এই পোস্টটি 552 বার দেখা হয়েছে
নারয়ণের পুত্র ব্রহ্মা, যমরাজ ও ভীষ্মদেবের কি সিদ্ধান্ত
কমললোচন গৌরাঙ্গ দাস
পরাৎপর পরমেশর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানতে হলে প্রথমে দ্বাদশ মহাজনের শরণাগত হতে হবে। কারণ তাঁরা ধর্মের প্রকৃত তত্ত্বেবত্তা।
ভগবানকে কারা জানেন আর কারা জানতে পারবে না?
শ্রীমদ্ভাগবতে (৬/৩/২০) বলা হয়েছে-“ব্রহ্মা, নারদ, শিব, চতুঃসন, কপিল (দেবাহূতি-পুত্র), স্বায়ম্ভুব মনু, প্রহ্লাদ মহারাজ, জনক মহারাজ, পিতামহ ভীষ্ম, বলি মহারাজ, শুকদেব গোস্বামী এবং আমি (যমরাজ)- আমরা এই বারো জন প্রকৃত ধর্মের তত্ত্ব জানি।” শ্রীল প্রভুপাদ তাৎপর্যে বর্ণনা করেছেন, “কেউ প্রশ্ন করতে পারে, “এই তত্ত্ব যদি এতই দুর্বোধ্য হয়, তা হলে তার প্রয়োজন কি?” তার উত্তরে যমরাজ এখানে বলেছেন যে, কেউ যদি ব্রহ্মা, শিব, চতুঃসন এবং অন্যান্য মহাজনদের পরম্পরার ধারা অনুসরণ করেন, তা হলে তা বোধগম্য হয়।”
তথাকথিত পন্ডিত বলেন, যেহেতু নারায়ণের চারটি হাত রয়েছে এবং শ্রীকৃষ্ণের দুটি হাত রয়েছে, তাই নারায়ণ হচ্ছেন আদিপুরুষ ভগবান, যাঁর থেকে কৃষ্ণ অবতাররূপে প্রকাশিত হয়েছে। (চৈ.চ আদি ২/৬১ তাৎপর্য)
কেউ যদি নিজের চেষ্টায় ভগবৎ-তত্ত্ব জানতে চেষ্টা করে তাকে শ্রীকৃষ্ণ গীতায় (৯/১১) বলেছেন, “আমি যখন মনুষ্যরূপে অবতীর্ণ হই, তখন মূর্খেরা আমাকে অবজ্ঞা করে।” যমরাজ স্বয়ং বলছেন ভাগবতের (৬/৩/১৪-১৫) কারা কারা ভগবানকে জানতে পারে না-“আমি যম, দেবরাজ ইন্দ্র, নির্ঋতি, বরুণ, চন্দ্র, অগ্নি, মহাদেব, পবন, ব্রহ্মা, সূর্য, বিশ্ববসু, অষ্টবসু, সাধ্যগণ, মরুৎগণ, রুদ্রগণ, সিদ্ধগণ, মরীচি প্রভৃতি অন্যান্য বিশ্বসষ্ট্রা, বৃহস্পতি প্রমুখ দেবশ্রেষ্ঠগণ এবং রজ ও তমোগুণ যাঁদের স্পর্শ করতে পারে না, সেই ভৃগু প্র্রমুখ সত্তগুণ-প্রধান মুনিগণও ভগবানের কার্যকলাপ বুঝতে পারেন না। অতএব, মায়ামোহিত অন্যান্য জীবেরা কিভাবে ভগবানকে জানতে পারবে?”বৈদিক সাহিত্যে নারায়ণ ও বিষ্ণুর নামই সাধারণত বেশি লক্ষ্য করা যায়, তবে তার কারণ কি? কখনো কখনো অনেক অ-তত্তজ্ঞ মানুষ শ্রীকৃষ্ণকে দশাবতারের এক অবতার বলে মনে করে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে কৃষ্ণ হচ্ছেন সকল পুরুষাবতার বা বিষ্ণুমূর্তি সমূহের উৎস – মহাবিষ্ণু গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু এবং ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণু সকলের উৎস। সকলেই শ্রীকৃষ্ণের স্বাংশ প্রকাশ। ২৪ জন লীলাবতার রয়েছেন। যেমন, মৎস্য, ক‚র্ম, নৃসিংহ ইত্যাদি। অনন্তকাল ধরে অসীম, অগণিত জড় ব্রহ্মাণ্ডসমূহে এইসব অবতারের প্রকাশ হয়, কিন্তু এঁরা সকলেই শ্রীকৃষ্ণেরই অংশ, কলা, শ্রীকৃষ্ণের স্বাংশ প্রকাশ বিস্তার। শ্রীমদ্ভাগবতে (ভাং ১/৩/২৮); সেই সত্য ঘোষিত হয়েছে।
