এই পোস্টটি 235 বার দেখা হয়েছে
কৃষ্ণ সর্বদাই ক্রীড়ামগ্ন কিন্তু যখনই আমরা তার অনুকরণ করতে যাই , তখন আমরা পরাজিত হই
সার্বভৌম দাস
আমেরিকায় রয়েছে আরেক ধরনের জনপ্রিয় প্রফেশনাল ফুটবল । যখন ২০১৭ সালে হিউস্টনে সুপার বোল খেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, তখন আমরা কয়েকজন ভক্ত ডাউনটাউনে শ্রীল প্রভুপাদের গ্রন্থ বিতরণ করতে চেয়েছিলাম। আমরা সাহসিকতার সাথে ক্রীড়া উন্মাদনায় রত জনগণের মাঝে গ্রন্থ বিতরণের চেষ্টা করছিলাম । কিছু গ্রন্থ বিতরণ করা সম্ভব হল, কিন্তু সেটি সংখ্যায় তেমন বেশি না। তবে আমাদের এই অভিজ্ঞতার ফলে আমরা সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করলাম যে, এই জড় ক্রীড়ায় রয়েছে একটি শক্তিশালী সম্মোহন শক্তি। বাস্তবিকপক্ষে, প্রতি বছর ছয়শ বিলিয়ন ডলারের অধিক অর্থ ব্যয় হয় ক্রীড়া শিল্পে, আর ক্রীড়ামোদী ফ্যানদের ব্যক্তিগত খরচের কথা বাদই দিলাম ।
কেন খেলাধুলা এত জনপ্রিয়? বৈষ্ণব শিক্ষা অনুসারে, এই পৃথিবীর সবকিছুই এমনকি ক্রীড়াপ্রবৃত্তিও হল চিন্ময় জগতের বিশেষত সর্বাকর্ষক পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত কর্মের বিকৃত প্রতিফলন। দুর্ভাগ্যবশতঃ, এই জড়জগতে খেলাধুলা আকর্ষণীয় বলে মনে হয়, কিন্তু এই আকর্ষণ হল মায়ার বিভ্রম। আমরা এখানে কখনোই প্রকৃত আনন্দ লাভ করতে পারব না। সর্বোচ্চ আমরা মরুভূমিতে মরীচিকার মত বিকৃত কোন উপস্থাপনা থেকে রস লাভের ব্যর্থ চেষ্টা করতে পারি ।
যখনই ক্রীড়ার উৎপত্তির দিকে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করি অর্থাৎ যেই খেলায় আমরা সর্বোচ্চ পবিত্র আনন্দ লাভ করতে পারি, সেখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হলেন সেই আদি ক্রীড়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন বিজয়ী। অবাঞ্ছিত অনুরাগী হিসেবে আমরা শ্রীমদ্ভাগবত (১০/১৮/১৯) এ পাই-“ক্রীড়ারসজ্ঞ কৃষ্ণ তখন গোপবালকগণকে একত্রে আহ্বান করে বললেন- “হে গোপবালকগণ! চল, এখন আমরা নিজেদের দুটি সমান দলে ভাগ করে নিয়ে খেলা করি।’ রবীন্দ্র স্বরূপ দাস ব্যাখ্যা করেছেন ভগবানের খেলা হল অপ্রাকৃত ও পবিত্র, কিন্তু আমাদের খেলা হল জড়দূষণে জর্জরিত।
“ভগবান ক্রীড়ারত: এই অপ্রাকৃত কার্যাবলীর সংস্কৃত অর্থ হল ‘প্রকৃতপক্ষে লীলা’। ভগবান আমাদের অভাবনীয় শক্তিমত্তার দ্বারা অবতরিত হয়ে (যদিও এই অবতরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য থাকে) ক্রীড়ায় মত্ত হন। ঠিক যেমন মৎস্য অবতার, তিনি জলপ্লাবনের তরঙ্গে ক্রীড়ারত ছিলেন। এরপর বরাহ অবতারে তিনি একটি যুদ্ধক্রীড়া উপভোগ করেন। তাঁর সকল অবতারেই দেখা যায় তিনি একটি কার্য সাধনের পাশাপাশি একজন খেলোয়াড়ের ভূমিকা পালন করেন। ভগবানের লীলার অর্থ হল অপ্রাকৃত কার্যকলাপ, এটি অনুকরণীয় নয়। সকল মানুষের কার্যসমূহ সাধিত হয় মূলত অনুকরণের মাধ্যমে, বিশেষত আমাদের মধ্যে থাকা কোন বিষয়ের অভাব পূরণের অভিলাষে । কিন্তু ভগবানের সবকিছুই রয়েছে। তার কোন কিছু অর্জন কিংবা হারানোর নেই।” (সূত্র: ব্যাক টু গডহেড, মে ১৯৮৫)
