এই পোস্টটি 1022 বার দেখা হয়েছে
গোল পূরণে গোলের খেলা বিশ্বকাপ ফুটবল
রাঘব কীর্তন দাস: রাত তখন ২.০০ টা। সমগ্র ঘরে তখন পিনপতন নিরবতা। এক কক্ষে বাবা-মা এবং অন্য কক্ষে ঘরের একমাত্র সন্তান ‘ভাস্কর’ ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ ভাস্করের কক্ষ থেকে চিৎকার শোনা গেল, “কেউ বাঁধতে পারবে না মেসিকে……. যাও …..যাও…..কাট…..কাট….গোল।” বিকট শব্দ শুনে বাবা মা ভাস্করের কক্ষে এসে দেখে সে বিছানায় নেই। ভাস্কর কোথায়? গোল গোল চিৎকার করে বিছানা থেকে পড়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে ভাস্কর। এই ধরণের কোটি ভাস্কর ও তার মা-বাবারা এখন বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮ জ্বরে উন্মত্ত। গোলের খেলা ফুটবলের এই টান টান উত্তেজনার উন্মত্ততা থেকে চলুন আমরা আমাদের গোল (Goal- লক্ষ্য) সমূহ পূরণে কিছু শিক্ষা গ্রহণ করি:
১. পরিকল্পনা:- দিনটি ছিল ৪ বছর আগে ২০১৪ সালের ২৮ অক্টোবর মস্কোর আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে মহাকাশচারীদের হাতে উন্মোচিত হয় রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮ এর লোগো। সেদিন থেকে শুরু হয় ৪ বছর পরের বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮ এর সর্ববৃহৎ পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার হাত ধরেই বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮ এর পর্দা উঠে ১৪ই জুন বাংলাদেশ সময় রাত ৯ টায়। নিঃখুত আয়োজন এবং জমকালো সাজসজ্জার মধ্য দিয়ে পর্দা নামবে মস্কোতে ১৫ জুলাই বাংলাদেশ সময় রাত ১১ টায়। এই সমগ্র আয়োজনে সাফল্যের মূলসুত্র হচ্ছে যথার্থ পরিকল্পনা। সেই সাথে যেসব দল তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে এগিয়ে যাচ্ছে তাদেরও গোপন শক্তি হচ্ছে কোচ, ক্যাপটেন এবং দলের সকলের সম্মিলিত পরিকল্পনা।
আমাদের জীবনেও সাফল্য লাভের মূল চাবিকাঠি হচ্ছে যথার্থ পরিকল্পনা এবং সেই অনুযায়ী কার্যসম্পাদন। তাই প্রবাদ আছে “যে পরিকল্পনা করতে ব্যর্থ হয় সে ব্যর্থ হবারই পরিকল্পনা করে।” আমরা বেশীর ভাগ সময়েই দ্বিধাগ্রস্থ থাকি,“ আমি এখন কি করব, আগামী কাল কি করব, পুরোসপ্তাহে, মাসে বা বছরে কি করব।” কারণ আমাদের কোন যথার্থ পরিকল্পনা থাকে না। তাই আব্রাহাম লিঙ্কন বলতেন, “যদি একটি গাছ কাটতে আমাকে ৬ ঘণ্টা সময় দাও, তাহলে প্রথম ৪ ঘণ্টা আমি কুড়ালে শান দিব।” এভাবে আব্রাহাম লিঙ্কন আমাদের জীবনে পরিকল্পনার গুরুত্ব বোঝাচ্ছেন যা কুড়ালে শান দেয়ার শামিল। এখানে একটি ভাববার বিষয় হচ্ছে আমরা ১ বছর, ১০ বছর বা সর্বোচ্চ ৬০-৬৫ বছরের পরিকল্পনা করতে পারি। কিন্তু তারপর? আমরা হয়তোবা পরিকল্পনা অনুযায়ী বিশ্বকাপ জয় করলাম, গোল্ড মেডেল পেলাম, পরীক্ষায় গোল্ডেন A+পেলাম বা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-বিসিএস ক্যাডার-ব্যাংকার প্রভৃতি হলাম। কিন্তু অদ্ভুত মৃত্যু এসে সবকিছু কেড়ে নিবে। মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য আমাদের কি পরিকল্পনা রয়েছে? ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভগবদ্গীতায় (১৬/১৩-১৩) বলেছেন, “অসুরস্বভাবের ব্যক্তিরা মনে করে- ‘আজ আমার দ্বারা এত লাভ হয়েছে এবং আমার পরিকল্পনা অনুসারে আরও লাভ হবে। এখন আমার এত ধন আছে এবং ভবিষ্যতে আরও ধন লাভ হবে। ঐ শত্রু আমার দ্বারা নিহত হয়েছে এবং অন্যান্য শত্রুদের ও আমি হত্যা করব। আমিই ঈশ্বর’ আমিই ভোক্তা। আমিই সিদ্ধ, বলবান ও সুখী। আমি সবচেয়ে ধনবান এবং অভিজাত আত্মীয়স্বজন পরিবৃত। আমার মতো আর কেউ নেই। আমি যজ্ঞ অনুষ্ঠান করব, দান করব এবং আনন্দ করব।” এভাবেই অসুরস্বভাব ব্যক্তিরা অজ্ঞানের দ্বারা বিমোহিত হয়। নানা প্রকার দুশ্চিন্তায় বিভ্রান্ত হয়ে এবং মোহজালে বিজড়িত হয়ে কামভোগ আসক্ত চিত্ত সেই ব্যক্তিরা অশুচি নরকে পতিত হয়।” সুতরাং আমাদের জীবনে এমনভাবে পরিকল্পনা এবং তদানুযায়ী কাজ করা উচিত যাতে আমরা জাগতিক লক্ষ্যসমূহ অর্জন করতে পারি এবং সাথে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবারুপ আধ্যাত্মিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে দেহাবসানে ভগবদ্ধামে প্রবেশ করতে পারি।
২.নিয়মশৃঙ্খলা অনুসরণ:-FIFA Governance Regulations ২০১৬ সহ অর্ধশতাধিক আইন অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮। সবকিছু ঠিকমত চললে আইনের ভূমিকা হয়ত আমরা ভুলে যায় কিন্তু যখনই কেউ ব্যতিক্রম করে তখনই আমরা দেখতে পাই আইনের শক্তি কতটুকু। মাঠেও খেলার সময় কোন খেলোয়ার আচরণ বিধি লঙ্ঘন করলে প্রথমে তাকে হলুদ কার্ড এবং পরবর্তীতে লাল কার্ডের মাধ্যমে বহিস্কার করা হয়। খেলোয়ারদের বার বা মদ্যালয়ে যাওয়া নিষেধ, এমনকি তাদের খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে ঘুমানো পর্যন্ত সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত থাকে। অনেকে প্রশড়ব করতে পারে, “এত নিয়মকানুন বা নিয়ন্ত্রনের কি দরকার?” কিন্তু এই নিয়ন্ত্রন বা নিয়মশৃঙ্খলা অনুসরণের ফলেই কেবল সবকিছু নিখুঁতভাবে সম্পাদিত হচ্ছে।একইভাবে আমাদের জীবনকেও ছন্দবদ্ধ করতে হলে প্রয়োজন শাস্ত্ররূপী আইন। দেশের আইন বা সংবিধান প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয় যেমন গত ৪৮ বছরে বাংলাদেশের সংবিধান ১৬ বার পরিবর্তিত হয়েছে। একটি সরকার যা সর্বসম্মতিক্রমে সংসদে পাশ করাচ্ছে, তা অন্য সরকার এসে ভুল বলে ঘোষণা করছে এবং নতুন আইন তৈরী করছে। কিন্তু ভগবানের আইন অভ্রান্ত, এর কোন পরিবর্তন নেই। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভগবদ্গীতায় (১৬/২৪) বলেছেন,
তস্মাৎ-শাস্ত্রং প্রমাণং তে কার্য-অকার্য-ব্যবস্থিতে․।
