জনসংখ্যা বিভ্রান্তি

প্রকাশ: ২২ মে ২০২১ | ১২:১৪ অপরাহ্ণ আপডেট: ২২ মে ২০২১ | ১২:১৫ অপরাহ্ণ

এই পোস্টটি 429 বার দেখা হয়েছে

জনসংখ্যা বিভ্রান্তি

একটি প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে পৃথিবী হুমকির সম্মুখিন। আসলেই কী তাই? শাস্ত্রমতে পৃথিবীতে ৪ লক্ষ প্রজাতির জীব রয়েছে, কিন্তু পৃথিবীর বর্তমান জনসংখ্যা তো তার চেয়েও বেশি। এর অর্থ কী? মহাভারতের যুদ্ধে এত লোক কীভাবে কুরুক্ষেত্রে জড়ো হল? এ সমস্ত নানা প্রশ্ন বা বিভ্রান্তি নিয়ে নিম্নের এই প্রতিবেদন।
প্রশ্নোত্তর সম্বলিত এ প্রতিবেদনটি তুলে ধরেছেন-

চৈতন্য চরণ দাস

মহাভারতের যুদ্ধে যত লোক মারা গিয়েছিল তা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যারও বেশি ছিল । এটি কী করে সম্ভব?

মহাভারতের একাদশ পর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, মহাভারত যুদ্ধে ১ বিলিয়নেরও বেশি যোদ্ধা নিহত হয়েছিল। ধৃতরাষ্ট্র ও যুধিষ্ঠির মহারাজের মধ্যকার এ কথোপকথনে এ পরিসংখ্যানটি উদ্ধৃত হয়। ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠির মহারাজকে জিজ্ঞেস করেন কত যোদ্ধা এ যুদ্ধে নিহত হয়? তখন যুধিষ্ঠির মহারাজ এ পরিসংখ্যানটি দেন। তবে যারা নিহত হয়েছিল তাদেরকে একটি শ্লোকে উদ্ধৃত করা হয় ‘বীরানাম’ হিসেবে, এই ‘বীরানাম’ শব্দটি মূলত যোদ্ধাকে বোঝায়। এর মানে এই নয় যে, যারা ঐ যুদ্ধে নিহত হয়েছিল সবাই মানুষ ছিল। এই পৃথিবীর জীব নয় এরকম জীবও ঐ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, যেটি আমরা মহাভারতে দেখতে পাই। উভয় পক্ষের সৈন্যদলের মধ্যেই এই প্রকার যোদ্ধা অংশগ্রহণ করেছিলেন। কৌরব পক্ষে লম্বুসা নামে রাক্ষস ছিল, যার ভাইকে ভীম হত্যা করেছিল। তাই লম্বুসা ভীমের বিপক্ষে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অপরদিকে পাণ্ডবদের পক্ষে ছিল ভীম পুত্র ঘটোৎকচ। এভাবে উভয় দলেই অসংখ্য রাক্ষস ছিল। ঐ যুদ্ধে শুধু একটি দেশ থেকে নয় পুরো পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ থেকে যোদ্ধারা অংশগ্রহণ করেছিল এবং শুধু মানুষ নয় বিভিন্ন প্রকারের বিচিত্র জীবও অংশগ্রহণ করেছিল। সেটি বিশাল যুদ্ধ ছিল যেটি বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও অনেক অনেক বড় ছিল ।
এক্ষেত্রে প্রশ্ন থাকতে পারে, কীভাবে বুঝব যে, তখন এত এত লোক ছিল। আসলে অধিক জনসংখ্যা উৎপাদন করা এবং তাদের জীবন ধারণে সহায়তা করার ক্ষমতা পৃথিবীর রয়েছে। যদি ভগবানের নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করা হয়, তবে পৃথিবী সবকিছুই সুন্দরভাবে সম্পাদন করে। পৃথিবী মাতা অনেক শস্য উৎপাদন করতে পারে এবং সেটি শুধু ক্ষত্রিয়দের জন্যে ছিল না সর্বসাধারণের জন্যেও পৃথিবী শস্য সরবরাহ করতেন৷ পৃথিবীতে তখন অনেক সম্পদে পরিপূর্ণ ছিল এবং জনসংখ্যাও অনেক ছিল। যেহেতু এটি বিশ্বযুদ্ধ ছিল তাই পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে সৈন্যরা যুদ্ধ করতে এসেছিল।
অতএব, মহাভারতের যুদ্ধে এত সৈন্য অংশগ্রহণ করাটা মোটেই অস্বাভাবিক নয় এবং তাদের সবাই শুধু মানুষই ছিল না, সেখানে রাক্ষসরাও অংশগ্রহণ করেছিল। কুরুক্ষেত্রের এই ছোট একটি স্থানে কিভাবে ৬৪ কোটি লোক লোক জড়ো হয়েছিল?
যে কুরুক্ষেত্র আজকে আমরা ভারতে দর্শন করি সেই কুরুক্ষেত্রে মহাভারতের সময় ভিন্ন ছিল। ভৌগলিকভাবে পূর্বের অনেক স্থান এখন বদলে গেছে। ৫০০০ বছর আগে যে কুরুক্ষেত্র ছিল তা ভৌগলিক বা রাজনৈতিক বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের কারণে পাল্টে গেছে। শাস্ত্রে প্রদত্ত কুরুক্ষেত্রের মানচিত্র অনুসারে এটি একসময় একটি বিশাল সমতল এলাকা ছিল। উদাহরণস্বরূপ মহাভারতের বর্ণানুসারে কৌরবদের সৈন্যদলের গঠন সম্পর্কে বলা হয়েছে, তাদের সমগ্র সৈন্যদলের প্রশস্ততার ব্যাপ্তি ২ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং ৪০ মাইল গভীর (Deep)। এর মাধ্যমে ঐ স্থানের প্রশস্ততা যে কত বিশাল ছিল তার একটি ধারণা পাওয়া যায়।

