লক্ষ্মী পূজা, নারায়ণ কোথায়?

প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২১ | ১০:৫৩ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২১ | ১০:৫৩ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 303 বার দেখা হয়েছে

লক্ষ্মী পূজা, নারায়ণ কোথায়?

গৌতম সাহা : অধিকাংশ সময়ই আমরা অর্থের বা ধনের পেছনে দৌড়াচ্ছি। অর্থই সমগ্র বিশ্বকে পরিচালিত করছে। এজন্যে লক্ষ্মীদেবী যেহেতু ধন-সম্পদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, সেহেতু আমরা তার কৃপা লাভের জন্য তার পূজা করে থাকি। আমাদের অনেকেই শুধু অর্থ লাভের দ্বারা লালায়িত, কিন্তু আমরা জানি না যে, লক্ষ্মীদেবী কিন্তু আমাদেরকে সৌন্দর্য, শক্তি, খ্যাতি জ্ঞান ও বৈরাগ্যও প্রদান করতে পারে। বৈরাগ্যও লক্ষ্মীদেবীর ঐশ্বর্যের একটি নিদর্শন, কিন্তু যেহেতু আমরা সবাই স্থূল জাগতিক মানসিকতার দ্বারা অন্ধ হয়ে পড়েছি, তাই এই বৈরাগ্য বা অনাসক্তির গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা উপলব্ধি করতে পারি না, যেটি লক্ষ্মীদেবীর অন্যতম ঐশ্বর্য যা আমাদের ওপর বর্ষিত হতে পারে।
ভারতে (বাংলাদেশেও) লক্ষ্মীদেবী হলো প্রশান্তি, সৌন্দর্য, সতীত্ব, ধার্মিকতা, মর্যাদা ও সমস্ত জাগতিক আশির্বাদের প্রতীক হিসেবে সর্বগণ্য। লক্ষ্মী হল আদর্শ ভারতীয় নারীর প্রতিভূ রূপ যিনি সবার পূজনীয়।
ঐতিহ্যগতভাবে ভারতের (বাংলাদেশেও) গৃহস্থ নারীরা কামনা করে তাদের কন্যা বা পুত্রবধু যেন লক্ষ্মী হয়, অর্থাৎ লক্ষ্মীদেবীর সমস্ত গুণাবলীতে যেন ভূষিত হয়।
এই বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে যে, পুত্রবধু যদি লক্ষ্মীদেবীর সমস্ত গুণাবলীতে ভূষিত হন তবে, সেই গৃহ সমস্ত আশির্বাদ, শান্তি ও ঐশ্বর্য পূর্ণ হবে।

নারায়ণের নিত্য সঙ্গী লক্ষ্মীদেবী

লক্ষ্মীদেবী হলেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রী নারায়ণের নিত্য সঙ্গী। শ্রী নারায়ণ হলেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিষ্ণু তত্ত্বের অন্যতম প্রকাশ। তাঁর চিন্ময় ধাম বৈকুণ্ঠলোকে সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ রূপে শ্রী নারায়ণ তার নিত্য সঙ্গী লক্ষ্মীদেবীকে নিয়ে বিরাজ করেন। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীনারায়ণ লক্ষ্মীদেবীর কাছ থেকে কিছুই কামনা করেন না, কেননা তিনি হলেন স্বয়ং পূর্ণ। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ৩/২২ শ্লোকে ভগবান ঘোষনা দিয়েছেন-

ন মে পার্থাস্তি কর্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন।
নানবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত এব চ কর্মণি ॥

