এই পোস্টটি 43 বার দেখা হয়েছে
শ্রীমৎ ভক্তিবিজয় ভাগবত স্বামী
১১ ডিসেম্বর, ২৪ (বুধবার)
মোক্ষদা একাদশীর তিথিতে সারা বিশ্বে গীতা জয়ন্তী মহোৎসব পালিত হয়।
➡ গীতা জয়ন্তী মানে কি?
গীতা জয়ন্তী মানে শ্রীমদ্ভগবদগীতার আবির্ভাব তিথি। কারণ মার্গ শীর্ষ বা অগ্রহায়ন মাসের শুক্লপক্ষের মোক্ষদা একাদশী তিথিতে কুরুক্ষেত্রের
রণাঙ্গনে পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে উদ্দেশ্য করে, সকল মানব জাতির উদ্দেশ্যে শ্রীমদ্ভগবদগীতার জ্ঞান দান করেছিলেন।
শাস্ত্রে বলা হয়েছে-
কৃষ্ণভুলি যেই জীব অনাদি — বহির্মুখ।
অতএব মায়া তারে দেয় সংসার — দুঃখ ॥ (চৈ: চ: মধ্যে ২০/১১৭)
শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে জীব অনাদিকাল ধরে জড়া প্রকৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে রয়েছে। তাই মায়া তাকে এই জড় জগতে নানা প্রকার দুঃখ প্রদান করছে। সরকারের আইন লঙ্ঘন করলে মানুষকে কারা যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়, ঠিক তেমনি ভগবৎ রাজ্যে এ জগৎ হল দূরতিক্রম্য কারাগার। যাতে জীব জন্ম-মৃত্যু- জরা-ব্যাধিরূপ চতুর্ধা দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করে। কি আইন আমরা লঙ্ঘন করেছি যার জন্য এত অবাঞ্ছিত দুঃখ-কষ্ট? শাস্ত্র তার স্পষ্ট উত্তর প্রদান করে বলছেন যে, আমরা ভগবৎ অংশ জীব, ভগবৎ সেবাই আমাদের একমাত্র কর্তব্য, কিন্তু আমাদের স্বতন্ত্র ভোগ বাসনা, প্রভু হওয়ার বাসনাই আমাদেরকে এই কারাবাসে বাধ্য করেছে। ভগবদ্গীতায় বর্ণনা করা হয়েছে, ভগবানের স্বীয় মায়া ত্রিগুণাত্মিকা দ্বারা পরিচালিত এই জড় জগৎরূপী কারাগারকে অতিক্রম করা খুবই কঠিন—
দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দূরত্যয়া।
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে ॥ (গীতা-৭/১৪)
আমার এই দৈবী মায়া ত্রিগুণাত্মিকা এবং তা দূরতিক্রমণীয়া। কিন্তু যাঁরা আমাতে প্রপত্তি করেন। তাঁরাই এই মায়া উত্তীর্ণ হতে পারেন।
শ্রীচৈতন্য ভাগবতে বলা হয়েছে–‘যেই বাঁধয়ে ছাড়য়ে সেই যে’। আর সেই জন্যই পরম করুণাময় পরমপিতা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জীবের প্রতি তাঁর অপার করুণাবশতঃ এই ধরাধামে অবতীর্ণ হয়ে কারামুক্তির শিক্ষা প্রদান করেন, যে শিক্ষার আশ্রয় গ্রহণ করে আমরা আমাদের নিত্যস্বরূপ আনন্দময় জীবনে অধিষ্ঠিত হতে পারি। গীতা মাহাত্ম্যে বলা হয়েছে–
মলিনে মোচনং পুংসাং জলস্নানং দিনে দিনে।
সকৃদ্ গীতামৃতস্নানং সংসারমলনাশনম্॥
