এই পোস্টটি 325 বার দেখা হয়েছে
চতুর্ভূজ সৃষ্টিকর্তা এবং বংশীধারী বৃন্দাবনের রাখাল বালকের মধ্যকার সম্বন্ধ
সত্যরাজ দাস
এখন কে প্রথম এ ধরনের প্রশ্ন সমস্যা উদ্রেক করে। কেননা ভগবানের আগমনকে কোন সময়ের বিচারে নির্ধারণ করা যায় না। এই কারণে ডিম আগে না মুরগী আগে এই যুক্তির কোনো সদুত্তর পাওয়া যায় না। বিষ্ণু এবং কৃষ্ণ নিত্য বিরাজ করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা একজনকে আরেকজনের উৎস রূপে পরিগণিত করতে পারি ঠিক যেমন সূর্য এবং সূর্য রশ্মির মতো। সূর্য এবং সূর্যরশ্মির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু সূর্যরশ্মির উৎস স্বয়ং সূর্য। তারা উভয়ই এক, সেসাথে বর্তমান, সূর্য ব্যতীত সূর্যরশ্মির অস্থিত্ব কল্পনা করা যায় না। আবার সূর্যরশ্মি বিনা সূর্যের কোনো মূল্য থাকে না। এই উদাহরণে কৃষ্ণ এবং বিষ্ণুকে কোন অবস্থানে আমরা দেখতে পারি-সূর্য না সূর্যরশ্মি?
ঐতিহাসিকভাবে আমরা ধরতে পারি যে, বিষ্ণু হলেন আদি। শাস্ত্র আমাদের জানাচ্ছে যে, তিনি হলেন সৃষ্টির উৎস যেখানে কৃষ্ণ এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন মাত্র ৫ হাজার বছর পূর্বে। বিষ্ণু তার ঐশ্বর্যময় ধাম বৈকুণ্ঠে রাজকীয়ভাবে অবস্থান করেন যাকে আমরা ভগবানের অবস্থানের প্রকৃত স্বরূপ বলে বিবেচনা করি। অন্যদিকে কৃষ্ণ বৃন্দাবনে একজন সাধারণ রাখাল বালকরূপে অবস্থান করেন যা ছিল অত্যন্ত সাদামাটা।
বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি এবং পালন অনুসারে বিষ্ণুর আবির্ভাবকে আদিরূপে গণ্য করা হয় যদিও সেটি তত্ত্বগত সত্য বিচারে সঠিক নয়। চলুন একটি বাস্তবিক উদাহরণ দেখা যাক। আপনি যদি একটি শিশুকে প্রশ্ন করেন জলের উৎস কোথায়? তখন সে বলবে জলের কল এবং সেটি প্রমাণ করার জন্য সে জলের কলটি অবমুক্ত করবে যাতে জল প্রবাহিত হয়। কিন্তু যখন আমরা আরো বড় হই তখন জানতে পারি জলের উৎস হলো বৃষ্টি এবং সে আরো জানতে পারে যে, বিভিন্ন জল সংরক্ষণ সংস্থার মাধ্যমে পাইপের সাহায্যে ঘরে ঘরে জল সরবরাহ করা হয়। সে তখন জলের উৎসের এই জটিল প্রক্রিয়া উপলব্ধি করে এবং সে সচেতন হয়। একইভাবে শাস্ত্রে বলা হয়েছে, কৃষ্ণ হলেন বিষ্ণু এবং সমস্ত অবতারদের উৎস এমনকি তা এই পৃথিবীতে কৃষ্ণের পূর্বে বিষ্ণুর আগমন সত্ত্বেও।
বহুরূপী একেশ্বরবাদ
এ সম্পর্কে শ্রীল প্রভুপাদ চৈতন্য চরিতামৃত আদি ৩/৭১ তাৎপর্যে লিখেছেন— বহুরূপে প্রকাশিত হলেও বিষ্ণুতত্ত্বের উক্তি কখনও হ্রাস পায় না, ঠিক যেমন একটি প্রদীপ থেকে আর একটি প্রদীপ জ্বালানো সত্ত্বেও সেই প্রদীপের শক্তি অপরিবর্তিতই থাকে। মূল প্রদীপ থেকে হাজার হাজার প্রদীপ জ্বালানো যেতে পারে এবং প্রতিটি প্রদীপ থেকে একই পরিমাণ আলোক প্রকাশিত হয়। এভাবেই বোঝা যায় যে, শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু থেকে বিভিন্ন যুগে রাম নৃসিংহ, বরাহ আদি বিভিন্ন রূপে প্রকাশিত সমস্ত বিষ্ণুতত্ত্বের সকলেই সমভাবে পরম শক্তিসম্পন্ন।
