১৯৭৬ সালের জুনে বোম্বের অন্যতম একটি সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জার্নালের সম্পাদকেরা শ্রীল প্রভুপাদকে কিছু প্রশ্নাবলি পাঠান এখানে এক ভক্ত প্রশ্নগুলো পড়ছেন এবং শ্রীল প্রভুপাদ সেগুলোর উত্তর দিচ্ছেন ।
ভক্ত : প্রথম প্রশ্নটি এইরকম : “বলা হয়, হিন্দুধর্মের বড় শত্রু হচ্ছে এর উদারতা বা দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতা, কিন্তু সেটি আবার এই ধর্মের দুর্বলতাও বলতে হবে। কেননা, এখানে সকলের পালনীয় বিধিনিয়ম খুব কমই রয়েছে, অন্যান্য ধর্মের মধ্যে যেমন রয়েছে। সকল হিন্দুর পক্ষে পালনীয় নির্দিষ্ট কিছু মৌলিক ন্যূনতম বিধিনিয়ম কি তৈরি করা প্রয়োজনীয় এবং সম্ভব?”
শ্রীল প্রভুপাদ : বৈদিক ধর্মের কথা বলতে গেলে বলতে হবে, সে ধর্ম কেবল হিন্দুদের জন্য নয়, সেটি সকল জীবসত্তার জন্য। সেটিই প্রথমে উপলব্ধি করতে হবে। বৈদিক ধর্মকে বলা হয় সনাতন ধর্ম, “জীবসত্তার শাশ্বত বৃত্তি।” জীবসত্তা সনাতন (শাশ্বত), ভগবান হচ্ছেন সনাতন এবং সেখানে সনাতন ধর্ম রয়েছে। সনাতন ধর্ম সকল জীবের জন্য, তথাকথিত কেবল হিন্দুদের জন্য নয়। হিন্দুধর্ম, এই ধর্ম, সেই ধর্ম–এগুলো সবই ভ্রান্ত ধারণা। ইতিহাস অনুসারে, সনাতন ধর্ম ভারতবর্ষে নিয়মিতভাবে অনুসৃত হয়ে আসছিল, তারপর মুসলিমরা ভারতীয়দের হিন্দু বলতে শুরু করে। মুসলিমরা দেখেছিল যে, ভারতীয়রা সিন্ধু নদীর অপর পারে বাস করে, আর মুসলিমরা সিন্ধুকে হিন্দু বলে উচ্চারণ করত। সেজন্য তারা ভারতকে ‘হিন্দুস্থান’ বলত এবং ঐ দেশে যারা বাস করত তাদের তারা বলত ‘হিন্দু’। কিন্তু বৈদিক শাস্ত্রে হিন্দু শব্দটির কোনো উল্লেখ নেই, তথাকথিত হিন্দু ধর্মেরও কোনো উল্লেখ নেই। এখন এই সনাতন ধর্ম বা বৈদিক ধর্মকে বিকৃত করা হচ্ছে, ঠিকমতো পালন করা হচ্ছে না, যথাযথভাবে মান্য করা হচ্ছে না এবং এটিকে এখন হিন্দুধর্ম বলে অভিহিত করা হচ্ছে। কিন্তু এটি একটি ভ্রান্তিপূর্ণ ধারণা, ধর্ম সম্বন্ধে এই ধারণা প্রকৃত ধারণা নয়। আমাদেরকে সনাতন ধর্ম উপলব্ধি করতে হবে, ভগবদ্গীতা এবং অন্যান্য বৈদিক শাস্ত্রে যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে সেভাবেই; তখন আমরা উপলব্ধি করতে পারব বৈদিক ধর্ম প্রকৃতপক্ষে কী? ভগবদ্গীতার একাদশ অধ্যায়ের ১৮ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে-
ত্বমক্ষরং পরমং বেদিতব্যং
ত্বমস্য বিশ্বস্য পরং নিধানম।
ত্বমব্যয়ঃ শাশ্বতধর্মগোপ্তা
সনাতনস্ত্বং পুরুষো মতো মে॥
“তুমি পরম ব্রহ্ম এবং একমাত্র জ্ঞাতব্য তুমি বিশ্বের পরম আশ্রয় । তুমি অব্যয়, সনাতম ধর্মের রক্ষক এবং সনাতন পরম পুরুষ। এই আমার অভিমত ।”