‘ আমরা প্রত্যহ জলে স্নান করে শরীর পরিচ্ছন্ন করি, ঠিক তেমনিভাবে ভগবৎ প্রদত্ত ভগবদ্গীতার শিক্ষা যদি কেউ নিজের ‘জীবনে প্রয়োগ করেন তাহলেই সংসাররূপ এই কারাবাস থেকে অনায়াসেই মুক্তি লাভ করা সম্ভব।’
সাধারণ জীবের ভূমিকায় সংসার জ্বালায় বিষাদ গ্রস্ত অর্জুনকে কুরুক্ষেত্রের মাঠে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই অমৃতময় শিক্ষা প্রদান করেছিলেন। ভগবান বলেছেন–
প্রথম ভগবানের প্রতিশ্রুতি
ভগবান বলেছেন-অর্জুন! তোমার প্রতি এই সর্বশ্রেষ্ঠ, সমস্ত শিক্ষার রাজশিক্ষা এবং অতি পবিত্রময় বস্তু–
রাজবিদ্যা রাজগুহ্যং পবিত্রমিদমুত্তমম
প্রত্যক্ষাবগমং ধর্মং সুসুখং কর্তুমব্যয়ম্্ ॥ (গীতা ৯/২)।
এই জ্ঞান সমস্ত বিদ্যার রাজা, সমস্ত গুহ্যতত্ত্ব থেকেও গুহ্যতর, অতি পবিত্র এবং প্রত্যক্ষ অনুভূতির দ্বারা আত্ম-উপলব্ধি প্রদান করে বলে প্রকৃত ধর্ম। এই জ্ঞান অব্যয় ও সুখসাধ্য ।
দ্বিতীয় ভগবানের প্রতিশ্রুতি
অর্জুন! তথাকথিত আত্মীয় পরিজন প্রতি মিথ্যাসক্তির মোহের জন্য তোমাকে এতটাই শোকে সতত নিমজ্জিত করছে (গীতা ২/২)। সে কথা অর্জুন নিজেই গীতার প্রথম অধ্যায়ে খোলাখুলিভাবে ব্যক্ত করেছেন, এও বলেছেন যে এর থেকে মুক্ত হওয়ার উপায় আমাকে বলুন, আমি আমার কর্তব্য সম্বন্ধে দ্বিধাগ্রস্ত, আমি সম্পূর্ণ রূপে আপনার শরণাগত। উত্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শিষ্যরূপে অর্জুনকে আত্মতত্ত্বজ্ঞান প্রদান করলেন এবং তিনি বললেন এই শিক্ষা অর্থাৎ আত্মজ্ঞানই তোমাকে মোহরূপ শোকাগার থেকে মুক্ত করবে–যজজ্ঞাত্বা ন পুনর্মোহমেবং যাস্যসি পাণ্ডব (গীতা ৪/৩৫)। কেননা তুমি প্রকৃতই উপলব্ধি করবে তোমার ও সমস্ত জীবের প্রকৃত স্বরূপ কি?–মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ (গীতা ১৫/৭) এই জগতে সমস্ত জীবই আমার সনাতন বিভিন্নাংশ কিন্তু জড়া প্রকৃতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তারা বেঁচে থাকার জন্য কঠোর সংগ্রাম করছে।
তৃতীয় ভগবানের প্রতিশ্রুতি
তুমি যে শুধু তোমার স্বরূপ জানতে পারবে তাই নয়, আমাকেও স্বরূপত জানবে। কেননা আমি প্রকৃতই সমস্ত জীবের প্রতি অত্যন্ত করুণাময় কেননা আমি হচ্ছি প্রত্যেক জীবের আসল পিতা।–তাসাং ব্রহ্ম মহদ্যোনিরহং বীজপ্রদঃ পিতা ॥ (গীতা ১৪/৪)। তাই সন্তানদের আমার ধামে ফিরিয়ে আনার জন্যই এই ধরাধামে জন্ম ও লীলা বিলাস, এই সমস্ত তত্ত্ব তুমি যদি যথাযথভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পার, তাহলে তুমি আমার নিত্য ধাম লাভ করতে সক্ষম হবে।
জন্ম কর্ম চ মে দিব্যমেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ ।
ত্যক্তা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোহর্জুন ॥ (গীতা ৪/৯)
