এই পোস্টটি 1323 বার দেখা হয়েছে
এবারের বিষয়: ভূতের কবল থেকে নিস্তার
জয়তীর্থ চরণ দাস: আমরা যদি সম্পূর্ণরূপে ভূতের হাত থেকে নিস্তার লাভ করতে চাই এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চাই তবে আমাদের কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে।
ভূত কে? যখন আমাদের কোন স্থুল বা পঞ্চভূতে নির্মিত শরীর থাকে না তখন আমরা প্রকৃতপক্ষে ভূত বা সূক্ষ্ম শরীর প্রাপ্ত হই। মৃত্যুর মাধ্যমে স্থুল শরীরের বিনাশ ঘটে। ভূত সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে গরুড় পুরাণে।
কে ভূতের জীবন লাভ করে?
যে ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে এবং যিনি জীবন সর্বদা অসৎ জীবনযাপন করেছেন এবং যিনি তার পরিবার, জায়গা, জমি তথা জাগতিক জীবনযাপনের প্রতি আসক্ত ইত্যাদি ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তি মৃত্যুর পর উচ্চতর লোকে গমন করতে পারেন না। তাই তারা বহুকাল ভূতের দেহ লাভ করে কষ্ট পেতে থাকেন এবং একসময় আবার পৃথিবীতে তাদের জন্ম হয়। আরো জানতে গরুড় পুরাণ পড়তে পারেন।
ভূতেরা কি করে?
দিনের বেলা ভূতেরা পৃথিবী থেকে বহু দূরে অন্তরীক্ষে বা ভূতলোকে থাকেন এবং রাতে পৃথিবাতে ফিরে আসেন। গরুড় পুরাণে ২/৪৯/১১ মতে তারা যেকোন জড় বস্তু, পোকা, পশু, মানুষ এবং দেবতাদের দেহে প্রবেশ করতে পারেন। তার অর্থ হচ্ছে তারা পরজীবির মতই তাদের সূক্ষ্মদেহকে অন্যকোন জীবদেহের সাথে সংযোগ ঘটান। তারা অপবিত্র বস্তুগুলো ভক্ষণ করেন। ভূতেরা অত্যন্ত কষ্ট লাভ করেন কেননা তাদের ভৌতিক দেহ না থাকায় তারা তাদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা বা জৈবিক চাহিদা মেটাতে পারেন না। যখনই তাদের কর্মফল সমাপ্ত হয় তখন তারা পুনরায় জন্মগ্রহণ করেন। উৎস: গরুড় পুরাণ।
ভূতেরা কেন আমাদের সামনে উপস্থিত হন?
অনেকেই তাদের সমগ্র জীবনে ভূতের দেখা পান না। এটি নির্ভর করে ব্যক্তির চেতনাশক্তি কতটা কাজ করে এবং সূক্ষ্ম ভূতের দেহের উপস্থিতি অনুভবে তার কতটা সক্ষমতা আছে তার উপর। অনেক সময় ভূতেরা তাদের আত্মীয়দের সামনে স্বপ্নে বা সরাসরি আর্বিভূত হয় কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার উদ্দেশ্যে। উদাহরণস্বরূপ গোস্ট নামক একটা হলিউড মুভি রয়েছে যেখানে ভাগবত পুরাণের বর্ণনানুযায়ী হুবহু ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এখানে আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে যে, অধিকাংশ ভূত যে স্থানের প্রতি আসক্ত, সে স্থানে অবস্থান করে, অনেক সময় তারা নিজেরাই জানে না যে তারা মারা গেছেন। যেহেতু ভূতের দেহে নেগেটিভ প্রভাব রয়েছে তাই তারা সহজে কোন স্থান ছেড়ে যায় না। কখনো যদি কোন আত্মীয়ের কাছে কোন ভূত আবির্ভূত হয় তবে বুঝতে হবে যে সে তার বর্তমান অবস্থা পরিত্যাগ করার জন্য তাদের সাহায্য চাইছে।
ভূতের উপস্থিতি কিভাবে বোঝা যাবে?