“পূর্বোল্লিখিত এই সমস্ত অবতারেরা হচ্ছেন ভগবানের অংশ অথবা কলা অবতার, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং। যখন নাস্তিকদের অত্যাচার বেড়ে যায়, তখন আস্তিকদের রক্ষা করার জন্য ভগবান এই ধরাধামে অবতীর্ণ হন।” বৈদিক সাহিত্যে নারায়ণ ও বিষ্ণুর নামই সাধারণত বেশি লক্ষ্য করা যায়। এর কারণ হচ্ছে সৃজন, পালন ও সংহার কার্যে শ্রীকৃষ্ণ কখনই প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন না। তিনি এ-সব হতে সর্বদাই দূরে অবস্থান করেন এবং তাঁর নিজ ধামে নিরন্তর লীলাবিলাস উপভোগ করেন, আনন্দ সম্ভোগ করেন। তিনি জড় ব্রহ্মাণ্ডর সকল কার্যাবলী সম্পাদন করেন তাঁর প্রকাশসমূহের মাধ্যমে, তাঁর পুরুষাবতার-সমূহের মাধ্যমে।
দৃষ্টান্তস্বরূপ, ধরা যাক আপনি এক হাজার কোম্পানীর মালিক। কিন্তু আপনাকে এজন্য প্রত্যেক কোম্পানীতে ব্যক্তিগতভাবে গিয়ে কোম্পানীর তত্ত্ববধান করতে হয় না। প্রত্যেক কোম্পানীতে কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য আপনি ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিয়োগ করেছেন, তারাই সবকিছুর তত্ত্ববধান করছে, আর আপনি আপনার বাড়ীতে আরামকেদারায় হেলান দিয়ে আরাম করছেন, আনন্দ উপভোগ করছেন। কখনো আপনি এক হাজারের যে কোন একটি কোম্পানী পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সেজন্য আপনি একটিতে ফোন করেন এবং সেখানে পৌঁছান। যখন ম্যানেজিং ডিরেক্টর আপনাকে ফুলের তোড়া দিয়ে অভ্যর্থনা করে আপনাকে ভিতরে নিয়ে যান, তখন সেখানকার কর্মচারীরা আপনাকে নাও চিনতে পারে। তারা হয়ত ভাববে যে আপনি একজন নিশ্চিত গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী কোন ব্যক্তি, হয়ত ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সহকারী। ঠিক তেমনি যখন শ্রীকৃষ্ণ এই জড় জগতের কোনো ব্রহ্মাণ্ডে অবতীর্ণ হন, তিনি বিষ্ণুর মাধ্যমে আসেন এবং সেজন্য তাঁকে অনেক সময় ভুল করে বিষ্ণুর অবতার বলে মনে করা হয়। এই জড় জগতে যত অবতার অবতীর্ণ হন, সকলেই অবতীর্ণ হন ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণুর মাধ্যমে (তৃতীয় পুরুষাবতার)। কেন? কারণ এই পুরুষাবতার জীবের পালন-পোষণে সর্বক্ষণ নিয়োজিত।