জ্ঞাত্বা শাস্ত্র-বিধান-উক্তং কর্ম কর্তুম-ইহ-অর্হসি।।
অতএব কর্তব্য ও অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই তোমার প্রমাণ। তাই শাস্ত্রীয় বিধানে কথিত হয়েছে যে কর্ম, তা জেনে তুমি সেই কর্ম করতে যোগ্য হও।” ভগবান আমাদের জন্য দুঃখনিবৃত্তির অব্যর্থ সূত্র প্রদান করেছেন কালজয়ী শাস্ত্র ভগবদ্গীতায় (৬/১৭)
যুক্ত-আহার-বিহারস্য যুক্ত-চেষ্টস্য কর্মসু।
যুক্ত-স্বপড়বারবোধস্য যোগো ভবতি দুঃখহা।।
“যাঁর আহার, নিদ্রা, বিনোদন এবং প্রয়াসের অভ্যাস নিয়ন্ত্রিত তিনি যোগ-অভ্যাসের দ্বারা সমস্ত জড়জাগতিক দুঃখের নিবৃত্তি সাধন করতে পারেন।” আহার: নিয়ন্ত্রিত আহার মানে জীবন ধারণের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই কেবল গ্রহণ করা। সক্রেটিস বলেন, Worthless People Live only to eat and drink; People of worth eat and drink only to live” তাই জিহ্বার লালসা মেটানোর জন্য পশুহত্যা করা অনুচিত বরং শাক-সব্জি, শস্যদানা, ডাল প্রভৃতি নিরামিষ খাবার ভগবানকে নিবেদন করেই গ্রহণ করা উচিত। নিদ্রা: ৬ ঘণ্টার বেশী ঘুমানো কারো পক্ষেই উচিত নয়। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে যে ৬ ঘণ্টার বেশী ঘুমায়, সে অবধারিতভাবে তমগুণের দ্বারা আচ্ছনড়ব, সে স্বভাবতই অলস এবং অত্যাধিক নিদ্রাতুর। তাই অধিক রাতজেগে নিশাচর প্রাণী হওয়ার চেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমানো উচিত এবং সূর্যোদয়ের পূর্বেই শয্যাত্যাগ করে ভগবানের আরাধনা দিয়ে দিন শুরু করা উচিত। আসলে এই প্রতিজ্ঞা আমাদের ছোটবেলা থেকে ছিল, “সূয্যি মামা উঠার আগে উঠব আমি জেগে।” কিন্তু শহুরে সভ্যতার করাল গ্রাসে আমরা এই সুন্দর অভ্যাসটি হারিয়েছি। তাই প্রকৃতি বাধ্য হয়ে ডায়াবেটিস সহ বিভিনড়ব রোগ প্রদান করে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতে এবং দে․ড়াতে আমাদেরকে বাধ্য করছে। খনার বচন আছে, “সকাল সকাল ঘুমায় যারা, সকাল সকাল উঠে। তার কড়ি ‣বদ্য না লুটে।” অর্থাৎ যেসব ব্যক্তি রাত্রে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যায় এবং সকাল বেলা দ্রুত শয্যা ত্যাগ করে তারা অসুস্থ হয় না। ফলে ‣বদ্য বা ডাক্তাররা তাদের কড়ি বা টাকা লুটতে পারে ন্ া। বিনোদন: এমন বিনোদনে আমাদের অংশগ্রহণ করা উচিত যা আমাদের চেতনাকে উনড়বত করবে। যেমন:- তীর্থস্থান ভ্রমণ, কীর্তন, নৃত্য প্রভৃতি। অন্যদিকে অশ্লীল চলচিত্র, জুয়া, তাস, অবৈধ স্ত্রীসঙ্গ, ডিস্কো-ড্যান্স প্রভৃতি আমাদের চেতনাকে কলুষিত করে। পরিণামে নিয়ে আসে অসীম দুঃখ। প্রয়াস: অতিরিক্ত ব্যাংক ব্যালেন্স তৈরী, ইন্দ্রিয় তৃপ্তি, নতুন মডেলের মোবাইল-গাড়ি-ল্যাপটপক্রয় করার জন্য মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম করা উচিত নয় বরং সরল জীবনযাপন করে ভগবানের আরাধনায় বেশী সময় নিয়োগ করা উচিত।