এই উপলব্ধি প্রয়োজন। শ্রীকৃষ্ণ সনাতন, শাশ্বত, আমরা শাশ্বত, আর যেখানে আমরা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বাস করতে পারি এবং তাঁর সঙ্গে আমাদের অনুভবের আদান প্রদান করতে পারি সেই স্থানটিও শাশ্বত। আর যে পদ্ধতি এই শাশ্বত আদান প্রদানের পন্থাটি শিক্ষা দেয়–সেটিই সনাতন ধর্ম, যা প্রত্যেকের জন্য।
ভক্ত : তাহলে যিনি সনাতন ধর্ম আশ্রয় করতে আগ্রহী, তার জন্য প্রাত্যহিক নির্ধারিত ধর্মীয় বিধি নিয়মগুলো কী হবে? অভিযোগ আছে হিন্দুধর্মে এত ব্যাপ্তি, এত বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্র্য রয়েছে যে…
শ্রীল প্রভুপাদ : তুমি কেন বৈচিত্র্যর দিকে যাচ্ছ? তুমি শ্রীকৃষ্ণের নিকট থেকে ধর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্বন্ধে শিক্ষা গ্রহণ কেন করছ না? শ্রীকৃষ্ণ বলছেন সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ। (গীতা ১৮/৬৬) “তথাকথিত অন্য সমস্ত ধর্ম বর্জন কর এবং কেবল আমার শরণাগত হও।” এটি কেন গ্রহণ করছ না? কেন তুমি সনাতন পুরুষ কৃষ্ণের উপদেশ গ্রহণ করছ না? ভগবান বলছেন গ্রহণ করতে–কিন্তু তুমি বলছ, “আমি কীভাবে এতসব বিচিত্র নীতি-নিয়ম বর্জন করব এবং সঠিক পথে আসব?” কেন তুমি ঐ সমস্ত বিভিন্ন পথ অনুসরণ করতে যাচ্ছ? কেবল এই একটি ভাবনা অবলম্বন কর।
ভক্ত : কীভাবে মানুষ তাদের ব্যবহারিক জীবনে দৈনন্দিন ভিত্তিতে এটি অনুসরণ করতে পারে?
শ্রীল প্রভুপাদ : আমরা কীভাবে করছি? আমরা যা করছি তা কি বাস্তব নয়? মানুষ তাদের নিজস্ব অবাস্তব ধর্ম পথ উদ্ভাবন করবে, কিন্তু তারা এই বাস্তব ব্যবহারিক পন্থাটি গ্রহণ করবে না। আর সেটি কী? মন্মনা ভব মদ্ভক্ত মদযাজি মাং নমস্কুরুঃ—কেবল শ্রীকৃষ্ণের চিন্তা কর, তাঁর ভক্ত হও, তাঁর পূজা কর এবং তাঁকে প্রণতি নিবেদন কর। এটি করতে অসুবিধা কোথায়? এখানে কোন্টি বাস্তবোচিত নয়? শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, এটি তোমার কর্তব্য। তুমি যদি এটি কর তাহলে তুমি নিঃসন্দেহে আমার কাছে ফিরে আসবে।” তাহলে তুমি সেটি করছ না কেন? কেন তুমি হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বুড্ডিস্ট হয়ে রয়েছ? এ সব অর্থহীন, সবকিছু বর্জন কর। কেবল শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হও এবং উপলব্ধি কর, “আমি শ্রীকৃষ্ণের একজন ভক্ত, শ্রীকৃষ্ণের একজন সেবক।” তাহলে তৎক্ষণাৎ সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে।
ভক্ত : কিন্তু হিন্দুরা বলবেন, “হিন্দুধর্মের আরও কত দিক রয়েছে।”