শ্রীকৃষ্ণ সকল বিষ্ণুতত্ত্বসমূহের উৎস
একবার এই ধরিত্রী অত্যন্ত অসুর-ভারাক্রান্ত হলে ব্রহ্মা এবং অন্যান্য দেবগণ ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণুর নিকটে গিয়ে ‘পুরুষসূক্ত’ মন্ত্রে তাঁর স্তব করেন। তারপর ব্রহ্মা উপবিষ্ট হয়ে ধ্যানে-নিমগ্ন হন এবং তাঁর হৃদয়ে তিনি শ্রীবিষ্ণুর বাণী শ্রবণ করেন। ব্রহ্মা তখন সেই বাণী দেবতাগণকে জানান। এই হচ্ছে বৈদিক জ্ঞান লাভ করার যথাযথ পন্থা। ব্রহ্মা শ্রীবিষ্ণুর যে বার্তা শ্রবণ করেছিলেন, তা ছিল “পুরুষোত্তম পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শীঘ্রই তাঁর স্বরূপ শক্তিরাজিসহ পৃথিবীতে অবতীর্ণ হবেন এবং যতদিন তিনি ভক্তদের রক্ষা ও অসুরদের বিনাশ কার্যের জন্য পৃথিবীতে অবস্থান করবেন, দেবগণও যেন তাঁকে সহায়তা করার জন্য সেখানে উপস্থিত থাকেন। তারা সকলেই যেন অবিলম্বে যদু বংশে জন্মগ্রহণ করেন, সে বংশে ভগবান যথাসময়ে আবির্ভূত হবেন। ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণুর এই বাণীর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সকল বিষ্ণুরতত্ত্বসমূহের উৎস।
কৃষ্ণ ও বিষ্ণু অভিন্ন
কৃষ্ণ যখন তার স্ব-ধামে তার স্বাভাবিক নিত্য-স্বরূপে বিরাজ করেন, তখন তিনি ক্রীড়াকৌতুক করেন, সখাদের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করেন, তাঁর শুদ্ধ ভক্ত-পরিকরগণের সঙ্গে ভগবান কৃষ্ণ কত ধরনের আনন্দবিলাস করে বিহার করেন। কিন্তু তিনি যখন তাঁর অংশাবতার মহাবিষ্ণু রূপে নিজেকে প্রকাশ করেন, তখন তিনি এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্ম সম্পাদনে রত হন, কারণ সমুদ্রে শায়িত হয়ে কোটি কোটি জড় ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন। সুতরাং কৃষ্ণের সংগে বিষ্ণুর পার্থক্য ঠিক একজন রাজসভার মহারাজার সঙ্গে রাজপ্রাসাদে প্রত্যাগত মহারাজার মতো। যখন রাজা সভাগৃহে থাকেন, তখন তিনি তাঁর শাসনকর্তাদের সাহায্যে সমস্ত রাজ্যের সুষ্ঠু পরিচালনায় ও নানাবিধ কর্তব্যকর্মে নিমগ্ন থাকেন। কিন্তু তিনি যখন প্রাসাদে বিরাজ করেন, তখন তিনি তাঁর নিজ পরিবার-পরিজনের সঙ্গে
আমোদ-প্রমোদ করেন, তখন তাঁর কোনো গুরুগম্ভীর কর্তব্য-ভার থাকে না। তিনি তাঁর শিশুকে পিঠে চাপাতে পারেন, প্রিয়ার ভর্ৎসনা বাক্য শুনতে পারেন। কিন্তু তিনি যখন পুনরায় রাজকার্যে নিয়োজিত হন, তখন তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয় দুষ্কৃতিকারীদের দণ্ডদান, প্রজাপালন, শত্রুবিনাশ ইত্যাদির মাধ্যমে। কৃষ্ণ ও বিষ্ণুর অভিন্ন। কেবল ভক্তদের সঙ্গে প্রীতিবিনিময়ের ক্ষেত্রে উভয়ের সম্বন্ধজাত রসের তারতম্য রয়েছে (এছাড়া, শাস্ত্রানুসারে অনন্ত গুণশালী বিষ্ণু বা নারায়ণের ৬০টি বিশেষ গুণ রয়েছে, আর শ্রীকৃষ্ণের ঐ ৬০টি গুণ ছাড়াও আরো ৪টি বিশেষ গুণ রয়েছে, যা কোনো বিষ্ণু-মূর্তিতেই নেই। এই গুণগুলী হচ্ছে :
