এই পোস্টটি 489 বার দেখা হয়েছে
ভগবান তাদেরই সাহায্য করেন, যাঁরা নিজেদের সাহায্য করেন
ড. প্রেমাঞ্জন দাস
শৃণ্বতঃ শ্রদ্ধয়া নিত্যং গৃণতশ্চ স্বচেষ্টিতম্।
কালেন নাতিদীর্ঘেণ ভগবান্ বিশতে হৃদি ॥
(শ্রীমদ্ভাগবত ২/৮/৪)
“যাঁরা নিয়মিত শ্রদ্ধাপূর্বক শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ করেন, তাঁদের হৃদয়ে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অচিরেই প্রকাশিত হন।”
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে- God helps those who help themselves অর্থাৎ ভগবান তাদেরই সাহায্য করেন, যাঁরা নিজেদের সাহায্য করেন। শ্রীমদ্ভাগবতেও এটি স্বীকৃত হয়েছে। নিয়মিত শ্রদ্ধা সহকারে ভগবানের কথা শুধু শ্রবণ করাই যথেষ্ট নয়, গৃণতশ্চ স্বচেষ্টিতম্। নিজের চেষ্টায় তা জীবনে গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ আমাদেরকে নিজেদের সঠিক এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে সাহায্য করতে হবে। তাহলেই আমাদের সমস্ত সমস্যার সমাধান হবে।
এই একই সিদ্ধান্ত ভগবান গীতার (৬/৫) নং শ্লোকে বলেছেন-
“মানুষের কর্তব্য তার মনের দ্বারা নিজেকে জড় জগতের বন্ধন থেকে উদ্ধার করা, মনের দ্বারা আত্মাকে অধঃপতিত করা কখনই উচিত নয়। মনই জীবের অবস্থা ভেদে বন্ধু ও শক্র হয়ে থাকে।”
মনকে এই প্রশিক্ষণ কে দেবে? আত্মা। অর্থাৎ আমাদের নিজেদেরকে নিজেই সাহায্য করতে হবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আরও গীতায় (৭/১৪) শ্লোকে বলেছেন-
দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া।মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে ॥
“আমার এই দৈবী মায়া ত্রিগুণাত্মিকা এবং তা দুরতিক্রমণীয়া। কিন্তু যাঁরা আমাতে প্রপত্তি করেন, তাঁরাই উত্তীর্ণ হতে পারেন।”
এখানে ‘প্রপদ্যন্তে’ কথাটির মাধ্যমে ভগবান একই কথা বুঝিয়েছেন। ‘প্র’ মানে ‘প্রকৃষ্টরূপে’। অর্থাৎ প্রকৃষ্টরূপে নিয়মিত কৃষ্ণকথা শ্রবণ। সদ্গুরুর নির্দেশ পালন ও কৃষ্ণের উপদেশকে নিজের আচরণের মধ্যে গ্রহণ করতে হবে – স্ব চেষ্টায়-গৃণতশ্চ স্বচেষ্টিতম্।
শ্রীল সচ্চিদানন্দ ভক্তিবিনোদ ঠাকুর বলেছেন-
নিজ বল চেষ্টা প্রতি ভরসা ছাড়িয়া।
তোমার কৃপায় আছি নির্ভর করিয়া ॥
অনেকে এই কথাগুলির অপব্যঅখ্যা করে বলেন, নিজের চেষ্টার কোনো মূল্য নেই। পুরুষভাব নয়, শুধু কৃপা হি কেবলম্। তাহলে- God helps those who help themselves যারা নিজেদের সাহায্য করেন, ভগবান তাদেরই সাহায্য করেন-এই কথাগুলি কি মিথ্যা?