পৃথিবীতে ৪ লক্ষেরও বেশি মানুষ রয়েছে, অথচ শাস্ত্রে ৪ লক্ষ প্রজাতীর মানুষের কথা বলা হয়েছে। এটি কীভাবে সম্ভব?

এখানে ৪ লক্ষ প্রজাতির মানুষ বলতে বোঝানো হয়েছে চেতনা অনুসারে ৪ লক্ষ প্রকারের মানুষ। ৮৪ লক্ষ প্রজাতির জীব বলতে সেটি জৈবিক আকারে বোঝানো হয়েছে। পদ্ম পুরাণ মতে পারমার্থিক পুণর্জাগরণ অনুসারে জীব নিম্ন স্তর থেকে অবশেষে মনুষ্য দেহ লাভ করে মুক্তির সুযোগ লাভ করে। এভাবে ৪ লক্ষ প্রজাতির মানুষ বলতে এ মনুষ্য জীবের মধ্যে চেতনা অনুসারে ৪ লক্ষ প্রকারের মানুষকে বোঝানো হয়। এ কারণে দুইজন মানুষ শারীরিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিভাবে, একে অপরের থেকে ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু বাহ্যিকভাবে ভিন্নতা সত্ত্বেও তাদের চেতনার স্তর এক হতে পারে এবং এটি ঘটতে পারে একই শ্রেণি কিংবা একই প্রজাতির মধ্যেও। অপরদিকে দুইজন মানুষ হয়তো যমজ হতে পারে বা একই রকম দেখতে হতে পারে, কিন্তু তাদের চেতনার স্তর ভিন্ন হতে পারে। কেউ একজন খুব বিষয়ী আবার কেউ একজন পারমার্থিক ভাবধারা সম্পন্ন। জৈবিক ও বাহ্যিকভাবে তারা একই হলেও চেতনা ভিন্ন হতে পারে।
এই ৪ লক্ষ প্রজাতির মধ্যে এমন অনেক উচ্চস্তরের জীব রয়েছে যারা মানুষের মত চেতনাসম্পন্ন এবং আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে এখনও যারা অজানা। এদের মধ্যে রয়েছে কিন্নর, দেব দেবীরা ইত্যাদি যারা পৃথিবীর বাইরের কোনো লোকে অবস্থান করছেন। তারাও এ ৪ লক্ষ প্রজাতির মানুষের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত আছেন। অর্থাৎ মূলত যারা পারমার্থিক বিষয় সম্পর্ক উদ্ঘাটনে এবং পারমার্থিক জীবন অনুশীলনে সমর্থ সে সমস্ত চেতনা সম্পন্ন জীব এ ৪ লক্ষ প্রজাতির মধ্যে অন্তর্ভূক্ত।
অতএব, শাস্ত্রে চার লক্ষ প্রজাতির মানুষ বলতে এ সমগ্র পৃথিবীর জনসংখ্যাকে বোঝানো হয়নি, বরং চেতনা অনুসারে চার লক্ষ প্রকার মানুষকে বোঝানো হয়েছে যাদের মধ্যে পৃথিবীর বাইরের কিছু উচ্চ স্তরের জীবরাও রয়েছে।