শ্রীল প্রভুপাদের প্রদীপের উপমাটি ব্রহ্মসংহিতার ৫/৪৬ থেকে নেওয়া হয়েছে। যেখানে কৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবানরূপে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এক মূল প্রদীপের জ্যোতিঃ যেরূপ অন্য বৰ্তি বা বাতি-গত হইয়া বিবৃত (বিস্তার) হেতু সমান ধর্মের সহিত পৃথক প্রজ্বলিত হয়, সেইরূপ (বিষ্ণুর) চরিষ্ণু-ভাবে যিনি প্রকাশ পান, সেই আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজন করি।
ব্রহ্মা একই শাস্ত্রে সরাসরি উল্লেখ করেছেন, সচ্চিদানন্দ-বিগ্রহ গোবিন্দ কৃষ্ণই পরমেশ্বর। তিনি অনাদি, সকলেরই আদি এবং সকল কারণের কারণ। (ব্রহ্মসংহিতা ৫/১)। তিনি আরো বলেছেন, যে পরমপুরুষ স্বাংশ কলাদি নিয়মে রামাদি মূর্তিতে স্থিত হয়ে ভুবনে নানাবতার প্রকাশ করেছিলেন এবং স্বয়ং কৃষ্ণরূপে প্রকট হয়েছিলেন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজন করি। ব্রহ্মসংহিতা ৫/৩৯
কৃষ্ণ তাঁর অপ্রাকৃত দেহ থেকে অসীম বিষ্ণুমূর্তি প্রকাশ করতে দেখে ব্রহ্মা তাঁর স্তুতিতে বর্ণনা করেন যা শ্রীমদ্ভাগবতের ১০/১০/১৪ রয়েছে। “হে পরম নিয়ন্তা, যেহেতু আপনি সকল দেহধারী জীবের আত্মা এবং সকল সৃষ্ট গ্রহলোকের নিত্য সাক্ষী, তাই আপনি কি মূল নারায়ণ নন? বাস্তবে, ভগবান নারায়ণ হচ্ছে | আপনার সম্প্রসারণ এবং তাই তাঁকে বলা হয় নারায়ণ, যেহেতু তিনি ব্রহ্মাণ্ডের আদি জলের মূল উৎস। তিনি পরম সত্য, আপনার মায়াশক্তি জাত নয়।
সুতরাং ভগবানের বিভিন্ন অবতারগণ একই হলেও আমাদের উপলদ্ধি করতে হবে যে, তাদের উৎস একজন রয়েছে। কেননা কৃষ্ণ সকল অবতারের পূর্বেও বর্তমান ছিলেন। কৃষ্ণ এবং তাঁর সমস্ত অবতারগণ হলেন একই পরমেশ্বর ভগবান। কিন্তু তারা ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যে ভিন্ন ভিন্ন কার্য সম্পাদনের জন্য এই জগতে আবির্ভূত হন। বিভিন্ন কর্মী, জ্ঞানী, যোগী ও ভক্তদের দ্বারা আরাধিত হওয়া থেকে শুরু করে বৃন্দাবনে অন্তরঙ্গ ভক্তদের সাথে ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমে রস আস্বাদন হল ভগবানের অবতরণের উদ্দেশ্য।
গৃহে ভগবান
কৃষ্ণ তাঁর বিভিন্ন রূপ দ্বারা ভক্তদের সাথে ভাবের আদান-প্রদান করেন। এটি একটি উপমা দ্বারা ব্যক্ত করা যায়, যেমন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ছিলেন হোয়াইট হাউসের প্রধান কর্ণধার। জনগণের সাথে তার একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক সম্বন্ধ ও কর্তব্য ছিল। কিন্তু তিনি যখন গৃহে ফিরেন তখন তিনি একজন পিতা, পতি এবং পিতামহ। এমন এক পতি যিনি পরাশক্তি আমেরিকার প্রেসিডে ন্ট হওয়া সত্ত্বেও দেরিতে গৃহে ফিরায় পত্নীকে হয়তো কৈফিয়ত দিতে হয়। একইভাবে কৃষ্ণ বিষ্ণুরূপে প্রাতিষ্ঠানিক ও শাসনকেন্দ্রিক দায়িত্ব পালন করেন কিন্তু তিনি যখন গৃহে রাখাল বালক কৃষ্ণ রূপে অবস্থান করেন তখন তিনি তার অন্তরঙ্গ ভক্তদের সাথে বিভিন্ন রস আস্বাদন করেন। কিন্তু ভগবান সকল রূপেই একই সময়ে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বর্তমান থাকেন ।
