার সিদ্ধান্তের কথা আমি আমার দীক্ষিত পুত্রদের জানালাম (যাদের মধ্যে সিদ্ধনাথের দীক্ষিত নাম হল সংকীর্তনানন্দ দাস এর সন্তোষের সুন্দরভর দাস)। খুব শান্ত ও সৌম্য শব্দে তারা আমাকে জানাল যে, আত্মহত্যাই আমাদের যেকোন সমস্যার সমাধান নয়। তারা আমাকে ব্যাখ্যা করল যে, আমাদের পূর্ব জন্মের কর্মফল আমাদের ভোগ করতেই হয় এবং আমরা তা পরিত্যাগ করতে পারি না। আত্মহত্যার মাধ্যমে আমি যে দুর্ভোগের পরিত্যাগ করতে চেয়েছিলাম তা মূলত আমার পরবর্তী জীবনের দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে ভক্তিমূলক সেবার মাধ্যমে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে আশ্রয় নেওয়া, দুর্দশা দুঃখগুলোকে ভগবানের কৃপা হিসেবে সহ্য করা এবং পূর্ণপবিত্র হয়ে অবশেষে এই জন্মেই ভগবদ্ধামে ফিরে যাওয়া। যাদেরকে আমি আমার বুকের দুধ পান করিয়ে বড় করেছি সেই আমার ছেলেদের এই প্রগাঢ় দর্শন শুনে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। ঐ গভীর জ্ঞান ও যুক্তিতে পূর্ণ সত্য কথাগুলো শুনে নতুন আশা পেলাম এবং সিদ্ধান্ত নিলাম বাকী সময়টা কৃষ্ণ স্মরণের ভক্তিমূলক পন্থায় কাটাবো। ইতোমধ্যে ডাক্তার জানালো যে, আমার আর মাত্র ৭ মাস সময় আছে।
আমি ভাবলাম রাজা পরিক্ষিতের কাছে মৃত্যুর প্রস্তুতির জন্য ৭ দিন সময় ছিল আর তিনি এই সাত দিন ক্রমাগত গঙ্গার তীরে শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ করে জীবন সার্থক করেছিলেন। আমিও তার পথ অনুসরণ করে পুনে ইসকন মন্দিরে যাবার জন্য মন্দিরের অধ্যক্ষ রাধেশ্যাম প্রভুকে অনুরোধ করলাম। তিনি আন্তরিক সম্মতি প্রকাশ করলে আমি দ্রুত মন্দিরে উঠলাম। প্রতিদিন বিগ্রহ দর্শন, কীর্তন, প্রবচন শ্রবণ এবং শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থগুলো পড়ে আমি অনুভব করলাম যে, কৃষ্ণ আমাকে সর্বদা রক্ষা করছেন সেই অসহনীয় ব্যাথার কবল থেকে। এরপর কিছুদিনের জন্য বাসায় গিয়ে অনুভব করলাম যে, ব্যথা আরো বেড়ে গেল। মনে হচ্ছিল হাজার হাজার তীর আমার শরীরকে বিদ্ধ করছিল। কিন্তু আবার মন্দিরে ফিরে আসার পর আশ্চর্যভাবে আমি অনুভব করলাম যে, আমার কোন ব্যথা নেই। বুঝলাম, কৃষ্ণ সবসময় আমাকে সুরক্ষা দিচ্ছেন, তাই আমি কৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করলাম, “হে কৃষ্ণ, এই দেহ পরিত্যাগ করার আগে যেন আমি একজন সদ্গুরুদেবের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারি।”
২০০৩ সালের ২৩ জানুয়ারি, আজ আমার খুবই গুরুত্বপূর্ণ সার্জারী হয়ে গেল। অপারেশনের সময় কয়েক মিনিটের জন্য আমার শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। সেই শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্তগুলোতে আমি উপলব্ধি করলাম যে, আমি আমার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। অপারেশন থিয়েটারের উপরে একটি স্থান থেকে আমি স্পষ্ট দেখলাম যে, আমার জীবনহীন দেহটা অপারেশন টেবিলে পড়ে আছে এবং ডাক্তার নার্সগণ উন্মত্তভাবে ছোটাছুটি করছিল আমার আশেপাশে। এরপর কি হল আমি জানি