কেন পৃথিবীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে? যেহেতু জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাই প্রাকৃতিক সম্পদের ওপরে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে; যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে দূষণ, বনায়ন ধ্বংস, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। তবে কেন কৃষ্ণ এ জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করবেন না?

প্রথমত, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাপারটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে খুব একটা দ্বন্দ্ব নয়। কেননা যদি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখি তবে কখন থেকে আদমশুমারী শুরু হয়েছিল তা ধোয়াশা রয়ে যায়। আসলে সঠিকভাবে আদমশুমারী প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে গত কয়েক’শ বছর ধরে। রোমান সাম্রাজ্যের সময় হয়তো এই আদমশুমারী ব্যাপারটি নিয়ে কিছুটা প্রচেষ্টা ছিল। কিন্তু এ নিয়েও বিতর্ক থেকে যায় যে আদৌ এ প্রক্রিয়াটি সেখানে ছিল কিনা কিংবা ঠিকভাবে জনসংখ্যার রেকর্ড করা হয়েছিল কিনা এবং সেখানে ঠিক কত লোক ছিল?
যদি এটি সত্যিও হয় যে, জনসংখ্যা গণনা প্রক্রিয়াটি শুধুমাত্র রোমান সাম্রাজ্যেই ছিল। তবে এর মাধ্যমে কীভাবে আমরা জানতে পারি যে, পৃথিবীতে ঠিক কী পরিমাণ জনসংখ্যা ছিল? সুতরাং জনসংখ্যা গণনা প্রক্রিয়াটি এমনকি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকেও অসচ্ছ ও অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। পাঁচ হাজার, আট হাজার কিংবা দশ হাজার বছর পূর্বে ঠিক কী পরিমাণ জনসংখ্যা ছিল? এই পরিসংখ্যান অজানা রয়েছে। তবে বৈদিক প্রেক্ষাপট থেকে এটুকু অবগত হওয়া যায় যে, অতীতের জনসংখ্যা বর্তমান জনসংখ্যার চেয়েও অধিক বেশি ছিল। কেননা তখন মানুষ প্রকৃতি ও ভগবানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ছন্দময় জীবন-যাপন করত। যার ফলে প্রকৃতি অফুরন্ত পরিমাণে সম্পদ সরবরাহ করত।
আজকে হয়তো আমরা বলতে পারি জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ঘটছে, তবে সেটি সত্য সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট থেকে। গত কয়েক শত বছর থেকে আজকের এ ধারণাটি সত্য। এক্ষেত্রে বলা বাহুল্য, হ্যাঁ, হয়তো জনসংখ্যা বাড়ছে তবে তার মানে এই নয় যে, এ বিশাল জনসংখ্যা ভরণ পোষণ করা প্রকৃতির পক্ষে অসম্ভব। প্রকৃতপক্ষে জনসংখ্যা বৃদ্ধিই সব সমস্যার কারণ নয় বরং জীবন নির্বাহের যথাযথ ধারাটি ঠিক না থাকা এবং গণতান্ত্রিক নকশা অযথাযথ হওয়াই হল সব সমস্যার কারণ।
আমাদের অধিকাংশ মানুষ শহর এলাকাগুলোতে বাস করে, যার ফলে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ঘটছে। কারণ আমাদের চোখের সামনেই তো জনবহুল এলাকা, জনবহুল রাস্তা-ঘাট ও ঘরবাড়ি। অথচ যখন ট্রেনে, বিমান বাসে করে যখন গ্রাম্য এলাকাগুলো ভ্রমণ করা হয় তখন দেখা যায় জনসংখ্যা তো ঠিক ততটা নয়। সেখানে অনেক বিস্তীর্ণ এলাকা দেখা যায় যেগুলো সভ্যতার উন্নতির জন্য ব্যবহার করা যায়। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। সভ্যতার উন্নতির জন্য যেখানে কিছুই করা হচ্ছে না, বাসস্থান গড়ে তোলার ব্যাপারটা আরো অনেক দূরের কথা।
এর কারণ আমাদের কৃত্রিম সামাজিক ব্যবস্থা বিভিন্ন উপায়ে কৃষি ব্যবস্থার প্রতি অনুৎসাহিত করে শিল্পায়নের দিকে ঝোক সৃষ্টি করে। এর ফলে মানুষ কৃষক হওয়ার পরিবর্তে কলকারখানাগুলোতে শ্রমিক হতেই গ্রাম থেকে শহরের দিকে ঝুঁকছে। অথচ পৃথিবীর যে ক্ষমতা রয়েছে তা দিয়ে বর্তমান জনসংখ্যার জীবিকাই নয়, এর চেয়ে অধিক জনসংখ্যা হলেও পৃথিবীর কোনো সমস্যা হবে না । প্রধান সমস্যা জনসংখ্যা নয়, যেটি পূর্বেই বলা হয়েছে। প্রধান সমস্যা হল জনগণ কিরূপ জীবন যাপন করছে। যেমন—যদি আমরা খাদ্য উৎপাদনের দিকে তাকাই তবে, যে পরিমাণ জমি রয়েছে তা আমরা শস্য উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করতে পারতাম। অথচ সেগুলো প্রায়ই ব্যবহৃত হচ্ছে প্রাণীদের জন্য বিশাল পরিমাণ চারণভূমি হিসেবে, যার অধিকাংশই বর্জ্য পদার্থ হিসেবে বের হয়ে যায় এবং বাকি যে যৎসামান্য থাকে তা হল তাদের মাংস, যেগুলো মানব জাতি খেয়ে থাকে।