একেশ্বরবাদ অনুসারে ভগবানের বিভিন্ন রূপ থাকতে পারে। কিন্তু বৈষ্ণব ধর্মের একটি উচ্চতর বৈশিষ্ট হলো রস। অর্থাৎ উচ্চতর পারমার্থিক স্থিতিতে ভগবানের সাথে সম্পর্ক যুক্ত হওয়া।
এটি সত্যি যে, বিভিন্ন বৈষ্ণব সম্প্রদায় যেমন শ্রী সম্প্রদায়ে বিষ্ণু তথা নারায়ণকে ভগবানের সর্বোচ্চ রূপ বলে স্বীকার করেন। সেটি তাদের বিশেষ অধিকার। কিন্তু কৃষ্ণভক্ত জানেন কৃষ্ণ এবং বিষ্ণুর মধ্যে প্রকৃত স্বরূপ এবং তাদের মধ্যেকার পার্থক্য। তাই তারা বিষ্ণুর ভক্তগণকেও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। যখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তার পরম্পরায় কারো সাথে মিলিত হন তখন তিনি তাদের বিষ্ণুভক্তি দেখে অত্য ন্ত তুষ্ট হন। একইভাবে শ্রীল সনাতন গোস্বামী
বিরচিত বৃহৎ ভাগবতামৃত (২/৪/৯৯-১০৭) থেকে জানা যায় যে, “বৈকুণ্ঠলোকবাসীরা কৃষ্ণের চেয়ে বিষ্ণুকে ভগবানের পদে অধিষ্ঠিত করেন।”
মহাজনদের মতে শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সমস্ত অবতারের অবতারী। এমন নয় যে, শ্রীকৃষ্ণের কোন অবতারী রয়েছে। পরমতত্ত্বের লক্ষণগুলি পূর্ণরূপে শ্রীকৃষ্ণে রয়েছে এবং ভগবদ্গীতায় ভগবান নিজেও ঘোষণা করে গেছেন যে, “তাঁর থেকে বড় অথবা তাঁর সমান আর কোনও সত্য নেই।”
সনাতন গোস্বামী এই বিশেষ ভাবের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “ভগবান তার ভক্তদের তার প্রতি এমন ভাবের কারণে অত্যন্ত তুষ্ট হন। কিন্তু যারা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সান্নিধ্যে আসেন তারা মহাপ্রভু থেকে জানতে পারেন যে, কৃষ্ণই হলেন একমাত্র পরমেশ্বর ভগবান।”
মহাপ্রভুর এই শিক্ষা শ্রীমদ্ভাগবত এবং ব্রহ্মসংহিতাতেও পাওয়া যায়। শ্রীমদ্ভাগবতের ১/৩/২৮ কৃষ্ণের স্থিতি সম্বন্ধে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত ঘোষণা প্রদান করা হয়েছে—
এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ম।
ইন্দ্রারিব্যাকুলং লোকং মৃড়য়ন্তি যুগে যুগে ॥
অর্থাৎ পূর্বোল্লিখিত এই সমস্ত অবতারেরা হচ্ছেন ভগবানের অংশ অথবা কলা অবতার, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং। যখন নাস্তিকদের অত্যাচার বেড়ে যায়, তখন আস্তিকদের রক্ষার করার জন্য ভগবান এই ধরাধামে অবতীর্ণ হন।
প্রকৃতপক্ষে প্রথম স্কন্ধের তৃতীয় অধ্যায় ব্যাপী এই তত্ত্বটির প্রমাণ করা হয়েছে। এই অধ্যায়ের প্রথম চারটি শ্লোকে বিষ্ণুকে মহিমান্বিত করা হয়েছে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে। এরপর ভগবানের বিভিন্ন অবতারগণের তালিকা দেওয়া হয়েছে। এই তালিকার শেষে বলা হয়েছে, কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ং। কৃষ্ণই হলেন একমাত্র ভগবান। এটিই হলো শ্রীমদ্ভাগবতের সারতত্ত্ব।