চৈতন্য সন্দেশ অ্যাপ ডাউনলোড করুন :https://play.google.com/store/apps/details?id=com.differentcoder.csbtg
সুতরাং, আমরা দেখতে পাই, ভগবানের সমস্ত ক্রীড়ালীলায় রয়েছে চিন্ময় সুবিধা এবং সকলের জন্য আশীর্বাদ, এমনকি যারা আমি কিংবা আপনার দর্শক হিসেবে সেইসব ক্রীড়ার কথা পঠন কিংবা শ্রবণ করি আমাদের মঙ্গল সাধিত হয়। কিন্তু এই জড়জগতে যারা ভগবানের সেই ক্রীড়ালীলাকে অনুকরণ করতে চাইবেন তারা প্রকৃতির আইনের অধীনে জড়িয়ে পড়বেন । উদাহরণস্বরূপ, কৃষ্ণ ব্যতীত কোন জাগতিক মানুষ যদি ষাড় লড়ায়ে কোন ষাড়কে হত্যা করে তবে তাঁর ফলাফল হিসেবে সেই ষাড় ও ষাড় লড়াই পরিচালকের জীবনে দুর্গতি নেমে আসে। কেননা তারা সেইসব দর্শক যারা সেই হত্যা ক্রীড়া দর্শন করেছেন সকলেই কর্মের বন্ধনে জড়িত হয়ে পড়েন, যার কারণে তাদের ভবিষ্যতে কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হবে। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে আমরা যেসমস্ত ক্রীড়াবিদদের প্রশংসা করছি কিংবা নিজেদের আইডল হিসেবে বিবেচনা করছি তারা কেউই কৃষ্ণভক্ত নয় এবং তাই তারা স্ফীত তৃপ্তি লাভ করেন তা যথাযথ নয়। যেমন, আমেরিকান ফুটবলের একজন জনপ্রিয় খেলোয়াড় ও জে. সিম্পসন তার অ্যাথলেটিক স্কিলের জন্য লক্ষ লক্ষ ফ্যানদের কাছে দেবতুল্যরূপে পরিগণিত হতেন কিন্তু তিনি একসময় তিনি হত্যার আসামী হয়ে জেলে যান এবং সেখানেও আরেকটি অপরাধ করেন এবং এখন আর তাকে হিরো বলে মনে করা হয় না। বিভিন্ন খেলার তথাকথিত ঈশ্বরদের অধিকাংশই ডোপিং, প্রতারণা, ধর্ষণ, মদ্যপান এমনকি নরহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত। এই প্রকারে ক্রীড়াবিদরা আমাদের বিনোদন দিতে পারে কিন্তু তারা আমাদের জড়বন্ধন থেকে মুক্ত করতে পারে না । কৃষ্ণ ভগবদ্গীতায় (৮/১৫) অর্জুনকে বলেছেন- দুঃখালয়ম্ অশাশ্বতম্ – দুঃখপূর্ণ নশ্বর সংসার। তাই সকল চেষ্টা করেও আমরা এখানে প্রকৃতপক্ষে বিজয়ী হতে পারি না এবং এমনকি বিজয়ী হলেও সেই কষ্টার্জিত বিজয়ের ফল বেশিদিন ভোগ করতে পারি না ।
সময় অপচয়
যে সমস্ত অতি সৌভাগ্যবান জীব মনুষ্যদেহ লাভ করেছেন তাদের উদ্দেশ্যে শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, জাগতিক ক্রীড়াসমূহ হল শুধুমাত্র মূল্যবান সময়ের অপচয় ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তির মাধ্যমে আনন্দ লাভের এক ব্যর্থ প্রচেষ্ঠা মাত্র ।
তিনি শ্রীমদ্ভাগবতে (১/১/১০, তাৎপর্য) লিখেছেন, “এই কলিযুগে মানুষ কেবল বিভিন্ন রাজনৈতিক সংস্থা এবং দলের শিকারই হচ্ছে না, ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির বিভিন্ন রকমের প্রলোভনের দ্বারাও বিপথগামী হচ্ছে। যেমন সিনেমা, অনর্থক খেলাধুলা, জুয়া, ক্লাব, জড় জাগতিক গ্রন্থাগার, অসৎ সঙ্গ, ধুমপান, আসব পান, প্রতারণা, চুরি, বাটপাড়ি ইত্যাদি।”
অবশ্যই ক্রীড়া অনুশীলন আমাদের বিনোদনের সাথে সাথে শরীরচর্চার সুযোগ প্রদান করে কিন্তু ঐকান্তিক ভক্তগণ জানেন- জাগতিক ক্রীড়া এমনকি দর্শক হিসেবে ক্রীড়া উপভোগও সূক্ষ্ম কিংবা স্থূলভাবে দূষণীয় । তাছাড়া অধিকাংশ দর্শক সহযোগে অনুষ্ঠিত ক্রীড়াসমূহ বিপুল পরিমাণ বিক্রম ও পাপবৃত্তিতে চালিত করে সকলকে কেননা এর পেছনে একটি অবৈধ অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য জড়িত থাকে।
যেহেতু এই জড় জগতের ক্রীড়া হল চিন্ময় জগতের কৃষ্ণ থেকে আসা ক্রীড়ার বিকৃত প্রতিরূপ তাই স্বাভাবিকভাবেই এটি আমাদের আকর্ষণ করতে পারে। কিন্তু আমাদের অবশ্যই জানতে হবে এটি মায়াদেবীর বিধ্বংসী অস্ত্রসমূহের মধ্যে একটি অস্ত্র, যার দ্বারা আমরা সহজেই ঘায়েল হতে পারি।
যদি আমরা এই জাগতিক ক্রীড়াসমূহকে একটি নৈমিত্তিক সৌন্দর্য, উদ্দীপনা, বীরত্ব, উত্তেজনা, স্বতঃস্ফূর্ততা, নাটক, সৃজনশীল, দৃঢ়তা, অসাধারণ টিমওয়ার্ক কিংবা উজ্জল কৌশলরূপে দেখি তবে পেলে, মোহাম্মদ আলী, মাইকেল ফিলিপস, উসাইন বোল্ট, শচীন টেন্ডুলকার কিংবা মেসির সেই দক্ষতা, রণকৌশল ও শক্তিমত্তার উৎস কোথায়? আমরা জানি (ভগবদ্গীতায় ১০/৪১) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “ঐশ্বর্যযুক্ত, শ্রী-সম্পন্ন ও বল- প্রভাবাদির আধিক্যযুক্ত যত বস্তু আছে, সে সবই আমার তেজাংশসম্ভূত বলে জানবে।” ও “আমি মানুষের পৌরুষ (মানুষের সকল ক্ষমতা)” ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চান না আমরা তাঁর শক্তির বিকৃত এক ঝলকমাত্র দর্শনে মোহিত হয়ে জাগতিক স্টেডিয়াম অথবা টিভি স্ক্রিনে তাকিয়ে থেকে অযথা কালক্ষেপন করি । তিনি চান আমরা যেন তাঁর পরম অভ্যুয়ম তথা নিত্য চিন্ময় লোক লাভ করি। শ্রীল প্রভুপাদের ভাষ্য : “সেই পদম্ অব্যয়ম্ বা নিত্য জগতে সেই যেতে পারে, যে নির্মানমোহ অর্থাৎ যে মোহমুক্ত হতে পেরেছে। এর অর্থ কি? এই জড় জগতে সকলেই কিছু না কিছু হতে চায়। কেউ চায় রাজা হতে, কেউ চায় প্রধানমন্ত্রী হতে, কেউ চায় ঐশ্বর্যশালী হতে, এভাবেই সকলেই কিছু না কিছু হতে চায় । যতক্ষণ না আমরা আধিপত্য করার এই বাসনাকে সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে পারছি, ততক্ষণ আমরা জড় বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ভগবানের আলয় সনাতন ধামে ফিরে যেতে পারব না। সেই ভগবৎ-ধাম, যা সনাতন, সেখানে কেবল তাঁরাই যেতে পারেন, যাঁরা জড় জগতের ভোগ-বাসনার দ্বারা লালায়িত নন, যাঁরা ভগবানের সেবায় নিজেদের সর্বতোভাবে নিয়োজিত করেছেন। কেউ এভাবে অধিষ্ঠিত হলে তিনি অনায়াসে পরম ধামে উপনীত হন ।
মিথ্যা উপাধি
জড় ক্রীড়ার সাথে নিজের পরিচয় জড়ানোর অর্থ হল আরো অপ্রয়োজনীয়, কৃত্রিম জড় উপাধিতে নিজেকে আবদ্ধ করা। আমরা অত্যন্ত গর্বের সাথে প্রিয় ক্রীড়াদলের লোগো সম্বলিত টি-শার্ট পরিধান করি। যদিও এই সমস্ত দলসমূহের অনেকের রয়েছে কল্পিত নাম, কেউ কেউ উপযুক্তভাবেই রেখেছে কোন প্রাণীর নামে তাদের নাম এবং এদেরকেই আমরা আমাদের হিরোরূপে বিবেচনা করি!
প্রকৃত হিরো
লেখক পরিচিতি: সার্বভৌম দাস, শ্রীমৎ তমাল কৃষ্ণ গোস্বামীর একজন শিষ্য যিনি হিউস্টন, টেক্সাসে অবস্থান করছেন। তিনি এখানে কৃষ্ণভাবনামৃত শিক্ষা দান ও বিভিন্ন লেখনী প্রকল্পে নিয়োজিত আছেন।