ভূতেরা আমাদের সূক্ষ্মদেহের সাথে অবস্থান করতে পারে এবং ভেতরে বা বাহিরে কোন বাসা বাড়ি বা অন্য কোন স্থানে অবস্থান করতে পারে। এছাড়াও বোঝা যাবে-
* কোন কারণ ছাড়াই কোন ঘরে অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা অনুভ’ত হলে।
* কোন শূণ্য ঘরে বিভিন্ন অদ্ভুত বা ভয়ংকর শব্দ শোনা গেলে।
* ভূতের ধরণ বা তার রং দেখে চেনা যাবে। সাদা হলে ভালো, কিন্তু কালো হলে ভয়ংকর।
* কখনো বিছানায় শোয়া অবস্থায় হঠাৎ প্যারালাইসড হলে। এই ধরনের বিছানায় প্যারালাইসড হওয়ার ঘটনা অনেক সময় ঘটে। শাস্ত্রমতে এটি হল একটি প্রচণ্ড রাগী ভূতের কারণে। তারা ঘুমন্ত মানুষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে প্রাণকে অসাড় করে যেটি আমাদের সূক্ষদেহের একটি অংশ (ছান্দোগ্য উপনিষদ)। ঘুমন্ত ব্যক্তিটির পুরো দেহটি কয়েক সেকেন্ডের জন্য প্যারালাইসড হয়ে যায় এবং তখন তিনি শুধুমাত্র তার চোখ নড়াচড়া করতে পারেন। আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণত ঠিক যেন কেউ তার উপর শুয়ে আছেন।
ভূতদের সাহায্য করা:
আপনার উপরোক্ত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় হয়তো ভূত সেখানে থাকবে না কিন্তু তারা অন্যত্র গিয়েও কষ্ট পেতে থাকবে। তাদের মুক্তির জন্য বিভিন্ন প্রার্থনা ও পূজা করা যায়। সবচেয়ে সহজ পন্থা হচ্ছে আপনার কিছু পারামার্থিক কাজের ফল তাকে অর্পন করা। যেমন আপনি ভগবদ্গীতা পাঠ বা শ্রীমদ্ভাগবত পাঠের ফল বা হরিনাম জপের ফল তাকে মানসে ভূতের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে পারেন। এতে সে কিছু পূণ্যফল লাভ করবে। বিশেষত কোন সেই ভূতের আত্মীয়দের উচিত তাকে মুক্ত করার জন্য এই ধরনের পারমার্থিক কার্যে অংশগ্রহণ করা কেননা তারা যদি তা না করে তবে সেই ভূত প্রতিনিয়ত তাদের সামনে আবির্ভূত হবে এবং পেতে থাকবে।
নিজের সুরক্ষা
* সর্বদা পবিত্র ভাবে থাকুন।
* অসবস্যার দিন বিশেষ করে গভীর রাতে সাবধানে চলাফেরা করুন।
* নারীদের রজস্রাবের সময় রাতে ঘরে বাইরে না যাওয়াই নিরাপদ।
বৈষ্ণব পূজারী কর্তৃক সুরক্ষা বিধি: পঞ্চরাত্র প্রদীপ বা ইস্কনের বিগ্রহ সেবা ম্যানুয়েল অনুসারে বিগ্রহ পূজার তিনটি পদ্ধতির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, ১০ দিক বন্ধ করার মাধ্যমে সমস্ত ভূত বা অন্যান্য ক্ষতিকর প্রভাব বন্ধ করা যায়। তার মধ্যে রয়েছে ভূত নিবারণ মন্ত্র।