পিথাগোরাস বলেছিলেন, যারা মৃত্যুতে ব্যাথার বীজ বপন করে, তারা আনন্দ ও জীবনের ফল পাকাতে পারে না। যতক্ষণ মানুষ কসাইখানায় প্রাণীদের হত্যা করবে, ততক্ষণ তারা যুদ্ধক্ষেত্রে হত্যা হবে। তাই মাঝে মাঝে এই প্রকার দুর্যোগ দেখা দিবে, সেক্ষেত্রে এটি ভাবা উচিত নয় যে, কৃষ্ণই এগুলো দিচ্ছে। কৃষ্ণ আমাদের কাছ থেকে এই গ্রহের প্রতি দায়িত্ববান হওয়ার আশা করে।


এমনকি এ সমস্ত জমিতে অনেক সময় শস্য উৎপাদন করা হলেও সেগুলো প্রধান ফসলের পরিবর্তে অর্থকরী ফসল ফলানো হয়। যেগুলোর মধ্যে রয়েছে বিশাল পরিমাণে চা, কফি, আখ (যেটি মদ তৈরীতে ব্যবহৃত হয়) ইত্যাদি। এক্ষেত্রে প্রায়ই যে কৃষকরা এ প্রকার শস্যগুলো ফলায় তারা ধান, গম ও শস্য উৎপাদনকারী কৃষকের চেয়েও বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারে।

