এই পোস্টটি 103 বার দেখা হয়েছে
আয়ুর্বেদ মতে, এই দেহটি হচ্ছে বায়ু, পিত্ত, কফ এই তিনটি ধাতুর সংমিশ্রণ। আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, এই দেহটি রক্ত, মাংস, হাড়, মল, মূত্র ইত্যাদি দ্বারা গঠিত। এখন আপনি যদি দেহকে বিশ্লেষণ করেন তাহলে দেখতে পারবেন যে, এইগুলি হচ্ছে তাদের উপাদান। কিন্তু যে অজ্ঞ, সেই কেবল এই সমস্ত উপাদানসমূহে আত্মবুদ্ধি করে। তাই পারমার্থিক জীবনের প্রথমে অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে যে, আমি এই রক্ত, মাংস, মূত্র ইত্যাদি দেহের অন্যান্য উপাদানসমূহ নই। আমি এই সমস্ত কিছু থেকে ভিন্ন। আমি হচ্ছি চিন্ময় আত্মা, পরমেশ্বর ভগবানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেটিই হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞান। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে ছাত্রদের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে এই প্রকৃত জ্ঞানটি অনুপস্থিত। তাই সকলেই দেহকে আত্মজ্ঞান করছে এবং দেহগত সম্পর্কে সমস্ত কিছুকে ‘আমার’ জ্ঞান করছে। শাস্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে- স্বধীঃ কলত্রাদিযু ভৌম ইজ্যধীঃ ইত্যাদি। অর্থাৎ নির্বোধ মানুষেরা তাদের স্ত্রী এবং অন্যান্য স্বজনবর্গকে নিজের বলে মনে করে এবং জন্মভূমিকে আরাধ্য বলে মনে করে।”
এই মুহূর্তে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী প্রত্যেকেই নিজের দেহটিকে আত্মবুদ্ধি বা ‘আমি’ মনে করছে এবং যে স্থানে তার দেহটি জন্ম হয়েছে, সেই স্থানটির আরাধনা করছে। তার দেহের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের তার আত্মীয় বলে ভাবছে। কিন্তু যারা এরকম ভাবছে, শাস্ত্রানুযায়ী তারা হচ্ছে গরু বা গাধার মতো। তাই বৈদিক শাস্ত্রমতে বর্তমান সমাজটি হচ্ছে গরু বা গাধার মতো। অন্যভাবে, এটি হচ্ছে পাশবিক সভ্যতা। পশু সমাজে কেউই সুখী হতে পারে না। জঙ্গলে সব সময়ই বাঁচার সংগ্রাম চলছে। একটি পশু আরেকটি পশুর সঙ্গে মারামারি করছে। তবুও, মনুষ্য সমাজের চেয়ে তুলনামূলকভাবে জঙ্গল অনেক শান্তিপূর্ণ। বর্তমানে সারা বিশ্বজুড়ে আমরা পশুর চেয়েও অধম হয়ে গেছি। কেননা মানুষ জানে না, সে কে? তার জীবনের চরম উদ্দেশ্যটি কি? মানুষেরা এগুলি জানে না। এই অজ্ঞতা দুরীভূত করার জন্য ভগবদ্গীতায় অর্জুন কৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ কি? জ্ঞান কি? এবং জ্ঞেয় কি?”