হে অর্জুন, যিনি আমার এই প্রকার দিব্য জন্ম ও কর্ম যথাযথভাবে জানেন,তাঁকে দেহত্যাগ করার পর পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয় না, তিনি নিত্যধাম প্রাপ্ত হন।
চতুর্থ ভগবানের প্রতিশ্রুতি
অতি সুদক্ষ সাঁতারু যেমন সাঁতার কেটে সমুদ্র পার হতে পারে না, তেমনি জড় জগতে জীবন সংগ্রাম দুরতিক্রম্য। মাঝ সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে যে মানুষ, তার উদ্ধারের একমাত্র উপায় হলো যদি কেউ এসে তাকে তুলে নেয়, তেমনি হে অর্জুন এই দুরন্ত ভবসমুদ্র থেকে উদ্ধারের জন্য এই ভগবদ্গীতার জ্ঞানরূপ তরণীতে আরোহন করো তাহলেই তুমি এই দুঃখ সমুদ্র অবশ্যই পার হতে সক্ষম হবে।–সর্বং জ্ঞানপ্লবেনৈব বৃজিনং সন্তরিষ্যসি। (গীতা ৪/৩৬)
পঞ্চম ভগবানের প্রতিশ্রুতি
বলা যেতে পারে ভগবদ্গীতার ৮ম অধ্যায়ে ভগবান বলছেন–
যং যং বাপি স্মরন্ ভাবং ত্যজত্যন্তে কলেবরম্ ।
তং তমেবৈতি কৌন্তেয় সদা তদ্ভাবভাবিতঃ ॥ (গীতা ৮/৬)
হে কৌন্তেয়, অন্তিমকালে যিনি যে ভাব স্মরণ করে দেহত্যাগ করেন, তিনি অবশ্যই সেই ভাবে ভাবিত তত্ত্বকেই লাভ করেন। কিন্তু এই শরীরে আমরা যদি এই শিক্ষা ও ভক্তিযোগের অনুশীলন করি তাহলে আমরা আমাদের চেতনা শুদ্ধ করতে পারি
তস্মাৎ সর্ব্বেষু কালেষু মামনুস্মর যুধ্য চ।
ময্যর্পিতমনোবুদ্ধির্মামেবৈষ্যস্যসংশয়ঃ॥ (গীতা ৮/৭)
অতএব হে অর্জুন, সর্বদা আমাকে স্মরণ করে তোমার স্বভাববিহিত যুদ্ধ কর। এভাবে আমাতে তোমার মন ও বুদ্ধি অর্পণ করে নিঃসন্দেহে তুমি আমাকে লাভ করবে। কৌশলটি আয়ত্ব করে দিতে পার তাহলে তুমি অবশ্যই কলুষময় জীবন পরিত্যাগ করে আমার কাছে আসবে। তোমার প্রতি আমার এই প্রতিশ্রুতিতে তুমি সন্দেহ করো না।
অন্তকালে চ মামেব স্মরন্মুক্তা কলেবরম্ ।
যঃ প্রয়াতি স মদ্ভাবং যাতি নাস্ত্যত্র সংশয়ঃ॥ (গীতা ৮/৫)
ষষ্ঠ ভগবানের প্রতিশ্রুতি
বলা যেতে পারে ভোগবাদী লোকেরা প্রায়ই প্রশ্ন করে, কেবল হরিভজনা কি আমাদের জীবনের খাদ্য দ্রব্যের সমাধান করে দিতে পারে? আমাদের অবশ্যই কর্ম করতে হবে। পিতা যেমন সন্তানদের ভরণ পোষণাদির চিন্তা করেন ঠিক তেমনি পরমপিতা জীব সৃষ্টির সাথে সাথে জীবের খেয়ে পরে বেঁচে থাকার সমস্ত সুবন্দোবস্ত করেছেন (গীতা ৩/১৪-১৬)। ভগবান বলছেন যে কর্ম অবশ্যই করতে হবে তবে কর্ম কৌশলটি জানতে হবে। কেবলমাত্র তুমি আমার জন্যই কর্ম করো, তা না হলে এই কর্মই তোমার বন্ধনের মেয়াদ বৃদ্ধি করবে।
যজ্ঞার্থাৎ কর্মণোহন্যত্র লোকোহয়ং কর্মবন্ধনঃ ।
তদর্থং কর্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর ॥ (গীতা ৩/৯)