অতএব, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, আবশ্যক পণ্যের প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারের প্রতি প্রকৃতপক্ষে অনুৎসাহিত করা হচ্ছে। এমনকি যদি আমরা পরিবেশ দূষণের কথাই বলি সেটি প্রধানত শহরের মাধ্যমেই হচ্ছে। এর কারণ অতিরিক্ত ঘনবসতি, শিল্পায়নের প্রভাব, যার ফলে নদীগুলো দূষিত হচ্ছে। অথচ এর প্রধান সমস্যা জনসংখ্যা বৃদ্ধি নয়, প্রধান সমস্যা হল অযথাযথ জীবন ধারা।
ইসকন গবেষক মাইকেল ক্রেমো ও মুকুন্দ গোস্বামী কর্তৃক রচিত ডিভাইন নেচার গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক গবেষণা ও আরো অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে যে, যদি পুরো বিশ্বই নিরামিষ জীবন ধারায় অভ্যস্ত হয়, তবে পৃথিবীর যে সম্পদ বিদ্যমান আছে তা যথাযথ পন্থায় ব্যবহারের ফলে জনসংখ্যার চেয়েও আরো অধিক জনসংখ্যার জীবিকা নির্বাহ করা যাবে। প্রায় ৪০ বছর আগে শ্রীল প্রভুপাদ আফ্রিকার মরিশাসে ভ্রমণকালে বলেছিলেন, কেন এই কৃষকরা শস্য উৎপাদনের পরিবর্তে অর্থকরী ফসল ফলাচ্ছে। এই নয় যে প্রকৃতি পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করতে পারে না। আমাদের উচিত প্রকৃতির সম্পদকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কথা বিবেচনা করলে, আমাদের এটি আশা করা উচিত নয় যে, কৃষ্ণ বিশ্ব ব্যবস্থাপনায় প্রত্যক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করবে। নির্দিষ্ট সময়ে বা পদ্ধতিগতভাবে কৃষ্ণ হয়তো হস্তক্ষেপ করতে পারেন।
কৃষ্ণ দ্বাপর যুগের শেষের দিকে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি আজ থেকে ৫০০ বছর পূর্বে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু রূপেও আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং পুনরায় তিনি এই যুগের শেষ দিকে কল্কি অবতার রূপে আবির্ভূত হবেন। তখন ভগবদ্ বিমুখ আসুরিক জনসংখ্যা পৃথিবী থেকে উৎপাটন হবে এবং সদগুণাবলী সম্পন্ন জনসংখ্যা সৃষ্টি হবে। কিন্তু সেটি হবে ৪,২৭,০০০ বছর পরে।
স্বাভাবিকভাবে বললে, কৃষ্ণ এই বিশ্বকে অঢেল সম্পদ দান করেছেন এবং তিনি শাস্ত্রীয় জ্ঞানও প্রদান করেছেন। এরপর তিনি যেটি প্রত্যাশা করেন তা হল, সেই শাস্ত্রীয় জ্ঞানকে ব্যবহার করা এবং আমাদের ভগবদ্ প্রদত্ত বুদ্ধির যথাযথ প্রয়োগ করা যাতে সবকিছু সুন্দরভাবে ব্যবস্থাপনা হয়। অবশ্যই তিনি শ্রীল প্রভুপাদের মত তার প্রিয় ভক্তদেরও প্রেরণ করেন আমাদের তত্ত্বাবধানের জন্য। অতএব, এ সমস্ত কিছু যথাযথভাবে ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে যখন কোনো দুর্যোগ আসে তখন এটি মনে করা উচিত নয় যে, কৃষ্ণই এগুলো প্রত্যক্ষভাবে করাচ্ছে, বরং ভাবতে হবে যে, মানব জাতির কর্মফলস্বরূপ এগুলো ঘটছে।
আমরা অনেক বিশাল বিশাল যুদ্ধ দেখেছি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখেছি। তদ্রুপ এখন রয়েছে সন্ত্রাসবাদ, যার ফলে অনেক লোক হত্যা করা হচ্ছে। কিন্তু মূল বিষয়টি হল, যখন আমরা ভগবানের সন্তানদের, প্রাণীদের হত্যার ব্যাপারে উৎসাহ জোগাই, তখন প্রকৃতি তার প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে এবং মানুষ নিহত হয়।
পিথাগোরাস বলেছিলেন, যারা মৃত্যুতে ব্যাথার বীজ বপন করে, তারা আনন্দ ও জীবনের ফল পাকাতে পারে না। যতক্ষণ মানুষ কসাইখানায় প্রাণীদের হত্যা করবে, ততক্ষণ তারা যুদ্ধক্ষেত্রে হত্যা হবে। তাই মাঝে মাঝে এই প্রকার দুর্যোগ দেখা দিবে, সেক্ষেত্রে এটি ভাবা উচিত নয় যে, কৃষ্ণই এগুলো দিচ্ছে। কৃষ্ণ আমাদের কাছ থেকে এই গ্রহের প্রতি দায়িত্ববান হওয়ার প্রত্যাশা করে। কেননা তিনি আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা প্রদান করেছেন এবং এর যথাযথ প্রয়োগও তিনি প্রত্যাশা করেন। বৈদিক শাস্ত্রানুসারে