শ্রীকৃষ্ণ সর্বপ্রথমে উত্তর দিলেন যে এই দেহটি হচ্ছে আমাদের ‘ক্ষেত্র।’ চুরাশি লক্ষ প্রকারের বিভিন্ন দেহ রয়েছে এবং আমাদের ইচ্ছানুযায়ী প্রকৃতি তা সরবরাহ করছে। এই সমস্ত দেহগুলি প্রকৃতি কিভাবে সরবরাহ করছে? শ্রীকৃষ্ণ সেকথা ভগবদ্গীতার (৪/১০) আরেক স্থানে বর্ণনা করেছেন- “ময়াধ্যক্ষেণ প্রকৃতিঃ সূয়তে সচরাচরম্- “আমার তত্ত্বাবধানে প্রকৃতি সমস্ত স্থাবর ও জঙ্গমরূপ জীবাত্মার দেহ উৎপাদন করে।”
পরমেশ্বর ভগবান প্রত্যেকের হৃদয়েই অবস্থান করছেন- ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রত্যেকের ভিতরে ও বাহিরে অবস্থান করছেন। তাঁকে দর্শন করার জন্য কেবলমাত্র আমাদের চক্ষুকে- যথার্থ চোখে পরিণত করা উচিত। শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করা অসম্ভব নয়। তাঁকে দর্শন করা যেতে পারে। কিন্তু কেবলমাত্র যার তাঁকে দেখার মতো যথার্থ চোখ রয়েছে, সেই তাঁকে দেখতে পারে। যেমন ব্রহ্মসংহিতায় (৫/৩৮) বলা হয়েছে-
প্রেমাঞ্জনচ্ছুরিত ভক্তিবিলোচনেন সন্তঃ
সদৈব হৃদয়েষু বিলোকয়ন্তি
যং শ্যামসুন্দরমচিন্ত্যগুণস্বরূপম্।।
অর্থাৎ “কৃষ্ণভাবনায় উন্নীত ভগবৎ প্রেমে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিগণ পরমেশ্বর ভগবান শ্যামসুন্দর শ্রীকৃষ্ণকে তাঁদের হৃদয়ে অবলোকন করেন।”
অতএব, ব্রহ্মসংহিতায় শ্রীকৃষ্ণকে অচিন্ত্যগুণস্বরূপম্ অর্থাৎ অচিন্ত্য চিন্ময় গুণাবলীর আধার রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের গুণাবলী আমরা কল্পনাও করতে পারি না। যেমন ভগবদ্গীতায় (৯/২৬) বলা হয়েছে-
পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মে ভক্ত্যা প্রযচ্ছতি।
তদহং ভক্ত্যুপহৃতমশ্লামি প্রযতাত্মনঃ।।
অর্থাৎ, “যদি কেউ ভক্তি সহকারে আমাকে একটি পাতা, একটি ফুল, একটি ফল ও জল নিবেদন করে, আমি তা গ্রহণ করি।” শ্রীকৃষ্ণ কিভাবে গ্রহণ করেন, তাই না? কিন্তু তিনি গ্রহণ করেন। তাই তাঁর গুণাবলী হচ্ছে অচিন্ত্য।
আমাদের খাওয়ার ধারণাটি হচ্ছে যে, আমরা মুখ দিয়ে খাই। যে খাদ্যই আমাদের দেওয়া হোক না কেন আমরা তা তুলে নিয়ে মুখে পুরে দেই। সেটিই আমাদের খাবার পন্থা। কিন্তু যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন অচিন্ত্য। তাই তাঁর খাবার পন্থাটিও আমাদের দিক থেকে ভিন্ন। ব্রহ্মসংহিতায় বলা হয়েছে- অঙ্গানি যস্য সকলেন্দ্রিয়বৃত্তিমত্তি “তাঁর দেহের প্রতিটি অঙ্গই যেকোনও অঙ্গের কাজ করতে পারে।” আমাদের চোখ দিয়ে আমরা দেখতে পারি। যদি আমরা চোখ বন্ধ করি, তাহলে দেখতে পারি না। কিন্তু কৃষ্ণ যদি তাঁর চোখ বন্ধ করে রাখেন তাহলে তাঁর হাতের মাধ্যমে তিনি সবকিছুই দেখতে পারেন। এটি হচ্ছে অচিন্ত্যনীয়।