বিষ্ণুর প্রীতিবিধান করার জন্যই কেবল কর্ম করা উচিত ; তা না হলে কর্মই এই জড় জগতে বন্ধনের কারণ হয়। হে কৌন্তেয় , তাই তাঁর সন্তÍুষ্টি -বিধানের জন্যই কেবল তুমি তোমার কর্তব্য কর্মেও অনুষ্ঠান কর এবং এভাবেই তুমি সর্বদা বন্ধন থেকে মুক্ত থাকতে পারবে।
অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে ।
তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্ ॥ (গীতা ৯/২২)
অনন্যচিত্তে আমার চিন্তায় মগ্ন হয়ে পরিপূর্ণ ভক্তি সহকারে যাঁরা সর্বদাই আমার উপাসনা করেন, তাঁদের সমস্ত অপ্রাপ্ত বস্তু আমি বহন করে আনি এবং তাঁদের প্রাপ্ত বস্তর সংরক্ষণ করি।
সপ্তম ভগবানের প্রতিশ্রুতি
তাই ভক্তের ভরণ পোষণের কোন সমস্যাই থাকে না।
মচ্চিত্তা মদ্গতপ্রানা বোধয়ন্ত পরস্পরম্ ।
কথয়ন্তশ্চ মাং নিত্যং তুষ্যন্তি চ রমন্তি চ ॥ (গীতা ১০/৯)
যাঁদের চিত্ত ও প্রাণ সম্পূর্ণরূপে আমাতে সমর্পিত, তাঁরা আমার কথা সর্বদাই আলোচনা করে এবং আমার সম্বন্ধে পরস্পরের মধ্যে ভাবের বিনিময় করে পরম সন্তোষ ও অপ্রাকৃত আনন্দলাভ করেন।
অষ্টম ভগবানের প্রতিশ্রুতি
অর্থাৎ ভক্তের ইহ জীবনে কোন প্রকার অভাব থাকবে না পরন্তু ভগবানের বিশেষ প্রতিশ্রুতি হলো পরবর্তী জীবনে তোমাকে আমার ধামে আমার সান্নিধ্যে নিয়ে আসব। যেখানে অক্ষয়, অনন্ত সুখ ও আনন্দময় জীবন প্রাপ্ত হবে
মন্মনা ভব মণ্ডক্তো মদ্যাজী মাং নমস্কুরু ।
মামেবৈষ্যসি যুবৈমাত্মানং মৎপরায়ণঃ ॥ (গীতা ৯/৩৪)
তোমার মনকে আমার ভাবনায় নিযুক্ত কর, আমার ভক্ত হও আমার পূজা কর এবং আমাকে প্রণাম কর। এভাবে আমাতে উৎসর্গীকৃত হয়ে সম্পূর্ণরূপে আমাতে অভিনিষ্ট হলে নিঃসন্দেহে তুমি আমাকে লাভ করবে।
নবম ভগবানের প্রতিশ্রুতি
ন তদ্ ভাসয়তে সূর্যো ন শশাঙ্কো ন পাবকঃ।
যদ্ গত্বা ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম ॥ (গীতা ১৫/৬)
যেখানে গেলে আর এই জড় জগতে ফিরে আসতে হয় না, আমার সেই পরম ধামকে সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি বা বিদ্যুৎ আলোকিত করে না। কেননা তা হচ্ছে জীবের প্রকৃত আলয় (বাড়ি)। দুর্বৃত্ত সন্তান পিতাকে ভুলে থাকতে পারে কিন্তু প্রকৃত পিতা সন্তানের এই দুঃখ সহ্য করতে পারেন না তাই তিনি কত ভাবে তাঁর প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। ভক্তিযোেগ অধ্যায়ে বলতে বলতে তিনি কতটাই নিজেকে আমাদের জন্য সুলভ করে দিয়েছেন। হে অর্জুন! যারা সমস্ত কর্ম সমর্পণ করে, মৎপরায়ণ হয়ে অনন্য ভক্তিযোগের দ্বারা আমার ধ্যানপূর্বক উপাসনা করেন, হে পার্থ, আমাতে আবিষ্টচিত্ত সেই সমস্ত ভক্তদের আমি মৃত্যুময় সংসার-সাগর থেকে অচিরেই উদ্ধার করি।