ঈশাবাস্যমিদং সর্বং যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ ধনম্ ॥১

এই বিশ্বচরাচরে যা কিছু আছে তার মালিক পরমেশ্বর ভগবান এবং তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন। তাই জীবন ধারনের জন্য তিনি যেটুকু বরাদ্দ করে দিয়েছেন, সেটুকুই গ্রহণ করা উচিত এবং সব কিছুই যে ভগবানের সম্পত্তি তা ভালভাবে জেনে, কখনই অন্যের জিনিস গ্রহণ করা উচিত নয়।
কিংবা শান্তির সূত্র

ভোক্তারং যজ্ঞতপসাং সর্বলোক মহেশ্বরম্।
সুহৃদং সর্বভূতানাং জ্ঞাত্বা মাং শান্তিমৃচ্ছতি ॥

অনুবাদ : আমাকে সমস্ত যজ্ঞ ও তপস্যার পরম ভোক্তা, সর্বলোকের মহেশ্বর এবং সমস্ত জীবের সুহৃদরূপে জেনে যোগীরা জড় জগতে দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্ত হয়ে শান্তি লাভ করেন। যদি আমরা এগুলো শিখতে পারি, তবে মানবজাতি এই পৃথিবীর সম্পদগুলোর সদ্ব্যবহার করতে পারবে এবং এক্ষেত্রে জনসংখ্যা বৃদ্ধি বা কম এটি মুখ্য বিষয় নয়।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি কী পুনর্জনা বিশ্বাসকে বিভ্রান্ত করছে না? যেহেতু আত্মা নিত্য এবং নতুন কোনো আত্মা সৃষ্টি হয় না, তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি
কীভাবে সম্ভব?