৩.সময়ানুবর্তিতা: ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে আর্জেন্টিনা ও জার্মানীর চরম প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ ম্যাচের কথা সবার নিশ্চয়ই মনে আছে। ৯০ মিনিটের খেলা গোলশূন্য শেষ হল। অতিরিক্ত ৩০ মিনিট বরাদ্দ হল তাও প্রায় শেষের দিকে। ২৩ মিনিটের মাথায় জার্মানীর মারিয়া গোটেজের অতর্কিত হামলা এবং একমাত্র গোল করে বিশ্বকাপ ছিনিয়ে নেয়ার ইতিহাস সবারই জানা। খেলার মাঠে প্রত্যেকটা মুহূর্তে সর্বোচ্চটা দিয়ে খেলতে হয়, না হলে যে কোন সময় ঘটতে পারে দুঃর্ঘটনা।
খেলার মাঠের সময়ের মত আমাদের জীবনের পরিধিও সীমাবদ্ধ। ফুটবলের মাঠে হয়ত অতিরিক্ত সময় বরাদ্দ হতে পারে কিন্তু আমাদের জীবনের সময় একমুহূর্ত ও অতিরিক্ত নেয়া সম্ভব নয়। তাই এমনভাবে প্রতিটা মুহূর্তকে ব্যবহার করা উচিত যাতে আমাদের ক্সদহিক এবং আত্মিক কর্তব্য সম্পাদিত হয়।দৈহিক কর্তব্য হচ্ছে এই দেহ এবং দেহের সাথে সম্পর্কিত আত্মীয় স্বজনদের ভরণপোষণের জন্য শিক্ষাগ্রহণ, পরিশ্রম এবং অর্থ উপার্জন। দেহ ক্ষণস্থায়ী (বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭০ বছর) হওয়ার কারণে দৈহিক কর্তব্যও ক্ষণস্থায়ী। অন্যদিকে আত্মিক কর্তব্য হচ্ছে, নিজেকে প্রথমে আত্মা হিসেবে জানা এবং আত্মার উৎস পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানা এবং তার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা। আত্মা নিত্য হওয়ায় আত্মিক কর্তব্যও নিত্য। শ্রীমদ্ভাগবতে (২/৩/১৭) তাই আয়ু বা সময়ের সদ্ব্যবহার নিয়ে বলছেন:
আয়ুঃ-হরতি বৈ পুংসাম-উদ্যন-অস্তম-চ যন্-অসে․।
তস্য-ঋতে যৎ ক্ষণে নীত উত্তম-শ্লোক-বার্তায়া।।
“সূর্যদেব প্রতিদিন উদিত ও অস্তগত হয়ে সকলের আয়ু হরণ করেন, কিন্তু যাঁরা সর্ব মঙ্গলময় পরমেশ্বর ভগবানের কথা আলোচনা করে তাঁদের সময়ের সদ্ব্যবহার করেন, তাদেরই আয়ু কেবল তিনি হরণ করেন না”। এখানে প্রশড়ব আসতে পারে ‘যারা ভগবানের ভজনা করছেন তারাও মারা যায় তাহলে তাদের আয়ু কিভাবে হরণ হচ্ছেনা?’ যারা ভগবানের কথা আলোচনা করে, তারা জানতে পারে যে তারা এই দেহ নয় বরং আত্মা। আত্মার কোন জন্ম বা মৃত্যু নেই। একারণেই ভগবদ্ভক্তদের আয়ু সূর্য্যদেব হরণ করতে পারেন না।
৪. বিশ্বভাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা:- ১২ মার্চ ২০১৫-১৫ নভেম্বর ২০১৭ অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮ বাছাই পর্ব। ২ বছর ৮ মাস ৩ দিন ব্যাপী এ বাছাইপর্বে ৬ টি অঞ্চলে ফিফার ২১০টি সদস্য দেশ বিশ্বকাপের চূড়ান্ত স্থান পাওয়ার জন্য লড়াই করে। অবশেষে ৩২টি দেশ বিশ্বকাপে খেলার সে․ভাগ্য অর্জন করে। বাকি ১৭৮ টি সহ অন্যান্য দেশগুলো কি খেলার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে? কখনোই না। সমগ্র বিশ্বের মানুষের মিলন-মেলা এখন রাশিয়া ফুটবল স্টেডিয়ামগুলো। সাদা-কালো-লাল-বাদামী প্রভৃতি রঙের মানুষগুলো এখন একসাথে আনন্দে খেলা দেখছে। ফুটবলপ্রেমীদের কাছে এটিই বিশ্বভ্রাতৃত্বের সর্বোচ্চ নিদর্শন বা জাতিসংঘ।