অনুবাদ: হে পার্থ! এই ত্রিজগতে আমার কিছুই কর্তব্য নেই। আমার অপ্রাপ্ত কিছু নেই। এবং প্রাপ্তব্যও কিছু নেই। তবুও আমি কর্মে ব্যাপৃত আছি। যখন ভগবান তার গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণুর প্রকাশ রূপে সৃষ্টির প্রথম জীব ব্রহ্মাকে সৃষ্টির বাসনা করেছিলেন, তখন তিনি সমুদ্রের ওপর সর্ব প্রথম প্রকাশ শেষনাগের (সঙ্কর্ষণ) শরীরের ওপর শায়িত হয়ে তার নাভীপদ্ম থেকে ব্রহ্মাকে সৃষ্টি করেন। ভগবান ইচ্ছা করলে ব্রহ্মা বা অন্যান্য সমস্ত জীবকে লক্ষ্মীদেবীর গর্ভ থেকে সৃষ্টি করতে পারতেন, যিনি তাঁর সঙ্গে নিত্য বিরাজ করেন এবং অত্যন্ত প্রিয়। কিন্তু তিনি ব্রহ্মাকে সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর থেকে স্বতন্ত্রভাবে, যাতে করে তার সর্বশক্তিমত্তা ও স্বতন্ত্রতার বিষয়টি প্রতীয়মান হয়। এভাবে ভগবান হলেন স্বয়ং সম্পূর্ণ এবং লক্ষ্মীদেবীর কোনো বরের প্রয়োজন হয় না। পক্ষান্তরে, লক্ষ্মীদেবী ক্ষণকালের জন্যে ও ভগবান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারেন না, কেননা নারায়ণ হলেন তাঁর অত্যন্ত প্রিয় পতি। অনেকে ‘দরিদ্র নারায়ণ’ এ শব্দটিও মাঝে মাঝে ব্যবহার করে থাকে, কিন্তু সেটি হল মূর্খতা। মাঝে মাঝে ভগবান একজন দরিদ্র ব্যক্তি হিসেবে লীলা বিলাস করেছিলেন, যেমনটি বলি মহারাজের কাছে একজন দরিদ্র ব্রাহ্মণরূপে আগমন করে ত্রিপাদ ভূমি প্রার্থনা করেছিলেন। কিন্তু যে ব্যক্তি লক্ষ্মীদেবীর ঐশ্বর্য সম্পর্কে অবগত, যিনি নিত্য সেবা করে যাচ্ছেন, তাকে কি কখনো দরিদ্র নারায়ণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়? ভগবান সর্বদাই ষড় ঐশ্বর্যে পূর্ণ। যখন ভগবান কৃষ্ণ রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন তখন লক্ষ্মীদেবীও রুক্মিনী দেবীরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে ভগবানের সর্বশেষ লীলার অংশ হিসেবে দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণের রাণী হিসেবে ছিলেন। রামচন্দ্র রূপে ভগবানের লীলাবিলাসের সময় লক্ষ্মীদেবী সীতাদেবীরূপে আবির্ভূত হয়েছিল, ভগবান সেই লীলায় একজন আদর্শ ব্যক্তি (পুরুষোত্তম) ও আদর্শ রাজা হিসেবে লীলা করেছিলেন।
অতএব, এটি আশ্চর্য যে, অধিকাংশ ব্যক্তি লক্ষ্মীদেবীর পূজা বা আরাধনার সময় তাঁর প্রিয় পতি শ্রীনারায়ণের কথা ভুলে যায় বা অগ্রাহ্য করে । অথচ লক্ষ্মীদেবী সেই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীনারায়ণকে ছাড়া ক্ষণকালের জন্যেও থাকতে পারে না। আপনি যদি আপনার গৃহে কোন শ্রদ্ধাভাজন নারীকে আমন্ত্রণ জানান সে সাথে তার প্রিয় পতিকে অগ্রাহ্য করেন তবে কি তিনি থাকবে এবং আপনার সেই আমন্ত্রণে খুশি হবে? তাছাড়া, এমনকি যদি লক্ষ্মীদেবীর কোন ভক্ত তার কাছ থেকে কোনো বর প্রার্থনা করলে সেই বর যদি পূর্ণও হয় তবুও সেই বর খুব বেশি সময় স্থায়ী হয় না, কেননা লক্ষ্মীদেবীর আরেকটি নাম হল ‘চঞ্চলা’। তাই শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীমদ্ভাগবতে (৪/৭/৩৭) তাৎপর্যে উদ্ধৃত করেছেন।
“যেখানে ভগবান বিষ্ণুর পূজা হয়, সেখানে স্বাভাবিকভাবে লক্ষ্মীদেবীর কৃপা থাকে। ভগবান শ্রীবিষ্ণুকে অমৃত বলে সম্বোধন করা হয়েছে। দেবতারা, এমনকি ব্রহ্মা এবং শিবও সৃষ্টির পরে উৎপন্ন হয়েছেন, কিন্তু শ্রীবিষ্ণু সৃষ্টির পূর্বে বিরাজমান ছিলেন। তাই তাঁকে অমৃত বলে সম্বোধন করা হয়েছে। শ্রীবিষ্ণু তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তি সহ বৈষ্ণবদের দ্বারা পূজিত হন।”
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার লীলাবিলাসের সময় প্রদর্শন করেছিলেন যে, কিভাবে সম্পূর্ণ কপর্দকহীন একজন দরিদ্র ব্রাহ্মণ সুদামা ভগবানকে খাওয়ার অনুপযুক্ত সামান্য সস্তা চাল অর্পনের মাধ্যমে ভগবানকে অপরিসীমভাবে সন্তুষ্ট করেছিলেন। লক্ষ্মীদেবী সুদামাকে এমন বর প্রদান করেন যে, তিনি জন্মান্তর ধরে এমনকি দেবরাজ ইন্দ্রের চেয়েও অকল্পনীয় ঐশ্বর্যের অধিকারী হবেন। এই হল ভগবানের প্রতি প্রীতির শক্তি। যখন কেউ নারায়ণকে সামান্য একটু খাদ্য কিংবা সেবা নিবেদন করে এবং এতে যদি ভগবান সন্তুষ্ট হন তখন লক্ষ্মীদেবী সেই ভক্তের প্রতি অবিলম্বেই বাধিত হয়ে পড়েন এবং ব্যক্তিগতভাবে সেই ভক্তের গৃহ পরিদর্শন করেন তখন কারো মনে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, তার গৃহ হয়ে উঠে ঐশ্বর্যময়।