তেমনই, আমরা কৃষ্ণকে খাদ্য নিবেদন করি এবং তিনি দৃষ্টিপাতের মাধ্যমে সেটি খান। ঠিক যেমন আমরা মুখ দিয়ে খাই, কিন্তু তিনি তাঁর চোখ দিয়ে খেতে পারেন। এখন আপনি তর্ক করতে পারেন, “তিনি যদি খাদ্যটি খেয়েছেন, তাহলে সেটি ঠিক যেভাবে নিবেদন করা হয়েছিল। সেভাবে পড়ে আছে কেন? ঈশোপনিষদের মঙ্গলাচরণে এই প্রশ্নের উত্তরটি দেওয়া হয়েছে।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে-“পরম পূর্ণ থেকে যদি পরম পূর্ণ বাদ দেওয়া যায়, তবু পরম পূর্ণই অবশিষ্ট থাকে।” তেমনই শ্রীকৃষ্ণ সম্পূর্ণ খাদ্যগ্রহণ করলেও খাদ্য সম্পূর্ণই থেকে যায়। এটি হচ্ছে তাঁর অচিন্ত্যনীয় চিন্ময় গুণ। কৃষ্ণভাবনা হচ্ছে এক পরম বিজ্ঞান, পারমার্থিক বিজ্ঞান। দুর্ভাগ্যক্রমে এই পারমার্থিক বিজ্ঞান হৃদয়ঙ্গম করার কোনও পন্থা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নেই। বিশেষ করে এই যুগে সমস্ত কিছুই ভগবৎ বিহীন, তাই মানুষেরা সুখী নয়। এই কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের উদ্দেশ্যটি হচ্ছে মানুষকে কৃষ্ণভাবনাময় হবার শিক্ষা প্রদান করে তাদের সুখী করে তোলা। সেটিই আমাদের ব্রত। তেমনিভাবে, সমস্ত ভগবদ ভক্তের ব্রতই হচ্ছে সেটি, যেমন অর্জুন। অর্জুন হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের ব্যক্তিগত বন্ধু। অর্জুনের কোন অজ্ঞতা থাকতে পারে না।
কিন্তু তিনি আমাদের মঙ্গলের জন্য প্রশ্ন করলেন এবং শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রশ্নের উত্তর দান করলেন। শ্রীকৃষ্ণের উত্তরকে কেন এত গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়? কেননা, তিনিই হচ্ছেন পরম নিয়ন্তা, পরমেশ্বর ভগবান। আমরা যদি পরম নিয়ন্ত্রকের কাছ থেকে জ্ঞান গ্রহণ করি, তাহলে সেটি পূর্ণ জ্ঞান। যেমন: আপনার চেয়ে অধিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, অধিক শিক্ষা সম্পন্ন কোন গুরুজনের কাছ থেকে কোন জ্ঞান গ্রহণ করেন। তখন আপনি বিশ্বাসযোগ্য ভাবেই গ্রহণ করে থাকেন। এই জড় জগতে কেউ হয়তো রয়েছে, যে কর্তৃত্ব করছে কিন্তু সে কখনই পরম কর্তা হতে পারে না। পরম কর্তা হচ্ছেন কৃষ্ণ। ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ।
তাই আমাদের জ্ঞান যদি আমরা পরম কর্তার কাছ থেকে প্রাপ্ত হই, তবে আমাদের জ্ঞান হচ্ছে পূর্ণ। আমরা যদি পরম কর্তার কাছ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান অন্যের মাধ্যমেও প্রাপ্ত হই তাহলেও মঙ্গল। সেই জ্ঞানটিও পূর্ণ। কিন্তু কেউ যদি মনোধর্মপ্রসূতভাবে, “এটা এরকম হতে পারে, ওটা ওরকম হতে পারে” বলে জ্ঞান দান করে তবে সেই জ্ঞান অপূর্ণ। আপনাকে পূর্ণ পুরুষ, পরমেশ্বর ভগবান অথবা তাঁর উপযুক্ত প্রতিনিধির কাছ থেকে জ্ঞান গ্রহণ করতে হবে। তখন আপনার জীবনে মঙ্গল হবে।