ইথিওপিয়ায় একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, “যখন মাকড়াসারা ঐক্যবদ্ধ হয় তখন তারা একটি সিংহকেও বাঁধতে পারে।” এগিয়ে যাওয়ার জন্য ঐক্য আবশ্যক। খেলার মাঠে সবার মধ্যে আপাত দৃষ্টিতে ঐক্য বা বিশ্বভাতৃত্বে দেখা গেলেও প্রত্যেক দেশের মানুষ আলাদা আলাদা গণ্ডিতে থাকে। তাই প্রায়শই ঝগড়া, কথা কাটাকাটি প্রভৃতি এমনকি সহিংসতাও দেখা যায়। ইসকন প্রতিষ্ঠাতা আচার্য অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী শ্রীল প্রভুপাদ প্রায়শঃ বলতেন, Universal Brotherhood is impossible without universal অর্থাৎ বিশ্বের একক পিতা ভগবানকে স্বীকার করা ছাড়া বিশ্বভাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাই ভগবদ্গীতায় ১৫/৭ বলেছেন, “এই জড় জগতে বদ্ধ জীবসমূহ আমার সনাতন বিভিনড়বাংশ। জড়া প্রকৃতির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ফলে তারা মনসহ ছয়টি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রকৃতিরূপ ক্ষেত্রে কঠোর সংগ্রাম করছে। এভাবে আমরা যদি ভগবানকে আমাদের পরমপিতারূপে গ্রহণ করি তাহলে সবাই আমাদের ভাই। ফলে ভগবানের নির্দেশ পালনের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্বভাতৃত্ব , ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। যার প্রমাণ শ্রীধাম মায়াপুর যেখানে আফ্রিকান, ইউরোপিয়ান, এশিয়ান, প্রভৃতি মহাদেশের লোকেরা একত্রে নৃত্য-কীর্তন সহযোগে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করছে।
৫. ঐক্য:-এমন একটি ফুটবল দলের কথা চিন্তা করুন যেখানে প্রত্যেক খেলোয়াড় অন্যকে পাস না দিয়ে কেবল একাই গোল করতে চায়। এই ধরনের মনোভাব থাকলে পরাজয় সুনিশ্চিত। বিপরীতভাবে প্রত্যেক খেলোয়াড় নিজে গোল করে সুনাম কুড়ানের মানসিকতা বাদ দিয়ে দলের স্বার্থে অন্যকে বল পাস দেয় এবং চরমে দল পেঁছে যায় সর্বোচ্চ শিখরে। বিশ্বকাপ ফুটবল থেকে আমাদের উচিত ব্যক্তিস্বার্থ বাদ দিয়ে গোষ্ঠীর লক্ষ্য পূরণে সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করার শিক্ষা নেয়া।
Team work makes the dream work অর্থাৎ দলগত প্রয়াসের দ্বারা অকল্পনীয় কার্য সম্পাদিত হয় যা এককব্যক্তি কখনো চিন্তাও করতে পারে না। ফুটবল কিংবদন্তী পেলেও বলেছেন, No individual can win a game by himself অর্থাৎ দলগত প্রয়াস ছাড়া কেউ একা খেলা জেতাতে পরে না। তাই একজন ব্যক্তির ১ হাজার পদক্ষেপের চেয়ে ১০০০ জন ব্যক্তির একটি পদক্ষেপ শ্রেয়।
