বাংলাদেশ ইস্‌কনের অগ্রগণ্য পথিকৃৎ

প্রকাশ: ৯ ডিসেম্বর ২০২১ | ১:২৪ অপরাহ্ণ আপডেট: ৯ ডিসেম্বর ২০২১ | ১:২৫ অপরাহ্ণ

এই পোস্টটি 363 বার দেখা হয়েছে

বাংলাদেশ ইস্‌কনের অগ্রগণ্য পথিকৃৎ

আবির্ভাব: ইস্‌কন বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি, বিশ্বখ্যাত কীর্তনীয়া ও গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণের উজ্জ্বল নক্ষত্ৰ, শ্রীপাদ কৃষ্ণকীর্তন দাস ব্রহ্মচারী ১৯৪৯ সালে ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী থানার ধোপাপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বনাম কালিপদ মণ্ডল। শ্রীগুরুদেব প্রদত্ত নাম হয়, “কৃষ্ণকীর্তন দাস”।

গুণাবলী: তিনি ছিলেন ইস্‌কন বাংলাদেশের এক উজ্জ্বল বাংলাদেশে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের গোড়াপত্তন থেকে শুরু করে আজ অবধি যে প্রচার পরিক্রমা চলমান তার মধ্যে শ্রীপাদ কৃষকীর্তন দাস ব্রহ্মচারীর অবদান অপ্রতিম। তিনি একাধারে বিশ্বখ্যাত কীর্তনীয়া, বিদগ্ধ আলোচক ও একজন আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। বহুগুণে গুণান্বিত এই মহান ব্যক্তিত্ব জীবদ্দশায় এমন সব কীর্তি রেখে গেছেন, যার সাক্ষ্য বৈষ্ণব সমাজ যুগ যুগ বহন করবে। তাঁর গুরুদেব শ্রীল জয়পতাকা স্বামী মহারাজ তাঁকে যথার্থ নামই প্রদান করেছিলেন। তিনি বিশ্বব্যাপী অগণিত ভক্তদের মাঝে নিরলসভাবে কৃষ্ণকীর্তন পরিবেশন করেছেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ভগবানের শ্রীনাম গুণ কীর্তনে নিয়োজিত ছিলেন।

শৈশব: বাল্যকাল হতেই তিনি ছিলেন বিবিধ বৈষ্ণবীয় গুণে গুণান্বিত। ছোটবেলায় তিনি পদকীর্তন ও ভাগবত পাঠ করে এলাকায় সুখ্যাতি অর্জন করেন। তিনি একাধারে বাংলা, ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।

শিক্ষা: তিনি ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী থানার অন্তর্গত এক স্থানীয় বিদ্যালয় ও কলেজে পড়েন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীনই তিনি কৃষ্ণভাবনায় যোগ দেন।

কৃষ্ণভাবনার সংস্পর্শে আসা: শ্রীল প্রভুপাদ প্রকটকালীন সময়েই ১৯৭৫ সালে তিনি শ্রীধাম মায়াপুর দর্শন করেন এবং সনাতন ধর্ম প্রচারে অনুপ্রাণিত হন। ১৯৭৮ সালে বৈয়াসকি দাস, ইলাপতি দাস (অধুনা শ্রীমৎ ভক্তি বিকাশ স্বামী), রসিক দাস প্রমুখ ভক্তবৃন্দ বাংলাদেশে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারে আসেন। ঐ বছরেই রাজবাড়ী জেলায় একটি অনুষ্ঠানে ইস্‌কন ভক্তদের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ এবং কথোপকথন হয়। তারপর তিনি ইস্‌কন ভক্তদের দিয়ে ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে বিশাল ধর্মসভার আয়োজন করেন। সেখানে তিনি কীর্তন পরিবেশন করেন এবং শ্রীমৎ ভক্তি বিকাশ স্বামী মহারাজের বঙ্গানুবাদের সুযোগ পান। শ্রীমৎ ভক্তি বিকাশ স্বামী মহারাজ ঢাকায় ফিরে তাঁকে তিন পৃষ্ঠার একটি বিশদ চিঠি প্রেরণ করেন এবং তাঁর সুললিত কণ্ঠকে কৃষ্ণসেবায় নিযুক্ত করতে অনুপ্রাণিত করেন।

দীক্ষা গ্রহণ: ১৯৭৮ সালেই নিজেকে কৃষ্ণসেবায় যুক্ত করার জন্য ব্রহ্মচারীরূপে ইস্‌কনের অস্থায়ী প্রচার কেন্দ্র ৬১, তেজকুনী পাড়া, ঢাকায় যোগদান করেন।

