এই পোস্টটি 645 বার দেখা হয়েছে
শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী মহারাজ
ভগবানের চতুর্ভুজ রূপ, তার সোনার কুন্তল, রক্তিম চক্ষু, যখন তিনি দাঁড়িয়েছিলেন তখন তাঁকে আকাশের তারার মতো দেখাচ্ছিল। এইরূপে পরীক্ষিৎ মহারাজ মাতৃগর্ভে ভগবানকে দর্শন করেছিলেন। ব্রহ্মসংহিতার পঞ্চম অধ্যায়ে বর্ণিত আছে যে ভগবান শ্রীগোবিন্দ পরমাত্মা রূপে তাঁর একটি স্বাংশ প্রকাশের দ্বারা এই জগতের আলোর মধ্যে প্রবেশ করেন এবং পরমাত্মারূপে প্রতিটি জীবের হৃদয়ের মধ্যে বিরাজ করেন এবং ভৌতিক শক্তির অণুর মধ্যেও থাকেন। তাই ভগবান সর্বদাই সর্বত্র বিরাজমান। তিনি তাঁর অচিন্ত্য শক্তি দ্বারা উত্তরা দেবীর গর্ভে প্রবেশ করেছিলেন তাঁর প্রিয় ভক্ত পরীক্ষিৎ মহারাজকে মহাবিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য। ভগবদ্গীতায় (৯/৩১) ভগবান প্রতিজ্ঞা করেছেন, তার ভক্তের কোন বিনাশ হবে না। কেউ ভগবানের ভক্তকে হত্যা করতে পারে না। যেহেতু ভগবান তাকে রক্ষা করেন এবং ভগবান যাকে মারতে চান কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না। ভগবান হচ্ছেন সর্বশক্তিমান, সেইজন্য তিনি রক্ষা বা বিনাশ তাঁর ইচ্ছামতো করতে পারেন। তিনি তাঁর ভক্ত মহারাজ পরীক্ষিৎকে দর্শন দিয়েছেন যখন পরীক্ষিৎ তার মাতৃগর্ভে বিপদগ্রস্ত ছিলেন, ভগবান তাঁকে ক্ষুদ্র আকার ধারণ করে দেখা দিয়েছিলেন, কেননা ভগবান ‘বহুগুণে বড় এবং অণুর চেয়েও ক্ষুদ্র আকার’ একই সঙ্গে ধারণ করতে পারেন । তিনি দয়ালঠাকুর এবং তিনি তাঁর বদ্ধ জীবদের জন্য উপযুক্ত পরিমাণ রূপ গ্রহণ করতে পারেন যাতে তারা তাকে দর্শন করতে পারেন। তিনি হচ্ছেন অপরিসীম এবং আমাদের চিন্তার থেকেও তিনি অধিক বিশাল এবং ক্ষুদ্র। তিনি হচ্ছেন সর্বশক্তিমান প্রভু। উত্তরার গর্ভে দর্শনদানকারী এবং বৈকুণ্ঠধামের নারায়ণের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। ভগবানের অশেষ কৃপার দ্বারা এই ভৌতিক জগতের জীবদের কাছে তিনি অর্চাবিগ্রহরূপে প্রকাশিত হয়েছেন। তার ফলে বদ্ধ জীবগণ তাঁর সেবা লাভ করে ভগবানের কৃপা লাভ করতে পারেন। ভগবানের আদিরূপ আমাদের জড় ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভব করা অসম্ভব।
সেই অর্চাবিগ্রহ একটি সর্ব আধ্যাত্মিক রূপ যার দ্বারা বদ্ধ জীবগণ সহজেই ভগবানের দর্শন লাভ করতে পারে। আমাদের কখনো ভাবা উচিত নয় যে ভগবানের অর্চাবিগ্রহ হচ্ছে এই জড় জগতের প্রাকৃত বস্তু। ভগবানের কাছে জড়া এবং আধ্যাত্মিকের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমাদের কাছে যদিও বা এক বিরাট পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু ভগবানের পক্ষে সব কিছুরই আধ্যাত্মিক পরিবেশ রয়েছে।
মাতৃগর্ভস্থ পরীক্ষিৎ মহারাজাকে হত্যা করার জন্য অশ্বথামা ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করল। উত্তরাদেবী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে “হে দেব দেব ! হে ভগবান! হে জগৎপতি!” সম্বোধন করে প্রার্থনা করে ভগবানের কাছে আশ্রয় নিলেন এবং বললেন, “হে ভগবান, আমাকে হত্যা করুন তাতে আমার কোন দুঃখ নেই কিন্তু আমার সন্তান যেন নষ্ট না হয়।”
এইটি ছিল আমাদের বৈদিক সংস্কৃতি। মায়েরা এমন দায়িত্বশীল যে তাদের নিজের সন্তানকে রক্ষা করার জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে তারা প্রস্তুত ছিলেন। তখন উত্তরাদেবী ভেবেছিলেন যে, “আমি মরে গেলেও আমার সন্তানকে বাঁচাতে হবে, যদিও সে আমার গর্ভের মধ্যে আছে।”