১. বেণুমাধুর্য,
২. রূপমাধুর্য,
৩. লীলামাধুর্য এবং
৪. মহাপ্রেমপর ভক্ত পরিবৃত থাকা)।
জীবসত্তাসমূহের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের সম্বন্ধকে পাঁচটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয় :
১.শান্ত; ২. দাস্য; ৩. সখ্য; ৪. বাৎসল্য ৫. মাধুর্য। যেখানে শ্রীবিষ্ণুর প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম মিশ্রিত (ঐশ্বর্য-জ্ঞানযুক্ত), কৃষ্ণের প্রতি প্রীতি ঐশ্বর্য-জ্ঞানলেশশূন্য, পরিপূর্ণ মাধুর্য-ভাব মণ্ডিত এবং পরম আস্বাদ্য।
তাঁর থেকে আর কেউ শ্রেষ্ঠতর নেই, সেই সত্য ঘোষণা করে ভগবদ্গীতায় (৭/৭) শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “হে ধনঞ্জয় (অর্জুন)! আমার থেকে শ্রেষ্ঠ আর কেউ নেই। সূত্রে যেমন মণিসমূহ গাঁথা থাকে, তেমনই সমস্ত বিশ্বই আমাতে ওতঃপ্রোতভাবে অবস্থান করে।”
অফিস ও বাড়ির ভগবান
উপরোক্ত বিষয়ে আরো দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত স্থাপন করেছেন স্বয়ং দ্বাদশ মহাজনের অন্যতম ভগবান ব্রহ্মাজী। যা শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতের
আদিলীলায় (২/২৮-৮৬) সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে-“সেই নারায়ণ ও শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান। যদিও তাঁরা একই বিগ্রহ, কিন্তু তাঁদের আকার ভিন্ন। (২৮)
ইহোঁত দ্বিভুজ, তিঁহো ধরে চারি হাত।
ইহোঁ বেণু ধরে, তিঁহো চক্রাদিক সাথ ॥ ২৯ ॥
“পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্বিভুজ এবং তাঁর সেই ভুজদ্বয়ে তিনি বংশী ধারণ করেন। আর তাঁর নারায়ণ রূপে তিনি চতুর্ভুজ এবং সেই ভুজচতুষ্টয়ে তিনি শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম ধারণ করেন।”
তাৎপর্য : নারায়ণ শ্রীকৃষ্ণ থেকে অভিন্ন। তাঁরা একই পুরুষ ভিন্নরূপে প্রকাশিত হয়েছেন। উচ্চ আদালতের (হাইকোর্টের) বিচারপতি যেমন আদালতে অবস্থানকালে একভাবে এবং তাঁর বাড়িতে অবস্থানকালে ভিন্নভাবে জীবন যাপন করেন, এটি অনেকটা সেই রকম। নারায়ণ রূপে ভগবান চতুর্ভুজ, কিন্তু কৃষ্ণরূপে তিনি দ্বিভুজ।
কৃষ্ণ কিভাবে নারায়ণ?