ভগবানের আদেশে অদৃশ্য সূক্ষ্ম আত্মাদের প্রস্থান হোক যারা এই সেবায় বিঘ্ন প্রদান করবে। এছাড়া নৃসিংহ কবচ, নারায়ণ কবচ ধারণ করা ভালো।
শ্রীল প্রভুপাদ ভূত হতে নিস্তারের সর্বোচ্চ উপায় বলেছেন, “তুমি ভ’তের কথা উল্লেখ করছ। এখনো পর্যন্ত আমার অভিজ্ঞতা মতে, সেগুলো তাড়ানোর সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করা এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা সেই স্থান ত্যাগ না করছে ততক্ষণ পর্যন্ত পরমানন্দে কীর্তন করতে থাকা। ইংল্যান্ডে ১৯৬৯ সালে আমি যখন জন লেননের বাসায় থাকতাম তখন সেখানে একটি ভূত ছিল। কিন্তু যখনই ভক্তরা উচ্চস্বরে কীর্তন শুরু করল, সে তৎক্ষণাৎ সেই স্থান ছেড়ে চলে গেল।” (শ্রীল প্রভুপাদ ০৩/১২/১৯৭১)
মৃত ব্যক্তির শ্রাদ্ধ প্রক্রিয়া: শ্রাদ্ধ বলতে আত্মার সদ্গতি লাভের জন্য বৈদিক যাগ-যজ্ঞ ও অন্যান্য ক্রিয়াদির মাধ্যমে ভগবান বিষ্ণুকে সন্তুষ্ট করার প্রক্রিয়া। যার মাধ্যমে মৃত ব্যক্তির আত্মা কর্তৃক কৃত পাপের ভার লাঘব হয়ে আত্মাটি প্রেতত্ম হতে মুক্ত হয়। স্থুল জড় দেহ লাভ করে সংশোধনের সুযোগ পায়। সাধারণত মৃত্যুর পর আত্মা বিষ্ণু প্রসাদের পিণ্ড প্রাপ্তির পূর্ব পুরুষদের উত্তরাধিকারী হওয়ায় কর্তব্য। অন্যথায় তারা তাদের বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে উত্তরাধিকারী ও পুত্র স্বজনদের নিকট (ভূতরূপে) দেখা দেন এবং তাদের উদ্ধারের জন্য তাদের প্ররোচিত করেন।
কিন্তু কিভাবে আমরা তা করতে পারি প্রভুপাদ ভগবদ্গীতায় ১/৪১ নং শ্লোকের তাৎপর্যে বলেছেন।
কর্মকাণ্ডের বিধি অনুসারে পিতৃপুরুষের আত্মাদের প্রতি পিণ্ডদান ও জল উৎসর্গ করা প্রয়োজন। এই উৎসর্গ সম্পন্ন করা হয় বিষ্ণুকে পূজা করার মাধ্যমে, কারণ বিষ্ণুকে উৎসর্গীকৃত প্রসাদ সেবন করার ফলে সমস্ত পাপ থেকে মুক্তিলাভ হয়। অনেক সময় পিতৃপুরুষেরা নানা রকমের পাপের ফল ভোগ করতে থাকে এবং অনেক সময় তাদের কেউ কেউ জড় দেহ পর্যন্ত ধারণ করতে পারে না। সূক্ষ্ম দেহে প্রেতাত্মারূপে থাকতে বাধ্য করা হয়। যখন বংশের কেউ তার পিতৃপুরুষদের ভগবৎ প্রসাদ উৎসর্গ করে পিণ্ডরদান করে, তখন তাদের আত্মা ভূতের দেহ অথবা অন্যান্য দুঃখময় জীবন থেকে মুক্ত হয়ে শান্তি লাভ করে। পিতৃপুরুষদের আত্মার সদ্গতির জন্য এই পিণ্ড দান করাটা বংশানুক্রমিক রীতি। তবে যে সমস্ত লোক ভক্তিযোগ সাধন করেন, তাঁদের এই অনুষ্ঠান করার প্রয়োজন নেই। ভক্তিযোগ সাধন করার মাধ্যমে ভক্ত শত-সহস্র পূর্বপুরুষের আত্মার মুক্তি সাধন করতে পারেন। শ্রীমদ্ভাগবতে (১১/৫/৪১) বলা হয়েছে-