প্রভুপাদ তার তাৎপর্যে লিখেছেন, “এই বিশেষ শ্লোকটিতে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে অন্যান্য অবতারদের পার্থক্য নিরূপিত হয়েছে। শ্রীল জীব গোস্বামীর বর্ণনা অনুসারে, মহাজনদের মতে শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সমস্ত অবতারের অবতারী। এমন নয় যে, শ্রীকৃষ্ণের কোন অবতারী রয়েছে। পরমতত্ত্বের লক্ষণগুলি পূর্ণরূপে শ্রীকৃষ্ণে রয়েছে এবং ভগবদ্গীতায় ভগবান নিজেও ঘোষণা করে গেছেন যে, “তাঁর থেকে বড় অথবা তাঁর সমান আর কোনও সত্য নেই।” এই শ্লোকে ‘স্বয়ম্” কথাটির বিশেষ উল্লেখের মাধ্যমে প্রতিপন্ন হয়েছে যে, শ্রীকৃষ্ণের কোনও অবতারী নেই। যদিও অন্যান্য অবতারদেরও ভগবান বলে বর্ণনা করা হয়েছে, কিন্তু কোথাও তাঁদের পরমেশ্বর বলে বর্ণনা করা হয়নি। এই শ্লোকে ‘স্বয়ম্’ শব্দটির মাধ্যমে পরম মঙ্গলময়ের শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপিত হয়েছে।”
শ্রীল জীব গোস্বামীর মতে, কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ং এই শ্লোকটি হল ভাগবতের ১৮ হাজার শ্লোকের মধ্যকার অন্যতম পরিভাস সূত্র। পরিভাস সূত্র হল কোন একটি রচনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। কৃষ্ণসন্ধর্বে (অনুচ্ছেদ ৭৩) শ্রীল জীব গোস্বামী ব্যাখ্যা করেছেন, ভাগবতের সমস্ত শ্লোকগুলো একটি সেনাবাহিনীর মতো আর ১/৩/২৮ নং শ্লোক হলো রাজা যিনি সমগ্র সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করছেন।
জয়দেব গোস্বামীর গীতগোবিন্দতে (১২ শতক) ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে সমস্ত অবতারদের সম্বন্ধে বর্ণিত হয়েছে যা শ্রীমদ্ভাগতের শিক্ষাকে আরো শক্তিশালী করে।
গীতগোবিন্দের ১ম অধ্যায়ে ভগবানের দশ অবতারের বর্ণনা প্রদানের পর জয়দেব গোস্বামী কৃষ্ণকে অবতারগণের উৎসরূপে বর্ণনা করেছেন। গীতগোবিন্দের ১ম স্তবকের ১৬ নং শ্লোকে বলা হয়েছে-“হে কৃষ্ণ, আমি আপনার চরণে প্রণিপাত করছি, আপনি এই দশ অবতাররূপ পরিগ্রহণ করেছেন।”
কৃষ্ণের অদ্বিতীয় গুণ
ভক্তিরসামৃতসিন্ধু গ্রন্থে শ্রীল রূপ গোস্বামী শ্রীকৃষ্ণের ৬৪টি গুণ উল্লেখ করেছেন, যার মধ্যে ৫০টি গুণ সাধারণ জীবের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু ভগবান ব্রহ্মা, ভগবান শিব এবং অন্যান্য দেবতাদের রয়েছে ৫৫টি গুণ। ভগবান বিষ্ণুর রয়েছে ৬০টি গুণ। কিন্তু সর্বশেষ ৪টি গুণ কেবল কৃষ্ণের মধ্যেই রয়েছে, তাই তিনি পরম পুরুষোত্তম ভগবান। কৃষ্ণের সেই অদ্বিতীয় ৪টি গুণ হল :
১। লীলা মাধুর্য : ভক্তদের প্রীতি বিধানে তিনি অসীম মাধুর্যময় লীলার প্রদর্শন ঘটান।
২। ভক্ত মাধুর্য : তিনি প্রিয় ভক্তদের সাথে অন্তরঙ্গ সম্বন্ধে ভাবের আদান-প্রদান করেন।
৩। বেণু মাধুর্য : তিনি তার অপ্রাকৃত বংশী বাদন করেন যা সকল আত্মাকে আকর্ষণ করে।
৪। রূপ মাধুর্য : সমগ্র সৃষ্টিজগতে তার সৌন্দর্যের কোন তুলনা হয় না।
এখানে বর্ণিত কৃষ্ণের শ্রেষ্ঠত্ব মূলত প্রাথমিক পর্যায়ের কেননা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শক্তিমত্তার বদলে ভালোবাসা এবং ঐশ্বর্যের বদলে মাধুর্য দিয়ে তার শ্রেষ্ঠত্বকেও ছাড়িয়ে গেছেন।
শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর তার নবদ্বীপ ভাবতরঙ্গ (১১৮) এ লিখেছেন: শ্রীকৃষ্ণ যে পরিমাণ | মাধুর্যরসের আধার বৈকুণ্ঠনাথও সম পরিমাণ ঐশ্বর্যরসে পূর্ণ। ব্রজেন্দ্রনন্দন শ্রীকৃষ্ণ কখনোই তার সমপরিমাণ ঐশ্বর্যকে পরিত্যাগ করেন না কিন্তু শুদ্ধ ভক্তদের কাছে তার সেই ঐশ্বর্য গুরুত্বহীন।