শ্রীল সচ্চিদানন্দ ভক্তিবিনোদ ঠাকুর বলেননি, ‘নিজ বল চেষ্টা আদি সকলি ছাড়িয়া…’ স্বচেষ্টা ছাড়তে বলেন নি। শুধু বলেছেন, অহঙ্কার ছাড়তে। অর্জুন তুমি নিমিত্তমাত্র যুদ্ধ কর, বাকি কাজ আমিই করব। তুমি ভেবো না, তুমি নিজের চেষ্টায় যুদ্ধে জয় লাভ করবে। কিন্তু যুদ্ধ করতে হবে আন্তরিকভাবে। স্বচেষ্টা যতক্ষণ আন্তরিক না হচ্ছে, কৃষ্ণের সাহায্য ততক্ষণ কার্যকর হয় না।
শ্রীল প্রভুপাদ চড়াই পাখীর কাহিনি বলে এই সিদ্ধান্তকে আরও সুষ্পষ্ট করেছেন। চড়াই পাখী সমুদ্রের কিনারে ডিম পেড়েছিল। সমুদ্র জলের ধাক্কায় ডিমগুলি তলিয়ে যায়। চড়াইপাখী ক্রুদ্ধ হয়ে তার ঠোঁটে করে সমুদ্রের জল শুকাবার চেষ্টা শুরু করল। এই হলো চড়াইপাখীর স্ব চেষ্টিতম্। তা দেখে গরুড় পাখির কৃপা হলো। অর্থাৎ পুরুষকার বা স্বচেষ্টা থেকে বৃহতের কৃপা বর্ষিত হলো। গরুড় এসে সমুদ্রকে হুমকি দিতেই সমুদ্রদেব স্বয়ং এসে ডিমগুলি ফেরৎ দিয়ে গেলেন।
বানর দর্শন বৈষ্ণব দর্শন নয়। বৈষ্ণব দর্শন হচ্ছে কূপে নিক্ষিপ্ত রজ্জু দর্শন। বানর দর্শন অনুসারে, শুধু স্বচেষ্টায় সবকিছু। বানর শাবক স্বচেষ্টায় মায়ের বুকে আঁকড়ে ধরে। বুক থেকে দৈবাৎ পড়ে গেলে মা তাকে অযোগ্য বলে পরিত্যাগ করে। পুরুষকার সর্বস্ব দর্শন বৈষ্ণব দর্শন নয়। বিড়াল শাবকের কোনও স্বচেষ্টা নেই। সবটুকুই মাতৃকৃপা। মা তাকে ঘাড়ে কামড় দিয়ে স্থান থেকে স্থানান্তরে বহন করে। সবটাই কৃপা। পুরুষভাব এখানে শূন্য। এটি বৈষ্ণব দর্শন নয়। বৈষ্ণব সিদ্ধান্ত হচ্ছে- একটি লোক যদি কূয়োতে পড়ে যায়, তার কাছে
শক্ত দড়ি ফেলতে হবে। এবার কূয়োতে পড়ে যাওয়া ব্যক্তিকে স্বচেষ্টায় তার পুরুষকার প্রয়োগ করে দড়িটাকে শক্ত করে ধরতে হবে। তারপর উপর থেকে কৃপার আকর্ষণ হবে। আমি লক্ষ প্রকার নিম্ন প্রজাতি সেই কৃপা রজ্জুকে ধরতে পারে না। কিন্তু চার লক্ষ প্রকার মনুষ্য জাতির এইটুকু শক্তি ভগবান দিয়েছেন, তারা স্বচেষ্টায় পুরুষকার প্রয়োগ করে সেই কৃপা রজ্জুকে শক্ত করে ধরতে পারবে। যারা আত্মপ্রতারণা করে স্বচেষ্টা এবং পুরুষভাব প্রয়োগ করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা প্রয়োগ করবেন না, পশুর মতো তারাও সেই কৃপা রজ্জুর আকর্ষণ থেকে বঞ্চিত হবেন।
লেখক পরিচিতি: শ্রীমৎ স্বরূপ দামোদর স্বামী ড. প্রেমাঞ্জন দাসের দীক্ষাগুরু আর শিক্ষাগুরু শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী। তিনি শিক্ষার্থী অবস্থায় ‘পুনরাগমন’ গ্রন্থ ১ম অধ্যায় অধ্যয়ন করেই ইস্কনের ভক্ত হয়ে যান।
সূত্র: ব্যাক টু গডহেড ( এপ্রিল – জুন) ২০২০ সালে প্রকাশিত।
মাসিক চৈতন্য সন্দেশ ও ব্যাক টু গডহেড এর ।। গ্রাহক ও এজেন্ট হতে পারেন
প্রয়োজনে : 01820-133161, 01758-878816, 01838-144699