শ্রীল প্রভুপাদ : শ্রীমদ্ভাগবতে প্রকৃত ধর্মের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে : ধর্মং তু সাক্ষাৎ ভগবৎ প্রণীতম্। “ভগবান যা বলেন–সেটিই হচ্ছে ধর্ম।” এখন, ভগবান বলছেন, “অন্য সকল ধর্ম বর্জন কর এবং আমার শরণাগত হও।” সুতরাং, সেই ধর্ম গ্রহণ কর। কেন তুমি একজন হিন্দু থাকতে চাও? আর তাছাড়া কোন্ হিন্দু শ্রীকৃষ্ণের প্রামাণিকতা স্বীকার করতে চাইবে না? এমনকি আজও যদি কোনো হিন্দু বলে “আমি শ্রীকৃষ্ণ এবং গীতাকে মানি না,” তৎক্ষণাৎ তাকে একজন উম্মাদ সাব্যস্ত করা হবে এবং তার কথা প্রত্যাখ্যান করা হবে। তাহলে কেন তুমি শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ গ্রহণ করবে না? তোমার সমস্যা হচ্ছে, তুমি জান না ধর্ম বা সনাতন ধর্ম কী? কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনে এমন অনেকে রয়েছে যারা পূর্বে তথাকথিত হিন্দু মুসলিম এবং খ্রিস্টান ছিল, কিন্তু এখন তারা ‘হিন্দু’ কিংবা ‘মুসলিম’ কিংবা ‘খ্রিস্টান’–এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না, গুরুত্ব দেয় না। তাদের সমস্ত মনোযোগ কেবল শ্রীকৃষ্ণে কেন্দ্রীভূত। তুমি যদি একটি মিথ্যা, ভ্রান্তিপূর্ণ ধর্মমত অনুসরণ করতে থাক, তাহলে তোমাকে কষ্ট পেতে হবে; তুমি যদি একটি প্রকৃত ধর্মপন্থা অনুসরণ কর, তুমি প্রকৃতই সুখী হবে।
দুর্ভাগ্যবশতঃ ভারতীয় জনগণ প্রকৃত ধর্মপন্থা সনাতন ধর্ম বা বর্ণাশ্রম ধর্ম পরিত্যাগ করেছিল এবং আবোল তাবোল কিছুকে গ্রহণ করেছিল, যাকে বলা হয় “হিন্দুধর্ম”। সেজন্য সমস্যা দেখা দিয়েছে। বৈদিক ধর্ম বলতে বোঝায় বর্ণাশ্রম ধর্ম, সমাজকে চারটি বর্ণ ও চারটি আশ্রমে বিভক্ত করা। চারটি বর্ণ বা সামাজিক শ্রেণি হচ্ছে ব্রাহ্মণ, (পুরোহিত ও বুদ্ধিজীবীগণ), ক্ষত্রিয় (রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সামরিক বাহিনীর লোকজন), বৈশ্য (ব্যবসায়ী ও কৃষক) এবং শূদ্র (শ্রমিক, দৈহিক শ্রমদানকারী)। চারটি আশ্রম বা পারমার্থিক শ্রেণি হচ্ছে ব্রহ্মচারী (অবিবাহিত ছাত্র), গৃহস্থ, বানপ্রস্থী (সংসার থেকে অবসর গ্রহণকারী) এবং সন্ন্যাসী । যখন এই সমস্ত বর্ণ ও আশ্রমের মানুষ পরমেশ্বর ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে, সেটিই প্রকৃত ধর্ম।
ভক্ত : বর্তমানে কলহের যুগ কলিযুগে ভক্তিকে ভগবদ্ উপলব্ধির সবচেয়ে উপযুক্ত পথ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তবুও কেন প্রখ্যাত ধর্মপ্রচারকেরা জ্ঞানের প্রাধান্যভিত্তিক বৈদান্তিক শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করছেন?