নারায়ণস্তং ন হি সর্বদেহিনা-
মাত্মাস্যধীশাখিললোকসাক্ষী ।
নারায়ণোহঙ্গং নরভূ-জলায়না-
ত্তচ্চাপি সত্যং ন তবৈব মায়া ॥ ৩০ ॥
“হে অধীশ্বর, তুমি অখিল লোকসাক্ষী। তুমি হচ্ছ সকলের প্রিয় আত্মা, তাই তুমি কি আমার পিতা নারায়ণ নও? নর (গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু) জাত জল হচ্ছে নার, তাতে যাঁর অয়ন (আশ্রয়স্থল), তিনিই নারায়ণ। তিনি তোমার অঙ্গ অর্থাৎ অংশ। তোমার অংশরূপ কারণোদকশায়ী বিষ্ণু, ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণু ও গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু কেউই মায়ার অধীন নন। তাঁরা সকলেই মায়াধীশ, মায়াতীত পরম সত্য।”
তাৎপর্য : এই শ্লোকটি শ্রীমদ্ভাগবত (১০/১৪/১৪) থেকে উদ্ধৃত। শ্রীকৃষ্ণের যোগৈশ্বর্যের কাছে পরাভূত হয়ে ব্রহ্মা যখন তার ভুল বুঝতে পারেন, তখন দৈন্যতা সহকারে শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা নিবেদন করার সময়ে তিনি এই উক্তিটি করেন। ব্রহ্মা পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলেন যে, গোপবালক রূপে লীলাবিলাসকারী শ্রীকৃষ্ণই প্রকৃতপক্ষে পরমেশ্বর ভগবান কিনা। ব্রহ্মা গো-চারণভূমি থেকে শ্রীকৃষ্ণের সমস্ত গাভীদের এবং গোপবালকদের অপহরণ করে নিয়ে যান। কিন্তু তারপর তিনি যখন গোচারণভূমিতে ফিরে আসেন, তখন তিনি দেখতে পান যে, তার অপহৃত সমস্ত গোপবালক ও গাভীরা সেখানে ঠিক আগের মতোই বিরাজ করছে, কেন না শ্রীকৃষ্ণ পুনরায় তাঁদের সৃষ্টি করেছিলেন। ব্রহ্মা যখন শ্রীকৃষ্ণের এই যোগৈশ্বর্য দর্শন করেন, তখন তিনি নিজের পরাজয় স্বীকার করেন এবং শ্রীকৃষ্ণকে সব কিছুর পরম অধীশ্বর, লোকসাক্ষী এবং প্রতিটি জীবের হৃদয়ে বিরাজমান পরমাত্মারূপী পরম প্রিয় প্রভু বলে সম্বোধন করে তাঁর বন্দনা করেন। এই শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন ব্রহ্মার পিতা নারায়ণ,
কারণ শ্রীকৃষ্ণের অংশ প্রকাশ গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু গর্ভসমুদ্রে শয়ন করে তাঁর নাভিপদ্ম থেকে ব্রহ্মাকে সৃষ্টি করেছিলেন। কারণ-সমুদ্রে শায়িত মহাবিষ্ণু এবং প্রতিটি জীবের হৃদয়ে পরমাত্মারূপে বিরাজমান ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণুও এই পরমেশ্বর ভগবানের চিন্ময় অংশ প্রকাশ।
“শ্রীকৃষ্ণের খেলার সাথী ও গো-বৎসদের হরণ করে শ্রীকৃষ্ণের চরণে ব্রহ্মা অপরাধ করেছিলেন। তাই, অপরাধ খণ্ডন করার জন্য তিনি ভগবানের কাছে কৃপাভিক্ষা করেন।” (৩১)
“তোমার নাভিপদ্ম থেকে আমার জন্ম হয়েছে। তাই তুমি আমার পিতা-মাতা এবং আমি তোমার সন্তান।” (৩২)
“পিতা-মাতা কখনও তাঁদের শিশু সন্তানের অপরাধ গ্রহণ করেন না। আমি তাই তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, আমার প্রতি কৃপা পরবশ হয়ে আমার এই অপরাধ ক্ষমা কর।” (৩৩)
শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “হে ব্রহ্মা, তোমার পিতা নারায়ণ। আমি একজন গোপশিশু মাত্র, আর তুমি বলছ যে তুমি আমার পুত্র। সেটি কি করে সম্ভব?” (৩৪)
