এই পোস্টটি 438 বার দেখা হয়েছে
স্বাস্থ্যের গোপন রহস্য !
প্রহ্লাদানন্দ স্বামী: স্বাস্থ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রহস্যটি কি? শ্রীল প্রভুপাদ সেই রহস্যটি উন্মোচন করেছেন। শ্রীমদ্ভাগবত ১/১/১০ এর তাৎপর্যে, “কলিযুগের মানুষদের আয়ু অল্প হওয়ার কারণ খাদ্যাভাব নয়, তার কারণ হচ্ছে অনিয়ম এবং অনাচার। সুনিয়ন্ত্রিতভাবে জীবন যাপন করলে, সাদাসিধে খাদ্য আহার করলে যে কোনও মানুষ সুস্থ ও সরলভাবে জীবনধারণ করতে পারে। অত্যাচার, অত্যধিক ইন্দ্রিয়তৃপ্তি, অন্যের করুণার উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা এবং কৃত্রিমভাবে জীবনের মান উন্নত করার চেষ্টা মানুষের জীবনী-শক্তি শোষণ করে নেয়। তাই তাদের আয়ু কমে যায়।
আয়ুর্বেদে ভগ্ন স্বাস্থ্যের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে মানসিক উদ্বিগ্নতাকে। মানসিক চাপের কারণে নানাবিধ পরিবর্তন দেখা দেয় যেমন – শরীরের তাপমাত্রার পরিবর্তন। যখন জাগতিক জীবনে মানুষের মানসিক চাপ অত্যধিক হয় তখন শরীরের শক্তি (দোষহ) সমূহ ভারসাম্যহীন হয়। এর কারণে শরীরের ভারসাম্য প্রবণ স্থিতির বিনাশ ঘটে।
এর ফলশ্রুতিতে রোগ-ব্যাধির উৎপত্তি ঘটে। কেউ যদি তার জীবনযাত্রায় রুটিন মেনে চলে সঠিক সময়ে সঠিক কার্য করে, তাহলে মানসিক চাপ কমে যায়। এর ফলে সে স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠে।
আমাদের জীবনে নিয়মানুবর্তিতা অনুশীলন করার জন্য প্রাত্যহিক এবং ঋতুভেদে আয়ুর্বেদ কিছু দিক নির্দেশনা প্রদান করেছে। সংক্ষিপ্ত আকারে সেগুলো হলো:
১. যেকোনো কাজের প্রস্তুতি পূর্বের রাত্রিতে করে নেয়া
২. সূর্যোদয়ের পূর্বে জাগরণ
৩. প্রাতঃ কার্য সমাপন যাতে শরীর খালি হয় এবং নতুন সজীবতা দেহে প্রবেশ করতে পারে।
৪. হাত, পা, মুখ-মণ্ডল, মুখ, চোখ এবং নাক (সমস্ত ইন্দ্রিয় সমূহ) ধৌত করা যাতে আমাদের ইন্দ্রিয় সমূহ পবিত্র হয় এবং আমরা সঠিকভাবে ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহকে গ্রহণ করতে পারি (স্নান)।
৫. শ্রী বিগ্রহের ধ্যান
৬. শরীরে হালকা ম্যাসেজ, শরীর চর্চা
৭. প্রাতঃরাশ,
৮. নিদ্রা
একটি সুস্বাস্থ্যবান সকাল নির্ভর করছে পূর্ব রাত্রির উপর, একটি ভাল নিদ্রার ওপর। একটি যথার্থ নিদ্রায় রয়েছে নানা উপকারিতা। যেমন এটি আমাদের শরীরের সকল শক্তি সমূহের মধ্যকার ভারসাম্য বজায় রাখে। নিদ্রার মাধ্যমে আমাদের সকল ইন্দ্রিয়সমূহ এবং মন সম্পূর্ণ বিশ্রাম লাভ করে। ঠিক যেমন খাদ্য; কার্বোহাইড্রেড, মিনারেল এবং শরীর থেকে নির্গত প্রয়োজনীয় উপাদান সমূহ পুনঃগঠনে সহায়তা করে। ঠিক তেমনি নিদ্রা আমাদের মানসিক ভারসাম্য পুনঃগঠন করে এবং আমাদেরকে সজীবতা প্রদান করে, মনে উদ্দীপনা প্রদান করে। গভীর নিদ্রা হলো একটি স্বাভাবিক ধ্যানের পন্থা।