আমাদের উচিত নারায়ণকে প্রসন্ন করা

লক্ষ্মী যেন গৃহ ছেড়ে চলে না যান, এজন্যে আমাদের সুনিশ্চিত হতে হবে সেই গৃহে নারায়ণ রয়েছেন কিনা? এক্ষেত্রে শাস্ত্রের বার্তা স্পষ্ট যে, যিনি তার খেয়াল বা ইচ্ছামত গৃহে আসেন আবার চলেও যেতে পারেন সেই লক্ষ্মীর পেছনে ছুটার পরিবর্তে আমাদেরকে এ বিষয়ে নিশ্চিত হবে, আমাদের গৃহে শ্রীনারায়ণের উপস্থিতি রয়েছে কিনা? এক্ষেত্রে শ্রীনারায়ণকে কিভাবে আমাদের গৃহে বন্ধী করতে পারি? এটি সম্ভব তার প্রতি শুদ্ধ প্রেম ও ভক্তিমূলক সেবা নিবেদনে মাধ্যমে। যদিও ভগবান অজেয়, তথাপিও তিনি তাঁর শুদ্ধ ভক্ত কর্তৃক বন্ধী হন। ভগবান আমাদের কাছ থেকে কোনো মহামূল্যবান উপহার চান না। তাঁর প্রতি প্রীতি প্রদর্শনস্বরূপ আমরা তাঁকে প্রতিদিন একটি তুলসী পত্র, একটি পুষ্প ও এক গ্লাস জল অর্পন করতে পারি, তাতে ভগবান সেগুলো শুধু গ্রহণই করবেন না বরং পরম সন্তুষ্টি সহকারে তা আহারও করবেন। (এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভগবানের সমস্ত ইন্দ্রিয় সমান কার্যকরী, তিনি যেকোনো একটি ইন্দ্রিয় দিয়ে সেটি চোখ বা নাক দিয়েও ইচ্ছানুসারে আমাদের নিবেদন গ্রহণ করতে পারেন।) তিনি তখন আমাদের গৃহে নিত্যই বিরাজ করবেন, যেটি হয়তো আমাদের স্থূল ইন্দ্রিয়সমূহ দিয়ে আমরা অবলোকন করতে পারব না।

পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মে ভক্ত্যা প্রযচ্ছতি।
তদহং ভক্ত্যুপহৃতমশামি প্রযতাত্মনঃ ॥

অনুবাদ: যে বিশুদ্ধচিত্ত নিষ্কাম ভক্ত ভক্তি সহকারে আমাকে পত্র, পুষ্প, ফল ও জল অৰ্পণ করেন, আমি তাঁর সে ভক্তিপুত উপহার প্রীতি সহকারে গ্রহণ করি। [গীতা ৯/২৬]
যদি পরমেশ্বর ভগবান নারায়ণ আমাদের গৃহে বন্দী হন তবে লক্ষ্মী আর দূরে থাকতে পারেন না। আমাদের ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধিমত্তার ভগবান শ্রীনারায়ণ যেরূপে আবির্ভূত হোক না যেমন কৃষ্ণ, রাম, নৃসিংহ তখন লক্ষ্মী আর দূরে থাকতে পারেন না। যদিও আমাদের স্থূল ইন্দ্রিয়সমূহের অবলোকনের আড়ালে সত্য হল, লক্ষ্মী সর্বদায় ভগবানের পাশেই অবস্থান করেন, যাতে করে তার পতিকে সেবারত ভক্তের প্রতি বর প্রদানের সুযোগ লাভ করতে পারেন।

উপলব্ধির পরিবর্তন

এই জাগতিক জীবনের শেষে, আমাদের সমস্ত জাগতিক প্রাপ্তি হারিয়ে ফেলি। তবুও আমরা জাগতিক বস্তু লাভের জন্য ব্যাকুল থাকি। আমাদের নিত্য সম্পর্ক হল ভগবানের সঙ্গে এবং তিনিই হলেন আমাদের প্রকৃত বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী। অন্য সমস্ত জাগতিক সম্পর্কগুলো হল অনিত্য।

বহূনিমে ব্যতীতানি জন্মানি তব চার্জুন ।
তান্যহং বেদ সর্বাণি ন ত্বং বেথ পরন্তপ ॥

অনুবাদ: পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে পরন্তপ অর্জুন! আমার ও তোমার বহু জন্ম অতীত হয়েছে। আমি সেই সমস্ত জন্মের কথা স্মরণ করতে পারি, কিন্তু তুমি পার না। [গীতা ৪/৫] এতএব, একজন বুদ্ধিমান ভক্ত ভগবানের কাছ থেকে ভক্তিমূলক সেবা বিনা অন্য কিছু কামনা করেন না। এই বিষয়টি নিশ্চিত করে যে, ভগবান সেই ভক্তের সাথে নিত্যই বিরাজ করেন। ভক্তের কাছে লক্ষ্মীর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি কোন বিষয় নয়, তিনি লক্ষ্মীকে জড় ঐশ্বর্য প্রদানকারী বা দাতা রূপে দর্শন করেন না। বরং ভগবানের একজন ভক্ত হিসেবে তিনি পূজনীয় এজন্যেই যে যাতে করে তিনি যেভাবে প্রেম ও ভক্তির সহিত ভগবানকে সেবা করেন সেই উন্নত গুণাবলী আমাদেরকে প্রদান করতে পারেন। হরে কৃষ্ণ!

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।