না। যখন আমি জেগে উঠলাম তখন দেখলাম আমি পুনরায় আমার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করেছি। পরে জানলাম এটি ছিল আউট অব বড়ি এক্সপিরিয়েন্স বা ওবিই। তখন বুঝলাম কৃষ্ণ আমাকে এক নতুন জীবন দিয়েছেন সদ্গুরুদেব আশ্রয় লাভের জন্য। ২০০৩ সালের ৪ এপ্রিল আমি শ্রীমৎ রাধানাথ স্বামী মহারাজের চরণে আশ্রয়ে লাভ করলাম। তিনি ছিলেন আমার পুত্রদেরও গুরুদেব। আমার পারমার্থিক নাম হল সুরপ্রিয়া দেবী দাসী। আমি আমার পেছনে ফেলে আসা দীর্ঘ জীবন আর বর্তমানের এই সংক্ষিপ্ত জীবনের দিকে তাকালে বুঝতে পারি যে, ক্যান্সার রোগ মূলত আমার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। হয়তোবা জন্ম-জন্মান্তরে ঘুরতে ঘুরতে কখনো আমার ভক্তসঙ্গ, ভগবানের অপ্রাকৃত দর্শন, সদ্গুরুর আশ্রয় কিংবা মন্দিরে বসবাসের সৌভাগ্য হতো না। আমার অসুস্থতার সময়ে আমার ভক্ত সন্তানগণ সবসময় আমার দেখাশুনা করেছে। তারা আমার জন্য রান্না, আমাকে সঙ্গ দেয়া থেকে শুরু করে সবসময় আমার পাশে থেকে উৎসাহিত করেছে। সবচেয়ে বড় বিষয়টি হল তারা আমার দেহেরও উর্ধ্বে আমার আত্মার প্রকৃত সেবা করেছে। তারা আমাকে পারমার্থিক শিক্ষা ও ভক্তিজীবন প্রদান করে আমাকে দৈহিক কষ্ট থেকে উদ্ধার করে প্রচণ্ড মানসিক প্রফুল্লতা দান করেছে। তারা আমার জন্য যা করেছে তা অন্যান্য সাধারণ সন্তানদের চেয়ে বহু উর্ধ্বে, এখন আমি তা অনুভব করছি। এখন বুঝতে পারছি ভগবানের সেবায় আত্মোৎসর্গ হয়েছে আমার সন্তানরা কি পরম জ্ঞানের কাজ করেছে। আমি অত্যন্ত গর্বিত যে তারা এতই বুদ্ধিমান যে তারা আমার আগেই ভক্তিজীবন অবলম্বন করেছে। শিশুরা হচ্ছে জাতির পিতা, আমার ক্ষেত্রে আমার সন্তানরা হচ্ছেন তাদের মায়ের প্রথম পারমার্থিক পিতা।
সর্বশেষে আমি শ্রদ্ধাবনত প্রণতি নিবেদন করছি শ্রীল প্রভুপাদ, তার অনুসারী এবং তার আদর্শ ইস্কনকে কেননা তাদের কৃপায় আমি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণাশ্রয়ে থাকার সুযোগ পেয়েছি এবং তাদের কৃপায় আমার ক্যান্সার রোগ আশীর্বাদে পরিণত হয়েছে। [সুরপ্রিয়া দেবী দাসী ২০০৩ সালের ১৩ জুন ইস্কন পুনে শ্রীশ্রী রাধাকুঞ্জবিহারী মন্দিরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর সময় তার রুমে সিডি প্লেয়ারে শ্রীল প্রভুপাদের হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র পরিবেশিত হচ্ছিল এবং তার ছোট পুত্র সুন্দরভর দাস জপমালায় তার মায়ের পাশে জপ করছিল। মৃত্যুর পূর্বদিন তিনি ক্রমাগত শ্রীল প্রভুপাদের নাম জপ করছিলেন এবং তার সাক্ষাৎ উপস্থিতি উপলব্ধি করেছিলেন। তার শেষ দিনগুলোতে তিনি শান্তি এবং গভীর সুখ অনুভব করেছিলেন যদিও এই ক্যান্সারটি ছিল অত্যধিক ব্যথাদায়ক। এটি দেখে তার আত্মীয়স্বজন এমনকি ডাক্তাররাও বিস্মিত হয়ে গেলেন।
সুপ্রিয়া দেবী দাসী অন্তিম সময় পর্যন্ত তার আত্মীয়স্বজন ও অন্যান্যদের হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
বক্তা : সুপ্রিয়া দেবী দাসী
উৎস: ব্যাক টু গডহেড ম্যাগাজিন
হরে কৃষ্ণ।
মাসিক চৈতন্য সন্দেশ , ডিসেম্বর – ২০১০ ইং