এই পোস্টটি 189 বার দেখা হয়েছে
ব্রজবিহারী দাস
“ওয়াও! তিনি সত্যিই অনেক সুন্দর। তিনি কি দেবতা?”-একটি বিলবোর্ডের দিকে তাকিয়ে আমার এ সরল প্রশ্ন। আমার বন্ধু শিশির শুনেই হেসে দিল। বলল, “তিনি গ্রিক দেবতা হিসেবে পরিচিত এবং অন্যদের চেয়ে তোমার ভালো জানা উচিত যে এ বাহ্যিক প্রদর্শন হল প্রতারণাপূর্ণ। “ঠিক আছে ভুল হয়েছে” বলে আমি থামলাম। এ প্রদর্শনগুলো সে সারগর্ভ শূন্য তার পারমার্থিক দর্শন সম্পর্কে আমি পূর্ণ অবগত তা-ই আমার কাছ থেকে আশা করা হয়। “হ্যাঁ, আমি সিনেমা দেখি না। কিন্তু তাঁর নামটি অনেক সুপরিচিত।” আমার বন্ধুটি বলল, “তিনি হৃতিক রৌশন।” তুমি যেমনটি ভাবছ তার শরীর আসলে তত বড় নয়। সিনেমাগুলোতে প্রায়ই তাদের শরীর বড় করে দেখানো হয়। “তিনি নিশ্চয়ই শরীর গঠনে পারদর্শী তাই না?- আমার উৎসুক জিজ্ঞাসা। শিশির এখন আমাকে জ্ঞান দিতে বলে উঠল, “এটা সত্য থেকে অনেক দূরে।” “তুমি হয়ত জানো, তিনি স্লিপ ডিস্কে এবং পাতলা শরীরে বড় বড় বাইসেপ ও ট্রাইসেপের কারণে ভারসাম্যহীনতায় ভুগছেন। “সত্যি?” আমি অবাক হয়ে আরো জানতে চাইলাম। “তিনি তাঁর নিতম্ব, কোমর, উরু, পায়ের গোড়ালী প্রভৃতি মূল পেশীগুলো উপেক্ষা করে শুধু বিশ্বকে দেখানোর জন্য যে পেশীগুলো বাড়ানো দরকার কেবল তাতেই মনোযোগ দিয়েছেন। ফলস্বরূপ, তাকে স্ক্রিনে ভালো দেখাচ্ছে কিন্তু বাস্তবে তীব্র যন্ত্রণায় ভুগছেন। তিনি মেরুদণ্ড ও হাটু ভেঙে ফেলেছেন এবং কাঁধ দুটোকে চওড়া করে বিদীর্ণ করেছেন। তারপরেও তিনি সুপারহিরো। কী হাস্যকর !” আমি মনে করি, এরকম দশা অনেক পারমার্থিক হিরোদের বেলায়ও ঘটতে পারে। ভক্তিপথে কয়েক দশক অনুশীলন করার পর লাভ-পূজা- প্রতিষ্ঠা এসে ধরা দেয়। যদি মানুষকে দেখানোর জন্য “পেশীগুলোর” দিকে মনোযোগ বেশী দেওয়া হয় তাহলে ভেতরে ও বাইরের চিত্র ভিন্ন হতে পারে। যদিও হৃতিকের ভক্তরা এ অবহেলাকে উৎসাহ দিচ্ছিল, কিন্তু হৃতিককে এর জন্য চড়ামূল্য দিতে হচ্ছে। ভালো ক্লাসের আয়োজন করতে পারা, পরামর্শদানের দক্ষতা, সুদ ব্যবস্থাপনা এবং অন্যান্য পারদর্শিতা আমাদের সাফল্য এনে দেয় যা মানুষ দেখতে পায়। কিন্তু ভক্তরা তাঁদের মূল্যবান সময়টুকু জপ, প্রার্থনা অথবা চেতনা জাগানোর বিভিন্ন পারমার্থিক অনুশীলনে ব্যয় করে যা প্রায়ই মানুষের অনুভব হয় না। কারো ঐকান্তিক অন্তদর্শনই তাঁকে তাঁর স্বরূপ ও ভগবানের সন্নিকটে নিয়ে যেতে পারে। এতে অনেক পরিশ্রম লাগে এবং তাঁর স্বীকৃতিও কম জোটে। যদি কোন নবীন ভক্ত এসব পার্থিব স্বীকৃতি ও প্রশংসার দ্বারা আকৃষ্ট হয়, তাহলে সে প্রবল উদ্দীপনায় তার দিকে আরো ধাবিত হবে। শুরুতে হয়ত প্রশংসা বা স্বীকৃতিগুলো ভালো টনিকের মত কাজ করে, কিন্তু এগুলো মাত্রাতিরিক্ত সেবনের খারাপ প্রতিক্রিয়াও আছে, তা ঔষুধ থেকে বিষে পরিণত হবে। এরপর এরকম বাহ্যিক প্রশংসা আনয়নকারী বিষয়গুলোতে অধিক সময় দেবে এবং আভ্যন্তরীন পুষ্টিসাধনকারী পারমার্থিক অনুশীলনগুলোকে অবহেলা করতে থাকবে । ফলস্বরূপ, জগৎ তাকে একজন মহান ভক্ত হিসেবে গুনগান করবে, কিন্তু ভেতরে সে হবে গর্ভশূন্য। ‘মার্চেট অব ভেনিস’ নাটকে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার লিখেছেন, “চকচক করলেই সোনা হয় না।” সে নবীনভক্ত একপর্যায়ে ‘স্লিপ ডিস্কের’ মতো ভারসাম্যহীনতায় ভুগতে ভুগতে কৃষ্ণভাবনা হতে সরে যাবে। এ দুঃসংবাদ শুনে লোকেরা হয়ত ব্যথিত হয়ে জিজ্ঞেস করবে “সে অনেক ভালো ভক্ত ছিল। সে কীভাবে কৃষ্ণভাবনার পথ ত্যাগ করতে পারে?” বা বলবে, “তাকে অনেক দারুণ সব কাজ সম্পন্ন করতে দেখেছি, তার কিভাবে পারমার্থিক পথে সমস্যা হতে পারে?” এই হল কিছু সাধারণ লোকের কিছু মোহগ্রস্ত অভিব্যক্তি। জগৎ হয়ত কোন ব্যক্তির বাহ্যিক দিক দেখে মুগ্ধ হতে পারে, কিন্তু পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যিনি সকলের ভেতরের কণ্ঠ, তিনি চান তাঁর ভক্ত সৎ হোক । যদি ভক্ত ভেতরের দিকে মনোযোগী না হয় এবং বাইরে ও ভেতরে যদি সামঞ্জস্য না থাকে, তাহলে শীঘ্রই ভেতরের অংশটি প্রতিশোধ নেবে। পরে সারা জগৎ জানবে যে, ভক্তটি যতটা প্রদর্শন করত ততটা উন্নত নয়। এমনকি যদি আমরা জগৎকে বোকা বানাই, তাহলেও অসত্যের সাথে আমরা কতদিন থাকতে পারবো? “মানুষ নিজেকে যা ভাবে, আসলে তা নয়। মানুষ তা-ই, যা সে লুকায়।”
(ফরাসী ঔপন্যাসিক, ১৯০১-১৯৭৬)
ব্যাক টু গডহেড, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৮ হতে প্রকাশিত