যে তু সর্বানিকর্মাণি ময়ি সংন্যস্য মৎপরাঃ।
অনন্যেনৈব যোগেন মাং ধ্যায়ন্ত উপাসতে ॥
তেষামহং সমুদ্ধর্তা মৃত্যুসংসারসাগরাৎ।
ভবামি ন চিরাৎ পার্থ ময্যাবেশিতচেতসাম্ ॥ (গীতা ১২/৬,৭)
এতটা সম্ভবপর না হলে অর্জুন অভ্যাস যোগ অনুশীলন কর। তাও যদি না পার আমার জন্য কর্ম কর, না হলে তুমি তোমার কর্মের ফল আমাকে প্রদান কর (গীতা ১২/৯-১১)। অর্থাৎ আমাতে সর্বতোভাবে আশ্রয় কর, আমি তোমাকে বুদ্ধি প্রদান করে তোমাকে পথ দেখাব–
তেষাং সততযুক্তানাং ভজতাং প্রীতিপূর্বকম্।
দদামি বুদ্ধিযোগং তং যেন মামুপযান্তি তে ॥ (গীতা ১০/১০)
যাঁরা ভক্তিযুক্ত হয়ে প্রীতিপূর্বক আমার সেবায় নিত্যযুক্ত থাকেন, আমি তাঁদের শুদ্ধ জ্ঞানজনিত বুদ্ধিযোগ দান করি, যার দ্বারা তাঁরা আমার কাছে ফিরে আসতে পারেন।
দশম ভগবানের প্রতিশ্রুতি
শ্রদ্ধাবান্ লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ।
জ্ঞানং লব্ধা পরাং শান্তিমচিরেণাধিগচ্ছতি ॥ (গীতা ৪/৩৯)
সংযতেন্দ্রিয় ও চিন্ময় তত্ত্বজ্ঞান লাভে তৎপর শ্রদ্ধাবান ব্যক্তি এই জ্ঞান অর্জন করেন। সেই দিব্যজ্ঞান লাভ করে তিনি অচিরেই পরাশান্তি প্রাপ্ত হন।
একাদশত ভগবানের প্রতিশ্রুতি
ভগবানের প্রতিশ্রুতি ভগবান স্বরাট পুরুষ, তিনি সবকিছুতেই সমর্থ একথা তিনি গীতায় বহুস্থানে ব্যক্ত করেছেন। পরন্তু এত কিছু বলা সত্ত্বেও যদি আমরা সন্দেহ বা ভগবদ্বাক্যে অশ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি তাহলে আমরা ইহলোকে ও পরলোকে সুখ বা শান্তি লাভে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হব।
অজ্ঞশ্চাশ্রদ্ধধানশ্চ সংশয়াত্মা বিনশ্যতি।
নায়ং লোকোহস্তি ন পরো ন সুখং সংশয়াত্মনঃ ॥ (গীতা ৪/৪০)
অজ্ঞ ও শাস্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাহীন ব্যক্তি কখনই ভগবদ্ভক্তি লাভ করতে পারে না । সে বিনাশপ্রাপ্ত হয়, কেননা সন্দিগ্ধচিত্ত ব্যক্তি ইহলোকে বা পরলোকে সুখভোগ করতে পারে না।
শুধু তাই নয় তারা বার বার এই মৃত্যুময় জগতে অধঃপতিত হয়ে দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করে। অপ্রাপ্যমাং নিবর্তন্তে মৃত্যুসংসারবানি। (গীতা ৯/৩)
প্রতিটি ব্যক্তিই ভগবদ্গীতার জ্ঞানের সংস্পর্শে অর্থাৎ ভগবানের সংস্পর্শে আসার ফলে অচিরেই শুদ্ধ হয়ে ওঠে। সে প্রতিশ্রুতির কথা বলতে গিয়ে ভগবান (গীতা ৯/৩০) ব্যক্ত করেছেন
অপি চেৎ সুদুরাচারো ভজতে মামনন্যভাক্ ।
সাধুরেব স মন্তব্যঃ সম্যগ¦্যবসিতো হি সঃ ॥
ভগবান বলছেন, অতি দুরাচারী ব্যক্তিও যদি অনন্যভক্তি সহকারে আমাকে ভজনা করেন, তাহলেও তাঁকে সাধু বলেই মনে করা উচিত। কারণ তাঁর দৃঢ় সংকল্পের মাধ্যমে তিনি যথার্থ মার্গে অবস্থিত।