বৈদিক ধর্মের কথা বলতে গেলে বলতে হবে, সে ধর্ম কেবল হিন্দুদের জন্য নয়, সেটি সকল জীবসত্তার জন্য। সেটিই প্রথমে উপলব্ধি করতে হবে। বৈদিক ধর্মকে বলা হয় সনাতন ধর্ম, “জীবসত্তার শাশ্বত বৃত্তি।” জীবসত্তা সনাতন (শাশ্বত), ভগবান হচ্ছেন সনাতন এবং সেখানে সনাতন ধর্ম রয়েছে । সনাতন ধর্ম সকল জীবের জন্য, তথাকথিত কেবল হিন্দুদের জন্য নয়।
শ্রীল প্রভুপাদ : তথাকথিত এসব বেদান্তবাদীরা প্রতারক। তারা জানে না বেদান্ত কী। এসব প্রতারকেরা সরল ও ধর্ম সম্বন্ধে অজ্ঞানী লোকদের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে। বেদ শব্দের অর্থ “পরম জ্ঞান” এবং অন্ত শব্দের অর্থ হচ্ছে “শেষ”। সুতরাং, বেদান্ত শব্দের অর্থ হচ্ছে “পরম জ্ঞান”। আর বেদান্তসূত্রে সেটিই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। বেদান্তসূত্রের প্রথম সূত্র হচ্ছে অথাতো ব্রহ্মজিজ্ঞাসাঃ “এখন মানব জীবন প্রাপ্ত হওয়ার পর, একজন মানুষের কর্তব্য হচ্ছে ব্রহ্ম সম্বন্ধে, পরম সত্য সম্বন্ধে অনুসন্ধান করা, জানার চেষ্টা করা।” সুতরাং, বেদান্ত অনুশীলন তখনই শুরু হয়, যখন কেউ পরম তত্ত্ব বস্তু সম্বন্ধে অনুসন্ধিৎসু হয়, জিজ্ঞাসু হয়। আর সেই পরম তত্ত্ব বস্তু বা সত্য হচ্ছে- জন্মাদস্য যতঃ “ব্রহ্ম হচ্ছেন সবকিছুর উদ্ভবের উৎস।” সুতরাং, ব্রহ্ম হচ্ছেন ভগবান, সবকিছুর উৎস এবং সমস্ত বেদ, অথবা সর্বজ্ঞান পরমেশ্বর ভগবানে গিয়ে পরম পরিণতি লাভ করে, সমাপ্ত হয়। এই তথ্য ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা সমর্থিত হয়েছে (১৫/১৫): বেদৈশ্চ সর্বৈরহমেব বেদ্যঃ “সকল বেদের, সকল দার্শনিক জ্ঞান গ্রন্থের উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাকে জানা ৷”
সুতরাং, সমগ্র বেদান্ত সূত্র হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবানের বর্ণনা। কিন্তু এই কলিযুগে মানুষ যথাযথভাবে বেদান্ত সূত্র অধ্যয়ন করতে সমর্থ হবে না, শিক্ষার অভাবের জন্য সেজন্য শ্রীল ব্যাসদেব স্বয়ং বেদান্ত সূত্রের একটি ভাষ্য রচনা করেন। সেই ভাষ্য হচ্ছে শ্রীমদ্ভাগবত (ভাষ্যাম্ ব্রহ্মসূত্রানাম্)। শ্রীমদ্ভাগবত বেদান্ত সুত্রের প্রকৃত ভাষ্য। একই লেখক বেদান্ত সূত্রের প্রণেতা ব্যাসদেবের দ্বারা শ্রীমদ্ভাগবত রচিত, তাঁর গুরুদেব শ্রীল নারদ মুনির উপদেশ অনুসারে। বেদান্ত সূত্রের মতোই শ্রীমদ্ভাগবত সেই একই সূত্র দিয়ে শুরু হয়েছে, জন্মাদস্য যতঃ এবং তারপরে অন্বয়াদ্ ইতরতশ্চার্থেষু অভিজ্ঞঃ স্বরাট।
কিন্তু কিছু পাষণ্ড বেদান্ত সূত্র না বুঝে, পাঠ না করেই নিজেদেরকে বৈদান্তিক বলে পরিচয় দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। যেহেতু মানুষ যথার্থ অর্থে শিক্ষিত নয়। তারা এ সমস্ত পাষণ্ডদের বৈদান্তিক হিসেবে গ্রহণ করছে। বেদান্ত সূত্র ব্যাখ্যা করা হয়েছে শ্রীমদ্ভাগবতে, আর আমরা যদি শ্রীমদ্ভাগবতকে বেদান্ত সূত্রের প্রকৃত ব্যাখ্যা, প্রকৃত ভাষ্য বলে গ্রহণ করি, তাহলে আমরা উপলব্ধি করতে পারব প্রকৃত বেদান্ত কী। কিন্তু আমরা যদি এসমস্ত ধোঁকাবাজদের আশ্রয় গ্রহণ করি, তাহলে আমরা বেদান্ত শিখতে পারব না। কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে বেদান্ত কী এবং বেদান্তের ব্যাখ্যা কী। তাহলে তারা উপকৃত হবে।
ভক্ত : সাধারণত যারা বেদান্ত সূত্রের নির্বিশেষবাদী ভাষ্য অনুসরণ করে, তারা এই জড়জগতের দুঃখ দুর্দশা থেকে মুক্ত হতে প্রচেষ্টা করে। শ্রীমদ্ভাগবতেও কি মুক্তির বিষয়টি আলোচিত হয়েছে?