“ব্রহ্মা উত্তর দিলেন, “তুমি কি নারায়ণ নও? তুমি যে নারায়ণ, তার কারণ আমি বলছি- কৃপা করে শোন।” (৩৫)
“প্রাকৃত ও অপ্রাকৃত জগতে যত জীব রয়েছে, তাঁদের সকলেরই আদি উৎস হচ্ছ তুমি। কারণ তুমি সকলের পরমাত্মা। (৩৬)
“পৃথিবী যেমন মাটি দিয়ে তৈরি সমস্ত পাত্রের মূল কারণ ও আশ্রয়, তুমিও হচ্ছ সমস্ত জীবের পরম কারণ ও আশ্রয়।” (৩৭)
“‘নার’ শব্দে সমস্ত জীবকে বোঝানো হয় এবং ‘অয়ন’ শব্দে তাদের আশ্রয়কে বোঝায়।” (৩৮)
“তাই তুমিই হচ্ছ মূল নারায়ণ। সেটি হচ্ছে একটি কারণ, এখন কৃপা করে দ্বিতীয় কারণটি শোন। (৩৯)
“পুরুষাবতারেরা হচ্ছেন জীবের ঈশ্বর। কিন্তু তোমার ঐশ্বর্য ও শক্তি তাঁদের থেকে অধিক। (৪০)
“তাই তুমি হচ্ছ সকলের অধীশ্বর, সকলের পরম পিতা। তাঁরা (পুরুষাবতারেরা) তোমার শক্তিতে শক্তিমান হয়ে জগৎ পালন করেন। (৪১)
“যেহেতু তুমি সমস্ত জীবের আশ্রয় এই পুরুষাবতারদের পালন কর, তাই তুমি হচ্ছ মূল নারায়ণ। (৪২)
“হে প্রভু, হে পরমেশ্বর ভগবান! দয়া করে আমার তৃতীয় কারণটি শ্রবণ কর। অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড ও বৈকুণ্ঠাদি ধাম রয়েছে। (৪৩)
“এই জড় জগৎ ও চিৎ-জগতের সমস্ত জীবের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমস্ত কার্যকলাপ তুমি প্রত্যক্ষ কর। যেহেতু তুমি হচ্ছ সমস্ত কার্যকলাপের সাক্ষী, তাই তুমি সব কিছুর মর্ম জান। (৪৪)
“সমস্ত কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করার মাধ্যমে তুমি তাদের পরিচালনা কর বলেই সমস্ত জগতের স্থিতি হয়। তোমার এই রকম পরিচালনা ব্যতীত কোন কিছুই স্থিতিশীল বা গতিশীল হতে পারে না অথবা কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না।” (৪৫)
“তুমি সমস্ত জীবের কার্যকলাপ দর্শন কর। সেই কারণেও তুমি হচ্ছ মূল নারায়ণ।” (৪৬)
ব্রহ্মাকে কৃষ্ণের পরীক্ষা কৃষ্ণ বললেন, “ব্রহ্মা, তুমি যে কি বলছ, তা আমি বুঝতে পারছি না। শ্রীনারায়ণ হচ্ছেন তিনি, যিনি সমস্ত জীবের হৃদয়ে বিরাজ করেন এবং কারণসমুদ্রের জলে শয়ন করেন।” (৪৭)
ব্রহ্মা উত্তর দিলেন, “আমি যা বলেছি তা সত্য। কারণসমুদ্রের জলে ও জীবের হৃদয়ে যে নারায়ণ বিরাজ করেন, তারা হচ্ছেন তোমার অংশ প্রকাশ”। (৪৮)
“কারণোদকশায়ী বিষ্ণু, গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু ও ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণু মায়ার দ্বারা জগৎ সৃষ্টি করেন। সেই সূত্রে তাঁরা মায়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।” (৪৯)
“জলে শয়নকারী এই তিনজন পুরুষ হচ্ছেন সব কিছুর পরমাত্মা। প্রথম পুরুষ হচ্ছেন ব্রহ্মাণ্ডসমূহের পরমাত্মা।” (৫০)
“সমষ্টিগত জীবের পরমাত্মা হচ্ছেন গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু এবং ব্যষ্টিজীবের পরমাত্মা হচ্ছেন ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণু।” (৫১)
এ সবার দর্শনেতে আছে মায়াগন্ধ ।
তুরীয় কৃষ্ণের নাহি মায়ার সম্বন্ধ ॥ ৫২ ॥