কিন্তু সমস্যা একটিই এত সুন্দর কথার বুলি আওড়ালেও নিজস্ব স্বার্থ বাদ দিয়ে একসাথে কাজ করাটা বাস্তব জীবনে প্রায় অসম্ভব। কেন? প্রত্যেকেরই নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ, চাওয়া-পাওয়া, স্বতন্ত্র মানসিকতা রয়েছে যা বাদ দিয়ে একসাথে কাজ করাটা কেবল আকাশ কুসুমই। খ্রিষ্টধর্মের ওল্ড টেস্টামেন্ট একটি সুন্দর সূত্র প্রদান করা হয়েছে, “যে পরিবারের সদস্যরা একসাথে ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করে , তারা একসাথে থাকতে পারে; একসাথে ভগবানের গুণকীর্তন করে, একসাথে এগিয়ে যেতে পারে।” তাই কোন পরিবারে বা গোষ্ঠিতে বা সমাজে যদি সত্যিই দলগত প্রয়াস সৃষ্টি করতে চায় তাহলে তার প্রাথমিক পদক্ষেপ হওয়া উচিত ভগবানকে প্রত্যেকের জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা এবং এর ফলে একই কেন্দ্রবিন্দু থেকে ভিনড়ব ভিনড়ব ব্যাসার্ধে বৃত্ত অঙ্কন করলেও কখনো একে অপরকে ছেদ করবে না। মহারাজ প্রাচীনবর্হিষতের ১০ জন রাজপুত্র একসাথে ভগবানের আরাধনা করায় ভগবান স্বয়ং সন্তুষ্ট হয়ে আবির্ভূত হন ও বলেন,
শ্রীভগবান উবাচ
বরং বৃণীধ্বং ভদ্রং বো যূয়ং মে নৃপনন্দনাং।
সে․হার্দেন-অপৃথক-ধর্মা-তুষ্টঃ-অহং সে․হৃদেন বঃ।।
(শ্রী.ভা. ৪/৩০/৮) পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে রাজপুত্রগণ। আমি তোমাদের পরস্পরের সে․হার্দ্য দর্শন করে অত্যন্ত প্রসনড়ব হয়েছি। তোমরা সকলেই একই ধর্ম-ভগবদ্ভক্তিতে নিযুক্ত। তোমাদের সে․হার্দ্য দর্শন করে আমি এত প্রসন্ন হয়েছি যে, আমি তোমাদের সর্বাঙ্গীন কল্যাণ কামনা করি। এখন তোমরা আমার কাছে বর প্রার্থনা কর।(শ্রীমদ্ভাগবাত ৪/৩০/৮)
এ বিষয়ে একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত প্রদান করা যায় যেম, যদিও ফুটবলে মধ্য মাঠের খেলোয়াড়রা বা স্ট্রাইকাররা সমস্ত মহিমা ও সবচেয়ে বেশি অর্থ আয় করে তবুও দলের মধ্যে একটি ঐক্য প্রদর্শিত হয় তার এই গোলের মাধ্যমে যারা খেলেনি সেসব খেলোয়ার সহ সমস্ত কোচিং স্টাফ ও দলটির ভক্ত বা ফ্যান সমানভাবে আনন্দ-উল্লাস করে। তারা সেই গোল করা খেলোয়াড়ের প্রতি সামান্যতম ঈর্ষা প্রদর্শন করলেও করতে পারে কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনও ঈর্ষাই প্রদর্শন করে না অবশ্য আমরা জানি প্রভুপাদ প্রায়ই বলতেন যে, এই ব্যাপারটি প্রসারিত দেহাত্মবুদ্ধির পরিচয় যা ইন্দ্রিয়তৃপ্তি জাত এবং বিকৃত মহিমা তবুও তাদের মধ্যে যে ঐক্য রয়েছে তা অনুপ্রেরণাদায়ক। আমরা প্রতিনিয়ত এই ঈর্ষার মত অনেক অনর্থের মুখোমুখি হই। আমরা প্রায়শই অনেক অর্জনের মহিমা প্রকাশ করতে ইতস্তত বোধ করি কিংবা রীতিমত সংগ্রাম করি সমস্তরের ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে অন্যের অর্জন আমাদের ঈর্ষান্বিত করে তোলে। তারা কিন্তু খেলতে নামার পূর্বে ৬৪ মালা জপ করে ঈর্ষাশূণ্য হয়েছে তা বলা চলে না, তবুও তারা দলের মহিমা প্রকাশের জন্য অর্থাৎ বৃহত্তর স্বার্থের জন্য তাদের ঈর্ষাকে দূরে রাখতে সমর্থ হয়, আমরা আমাদের প্রাত্যাহিক দলগত কার্যে এই মনোভাব পোষন করলে কিংবা অন্যের মহিমা কীর্ত্তন করলে অনেক ক্ষেত্রেই সুফল পেতে পারি।