শ্রীল প্রভুপাদ : হ্যাঁ। যেহেতু শ্রীমদ্ভাগবত হচ্ছে
বেদান্ত সূত্রের প্রকৃত ভাষ্য, আমরা এই শ্লোকে এই যুগে মুক্তিলাভের পন্থার বর্ণনা পাই :
কলের্দোষনিধে রাজন্নস্তি হ্যেকো মহান্ গুণঃ।
কীর্তনাদেব কৃষ্ণস্য মুক্তসঙ্গঃ পরং ব্রজেৎ ॥
এই কলিযুগ হচ্ছে দোষের সাগর, কিন্তু একটি মহান গুণ রয়েছে। সেটি কী? কেবল হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তনের মাধ্যমে যে কেউ মুক্ত হয়ে যেতে পারে। এ হচ্ছে প্রকৃত বেদান্ত এবং প্রকৃতপক্ষে এটা ঘটছে।
ভক্ত : এটি বলছেন যে, বেদান্ত সূত্রের সিদ্ধান্ত এবং শ্রীমদ্ভাগবতের সিদ্ধান্ত এক ও অভিন্ন–ভক্তি?
শ্রীল প্রভুপাদ : হ্যাঁ ।
ভক্ত : কিন্তু বৈদান্তিক জ্ঞানের সিদ্ধান্তের সঙ্গে কীভাবে ভক্তিকে সংবদ্ধ করা যেতে পারে? এখানে প্রশ্নে বলা হয়েছে যে, ভক্তি হচ্ছে ভগবদ্ উপলব্ধির সবচেয়ে উপযোগী ও সহজতম উপায়, কিন্তু এখানে এটিও বলা হয়েছে, বৈদান্তিক শিক্ষায় জ্ঞানের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সেটি কী সত্যি?
শ্রীল প্রভুপাদ : জ্ঞান কী? গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেটি ব্যাখ্যা করেছেন (৭/১৯): বহুনাং জন্মনামন্তে জ্ঞানাবান্মাং প্রপদ্যতে। “বহু বহু জন্মের পর প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তি আমার শরণাগত হন।” সুতরাং, কেউ যদি শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত না হয়, তাহলে তার জ্ঞানের কোনো প্রশ্ন নেই। এই নির্বিশেষবাদী “জ্ঞান” সম্পূর্ণভাবে এক অর্থহীন প্রলাপ। নির্বিশেষবাদীরা নিজেদের জ্ঞানী বলে অভিহিত করছে, কিন্তু তাদের আদৌ কোনো জ্ঞান নেই।
বেদান্তের অর্থ হচ্ছে “চরম জ্ঞান”। অতএব, চরম জ্ঞান বা পরম জ্ঞানে বিষয়বস্তু হচ্ছেন কৃষ্ণ, ভগবান । কেউ যদি ভগবান কে, শ্রীকৃষ্ণ কে, সেটি না জানে, তা হলে তার জ্ঞান কোথায়? কিন্তু যদি কোনো দুষ্টাশয় পাষণ্ড দাবি করে, “আমি একজন জ্ঞানী ব্যক্তি” তাহলে কি করার আছে?
শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, বাসুদেবঃ সর্বমিতি স মহাত্মা সুদুর্লভঃ “কেউ যখন উপলব্ধি করেন, বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সবকিছু, সর্ব কারণের কারণ তাহলে তিনি জ্ঞানী, মহাত্মা।” তার পূর্বে, জ্ঞানের কোনো প্রশ্ন নেই। কেবল ভ্রান্ত ধারণা মাত্র। ব্রহ্মেতি পরমাত্মেতি ভগরানিতি শব্দতে। জল্পনা-কল্পনার পথ জ্ঞানের পথের মাধ্যমে কেউ নির্বিশেষ ব্রহ্মের অনুসন্ধানের মাধ্যমে শুরু করতে পারে। তারপর তার জ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে পরমাত্মার উপলব্ধি লাভ করতে পারে। সেটি হচ্ছে পরমাত্মা উপলব্ধির দ্বিতীয় ধাপ। অতএব, তুমি যদি শ্রীকৃষ্ণকে উপলব্ধি করতে না পার, তাহলে তোমার জ্ঞান অর্থহীন? আমরা চাই, পূর্ণ জ্ঞান এবং সেই পূর্ণ জ্ঞান লাভ করা সম্ভব ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপার দ্বারা, ভগবদ্গীতার মাধ্যমে ।
ভক্ত : পারমার্থিক মার্গে প্রবেশ করা এবং লক্ষ্য অর্জন করার জন্য একজন গুরু গ্রহণ কি অপরিহার্য? আর কাউকে কীভাবে নিজের গুরু বলে সনাক্ত করা যেতে পারে?
শ্রীল প্রভুপাদ : হ্যাঁ। একজন গুরু গ্রহণ প্রয়োজন । ভগবদ্গীতায় সেটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যখন শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন বন্ধুর মতো কথা বলছিলেন, সেখানে কোনো জ্ঞানের প্রসঙ্গ ছিল না। সেজন্য অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে গুরু হিসেবে গ্রহণ করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে গীতায় অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে বলছেন—
কার্পণ্যদোষোপহতস্বভাবঃ
পৃচ্ছামি ত্বাং ধর্মসম্মূঢ়চেতাঃ।
যচ্ছ্রেয়ঃ স্যান্নিশ্চিতং ব্রুহি তন্মে
শিষ্যস্তেহহং শাধি মাং ত্বাং প্ৰপন্নম্ ॥
“কার্পণ্যজনিত দুর্বলতার প্রভাবে আমি এখন কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়েছি এবং আমার কর্তব্য সম্বন্ধে বিভ্রান্ত হয়েছি। এই অবস্থায় আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি, এখন কি করা আমার পক্ষে শ্রেয়স্কর, তা আমাকে বল। এখন আমি তোমার শিষ্য এবং সর্বতোভাবে তোমার শরণাগত। দয়া করে তুমি আমাকে নির্দেশ দাও (ভগবদ্গীতা ২/৭)
কেবল অর্জুন নয়, প্রত্যেকেই তার কর্তব্যকর্ম সম্বন্ধে বিভ্রান্ত, বিমূঢ়, কেউই নিজে নিজে আপন করণীয় সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তিনি জানেন যে, যখন গুরুতর অসুস্থ হন, তিনি নিজের চিকিৎসা নিজে করেন না। তিনি জানেন যে, তার মস্তিষ্ক এখন সুস্থ নেই, সেজন্য তিনি আরেকজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। ঠিক সেরকম, যখন আমরা হতবুদ্ধি হই, বিমূঢ় হয়ে পড়ি, যখন আমরা কোনো সমাধানে পৌছাতে পারি না- সেইসময় যে যথার্থ ব্যক্তিটির অনুসন্ধান করা প্রয়োজন তিনি হচ্ছেন গুরু। এটি প্রয়োজনীয়; তুমি এটি এড়িয়ে যেতে পারনা।