“আপাতদৃষ্টিতে এই সমস্ত পুরুষদের সঙ্গে মায়ার সম্বন্ধ রয়েছে। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন মায়াতীত, তাঁর সঙ্গে মায়ার কোন সম্বন্ধ নেই।”
তাৎপর্য : কারণোদকশায়ী বিষ্ণু, গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু ও ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণু-এই তিন পুরুষাবতারের সকলেরই জড়া প্রকৃতি বা মায়ার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে, কারণ মায়ার দ্বারা তাঁরা জড় জগৎ সৃষ্টি করেন। এই তিন পুরুষ, যাঁরা যথাক্রমে কারণসমুদ্র, গর্ভসমুদ্র ও ক্ষীরসমুদ্রে শয়ন করেন, তাঁরা হচ্ছেন সব কিছুর পরমাত্মা। কারণোদকশায়ী বিষ্ণু হচ্ছেন সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের পরমাত্মা, গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু হচ্ছেন সমষ্টিগত জীবের পরমাত্মা এবং ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণু হচ্ছেন ব্যষ্টিজীবের পরমাত্মা সৃষ্টির কারণে তাঁরা যেহেতু মায়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, তাই বলা যায় যে তারা মায়ার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন মায়াতীত। তাঁর সঙ্গে মায়ার কোন সংস্পর্শ নেই। তাঁর এই চিন্ময় স্থিতিকে বলা হয় তুরীয় বা মায়াতীত।
বিরাড়্ হিরণ্যগর্ভশ্চ কারণং চেত্যুপাধয়ঃ ।
ঈশস্য যত্রিভির্হীনং তুরীয়ং তৎ প্রচক্ষতে ॥ ৫৩ ॥
“এই জড় জগতে ভগবান বিরাট হিরণ্যগর্ভ ও কারণ এই তিন মায়া সম্বন্ধীয় উপাধিযুক্ত। কিন্তু এই তিনটি উপাধির অতীত চতুর্থ স্তরে ভগবানের যে চরম স্থিতি, তাকে বলা হয় তুরীয়।”
তাৎপর্য : বিরাটরূপে ভগবানের প্রকাশ, সব কিছুর আত্মারূপে তাঁর প্রকাশ এবং প্রকৃতির কারণরূপে তাঁর প্রকাশ—এই সমস্তই পুরুষাবতারদের উপাধি, যাঁরা জড় সৃষ্টিকে পরিচালনা করেন। ভগবানের চিন্ময় স্তর সব রকম উপাধির অতীত, তাই সেই স্তরকে বলা হয় চতুর্থ বা মায়াতীত স্তর। এটি শ্রীমদ্ভাগবতের একাদশ স্কন্ধের পঞ্চদশ অধ্যায়ে ষোড়শ শ্লোকের শ্রীধর স্বামীকৃত টীকার উদ্ধৃতি।
“যদিও এই তিনজন পুরুষাবতার মায়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, তবুও মায়া তাদের স্পর্শ করতে পারে না। তাঁরা সকলেই মায়ার অতীত।” (৫৪)
এতদীশনমীশস্য প্রকৃতিস্থোহপি তদ্গুণৈঃ।
ন যুজ্যতে সদাত্মস্থৈর্যথা বুদ্ধিস্তদাশ্রয়া ॥ ৫৫ ॥
(শ্রীমদ্ভাগবত (১/১১/৩৮)
“জড়া প্রকৃতিতে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও প্রকৃতির গুণের বশীভূত না হওয়াই হচ্ছে ভগবানের ঐশ্বর্য। তেমনই, যাঁরা তাঁর শরণাগত হয়ে তাঁদের বুদ্ধিকে তাঁর উপর নিবন্ধ করেন, তাঁরাও কখনও প্রকৃতির গুণের দ্বারা প্রভাবিত হন না।”
“তুমি হচ্ছ সেই তিন পুরুষাবতারের পরম আশ্রয়। সুতরাং তুমিই যে মূল নারায়ণ, সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।” (৫৬)