নিদ্রা শুধুমাত্র আমাদের শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে তা নয়। এটি আমাদের বীর্য (বীর্য হলো এমন শক্তি যা শরীরকে কাম, দৃঢ়তা এবং বুদ্ধিমত্তা প্রদান করে) গঠনে সহায়তা করে। একজনের কাজের ধরনের ওপর নির্ভর করে নিদ্রার সময়কাল। একজন শ্রমজীবি ব্যক্তির, একজন চাকুরীজীবির চাইতে অধিক নিদ্রা প্রয়োজন। একটি সাধারণ নিয়মানুসারে মানুষের নিদ্রা বয়সের সাথে কমতে থাকে। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা অনুসারে ৬/১৬ তাৎপর্য অনুসারে “যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত আহার করে, সে ঘুমন্ত অবস্থায় নানা রকম স্বপ্ন দেখে এবং তার ফলে সে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঘুমায়। ৬ ঘণ্টার বেশি ঘুমানো কারও পক্ষেই উচিত নয়। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে যে ছয় ঘন্টার বেশি ঘুমায় সে অবধারিতভাবে তমোগুণের দ্বারা প্রভাবিত। যে মানুষ তমোগুণের দ্বারা আচ্ছন্ন, সে স্বভাবতই অলস এবং অত্যধিক নিদ্রাতুর। সেই মানুষ যোগ অনুশীলন করতে পারে না।”
অন্যত্র শ্রীল প্রভুপাদ ব্যাখ্যা করেছেন, নিদ্রার সময়কাল মানুষ ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু আমাদের উচিত নিদ্রার সময়কাল কমানোর চেষ্টা করা। “একইভাবে, নিদ্রাও। তোমার কিছুটা বিশ্রাম প্রয়োজন কিন্তু তাই বলে ২৬ ঘন্টা নিদ্রা যেওনা। সর্বমোট ৬ ঘন্টা থেকে ৮ ঘন্টা – একজন সুস্বাস্থ্যবান ব্যক্তির পক্ষে যথেষ্ট। এমনকি ডাক্তারও বলেছেন, ‘যদি কেউ ৮ ঘন্টার অধিক নিদ্রা যায় তবে সে অবশ্যই রোগাক্রান্ত হবে। সে অবশ্যই দুর্বল হবে।’ একজন স্বাস্থ্যবান মানুষ সর্বোচ্চ ৬ ঘন্টা নিদ্রা যায়। এটাই পর্যাপ্ত। ঠিক যেমন গোস্বামীগণ করেছিলেন। তারা শুধুমাত্র দেড় ঘন্টা অথবা সর্বোচ্চ দুই ঘন্টা নিদ্ৰা যেতেন।
(শ্রীমদ্ভাগবত ১/৫/৩৫, বৃন্দাবন ১৬ আগস্ট ১৯৭৪ প্রবচন ) অতিরিক্ত নিদ্রা যাপন করা মানসিক ভারসাম্য বিনষ্ট করে এবং শারীরিক সমস্যা যেমন বদহজম, অতিরিক্ত দুর্বলতা ও অসংলগ্ন হাড়ের সমস্যা সৃষ্টি করে। যার প্রচণ্ড গলার সমস্যা, যাকে সর্প দংশন করেছে অথবা যিনি বিষ পান করেছিলেন, তিনিই শুধুমাত্র একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুসারে অতিরিক্ত নিদ্রা যেতে পারে। অনিয়মিত নিদ্রার সময়কাল বিভিন্ন সমস্যার উদ্রেক করতে পারে। যেমন সাইনাসের প্রদাহ, মাথা ব্যাথা, খাবারে রুচিহীনতা এবং এমনকি জ্বরেরও কারণ হতে পারে। কারো দিনের বেলায় নিদ্রা যাপন করা উচিত নয়, কিন্তু গ্রীষ্মের দিনে একটি ক্ষুদ্র সময়কালীন বিশ্রাম গ্রহণযোগ্য। অপর্যাপ্ত নিদ্রার কারণে বিভিন্ন লক্ষণ যেমন শারীরিক ব্যাথ্যা, মাথা ভার হওয়া, দুর্বলতা, বদহজম ও তন্দ্রাচ্ছন্নতা দেখা দেয় এবং অতিরিক্ত নিদ্রার কারণে বাতুলতা দেখা দেয়। আয়ুর্বেদের একজন কর্তৃপক্ষ ভগভট্ট বলেন, “যিনি ব্রহ্মচর্য পালন করেন, যিনি উত্তেজিত হন না এবং আত্ম তুষ্ট, তিনি সঠিক সময়ে স্বাভাবিক নিদ্ৰা লাভ করেন।”
যারা অনিদ্রায় ভুগছেন তাদের জন্য কিছু আয়ুর্বেদিক দিক নির্দেশনা হলো:
১. অনিদ্রা দূর করতে হলে নিয়মিতভাবে খাদ্য গ্রহণ, নিদ্রাযাপন, কর্ম এবং চিত্ত বিনোদনের অভ্যাস গঠন করতে হবে। প্রতিদিন রাত্রিতে একটি নির্দিষ্ট সময়ে নিদ্রা যেতে হবে এবং প্রতিদিন ভোরে একটি নির্দিষ্ট সময়ে নিদ্রা ত্যাগ করতে হবে।
২. মাথা এবং ঘাড়ের পেছনের অংশ এবং পায়ের পাতার নিচের অংশকে তিলের তেল দ্বারা (গ্রীষ্মকালে) এবং সরিষা তেল দ্বারা (শীতকালে) ম্যাসেজ করা এটি ভাল নিদ্রা
যাপনে সহায়তা করে।
৩. একটি উষ্ণ স্নান গ্রহণ।