অতএব, আমাদের অস্তিত্বের বর্তমান অবস্থায় আমরা সকলেই মোহগ্রস্থ। আর এই পরিস্থিতিতে, আমাদেরকে সঠিক পথনির্দেশ দানের জন্য একজন গুরুর প্রয়োজন। অর্জুন এখানে জড় জগতের একজন বিষয়াসক্ত মোহগ্রস্ত মানুষের প্রতিভু, যিনি একজন গুরুর শরণাগত হচ্ছেন। আর প্রকৃত দৃষ্টান্ত প্রদর্শনের জন্য অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে তাঁর গুরু রূপে বরণ করেন। তিনি অন্য কারো কাছে যাননি, সুতরাং প্রকৃত গুরু হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণ কেবল অর্জুনের গুরু নন, প্রত্যেকেরই গুরু। আমরা যদি শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ গ্রহণ করি এবং সেই উপদেশ মেনে চলি, আমাদের জীবন সার্থক হবে। কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রত্যেককে শ্রীকৃষ্ণকে গুরু হিসেবে গ্রহণ করতে উৎসাহিত করা সেটিই হচ্ছে আমাদের প্রচার ব্রত। আমরা এমন বলি না, “আমি কৃষ্ণ”। আমরা কখনই তা বলিনা। আমরা কেবল মানুষকে অনুরোধ করি, “অনুগ্রহ করে শ্রীকৃষ্ণের আদেশ মেনে চলুন।”
ভক্ত : বর্তমানে তথাকথিত গুরুদেবেরা শ্রীকৃষ্ণ যা বলেছেন তার কিছুটা তারা বলবে, আবার তারা তাদের নিজস্ব কিছু উপদেশও দেবে। এরকম ব্যক্তিদের স্থিতি কেমন? ৮৭,
শ্রীল প্রভুপাদ : তারাই সবচেয়ে বিপজ্জনক ও সুবিধাবাদি। কিন্তু তার মানসিকতা অনুসারে এরা কিছু শিক্ষা দিয়ে থাকে যাতে সে সন্তুষ্ট হয়। এরকম ব্যক্তি গুরু নয়, সে একজন সেবক। সে তার তথাকথিত এসব শিষ্যদের সেবা করতে চায় যাতে তারা সন্তুষ্ট হয় এবং তাকে কিছু দান করে। একজন প্রকৃত গুরু তার শিষ্যদের সেবক নয়; সে তাদের প্রভু। যদি কেউ তার শিষ্যের সেরক হয়, যদি সে শিষ্যদের অর্থ আত্মসাতের জন্য তোষামোদের দ্বারা তাদের পরিতুষ্ট করতে চায়, তবে সে গুরু নয়। হ্যাঁ, একজন গুরুও সেবক হবেন– কিন্তু তাঁর শিষ্যের রক্ষায় পরমেশ্বর ভগবানের সেবক। গুরু শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ‘ভারী’–তাঁর কর্তৃত্ব ও জ্ঞানের দ্বারা তিনি ভারী, কেননা তাঁর জ্ঞান ও কর্তৃত্বের অধিকার শ্রীকৃষ্ণ থেকে আসছে। তুমি তোমার নিজের খেয়াল চরিতার্থ করার জন্য গুরুকে ব্যবহার করতে পার না। শ্রীকৃষ্ণ বলেন, সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ; “সকল ধরনের ধর্ম পরিত্যাগ কর এবং আমার শরণাগত হও।” আর আমরা সেই একই কথা বলছি; কৃষ্ণের শরণাগত হও। তথাকথিত ধর্ম সংক্রান্ত সমস্ত ধারণা পরিত্যাগ কর। আমরা এমন বলিনা, “আমি সর্বময় কর্তা।” না। আমরা বলি, কৃষ্ণ হচ্ছেন সর্বময় কর্তা, প্রামাণিক কর্তৃপক্ষ, আর তোমার কর্তব্য হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করা।” এই হচ্ছে কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন।