অজ্ঞাত সুকৃতি অনিচ্ছাকৃত ভক্তির রহস্য!

প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২১ | ৫:১২ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২১ | ৫:২১ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 208 বার দেখা হয়েছে

অজ্ঞাত সুকৃতি অনিচ্ছাকৃত ভক্তির রহস্য!

ভগবানের প্রতি ভক্তিমূলক সেবা সম্পাদনের যে দূর্লভ উপহার তা লাভের যোগ্যতা কি?
সত্যরাজ দাস
অনুবাদক : ললিতা মঞ্জুরী দেবী দাসী

অজ্ঞাত সুকৃতি মানে অজ্ঞাতসারে বা না জেনে পূণ্যকর্ম করা। আমরা জনগণকে তাদের অজ্ঞাতসারে পূণ্যকর্ম করার সুযোগ দিই। এটিই কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন।”
(বব কোহেনের সাথে শ্রীল প্রভুপাদের কথোপকথন, ফেব্রুয়ারী ১৯৭২, মায়াপুর)
সাধারণত অজ্ঞভাবে কোনকিছু করার চেয়ে সজ্ঞানে করা উত্তম। ভক্তিযোগ বা ভক্তিও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু নবীন হিসেবে প্রত্যেক ব্যক্তির প্রতিটি প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে কোথাও না কোথাও তার সূত্রপাত ঘটে। কৃষ্ণভাবনামৃতের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অসীম কৃপার প্রভাবে আমাদেরকে অজ্ঞাতসারে বা কখনো সম্পূর্ণ ঘটনাক্রমেই নিজেদের প্রথম পারমার্থিক পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যবস্থা করে দেন।
প্রকৃতপক্ষে আমরা হয়তোবা পূর্বজন্ম থেকেই এই যাত্রা শুরু করেছি, অথবা হতে পারে এই জন্মেই অজ্ঞাতসারে কিংবা আমরা কোনো ভক্তের কৃপা লাভ করেছি অথবা হতে পারে কেবল জন্মগত ভাবেই আমাদের মধ্যে পারমার্থিক আকুলতার অন্তর্নিহিত উন্মুখতা আছে, যার ব্যাপারে আমরা সচেতন ছিলাম। কিন্তু যদি এই জীবনে আমরা পরম সৌভাগ্যশালী হই, তবে আমরা কৃষ্ণভক্তের সাক্ষাত লাভ করি এবং অনেক সময়, এতেই আমাদের ভক্তিজীবনের সূচনা হয়। যেভাবে তারা বলে ‘ভাগ্যক্রমে’।

ঘটনাক্রমে (কৃষ্ণের ব্যবস্থাপনায়) আমাদের কোনো ভগবদ্ভক্তের সাথে সাক্ষাৎ হলে অথবা ভগবানের নাম কীর্তন শ্রবণ করলে অথবা কোন গ্রন্থ প্রাপ্ত হলে, সেখান থেকেই পারমার্থিক জীবনের সূচনা হয়। আমাদের অপ্রাকৃত কৃষ্ণভক্তির পন্থায় আরো উন্নতি করার সুযোগ রয়েছে। যেমনটি শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, “আমরা বিভিন্ন গ্রহে বিভিন্ন প্রজাতির দেহে ভ্রমণ করেছি। ব্রহ্মাণ্ড ভ্রমিতে ভ্রমিতে কোন ভাগ্যবান জীব- কৃষ্ণ এবং গুরুর সংস্পর্শে আসার জন্য অনেক সৌভাগ্যশালী হতে হয়। অজ্ঞাত সুকৃতির অর্থ হলো উদাহরণস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধি বিশ্বব্যাপী প্রচার করছেন এবং কেউ যদি সেই ভগবৎ প্রতিনিধির সংস্পর্শে আসে এবং তাঁকে সন্তুষ্ট করে, তবে সে কিছু অজ্ঞাত-সুকৃতি অর্জন করে। একেই অজ্ঞাত-সুকৃতি বলে। শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধিকে সেবা করার মাধ্যমে কি পারমার্থিক কল্যাণ সাধিত হচ্ছে, তা সে নিজেও জানে না। কিন্তু একেই বলা হয় অজ্ঞাত-সুকৃতি। যখন এভাবে অজ্ঞাত-সুকৃতি পূঞ্জীভূত হয়, তখন তার সৌভাগ্যের উদয় হয়। একেই বলা হয় কোন ভাগ্যবান জীব।”
(শ্রীল প্রভুপাদ প্রদত্ত প্রবচন, ভক্তিরসামৃতসিন্ধু, বৃন্দাবন, ভারত, ২৯ অক্টোবর, ১৯৭২)

অজ্ঞাত-সুকৃতি কি?

অজ্ঞাত শব্দের অর্থ “অজান্তে” বা “অসচেতনভাবে” এবং সুকৃতি শব্দের অর্থ “পূণ্যকর্ম”। তাহলে এই পুরো শব্দগুচ্ছের অর্থ দাঁড়ায় “অপরিকল্পিত বা অনিচ্ছাকৃত পূণ্যকর্ম” এই ধরণের কর্মের ফল হলো ভবিষ্যতে অপ্রত্যাশিত পুরষ্কার, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকৃত কর্ম সংঘটনের দীর্ঘ সময় পরে প্রকাশিত হয়। একটি উপমার সাহায্যে বিষয়টি আরো স্পষ্টভাবে বুঝা যায়; স্বভাবতই কোনো প্রতিদানের আশা ব্যতিরেকেই কেউ একটি শিশুর প্রতি দয়ার্দ্র হতে পারে। যাহোক, যখন সেই শিশুটি বড় হয় এবং অর্থপূর্ণভাবে আচরণ করে তখন সেটি অজ্ঞাত-সুকৃতিরই একটি দৃষ্টান্ত। অন্ততপক্ষে জাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে হলেও। আমাদের দৃষ্টিতে এটি নিছক পূণ্যকর্ম হলেও, এই শব্দ গুচ্ছের গভীর তাৎপর্য রয়েছে।

ভক্তিযোগের ভাবধারায় পূণ্যকর্ম ও সুকৃতি অথবা ভৌতিক ও পারমার্থিক উৎকর্ষতার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নিরূপিত হয়েছে। ভৌতিক পূণ্যকর্মের মূল্য ক্ষণস্থায়ী এবং চরমে কলুষিত, বিকৃত ও নশ্বর হয়ে থাকে। কিন্তু পারমার্থিক সুকৃতি নিত্য এবং অক্ষয়। উভয় সুকৃতি প্রশংসনীয় হলেও সাধারণ পুণ্যকর্ম হলো এই জড় জগতের বস্তু। জাগতিক কর্মের ফলস্বরূপ তাদের উদয় হয়। তাই জাগতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অপরিহার্যভাবে জাগতিক প্রতিক্রিয়ায় দেখা দেয়। যা আমাদেরকে ভগবানের সন্নিকটে নিয়ে আসার পরিবর্তে এই জড় জগতে কর্মবন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে।
“সংস্কৃতে ভৌতিক উৎকর্ষতাকে বলা হয় সত্ত্ব, কিন্তু পারমার্থিক উৎকর্ষতাকে বলা হয় শুদ্ধ-সত্ত্ব অর্থাৎ ‘বিশুদ্ধ উৎকর্ষতা’ এবং যখন সত্ত্ব এবং শুদ্ধ-সত্ত্ব বিভিন্ন উপায়ে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত তথাপি তাদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে।” “জীব যখন জড়া প্রকতির সংস্পর্শে আসে, তখন আত্মার বৃত্তি কলুষিত হয়ে যায় এবং সেই কলুষিত বা বিকৃত বৃত্তির প্রকাশ হচ্ছে কাম, ক্রোধ, লোভ নিস্ক্রিয়তা, অজ্ঞান এবং নিদ্রা। রজো এবং তমোগুণের এই সমস্ত প্রভাবগুলির সম্পূর্ণ নিবৃত্তি হচ্ছে ভগবদ্ভক্তির প্রকাশের ফল। ভক্ত তৎক্ষণাৎ সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত হন। এই শুদ্ধ-সত্ত্ব স্তরেই কেবল ভগবানের প্রতি শুদ্ধ প্রেম লাভ করে তাঁকে চাক্ষুষ দর্শন করা যায়।”
(শ্রীমদ্ভাগবত ১/২/১৯ তাৎপর্য)

