এই পোস্টটি 1235 বার দেখা হয়েছে
অত্যন্ত জটিল আলোক বিজ্ঞানের প্রযুক্তি
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ‘শিখিপুচ্ছ মৌলি’ ময়ূর দিয়ে তিনি শোভিত করেন তাঁর উষ্ণীব, শিরোদশ-শিখিপুচ্ছ তাঁর শিরোভূষণ। ময়ূরপুচ্ছের রামধনু রঙের বাহারী বর্ণালী শিল্পী কবি সহ সকলকে বিস্মিত করে। ময়ূর পুচ্ছের চোখের মতো বিচিত্র রঙ-বিন্যাস থেকে যে রঙীন ও শৈল্পিক বর্ণচ্ছটা বেরোয়, বিজ্ঞানীরা তাঁর রহস্য জানার জন্য গবেষণা করছে। আধুনিকতম প্রযুক্তিজ্ঞান প্রয়োগ করে ও ঐরকম বিস্ময়কর শিল্প সূষমাময় রঙ-বাহার, ডিজাইন সৃষ্টি সম্ভব নয়। চীনা বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা করে এক অতি সূক্ষ্ম সিস্টেম (delicate mechanism) এর সন্ধান পেয়েছেন। চীনের ফুডান ইউনিভার্সিটির পদার্থবিদ জিয়ান জি এবং তাঁর সহযোগীরা গবেষণায় দেখেছে যে ময়ূরপুচ্ছের অতিক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক রোমরাজি ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বা ওয়েভলেংথের আলো শোষণ ও প্রতিফলন করে। ‘প্রসিডিঙস্ অব্ দি ন্যাশনাল অ্যাকাডেমী অব্ সায়েন্স্’ নামক জার্নালে প্রকাশিত তাদের গবেষণা নিবন্ধে তারা জানিয়েছেন, ময়ূও পালকের উজ্জ্বল রঙ-বাহার পিগমেন্ট বা রঞ্জক থেকে সৃষ্টি হয় না, পালকে এক ধরণের ক্ষুদ্র দ্বিমাত্রিক (two-deimensinal) ক্রিস্টালের মতো গঠন কাঠামো থেকে বিকশিত হয় এই অনুপম বর্ণালি রঙচ্ছটা, নিখুঁত শিল্প। বিজ্ঞানী জিয়ান জি এবং তাঁর সহযোগীরা শক্তিশালী ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে সবুজাভ পুরুষ ময়ূরের (Pavomuticus) পালকের অতি ক্ষুদ্র রোম (micro hairs) পরীক্ষা করে। এগুলি মানুষের চুলের চেয়ে কয়েকশো গুণ বেশি সরু। এগুলি পালকের কেন্দ্রীয় স্টেমের গিট বা বার্ব থেকে বেরিয়েছে। মাইক্রোস্কোপে তাঁরা এক ল্যাটিস ডিজাইনের জ্যামিতিক বিন্যাস দেখতে পান। সেখানে মেলানিন ও কেরাটিনের তৈরী রডগুচ্ছ রয়েছে। এই দ্বিমাত্রিক কাঠামোগুলি আণুবীক্ষণিক রোমের উপর একটির পিছনে আরেকটি নিখুঁত বিন্যাসে সজ্জিত। আরো কিছু অপ্টিক্যাল পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করে তাঁরা দেখেন যে ঐ ফোটোনিক ক্রিস্টালগুলির দুটির মধ্যে যে ব্যবধান স্থান বা স্পেস রয়েছে, তার পরিমাণের তারতম্যে এবং এদের মাত্রা ও গঠনের তারতম্যের ফলে আলো বিভিন্ন কৌন্থিকতায় প্রতিফলিত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন রঙে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। অর্থাৎ ঐ ক্রিস্টালগুলির সূক্ষ্ ও সুনির্দিস্ট ল্যাটিস বিন্যাসই তৈরী করছে নির্দিস্ট শৈল্পিক নক্শার বর্ণালী চিত্র। ঐ গবেষণাপত্রে বিস্মিত জি লেখেন
(“The male peacock tail contains
spectacular beauty because of
the brilliant, iridescent,
diversified, colourful eye
patterns. When I watched, I
was amazed by the stuning
beauty of the fethers.”)
ময়ূরের পালক তাই এক অত্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে নিয়ন্ত্রিত ডিজাইন
(‘a very specially regulated design’) এর নিদর্শন; ক্রিস্টালগুলি মধ্যবর্তী স্পেস-অ্যাডজাস্টমেন্ট সামান্য এদিক-ওদিক হলে রঙ যাবে গুলিয়ে, পাওয়া যাবে না রামধনুকে লজ্জা দেওয়া বর্ণময় দীপ্তিচ্ছটা। মানুষ, এমনকি বিজ্ঞানীরও মাথায় চুল পেকে গেলে দেহে মেলানিন তৈরী কওে তা কালো করার ক্ষমতা থাকে না। ময়ূরের এই অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ, জমকালো, ইনসপিরেশনাল আর্ট-এর উদ্ভব হলো কিভাবে? ময়ূর কি আগে কাকের মতোই ছিল, পরে এই কালারিং ইন্সট্রুমেন্টস্ সে তার দেহে নিজে যোগ করেছে? তারা নিজেরাই কি ডিজাইনিং করে ঐ ফোটোনিক ক্রিস্টালগুলির মধ্যবর্তী স্পেসগুলি রামধনু বর্ণালী ফোটাতে নিখুঁতভাবে নির্ধারণ করেছে? নাহলে কি পরিবেশের সঙ্গে সংঘর্ষ করতে করতে ঐরকম সৌন্দর্যেও পরম উৎকর্ষ আপনা থেকে সন্নিবেশিত হয়েছে ময়ূরের দেহে? একটি ময়ূরের অংকিত ছবি দেখলে আমরা বুঝতে পারি তার পিছনে একজন শিল্পী আছে। আসল ময়ূরটি কি শিল্পীর শিল্পচেতনা ছাড়াই উদ্ভূত? অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির একজন জুওলজিস্ট ও কালার এক্সপার্ট অ্যান্ড্রু পার্কার বলেন যে, ময়ূর পালকের এই প্রযুক্তি এক শিল্প বাণিজ্য ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে, বিশেষ টেলিকমিউনিকেশন ইকুইপ্মেন্টসে আলোকে চ্যানেলাইজ করতে অথবা নতুন ধরণের ক্ষুদ্র কম্পিউটার মাইক্রোচিপ্স্ তৈরী করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। তাঁর এই উক্তিতে আমরা বুঝতে পারি ময়ূর পালকে আলোক বিন্যাসের প্রযুক্তি কত সূক্ষ্ম। ঐ প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে মাইক্রোচিপ্স্ তৈরী হলে সেটি হবে এক বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিমত্তার ফসল, আর সত্যিকার পালকটির সৃষ্টি আপনা থেকে? এই দ্বৈতবিচার যুক্তিসিদ্ধ না বিশ্বাস প্রসূত, নির্ধারণের ভার পাঠকের। হরেকৃষ্ণ।
(মাসিক চৈতন্য সন্দেশ্ জুলাই ২০০৯ সালে প্রকাশিত)