দেবর্ষিভূতাপ্তনৃণাং——–কর্তম্॥
“যিনি সব রকম কর্তব্য পরিত্যাগ করে মুক্তি দানকারী মুকুন্দের চরণ-কমলে শরণ নিয়েছেন এবং ঐকান্তিকভাবে পন্থাটি গ্রহণ করেছেন, তাঁর আর দেব-দেবী, মুনি-ঋষি, পরিবার-পরিজন, মানব-সমাজ ও পিতৃপুরুষদের প্রতি কোন কর্তব্য থাকে না। পরমেশ্বর ভগবানের সেবা করার ফলে এই ধরনের কর্তব্যগুলি আপনা থেকেই সম্পাদিত হয়ে যায়।”
কিন্তু বর্তমানের তথাকথিত শ্রাদ্ধে মাছ মাংস সমেত ভোগদ্রব্য ভগবান বিষ্ণু কখনো গ্রহণ করেন না। ফলে এই সমস্ত দ্রব্য পিণ্ড (বিষ্ণু প্রসাদরূপে) তাদের মৃত ব্যক্তিদের উদ্ধারের প্রশ্নই আসে না। বরঞ্চ তাদের দুর্ধষা আরো বর্ধিত হয় এবং তারা ভূতরূপে তাদের উত্তরাধিকারীদের জ্বালাতন করেন।
ভূত প্রতিরোধের উপায় কি?
* সর্বদাই বাড়িঘর পরিষ্কার পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বাড়ি ঘরে কোন অপবিত্র জিনিস রাখা যাবে না বিশেষত কোন মাংস, মৃত ব্যক্তির হাড়। ঘর সর্বদা পবিত্র রাখতে হবে। ঘরে ভগবানের বিগ্রহ, চিত্রপট থাকতে হবে।
* কিছু লোহার জিনিস যেমন কাচি আপনার বিছানার অভ্যন্তরে নিরাপদ স্থানে রাখতে পারেন। রূপার কোন জিনিস এবং তিলের বীজ ভূত তাড়াতে সাহায্য করে। (গরুড় পুরাণ ২/২/২৬) ঘরের দরজা বা দেওয়ালে বিভিন্ন বৈদিক চিহ্ন আঁকতে পারেন।
* সর্বদা দ্বাদশ অঙ্গে তিলক করে থাকুন।
* হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করুন।
* ঘরে ভগবদ্গীতা এবং শ্রীমদ্ভাগবত রাখুন। এই দিব্য গ্রন্থসমূহের ঐশ্বরিক শক্তিতে ঘরে কোন নেগেটিভ প্রভাব থাকতে পারে না।
সর্বোৎকৃষ্ট সমাধন: ‘হরে কৃষ্ণ’ মহামন্ত্র প্রতিদিন ১৬ মালা জপ করলে কিংবা কীর্তন করলে শুধু ভূত কেন সমস্ত আসুরিক শক্তি পর্যন্ত তৎক্ষণাৎ দূরে চলে যায়। এর দৃষ্টান্ত শ্রীল প্রভুপাদ ও সমস্ত আচার্যেরা রেখে গিয়েছেন। একসময় এক প্রাচীন গৃহে শ্রীল প্রভুপাদ এক ভূতকে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপের মাধ্যমে উদ্ধার করে সমস্ত আসুরিক শক্তি নির্মূল করেছিলেন। অতএব এ মহামন্ত্রের আশ্রয় নেওয়াই সর্বোৎকৃষ্ট সমাধান। হরেকৃষ্ণ!
(মাসিক চৈতন্য সন্দেশ পত্রিকা আগস্ট ২০১২ প্রকাশিত)