তাই তিনি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলেন যে আমার জন্য আমি প্রার্থনা করছি না, কেননা ভক্তরা কখনও ভগবানের কাছে নিজের জন্য প্রার্থনা করেন না। তারা সব সময় ভগবানের সেবার জন্য এবং অপরের জন্য প্রার্থনা করেন। এই জন্য উত্তরাদেবী প্রার্থনা করলেন যে তার গর্ভস্থ সন্তান যেন নষ্ট না হয়, কারণ সে ভগবানের ভক্ত হবে।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা চিন্তা করা দরকার যে এমন একটি কুসংস্কার ঢুকে গেছে আমাদের মধ্যে যে আধুনিক প্রভাবের জন্য বিভিন্ন রকম নাস্তিকদের ভুল ভ্রান্তির জন্য এখন মায়েরা নিজেরাই স্বীকার হচ্ছেন ভ্রুণ হত্যা করার জন্য। সাধু ঋষিরা আগে কোনোদিন কল্পনা করতে পারেনি যে একজন মা তার নিজের সন্তানকে হত্যা করেন। আমাদের বেদ শাস্ত্র বলে যে সন্তান যখন গর্ভে আসে তখন সে জীবিত। যখন স্ত্রী-পুরুষের মিলন হয় এবং গর্ভের মধ্যে প্রথম দিনে দুটি বীজ এক সঙ্গে মিলন হয় তখন থেকেই জীবের সঞ্চার হয়। সেই জীবকে গর্ভ থেকে অসাধারণভাবে হত্যা করাকে শাস্ত্রে মহাপাপ বলা হয়।
হিরণ্যকশিপু যখন তপস্যা করছিলেন সে সময় তার স্ত্রী গর্ভবতী ছিল; তখন দেবগণ ভেবেছেন যে হিরণ্যকশিপু মস্ত বড় অসুর; ভবিষ্যতে কি কষ্টই না সে আমাদের দেবে এবং তার যদি সন্তান জন্মে তাহলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলব, তা না হলে ভবিষ্যতে না জানি আমাদের কত কষ্টই না হবে। তারা বাচ্চাকে মারতে রাজি কিন্তু ভ্রুণ হত্যা করতে রাজি হয়নি। ভ্রুণ হত্যা করা পাপ বলে দেবগণ পর্যন্ত ভয় পেয়েছিল ।
প্রহ্লাদ মহারাজের জন্যে আগে থেকেই দেবগণ তার মাকে আটক করে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু নারদমুনি তার মাকে বলেছিলেন কোন রকম ভয় করবেন না। হিরণ্যকশিপুর সন্তান হবে মহা ভাগবত ভক্ত। তাই ঐ সময়ে হিরণ্যকশিপুর স্ত্রী কয়াধু গর্ভবতী থাকাকালে নারদ মুনির নিকট ভাগবত কথা শ্রবণ করছিলেন। তখন প্রহাদ মাতৃগর্ভ থেকে ভাগবত কথা শ্রবণ করে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করেন। কিন্তু যদিও কয়াধু হরি কথা শ্রবণ করেছেন, কিন্তু পরবর্তী কালে অসৎ সঙ্গের প্রভাবে তা ভুলে যান কিন্তু প্রহøাদ কখনও ভুলে যাননি।
আগে মানুষের স্মরণশক্তি খুব বেশি ছিল এবং হয়ত অনেক স্ত্রী লোকেরও ভাল স্মরণ শক্তি ছিল। আবার কখনও তারা হয়ত ভুলে যেত। কিন্তু আজকাল স্ত্রী-পুরুষ সবাই খুব সহজেই ভুলে যায় এবং অল্পসংখ্যক লোকই কিছু মনে রাখতে পারে। তার জন্য ব্যাসদেব আমাদের জন্য বেদ লিখেছেন যাতে আমরা প্রতিদিন হরিকথা শ্রবণ করতে পারি। আমরা যদি প্রতিদিন গীতা, ভাগবত শ্রবণ না করি তাহলে আমরা আস্তে আস্তে সব ভুলে যাই, ভুলে গিয়ে অন্ধকার মহামায়ার মধ্যে আমরা ডুবে থাকি।
সে জন্য শ্রীমদ্ভাগবতে আছে, “নিত্যং ভাগবতম্ সেবয়া”– আমাদের প্রতিদিন শ্রীমদ্ভাগবত অধ্যয়ন এবং সদ্গুরুর আনুগত্যে সেবা করার বিশেষ কর্তব্য রয়েছে। এইভাবে কয়াধুর গর্ভে প্রহ্লাদের জন্ম হয় এবং তাঁর লীলা কাহিনী আপনারা নিশ্চয়ই জানেন।
ঠিক এইভাবে উত্তরাদেবী তার সন্তানকে বাঁচাতে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলেন এবং কৃষ্ণ তার গর্ভে পরমাত্মার মতো রূপ গ্রহণ করে প্রবেশ করে পরীক্ষিৎ মহারাজাকে দর্শন দিলেন। পরীক্ষিৎ নাম হল, কেননা পরীক্ষিৎ মহারাজ যে রূপ দর্শন পেয়েছেন গর্ভের মধ্যে, তিনি সব সময় খুঁজছেন তার প্রভুকে দর্শন পাবার জন্য। সেজন্য প্রত্যেক মানুষের মুখের দিকে পরীক্ষিৎ মহারাজ তাকিয়ে পরীক্ষা করতেন এই সেই পরম পুরুষ ভগবান কিনা। তার কখনও ভুল হয়নি। সব সময় খুঁজে খুঁজে পরীক্ষা করছেন, কোথায় ভগবান। এই জন্য তার নাম হল পরীক্ষিৎ।
আমরা আশা করি যে ভবিষ্যতে ভারতবর্ষের মানুষেরা বুঝবে যে সত্যিকারে ভ্রণ হত্যা হচ্ছে এক বিরাট পাপ এবং এই সব কাজ করা খুব খারাপ। যদিও সরকার সেটা অনুমোদন করছেন তার নাস্তিক প্রভাবে। আসলে কোনো ধর্ম সেটা অনুমোদন করে না। মানুষ ভুলভ্রান্তি করে মহাপাপ করছে বলে ভবিষ্যতে অনেক দুঃখ-কষ্ট তারা পাবে। সেই কষ্ট যাতে তারা না পায় তার জন্য আমি এইটুক বললাম।