তাৎপর্য: ব্রহ্মা এখানে তাঁর উক্তির মাধ্যমে প্রতিপন্ন করেছেন যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরমেশ্বর এবং তিন পুরুষাবতার ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণু, গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণু ও কারণোদকশায়ী বিষ্ণুর মূল উৎস। তাঁর লীলাবিলাসের জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে প্রথমে বাসুদেব, সঙ্কর্ষণ, প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধরূপে প্রকাশ করেন এবং এই চার প্রকাশই (চতুর্ব্যহ) হচ্ছেন ভগবানের আদি প্রকাশ। কারণ সমুদ্রে শায়িত সমগ্র ‘জড় শক্তি বা মহৎ-তত্ত্বের স্রষ্টা প্রথম পুরুষাবতার মহাবিষ্ণুর প্রকাশ হয় সঙ্কর্ষণ থেকে, দ্বিতীয় পুরুষাবতার গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণুর প্রকাশ হয় প্রদ্যুম্ন থেকে এবং তৃতীয় পুরুষাবতার ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণুর প্রকাশ হয় অনিরুদ্ধ থেকে। এই তিন পুরুষাবতার নারায়ণ থেকে উদ্ভূত প্রকাশসমূহের সমপর্যায়ভুক্ত। নারায়ণ প্রকাশিত হন স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ থেকে।
“এই তিন পুরুষাবতারের উৎস হচ্ছেন চিদাকাশে নিত্য বিরাজমান নারায়ণ, যিনি হচ্ছেন তোমার বিলাস-বিগ্রহ। তাই তুমিই হচ্ছ মূল নারায়ণ।” (৫৭)
“সুতরাং ব্রহ্মার বিচার অনুসারে, চিদাকাশে নিত্য অধিষ্ঠিত নারায়ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিলাস-বিগ্রহ। এই বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতিপাদিত হয়েছে।” (৫৮)
“এই শ্লোকে (৩০) যে সত্য নিরূপিত হয়েছে, তা শ্রীমদ্ভাগবতের চূড়ান্ত বিচার। এই বিচার শাস্ত্রীয় পরিভাষারূপে সর্বত্র ব্যবহার করা হয়।” (৫৯)
“ব্রহ্ম, পরমাত্মা, ভগবান এই সবই যে শ্রীকৃষ্ণের প্রকাশ, সেই সম্বন্ধে যথাযথভাবে অবগত না হয়ে পণ্ডিতাভিমানী মূঢ় ব্যক্তিরা নানা রকম জল্পনা-কল্পনা করে।” (৬০)
“তাদের ভ্রান্ত বিচার অনুসারে, যেহেতু নারায়ণ চতুর্ভুজ সম্পন্ন এবং শ্রীকৃষ্ণ দ্বিভুজসম্পন্ন সাধারণ মানুষের মতো, তাই নারায়ণ হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান এবং শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন তাঁর অবতার।” (৬১)
তাৎপর্য : তথাকথিত কোন কোন পণ্ডিতেরা বলে যে, যেহেতু নারায়ণের চারটি হাত রয়েছে এবং শ্রীকৃষ্ণের দুটি হাত রয়েছে, তাই নারায়ণ হচ্ছেন আদিপুরুষ ভগবান, যাঁর থেকে কৃষ্ণ অবতাররূপে প্রকাশিত হয়েছেন।
এই ধরনের নির্বোধ পণ্ডিতেরা পরমতত্ত্বের বিবিধ প্রকাশ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। চলমান…
লেখক পরিচিতি: শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামীর কাছ থেকে ১২ মার্চ ২০১৭ সালে শ্রীধাম মায়াপুরে দীক্ষা গ্রহণ করেন কমললোচন গৌরাঙ্গ দাস। তিনি ২০১৪ সাল থেকে চৈতন্য সন্দেশ ও ব্যাক টু গডহেড এর প্রকাশনার বিভিন্ন সেবার নিয়োজিত আছেন। বর্তমানে তিনি ব্যাক টু গডহেড এর সহকারী ব্যবস্থাপক ও ডিজাইনার হিসেবে সেবা করছেন। সে সাথে তিনি কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচার করছেন।
ব্যাক টু গডহেড জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২১ প্রকাশিত