অবদান: দীক্ষার পর থেকেই সারাদেশে সনাতন ধর্ম প্রচারের গুরু দায়িত্ব অর্পণ করা হয় শ্রীপাদ কৃষ্ণকীর্তন প্রভুকে। অসীম সাহস ও ধৈর্যের সাথে তিনি প্রচার আন্দোলনকে বেগবান করেন। ১৯৮০ সালে শ্রীধাম মায়াপুরে তিনি ইস্‌কনের অন্যতম দীক্ষাগুরু শ্রীল জয়পতাকা স্বামী মহারাজের নিকট হতে হরিনাম দীক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে শ্রীগুরুদেব এবং শ্রীমৎ প্রভাবিষ্ণু স্বামী মহারাজের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় সারাদেশে ব্যাপকভাবে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচার এবং মন্দির প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হন । সুদীর্ঘ সময় তিনি ইস্‌কন বাংলাদেশের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ইস্‌কন বাংলাদেশের বর্তমান নেতৃবর্গের অধিকাংশই তাঁর মাধ্যমে কৃষ্ণভাবনা আত্মনিয়োগ করেন। বৈষ্ণবাচার্যগণের পদসমূহ সংরক্ষণ এবং অবিকৃতভাবে কীর্তন পরিবেশন করার জন্য তিনি চৈতন্য কালচারাল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। দেশ বিদেশের ভক্তগণ এখান থেকে বিশুদ্ধ ভজন কীর্তন শিক্ষা লাভ করে বিশ্বব্যাপী প্রচার করছেন। ‘হরেকৃষ্ণ সমাচার’ পত্রিকার সূচনালগ্ন থেকে দীর্ঘকাল যাবৎ তিনি এর প্রধান উপদেষ্টার পদ অলংকৃত করেছিলেন। তাঁর দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তিনি শ্রীল প্রভুপাদের মিশন ও শ্রীচৈতন্যদেবের বাণী প্রচারে আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়াসহ সমগ্র বিশ্বে কৃষ্ণকথা ও কীর্তন করেছেন।

মিডিয়াতে অবদান: এই মহান বৈষ্ণব বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারের নিয়মিত গীতা পাঠক ছিলেন। বিদগ্ধ ভাগবত আলোচক হিসেবে তার সুখ্যাতি রয়েছে। কুসংস্কার থেকে সনাতন ধর্মকে মুক্ত রাখতে তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন।

অর্জন: উপমহাদেশের কীর্তন জগতে তাঁর অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ নবদ্বীপে কীর্তন সম্মেলনে কীর্তন সম্রাজ্ঞী সরস্বতী দেবী কর্তৃক তিনি ‘কীর্তনরসসিন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন।

দেহ ত্যাগ: ২০২১ সালের ১৮ মার্চ দিবাগত রাত ১১.৩০ ঘটিকায় জড়দেহ ত্যাগ করে গোলকধামে তিনি প্রত্যাবর্তন করেন। দিনাজপুর জেলার খানসামা থানাধীন টঙ্গুয়া (মাদারডাঙ্গা) হাই স্কুল প্রাঙ্গনে আয়োজিত সনাতন ধর্ম সম্মেলন অনুষ্ঠানে অগণিত ভক্তদের মাঝে ভাগবত আলোচনা ও শ্রীনরোত্তম দাস ঠাকুরের বিখ্যাত পদ “হরি বলব আর মদনমোহন হেরিব গো” কীর্তন পরিবেশন করে প্রসাদ আস্বাদনের পর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরদিন ১৯ মার্চ রাত্রির প্রথম প্রহরে এই মহান বৈষ্ণবকে শ্রীশ্রী রাধাগোপীনাথ মন্দির,  গড়েয়া, ঠাকুরগাঁও এবং বেলা ১.০০ ঘটিকায় স্বামীবাগ আশ্রম, ঢাকায় যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন শেষে সংকীর্তন যোগে ঢাকাস্থ রাজারবাগের বরদেশ্বরী কালীবাড়ি ও মহাশ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। বিকাল ৪.৩০ ঘটিকায় পূর্ণাঙ্গ বৈষ্ণব রীতিতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।

স্মৃতিচারণ: তাঁর সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী মহারাজ বলেন, “শ্রীমান কৃষ্ণকীর্তন দাস ব্রহ্মচারী ছিলেন বাংলাদেশের প্রচার প্রচেষ্টার অন্যতম পথিকৃৎ।” শ্রীমৎ ভক্তিপুরুষোত্তম স্বামী মহারাজ বলেন, “তিনি (কৃষ্ণকীর্তন দাস ব্রহ্মচারী) আমার অন্যতম প্রিয় গুরুভ্রাতা। তাঁকে গুরুমহারাজের পার্ষদ বললে অত্যুক্তি হবে না। বাংলাদেশে তিনি কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের সূত্রপাত করেছিলেন। তাঁর দেহরক্ষাটিও অত্যন্ত বিস্ময়কর। এটি আমাদের শিক্ষা দেন কিভাবে ভগবানের শুদ্ধভক্ত দেহত্যাগ করেন।”

স্মরণ সেবা ও বৈষ্ণব সেবা: ২১ মার্চ সকাল থেকে সমগ্র দিনব্যাপী ইসকন স্বামীবাগ আশ্রমসহ বিভিন্ন মন্দিরে স্মরণোৎসব ও বৈষ্ণব সেবা অনুষ্ঠিত হয়। অগণিত ভক্তের স্মৃতিচারণায় অনুষ্ঠানটি সু-সম্পন্ন হয়। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর বলেছেন, একজন বৈষ্ণব কখনো মরে না, তিনি বেঁচে থাকেন তাঁর নামের মাধ্যমে। লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেলেও শ্রীপাদ কৃষ্ণকীর্তন দাস ব্রহ্মচারী সকলের স্মৃতিতে চির অম্লান থাকবেন।

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।