৬.অনুশীলন:বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক খেলোয়াড়ই শৈশব জীবন থেকেই ফুটবল চর্চা শুরু করেছে। এমন নয় যে জীবনের ২০ বছর পার হওয়ার পর হঠাৎ করে ইচ্ছা করেছে আর জাতীয় দলে খেলার চান্স পেয়েছে। এটা স্বপ্নেও মানুষ চিন্তা করে না। ক্সশশবই হচ্ছে শেখার সর্বোত্তম সময়, আর দিন যত বয়ে যাবে নতুন কিছু গ্রহণ করার ধৈর্য্যও শক্তি কমে আসবে। তাই ইংরেজীতে প্রবাদ আছে, You can’t teach an old dog a new triat অর্থাৎ একটি বৃদ্ধ কুকুরকে আপনি নতুন কোন মুদ্রা শেখাতে পারেন না।
সাধারণ খেলায় জয়ী হওয়ার জন্য মানুষকে যদি এত পরিশ্রম করতে হয় এবং ছোট বয়স থেকে অনুশীলন শুরু করতে হয় তবে মৃত্যুর করাল থেকে উত্তীর্ণ হয়ে ভগবানকে জয় করার জন্য আমাদের কি ধরনের অনুশীলন করা উচিত এবং কত ছোট বয়স থেকে শুরু করা উচিত? প্রহলাদ মহারাজ একারণেই বলছেন,
কে․মার আচরেৎ প্রাজ্ঞো ধর্মান ভাগবতানিহ।
দুর্লভং মানুষং জন্ম তদ-অপি-অধ্রুবম-অর্থদম।।
প্রাজ্ঞ ব্যক্তি মানব জন্ম লাভ করে জীবনের শুরু থেকেই অর্থাৎ বাল্যকাল থেকেই অন্য সমস্ত প্রয়াস ত্যাগ করে ভাগবত ধর্ম অনুষ্ঠান করবেন। মানবজন্ম অত্যন্ত দুর্লভ এবং অন্যান্য শরীরের মতো অনিত্য হলেও তা অত্যন্ত অর্থপূর্ণ, কারণ মানব জীবনে ভগবানের সেবা সম্পাদন করা সম্ভব। নিষ্ঠাপূর্বক কিঞ্চিৎ মাত্র ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন করলেও মানুষ পূর্ণসিদ্ধি লাভ করতে পারে।” (শ্রীবদ্ভাগবত ৭/৬/১)
অবশেষে বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮তে আমাদের ভগবানের সেবায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হওয়ার শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। এর প্রভাবে আমরা বিশ্বকাপ ফুটবলের ৬.১৭৫ কেজি ওজনের গোল্ডকাপের মত দুর্লভ মানুষ্যজীবনে ভগবদ্ভক্তির ডায়ম- বা হীরা বসাতে পারব। চিন্তা করুন গোল্ডকাপের উপর হীরা বসালে কতই না আকর্ষণীয় লাগবে! তেমনি মনুষ্যজীবনে ভগবদ্ভক্তি অনুশীলন করলে নিশ্চয়ই সমস্ত জগৎ আকর্ষিত হবে এবং তাতে জগতের পরম কল্যাণ সাধিত হবে। হরেকৃষ্ণ!
প্রতিবেদনের ভিডিও লিংক দেখতে ভিজিট করুন: Youtube.com/caitanyasandesh
লেকখ পরিচিতি: রাঘব কীর্তন দাস বি.বি.এ, এম.বি.এ. (চ.বি.) ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি অফিসার, প্রিমিয়ার ব্যাংক। তিনি চট্টগ্রাম ইস্কন ইয়ুথ ফোরামের সাথে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের সেবায় যুক্ত। বিশেষত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচার করছেন।
(মাসিক চৈতন্য সন্দেশ জুলাই ২০১৮ সালে প্রকাশিত)