সুকৃতি তিন প্রকার

অজ্ঞাত-সুকৃতির সাথে এসবের কি সম্পর্ক রয়েছে? অজ্ঞাত-সুকৃতি সাধারণ পুণ্যকর্মকে অপ্রাকৃত কর্মে প্রসারিত করে। আমাদের গৌড়ীয় বৈষ্ণব পরম্পরার একজন আচার্য শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর (১৮৩৮-১৯১৪) তা নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করেন। সুকৃতি বা পূণ্যকর্ম তিন প্রকারের :
১. কর্র্মোন্মুখী অর্থাৎ সকাম কর্মজাত সুকৃতি।
২. জ্ঞানোন্মুখী অর্থাৎ জ্ঞানানুশীলনজাত সুকৃতি।
৩. ভক্ত্যুন্মুখী অর্থাৎ ভক্তিজাত সুকৃতি।
প্রথম দু’টি যথাক্রমে ভুক্তি ও মুক্তি প্রদান করে। কিন্তু ভক্ত্যুন্মুখী সুকৃতির ফলে কৃষ্ণভক্তিতে বিশ্বাস ও আসক্তির উদয় হয়। কোনোরকম পারমার্থিক জ্ঞান ছাড়া, না জেনেই কোনো ভক্তিমূলক সেবা সম্পাদনের মাধ্যমে এই ধরনের মহিমান্বিত পুণ্য বা অজ্ঞাত সুকৃতি অর্জিত হয়। ভক্তি-উন্মুখী সুকৃতি হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুকৃতি এবং এর ফলে জীব একজন শুদ্ধভক্ত বা সাধুর সাক্ষাৎ লাভ করে। কৃষ্ণভক্তের সঙ্গের প্রভাবে জীবের হৃদয়ে বিশ্বাস দৃঢ় হয়। ক্রমান্বয়ে জীব ভগবানের নাম কীর্তনে রুচি লাভ করে, সমস্ত জীবের প্রতি দয়ালু হয় এবং ভক্তিতে দৃঢ়তা লাভ করে।
(হরিনাম চিন্তামনি, ১ম অধ্যায়)
শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের উদ্ধৃতি উল্লেখ পূর্বক শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীচৈতন্য-চরিতামৃতে (মধ্যলীলা ২২/৪৫) এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি গুরুত্বারোপ করেন যে কেবল ভক্তি-উন্মুখী-সুকৃতি না অপ্রাকৃত পূণ্যকর্মই প্রকৃত সৌভাগ্যের বাহক।
ভক্তিশাস্ত্র সুকতিকেই ‘ভাগ্য’বলেন। সুকৃতি তিন প্রকার- ভক্তি উন্মুখী সুকৃতি, ভোগ উন্মুখী সুকৃতি এবং মোক্ষ উন্মুখী সুকৃতি। যে সমস্ত কার্য সংসারে শুদ্ভভক্তি-জনক বলে স্থির আছে, সেই সমস্ত কার্য ভক্তি উন্মুখী সুকৃতিকে উৎপন্ন করে, যে সমস্ত কার্যের ফল-বিষয় ভোগ, সেই সমস্ত কার্যই ভোগ উন্মুখী সুকৃতিপ্রদ; যে সমস্ত কার্যের ফলÑমোক্ষ, সেই সমস্ত কার্যই মোক্ষ উন্মুখী সুকৃতি-জনক। সংসার ক্ষয় পূর্বক স্বরূপ ধর্ম কৃষ্ণভক্তির উদ্বোধিনী সুকৃতি যখন পুষ্ট হয়ে ফলোন্মুখ হয়, তখনই ভক্ত সাধুসঙ্গে সংসার থেকে উদ্ধার পান এবং কৃষ্ণে তাঁর রতি উৎপন্ন হয়।” (চৈ.চ.মধ্য ২২/৪৫ তাৎপর্য) এভাবে ভক্ত্যুন্মুখী সুকৃতি যা সর্বোৎকৃষ্ট অজ্ঞাত-সুকৃতি একটি প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করে, যে দ্বার জীবকে অপ্রাকৃত জগতের পথে পরিচালিত করে। এই ধরণের সুকৃতি বা পূণ্যকর্ম সম্পাদনের ফলে, যে ব্যক্তির হয়তো আধ্যাত্মিক জীবনে কোন আগ্রহই নেই, তিনিও অজ্ঞাতভাবে ভগবানের উদ্দেশ্য প্রচারে অবদান রাখেন এবং এই অবদানই তার ভক্তিরাজ্য উন্মুক্ত করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, সেই ভূমি মালিকের কথা বিবেচনা করুন যারা অসচেতনভাবে শ্রীল প্রভুপাদ ও তাঁর অনুগামীদের মন্দির নির্মাণের জন্য বিশেষ সুযোগ দেন, অথবা প্রকাশনা সংস্থার সেই মালিকের কথা ভাবুন, যিনি “একজন ভারতীয় বৃদ্ধ ভদ্রলোককে” দেখে দয়াপরবশ হয়ে তাদের নির্ধারিত মূল্য কমিয়ে দিয়েছিলেন, অথবা সুপারমার্কেটের সেই করণিক যিনি ভক্তদের ফলমূল ও শাকসবজি উপহার স্বরূপ দিয়েছিলেন কারণ “ভক্তদের দেখে তার ভালো মনে হয়েছিল”, এই সকল দৃষ্টান্তেই মানুষ অজ্ঞাতসারে সেবা করছে এবং এভাবে তারা গোপনে ভক্ত্যুন্মুখী সুকৃতি অর্জন করছে।
এই অসচেতন ক্রিয়াকলাপের ফলস্বরূপ যথাসময়ে সম্যকরূপে তাদের পারমার্থিক জীবন পুনর্জাগরিত হবে। যদিও উপরের কিছু ঘটনা অবাস্তবভাবে সুদূর প্রসারিত মনে হতে পারে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধারার মতানুযায়ী, ভগবানের কৃপা সর্বব্যাপ্ত, এমনকি যদি কেউ নগন্য কোন সেবাও করেন, শ্রীকৃষ্ণ তার নিকট ঋণী হয়ে যান এবং পরিনামে তাকে সজ্ঞানে সেবা সম্পাদনের ও পারমার্থিক পথে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ দান করেন। ভগবানের একটি নাম অচ্যুত (যিনি কখনো চ্যুত হন না) কারণ, যেভাবে শ্রীল প্রভুপাদ ব্যাখ্যা করেছেন, তিনি ‘তাঁর ভক্তের নিবেদিত তুচ্ছ সেবাও তিনি কখনো বিস্মৃত হন না।
(লীলা পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ, ১৪ অধ্যায়)
উদাহরণস্বরূপ, কোনো ব্যক্তি যদি রাস্তায় সংকীর্তনরত ভক্তদের কীর্তন শ্রবণ করেন, তাহলে তিনি অনিচ্ছাকৃতভাবে ভক্তদের কীর্তন শ্রবণ করেন, তাহলে তিনি অনিচ্ছাকৃতভাবে একটি ভক্ত্যাঙ্গ সম্পাদন করেন, কারণ ভগবানের সম্পর্কে শ্রবণ করা শ্রীমদ্ভাগবতে উল্লেখিত নববিধা ভক্তির অন্যতম একটি অঙ্গ। তাই এমনকি সেই ব্যক্তি যদিও ভগবানের পবিত্র নাম শ্রবণের ফল সম্পর্কে জানে না, তথাপি তার এই শ্রবণ ধীরে ধীরে প্রত্যক্ষ ও সচেতন ভক্তিমূলক সেবায় পর্যবসিত হয়ে পূর্ণতা লাভ করতে পারে। যদি এমনটি হয়, তবে তা অজ্ঞাত-সুকৃতির অনুপমত্ত্ব। বিষয়টি হল- অজ্ঞাত-সুকৃতি সাধারণ পূণ্যকর্ম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বস্তু-  এটি চিন্ময়, যার অপ্রাকৃত মূল্য রয়েছে। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর তার সারার্থ এভাবে বর্ণনা করেন; সুকৃতি দ্ইু প্রকার-  নিত্য ও নৈমিত্তিক যে সুকৃতির দ্বারা সাধুসঙ্গ ও ভক্তি লাভ-হয় তা নিত্য এবং যে সুকৃতি দ্বারা ভুক্তি ও মুক্তি লাভ হয় তা নৈমিত্তিক অথবা অনিত্য (ক্ষণস্থায়ী) সুকৃতি। ফলভেদে সুকৃতির ভিন্নতা হয়। ফল যদি নিত্য হয় তবে সুকৃতিও নিত্য এবং যদি ফল অনিত্য হয় তবে তা ক্ষণস্থায়ী নৈমিত্তিক সুকৃতি।
(জৈবধর্ম, ষষ্ঠ অধ্যায়)
ন্যায়সঙ্গতভাবে কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, অসচেতনভাবে ভক্তি সাধন করা কিভাবে সম্ভব? অনুপ্রাণিত সর্বোপরি, ভগবৎ সেবার দৃঢ় প্রচেষ্টা যদি ভক্তি সহকারে সম্পাদিত না হয়, তবে তার সম্পাদিত কার্যকে কিভাবে ভক্তিমূলক বলা হয়?
স্পষ্টতঃ শুদ্ধভক্তি অবশ্যই ইচ্ছাকৃত এবং অনুকূল, যা শ্রীল রূপ গোস্বামী ভক্তিরসামৃতসিন্ধু (১/১/১১) গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। তথাপি ব্যক্তির ভগবদ্ভক্তির সূচনা স্বাভাবিকভাবেই অনিচ্ছাকৃত ও প্রেমরহিত এবং এতদসত্ত্বেও তা কাঙ্খিত ফলপ্রদ।
শ্রীমদ্ভাগবতে (৬/২/১৮-১৯) বলা হয়েছে :
“অগ্নি যেমন তৃণরাশি ভস্মীভূত করে, তেমনই জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে উত্তমশ্লোক ভগবানের নাম কীর্তন করলে সমস্ত পাপ ভস্মীভূত হয়ে যায়। কেউ যদি কোন ওষুধের শক্তি সম্বন্ধে অবগত না হয়ে সেই ওষুধ সেবন করে অথবা তাকে জোর করে সেবন করানো হয়, তা হলে সে ওষুধের প্রভাব না জানলেও তা ক্রিয়া করবে, কারণ সেই ওষুধের শক্তি রোগীর জ্ঞানের উপর নির্ভর করে না। তেমনই, ভগবানের দিব্য নাম কীর্তনের প্রভাব না জানালেও কেউ যদি জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে তা উচ্চারণ করে, তার ফল সে প্রাপ্ত হবে।” এই সমস্ত উদাহরণের দ্বারা এটি স্পষ্ট যে কেউ এমনকি ভুলবশত বা অজ্ঞাতসারেও যদি ভগবানের দিকে অগ্রসর হয়, পারমার্থিক শক্তি তার স্বনিয়মে কার্য করবে।

অজ্ঞাত-সুকৃতির কিছু শাস্ত্র প্রমাণ

শাস্ত্রে উল্লেখিত অজ্ঞাত সুকৃতির বহু উদাহরণের মধ্যে আমি সংক্ষেপে কেবল তিনটি: মৈত্রেয়, অজামিল ও প্রকাশানন্দ সরস্বতীর দৃষ্টান্ত উল্লেখ করবো। যদিও এই তিন পৌরাণিক ব্যক্তি বর্তমান যুগে বৈদিক জ্ঞানের মধ্যে আলোচ্য বিষয়। কিন্তু তাঁদের পারমার্থিক জীবনের সূচনা হয়েছিল অনিচ্ছাকৃতভাবে সম্পাদিত ভগবতসেবার দ্বারা । শ্রীল প্রভুপাদ লিখেন, মহর্ষি মৈত্রেয়, যিনি ব্যাসদেবের পিতা মহর্ষি পরাশরের শিষ্য
শ্রীমদ্ভাগবতের মূল বক্তাদের অন্যতম হিসেবে পূজিত হন। তথাপি শুরুতে তিনি ছিলেন একজন “মিশ্রভক্ত” এবং ক্রমান্বয়ে অজ্ঞাত সুকৃতির প্রভাবে তিনি শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তির গুরুত্ব অনুধাবন করেন। “সৌভাগ্যক্রমে, মৈত্রেয় তখন সেখানে এসে উপস্থিত হলেন, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ বিশ্রাম করছিলেন। ভগবানের সাক্ষাৎ লাভ করা কোন সাধারণ ঘটনা নয়। মৈত্রেয় ছিলেন একজন মহান ঋষি এবং একজন বিদ্বান দার্শনিক। কিন্তু তিনি ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত ছিলেন না, তাই সেই সময় ভগবানের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল তাঁর অজ্ঞাত সুকৃতির বলে।” (শ্রীমদ্ভাগবত ৩/৪/৯ তাৎপর্য)
শ্রীল প্রভুপাদ লিখেন, অন্য একটি উদাহরণ হয় অজামিল। তিনি জীবনের পরম উদ্দেশ্য বিস্মৃত হয়েছিলেন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে নিজের পুত্রের নারায়ণ” নামকরণ করেন।
“ভগবান বদ্ধ জীবদের প্রতি অত্যন্ত কৃপাপরায়ণ। অজামিল সম্পূর্ণভাবে নারায়ণকে ভুলে গেলেও, সে যখন তার শিশুটিকে ডাকত, “নারায়ণ, এখানে এসে এই খাবারটি খাও। নারায়ণ, এই দুধটি খেয়ে নাও।” তখন সে কোন না কোনভাবে নারায়ণের নামের প্রতি আসক্ত হচ্ছিল। একে বলা হয় অজ্ঞাত-সুকৃতি। তার পুত্রের নাম ধরে ডাকলেও অজ্ঞাতসারে সে নারায়াণের নাম উচ্চারণ করছিল।” (শ্রীমদ্ভাগবত ৬/১/২৬ তাৎপর্য)
অন্যান্য দৃষ্টান্তের মধ্যে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর লীলায় আমরা প্রকাশানন্দ সরস্বতীর দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। প্রকাশানন্দ ছিলেন মায়াবাদী সন্ন্যাসী এবং ষাট হাজার শিষ্য সমন্বিত ঐ সময়ের একজন সম্মানিত পারমার্থিক পথ প্রদর্শক। তথাপি বৈষ্ণব দর্শনের প্রতি তাঁর অপরাধমূলক মনোভাব বা শাস্ত্রীয় ধারণা ছিল। যা শুদ্ধ ভক্তির বিরোধিতা করে। অথচ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সাথে সাক্ষাৎ হলে, তিনি সম্ভ্রম সহকারে মহাপ্রভুর হাত ধরে তাঁকে বসার আসন প্রদান করেন। তিনি ভগবানের সাথে মধুর সৌহার্দ্যপূর্ণ বাক্যালাপ করেন। তার ফল শ্রীল প্রভুপাদ আমাদের অবগত করেন
“শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রতি প্রকাশানন্দ সরস্বতীর এই সম্নানজনক ব্যবহার অত্যন্ত প্রশংসার যোগ্য। এই ধরনের ব্যবহারকে বলা হয় অজ্ঞাত-সুকৃতি। এভাবেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রকাশানন্দ সরস্বতীকে অজ্ঞাত-সুকৃতির দ্বারা পারমার্থিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আয়োজন করছিলেন, যাতে ভবিষ্যতে তিনি বৈষ্ণব সন্ন্যসীতে পরিণত হতে পারেন।” (চৈ.চ.আদি ৭/৬৫ তাৎপর্য)

ভক্তিই ভক্তির একমাত্র কারণ

বর্তমান যুগের অধিকাংশ লোক মৈত্রেয় অজামিল বা প্রকাশানন্দ সরস্বতীর মত প্রখ্যাত নাও হতে পারে কিন্তু তাদের সবার মধ্যে একটি সাধারণ বিষয় পরিলক্ষিত হয়, তা হল পারমার্থিক জীবন নিয়ে অপূর্ণ জ্ঞান বা হতে পারে এমনকি ভগবানের প্রতি বা যে সমস্ত ব্যক্তি জীবনের পরম উদ্দেশ্যকে গ্রহণ করেছেন তাঁদের প্রতি অপরাধমূলক মনোভাব পোষণ করা। এই ধরণের লোকেদের জন্য অজ্ঞাত-সুকৃতি হল ভগবৎ প্রদত্ত উপহার। সময়ের আবর্তে এধরণের সুকৃতির ব্যক্তিকে কোন সাধুর সঙ্গ ও নির্দেশনা গ্রহনের পথে পরিচালিত করে। আর এই একটি ইঙ্গিত ব্যক্তিকে অজ্ঞাত-সুকৃতি থেকে জ্ঞাত-সুকৃতি অর্থাৎ সচেতনভাবে ভক্তি সাধনের দিকে পরিচালিত করে। সেখান থেকে শ্রদ্ধা উদয় হয় এবং শ্রদ্ধার ফলে অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে।

সৌভাগ্যের উৎস কি?

কৃষ্ণভাবনামৃতের প্রতি শ্রদ্ধার উদয় হলে, এমনকি অনিচ্ছাকৃত ভক্তির দ্বারা এটি শুরু হলেও, অপ্রাকৃত জগতের দ্বার উন্মোচন হয় এবং প্রকৃত চেতনাময় আধ্যাত্মিক জীবনের সূচনা হয়। শ্রীল রূপ গোস্বামী এই একই নীতি অন্যভাবে পূর্ণনিবেদন করেন। শ্রীভক্তিরসামৃতসিন্ধুতে (১/২/১৪) তিনি বলেন, অতিভাগ্যের ফলে শ্রদ্ধার উদয় হয়। কিন্তু কেউ প্রশ্ন করতে পারে এই সৌভাগ্যের উৎস কি?
শ্রীল জীব গোস্বামী ও শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর উভয়েই তাঁদের ভাষ্যে এর উত্তর প্রদান করেন: মহান ভক্তের সঙ্গের ফলে এই অতিভাগ্যের উদয় হয়। সমস্ত জীব শুরুতে অজ্ঞাতসারে কৃষ্ণের কৃপা লাভ করে, যা কোনো সাধুর মাধ্যমে প্রাপ্ত হয় পরবর্তীতে যখন আমরা কৃষ্ণভাবনায় উন্নতি সাধন করি তখন প্রত্যক্ষ কৃপা লাভ করার সুযোগ হয়। প্রারম্ভিক পর্যায়ে আমাদের অজান্তে সাধুসঙ্গ দানের মাধ্যমে তাঁর কৃপা বর্ষণ করেন : সংক্ষেপে এই হল অজ্ঞাত সুকৃতি।
সেই প্রারম্ভিক ক্রিয়াটি আপাতদৃষ্টিতে জড় মনে হতে পারে অথবা পারমার্থিক বলতে আমরা যা বুঝি তার চেয়ে ভিন্ন হতে পারে। পুনশ্চঃ নিজের অজান্তে আমরা রাজপথে সংকীর্তনরত ভক্তদের মুখ থেকে হরিনাম শ্রবণ করে থাকতে পারি অথবা স্বাভাবিক সৌজন্যতাবশত কোনো ভক্তকে দরজা খুলে দিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারি। কিন্তু এই সাধারণ কর্মগুলো কি জড়? না। এ সব জড় নয়।
ভক্তি স্বতন্ত্র। ভক্তির কারণ কেবল ভক্তি এবং ভৌতিক কোন বস্তু সেই পরম পুরুষার্থ (ভক্তি) দানে সক্ষম নয়। তাই এই সমস্ত ক্ষুদ্র সুকৃতি চিন্ময় বলে পরিগণিত হবে। যেহেতু তা ভক্তির পথে পরিচালিত করে। শ্রীমদ্ভাগবতেও সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, কৃষ্ণভক্তি সম্পূর্ণ স্বাধীন (স্বরাট) কারণ কর্ম-জ্ঞানাদি নিকৃষ্ট বস্তু সমূহ থেকে ভক্তির উদয় হয় না। ভাগবতের একই শ্লোকে বলা হয়েছে, “দান, ব্রত, তপ, যজ্ঞ, জপ, বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ, সংযম কৃষ্ণ-ভক্তির পথে পরিচালিত করে” (শ্রীমদ্ভাগবত ১০/৪৭/২৪)। তাহলে এর তাৎপর্য কি? যদি ভক্তিই ভক্তির একমাত্র হেতু হয়, যদি ভক্তি অন্য কোন কিছুর উপর নির্ভর না করে, তাহলে কিভাবে এসব বিষয় এমনকি অজ্ঞাত-সুকৃতিও ভক্তির পথে পরিচালনা করে? এই প্রসঙ্গে শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর শ্রীমদ্ভাগবতের ১০/৪৭/২৪ টীকায় এবং অন্য কিছু জায়গায়ও উল্লেখ করেন যে, শ্রীমদ্ভাগবত ভক্ত্যুন্মুখী সুকুতির বিষয়ে আলোচনা করে, সাধারণ সুকৃতি বা সাধারণ পুন্যকর্ম নিয়ে নয়, যা কেবল এই জড় জগতেই সীমাবদ্ধ।
শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর প্রদত্ত শ্রীমদ্ভাগতের ভাষ্য লিখেছেন : সারার্থ দর্শিনীতে ও তার রচিত মাধুর্য্য কাদম্বিনী গ্রন্থে, এই শ্লোকের তাৎপর্যে এই বিষয়টি স্পষ্ট তুলে ধরেছেন। তিনি বর্ণনা করেন যে, শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণিত এসব বিষয়গুলো সাধারণ কোন পূণ্যকর্ম নয়, যা কর্মযোগের বিষয়। উপরন্তু, তা ভক্তির সূচনা। কেউ যখন ভগবদ্ভক্তের সংস্পর্শে আসে তখন তার প্রতিটি কর্ম চিন্ময স্তরে সম্পাদিত হয় যদিও ব্যক্তি সে সম্পর্কে উদাসীন থাকে। এটিই অজ্ঞাত-সুকৃতি।
লেখক পরিচিতি: সত্যরাজ দাস (স্টিভেন রোসেন) হলেন শ্রীল ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের একজন দীক্ষিত শিষ্য। এছাড়াও তিনি জার্নাল অব বৈষ্ণব স্টাডিস এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এবং ব্যাক টু গডহেড ম্যাগাজিনের সহ-সম্পাদক। তিনি ৩০টির ও বেশি কৃষ্ণভাবনাময় গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।

 


ব্যাক টু গডহেড অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০২১ প্রকাশিত

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।