ভগবানের সংস্পর্শে আমার ফলে তিনি ধীরে ধীরে পবিত্র হয়ে উঠেন কেননা ভগবান হচ্ছেন পরম পবিত্র–পরং ব্রহ্ম পরং ধাম পবিত্রং পরমং ভবান্। (গীতা ১০/১২)। ভগবান যেহেতু সকল জীবের হৃদয়ে অবস্থান করছেন তাই, জীব যখন ভগবৎ ভজনে উন্মুখ হন তখন ভগবান তার হৃদয় থেকে তাকে অনুপ্রেরণা ও ভগবানের স্বভাবশতঃ তাঁর ক্রিয়াশক্তির দ্বারা তাঁকে শুদ্ধ করে তোলেন। ইংরেজী ভাষায় ভগবানকে ‘GOD’ বলে সম্বোধন করা হয়। ‘G’ অর্থে Generator অর্থাৎ তিনি স্রষ্টা, ‘O’ অর্থে Operator অর্থাৎ তিনি সৃষ্টিকে পালন করেন আর ‘D’ অর্থে Destroyer অর্থাৎ তিনি ধ্বংস করেন। তাঁর এই ক্রিয়াশক্তি দ্বারা তিনি ভক্ত হৃদয় থেকে সমস্ত সদ্গুণের সৃষ্টি বা বিকাশ সাধন করেন। আর পালন অর্থে তিনি ভক্তের সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করে পালন করেন। তা আগেই বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। আর ধ্বংস অর্থে তিনি ভক্তের সমস্ত প্রকার কলুষ নাশ করে ভক্তকে শুদ্ধ করে তোলেন। এভাবে করুণাময় ভগবান তাঁর সৃষ্ট জীবকে জড় জগতের দুঃখ যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করার জন্য কতটাই না করেছেন। এখানে আর একটি বিশেষ উল্লেখ্য যে ভগবান বলেছেন যে, যেহেতু ভক্তের সমস্ত দায়িত্ব আমার সেহেতু আমি নির্দেশ করছি যে, ভজনকারী ব্যক্তির পূর্বের দোষত্রুটি বিচার না করে অবশ্যই তাঁকে সাধু বলে সম্বোধন করবেন–‘ সাধুরেব স মন্তব্যঃ।’ আচার্যগণ এই কথার উপর বহু টীকা দিয়ে সতর্কতা করেছেন যে–এই কথার অবমাননা করে আমরা যেন ভগবৎ চরণে অপরাধী না হই।
পূর্ববর্তী আচার্যগণ আর এক দৃষ্টিকোন দিয়ে এই শ্লোকের (গীতা ৯/৩০) আরো বিচার দিয়েছেন। বিচার এই যে, ভজন- সাধনে যুক্ত ভক্ত পূর্ব অভ্যাসবশতঃ হঠাৎ কোন কারণে যদি দুরাচারী কার্য করে ফেলেন বা দুরাচারী কার্যে যুক্ত হয়ে পড়ে, তাহলেও ভগবান বলছেন যে, সেই ভক্তকে তুমি তাঁর সাধুত্ব সম্মান প্রদান অবশ্যই করবে। ইস্কন প্রতিষ্ঠাতা আচার্য ও ভগবদ্গীতা যথাযথ গ্রন্থের ভাষ্যকার শ্রীল প্রভুপাদ একটি ছোট উদাহরণের মাধ্যমে আমাদের এ বিষয়ে স্পষ্টীকরণ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন পাখার ইলেকট্রিক সুইজ অফ্ করলেও পাখাটি তৎক্ষণাৎ বন্ধ হয়ে যায় না। ধীর গতিতে গতিবেগ কমতে কমতে একসময় তা বন্ধ হয়। সেইভাবে ভগবৎ ভজনে যুক্ত ব্যক্তি ক্রমগতিতে দুরাচার কর্ম থেকে মুক্ত। তাছাড়াও ভগবান পরের শ্লোকে (গীতা ৯/৩১) বলছেন–আমিই তাকে ধর্মাত্মার স্তরে উন্নীত করে তুলি
ক্ষিপ্রং ভবতি ধর্মাত্মা শশ্বচ্ছান্তিং নিগচ্ছতি।
কৌন্তেয় প্রতিজানীহি ন মে ভক্তঃ প্রণশ্যতি ॥
তিনি শ্রীঘ্রই ধর্মাত্ম পরিণত হন এবং নিত্য শান্তি লাভ করেন। হে কৌন্তেয়,তুমি দৃপ্তকন্ঠে ঘোষণা কর যে, আমার ভক্ত কখনও বিনষ্ট হন না। তার দুষ্কর্মের জন্য নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হয় না বা এই জগতের কোন শক্তি দ্বারা তাঁকে শাস্তি ভোগ করতে হয় না। এখানে আরো উল্লেখ্য যে একথা তিনি নিজে ঘোষণা না করে তাঁর ভক্ত অর্জুনকে দিয়ে ঘোষণা করিয়েছেন–“ অর্জুন তুমি ঘোষণা কর।” কারণ ভক্তের বাক্য বা ভক্তের প্রতিশ্রুতি ভগবান সর্বদা রক্ষা করেন।
ইস্কন প্রতিষ্ঠাতা আচার্য জগৎগুরু শ্রীল প্রভুপাদ ভগবানের মুখনিঃসৃত এই ভগবদ্বাক্য ভগবদ্গীতাকে সহজ করে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এই সরল শিক্ষা সারা বিশ্বে প্রায় ১০০টির বেশী ভাষায় অনুদিত হয়ে প্রচার হচ্ছে এবং তাঁরই শিক্ষার উপর আধারিত বর্তমান শিক্ষার সাথে উপযোগ করার স্বার্থে ইসকন কর্তৃপক্ষ এর উপর একটি পাঠ্যক্রম তৈরী করেছেন ।
এই ভগবদ্গীতা স্টাডী কোর্সটির মাধ্যমে আপনি পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে অবস্থান করলেও এই শিক্ষাটি আয়ত্ব করতে সক্ষম হবেন এবং আপনার জীবনের সমস্ত প্রয়োজন প্রাপ্ত হবেন ও অন্তিম লক্ষ প্রাপ্ত হবেন।
➡ গীতার বয়স কত?
আক্ষরিক অর্থে লোকজন প্রায় ৫০০০ বছর হিসেব করলেও কেবল ২০ লক্ষ বছর পূর্বেই মানবজাতির জনক মনু তার পুত্র ঈক্ষ্বাকুকে এই গীতার জ্ঞান দান করেছিলেন। আবার ১২ কোটি বছর পূর্বে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই জ্ঞান সূর্যদেবকে দান করেন। যদি শুধু এই কল্পের হিসেব এমন হয়, তাহলে সহজেই অনুমেয় গীতার জ্ঞান অনাদিকাল থেকেই বাহিত হয়ে আসছে ও বিরাজমান।
➡ গীতা কি?
গীতা হচ্ছে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণী।
(স্কন্ধ পুরাণ, আদি খন্ড – শ্রী ব্যাসদেব)
ভগবানের বাণী, রূপ, গুণ, লীলা ভগবান থেকে অভিন্ন। তাই শ্রীমদ্ভগবদগীতাও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ থেকে অভিন্ন।
শ্রীমদ্ভগবদগীতার ১ম থেকে ৫ম অধ্যায় হচ্ছে ভগবানের মস্তক। ৬ষ্ঠ থেকে পঞ্চদশ অধ্যায় নির্দেশ করে ভগবানের বাহু। ১৬ তম অধ্যায় নির্দেশ করে উদর দেশ। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ অধ্যায় নির্দেশ করে ভগবানের চরণদ্বয়।
➡ গীতায় কতটি শ্লোক আছে?
গীতাকে বলা হয় সমস্ত উপনিষদের সারাতিসার। (গীতা মাহাত্ম্য – ০৭) এতে ৭০০ টি শ্লোক আছে। এজন্য গীতার আরেক নাম সপ্তশতী।
৭০০ টি শ্লোকের মধ্যে রয়েছে…
ভগবান শ্রী কৃষ্ণের ৫৭৪ টি,
অর্জুনের ৮৫ টি,
সঞ্জয়ের ৪০ টি,
এবং ধৃতরাষ্ট্রের ১ টি।