এ যুক্তিটি দুটি অনুমিত ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত।
(১) শুধু মানুষেরই আত্মা রয়েছে
(২) সমস্ত আত্মা শুধু এ পৃথিবীতেই অবস্থান করে।
বিজ্ঞান বা শাস্ত্রীয় প্রেক্ষাপট থেকে হোক না কেন, এই অনুমিত ধারণা অযৌক্তিক। বিজ্ঞান যেহেতু পারমার্থিক রাজ্যে প্রবেশ করেনি, তাই বিজ্ঞান এই ধারণা প্রমাণ করতে পারে না কিংবা অস্বীকার করে। এবার শাস্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে বললে, শুধু মানুষ নয় প্রাণীদেরও আত্মা আছে এবং শুধু এই পৃথিবীতেই নয়, পৃথিবীর বাইরে বিভিন্ন লোকেও আত্মার অস্তিত্ব রয়েছে।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আত্মার অনেক গতিশীল পথ রয়েছে : কিছু আত্মা কিছুটা মানুষের মত চেতনাসম্পন্ন, কিছু মনুষ্য প্রজাতির এবং তাদের বিচরণ এই পৃথিবীতেই, কিছু উচ্চমানব প্রজাতির যারা পৃথিবীর বাইরে দিব্যলোকে থাকেন। আত্মার এই গতিশীলতার কারণ হল কর্ম : খারাপ কর্ম আত্মাকে নিম্নদিকে গতিশীল করে, মধ্যম স্তরের একপ্রকার কর্ম কোনো দিকে গতিশীল করে না এবং খুব ভাল কর্ম আত্মাকে মুক্ত করে।
যেহেতু অনেক লোকই আজকাল মধ্যম স্তরের কর্মে নিয়োজিত, তাই তাদের হয়তো মনুষ্য স্তরেই পুনর্জন্ম হচ্ছে। কিছুটা মনুষ্য চেতনাসম্পন্ন জীব প্রকৃতির নিয়মে কালাবর্তে মনুষ্য শরীর লাভ করে, যার কারণে হয়তো জনসংখ্যা বিস্ফোরণ সাধিত হচ্ছে। এমনকি যদি আমরা এই ধারণাটি গ্রহণ করি যে, কিছু আত্মা নিম্ন প্রজাতিতে বা লোকে গমন করছে, তবুও এর মাধ্যমে বিশাল সংখ্যক অন্য আত্মাদের অন্য কোনো লোক থেকে এই পৃথিবীতে আসার ব্যাপারটি রোধ করা যায় না।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি একটি মহাজাগতিক পরিকল্পনা হতে পারে, যার মাধ্যমে আমরা কর্মফল প্রাপ্ত হচ্ছি। বর্তমানে লোকেরা খারাপ কর্মে আনন্দিত হয় এবং নিজেদের স্বার্থের জন্য পৃথিবীর সম্পদকে অপব্যবহার করছে। যার ফলে কর্মের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ পৃথিবী তার সম্পদ বা উপহারসমূহ তুলে নিয়ে বিশ্বসম্পদে দুরবস্থা সৃষ্টি করছে। কর্মের এরকম প্রতিক্রিয়া হল সাম্প্রতিক জনসংখ্যা বিস্ফোরণ : জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অপরদিকে প্রাকৃতিক সম্পদ ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে।

অভাবের কারণ অতিরিক্ত জনসংখ্যা নয় বরং অব্যবস্থাপনা

সারা পৃথিবী জুড়ে যথেষ্ট পরিমাণে শস্য উৎপাদন হচ্ছে। তাই পশুহত্যার জন্য কসাইখানা খোলা কখনও সমর্থন করা যেতে পারে না। কোনো কোনো রাষ্ট্রে এত অতিরিক্ত শস্য উৎপাদন হয় যে, তা সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয় এবং কখনও কখনও সরকার অতিরিক্ত শস্য উৎপাদনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। অর্থাৎ জনসাধারণের আহারের জন্য পৃথিবী পর্যাপ্ত পরিমাণে শস্য উৎপাদন করে, কিন্তু বাণিজ্য সংক্রান্ত বাধ্যবাধকতা এবং লাভের আশায় সেই শস্য বিতরণ ব্যাহত হয়। ফলে কোনো কোনো স্থানে খাদ্যের অভাব হয় এবং অন্য কোনো স্থানে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন হয়। সারা পৃথিবী জুড়ে যদি একটি সরকার থাকে, তা হলে খাদ্যশস্য বিতরণ ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা যেতে পারে, এবং তার ফলে অভাবের কোনো প্রশ্নই উঠবে না, এবং জনসংখ্যার বৃদ্ধির মিথ্যা প্রচারের কোনো প্রয়োজন থাকবে না। (শ্রীমদ্ভাগবত ৪/১৭/২৫ তাৎপর্য)


চৈতন্য চরণ দাস রাধানাথ স্বামী মহারাজের একজন শিষ্য। তিনি ইলেক্ট্রনিক ও টেলিকমিউনিকেশনের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করেছেন এবং পুনে মন্দিরে ব্রহ্মচারীরূপে শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। তিনি এই পর্যন্ত আটটি গ্রন্থ লিখেছেন।


 

ত্রৈমাসিক ব্যাক টু গডহেড, জানুয়ারী – মার্চ ২০১৪

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।