৪. এক কাপ উষ্ণ দুধ, সেই সাথে আধা চামচ ঘি মিশ্রন করে পান করা নিয়মিত।
৫. দুই কৰ্ণে ১/২ ফোটা তেল দেওয়া।
৬. পরমেশ্বর ভগবান এবং তার বিভিন্ন লীলাসমূহ ধ্যান বা মনন একটি শান্তিপূর্ণ নিদ্রা যাপনে সহায়তা করে।
৭. শারীরিক পরিশ্রম নিদ্রা যাপনে সহায়ক আমাদের মানসিক উদ্বিগ্নতা, চাপ এবং বিষণ্নতা – যার ফলে নিদ্রাহীনতা হয় তা নিয়মিত শরীর চর্চায় নিবারিত করে। যখন আমাদের মস্তিষ্ক শান্ত তাকে তখন আপনা থেকে নিদ্রা চলে আসে।
জাগরণ
সূর্যোদয়ের পূর্বে নিদ্রা ত্যাগ করার বহু উপকারিতা রয়েছে যেমন এতে আমাদের শরীরের ওপর সূর্যের নানাবিধ প্রভাবের সামঞ্জস্য বিধান করতে পারে। রাত্রির শেষান্তে শরীরে ভত্তের প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং এটির হালকা প্রভাবে নিশ্চিত নিদ্রা লাভ হয়। যেহেতু শরীরের বর্জ্য নিষ্কাশনে ভত্তের প্রভাব রয়েছে তাই আমাদের উচিত সূর্যোদয়ের পূর্বেই শরীরের বর্জ্য নিষ্কাশন করা।
শরীরের হজমনালী খালি করণ
একটি অগ্নিকুণ্ডে অনেক ভালভাবে আগুন তখনই জ্বলে যখন পূর্বের ছাইগুলো পরিষ্কার করা হয় ঠিক তেমনি আমাদের খাদ্য তখনই ভালভাবে হজম হয় যখন আমরা পূর্বেই দেহের সকল বর্জ্য নিষ্কাশন করি ।
স্নান ও পরিচ্ছন্নতা
চর্ম হলো আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিষ্কাশন অঙ্গ। অন্যগুলো হলো কিডনী এবং অস্ত্র। যেহেতু স্বাভাবিক অবস্থায় কিডনী এবং অস্ত্র সঠিকভাবে কাজ করে থাকে সেহেতু যদি চর্ম স্বাভাবিকভাবে শরীরের বর্জ্য নিষ্কাশন করে তবে শরীর সুস্থ থাকবে। নিয়মিতভাবে স্নান করা এবং পরিচ্ছন্ন থাকা এই পন্থাকে ফলপ্রসূ করে।
শ্রীবিগ্রহের ধ্যান
শরীর যেমন পবিত্র করতে হয় ঠিক তেমনি মনও পবিত্র করতে হয়। একটি বিখ্যাত আয়ুর্বেদিক গ্রন্থ চরক সংহিতা অনুসারে পরমেশ্বর ভগবানের নাম জপ হল মনকে পবিত্র করার সর্বোত্তম পন্থা।
হালকা ম্যাসেজ এবং শরীর চর্চা
আমাদের দেহে রয়েছে বিভিন্ন রন্ধ্র যাকে বলা হয় শ্রোত। যখন এই রন্ধ্রসমূহ পরিষ্কার ও উন্মুক্ত অবস্থায় থাকে তখন তারা শরীরের প্রতিটি কোষে পুষ্ঠি উপাদান ছড়িয়ে দিতে পারে এবং সকল বর্জ্য পদার্থ সংগ্রহ করতে পারে। শরীর চর্চা এবং শরীরে হালকা ম্যাসেজ আমাদের সেই রন্ধ্রগুলোকে উন্মুক্ত ও পরিচ্ছন্ন করে। শরীর চর্চা সঠিক উপায়ে করলে আমাদের শরীর ও মনে প্রাণবায়ু বৃদ্ধি পায়। শরীর চর্চা ইন্দ্রিয়সমূহের প্রাণ সঞ্চার করে, হজম শক্তি বৃদ্ধি করে এবং মানুষের আচরণে প্রভাব বিস্তার করে।
প্রাতঃরাশ
এখন উপরোক্ত নিয়মসমূহ সঠিক উপায়ে পালনের মাধ্যমে আমাদের দেহের বাহ্যিক এবং আভ্যন্তরীন পরিচ্ছন্নতা লাভের পর এবং জঠাগ্নি জাগরিত হলে মানুষ নিত্য কর্ম হিসেবে শক্তি লাভের জন্য খাবার গ্রহণ করতে পারে। আমাদের উচিত গ্রীষ্মকালীন দিনগুলোতে হালকা খাবার এবং শীতকালীন দিনগুলিতে ভারী খাবার গ্রহণ করা।
উপরিউক্ত সাধারণ রুটিন মানুষকে রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে এবং আমাদের শরীরে শক্তির প্রবাহ এতই উচ্চ স্তরে রাখে যে, আমরা ভক্তিমূলক সেবাসমূহ স্বতস্ফূর্তভাবে করার শারীরিক ও মানসিক সহায়তা পেতে পারি।
মাসিক চৈতন্য সন্দেশ ডিসেম্বর ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