অন্য কথায় কৃষ্ণ মাঝে মাঝে তার ঐশ্বর্যময় সত্ত্বা প্রকাশ করেন ভগবান বিষ্ণুর মতো, ঠিক যেমন দ্বারকা লীলা । কিন্তু বিষ্ণু কখনোই কৃষ্ণ এবং তার অ ন্তরঙ্গ ভক্তদের ন্যায় মাধুর্য প্রকাশ করেন না। তাই বলা যায় কৃষ্ণের এমন কিছু রয়েছে যা বিষ্ণুর লীলায় পাওয়া যায় না- তা হলো অন্তরঙ্গ ভালোবাসার আদানপ্রদান, মাধুর্যলীলা।
ভগবান বিষয়ে যেসকল ধারণা রয়েছে, এমনকি বৈষ্ণব ঐতিহ্যও, তা সাধারণত সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধার দিকে ধাবিত করে। কিন্তু কৃষ্ণ অন্তরঙ্গতা এবং পারস্পরিক ভালোবাসার সম্বন্ধ প্রকাশ করেছেন। এটি তাকে সকল কিছু থেকে ভিন্নতর রেখেছে এবং তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। আমরা জানি যে, ভালোবাসা হচ্ছে আমাদের অস্তিত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ইন্দ্রিয় উপলব্ধির বিষয়।
গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতে ভগবানের সকল অবতারগণ একই । কিন্তু শুধুমাত্র কৃষ্ণ সকল অবতারদের মধ্যে মুখ্য অবস্থানে আছেন ঠিক যেমন প্রথম প্রদীপটি সকল প্রদীপের আলোর উৎস হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও কৃষ্ণ সকল বিষ্ণুতত্ত্বের উৎস হওয়া সত্ত্বেও তার মাধুর্য ও অন্তরঙ্গ সম্বন্ধ তার ঐশ্বর্যের অন্তরালে চলে গেছে। এমনকি তার সর্বাকর্ষক প্রকৃতি ভগবানের অন্যান্য অবতারদেরও আকর্ষণ করে।
শ্রীল প্রভুপাদ বর্ণনা করেছেন, কৃষ্ণ হলেন মদনমোহন। কারণ তিনি সকলের আকর্ষক মদনেরও চিত্ত হরণ করতে পারেন। যখন তিনি ত্রিভঙ্গ রূপে দণ্ডায়মান হন, তখন তিনি সকল জীবকে আকর্ষণ করেন, এমনকি দেব-দেবীদেরও। এমনকি তিনি বৈকুণ্ঠে অবস্থিত শ্রীনারায়নের চিত্তও আকর্ষণ করেন। শ্রীল প্রভুপাদ চৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা গ্রন্থের দশম অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন “শ্রীকৃষ্ণের রূপ মাধুরিমা অনুপম, কারণ সেই রূপ মাধুর্য হচ্ছে অসমোধ্বর্য—যার সমান সৌন্দর্য কারও নেই, যার চেয়ে কারও সৌন্দর্য শ্রেয় নয়। নারায়ণ মূর্তিসহ তিনি সকল অবতারের অবতারী হওয়ায় নারায়ণের প্রিয়তমা লক্ষ্মীদেবীও নারায়ণের সঙ্গ ত্যাগ করে কৃষ্ণ-সান্নিধ্য লাভের জন্য তপস্যা করেন। কৃষ্ণ হচ্ছেন সৌন্দর্যসিন্ধু, রূপামৃত পারাবার; এই হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণরূপ মাধুর্যের মহিমা।”
লেখক পরিচিতি : সত্যরাজ দাস (স্টিভেন জে. রোজেন) একজন আমেরিকান লেখক। শ্রীল প্রভুপাদের অন্যতম একজন শিষ্য এবং শ্রীমৎ ভক্তিতীর্থ স্বামী মহারাজের অন্ত রঙ্গ জন। বৈদিক শাস্ত্রের বিবিধ বিষয়ের ওপর ২০টিরও বেশী গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি জার্নাল অব বৈষ্ণব স্টাডিজ এর প্রধান সম্পাদক ও আন্তর্জাতিক ব্যাক টু গড়হেড এর সহ সম্পাদক। তাঁর অন্যতম বিখ্যাত একটি গ্রন্থ হলো, শ্রীমৎ ভক্তিতীর্থ স্বামী মহারাজের জীবনী সম্বলিত ব্ল্যাক ।