এই পোস্টটি 1065 বার দেখা হয়েছে
জীব সুখের ভান করে
বৃন্দাবন ভজনের কবিতা রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে
কত ‘প্ল্যান’ করে তারা ভাল থাকিবারে প্রকৃতি ভাঙ্গিয়া দেয় সব বারে বারে।
“দৈবী হ্যেষা গুণময়ী ”ভগবানের মায়া। ‘ভাল থাকার’ অর্থ বুঝ ভাল করে ভায়া।
কেহ ‘ভাল’ নাই হেথা তবু ভাল বলে।এইভাবে মায়া সব বদ্ধজীবে ছলে ॥
ছলনায় ভুলি জীব সর্বদা মশগুল। মায়া লাগি মরে তবু ভাঙ্গে নাকো ভুল।
ভাল থাকার জন্য মানুষেরা কতই না পরিকল্পনা করে থাকে । কিন্তু প্রকৃতি দেবী সমস্ত পরিকল্পনা বারংবার ভেস্তে দেয় । দৈবী হ্যেষা গুণময়ী- জড়া প্রকৃতি হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিশেষ শক্তি। তাই, ভ্রাতা, তোমাকে বলছি যে জড় জগতে ভাল থাকার অর্থ ভালো করে বুঝে নাও। এই জড় জগতে কেউ ভালো নেই, তবুও তারা নিজেদের ভালো বলে দাবী করে। এই হচ্ছে মায়া, যা বদ্ধ জীবাত্মাদের বিভ্রান্ত করে । এভাবেই সে নিত্য দেহ ধারণ করে জন্ম মৃত্যুর চক্রে বারবার আবর্তিত হয়। এভাবে বিমোহিত হয়ে সে ভগবানের সেবা করার নিত্য আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয় এবং নিজে ইন্দ্রিয় তোষণে ব্যস্ত থাকে যদিও মৃত্যুর কঠিন নিগড়ে তাকে জীবন দিতেই হয় তবু সে অজ্ঞতায় মশগুল থাকে এবং তার মায়া ভাঙ্গে না । সেই কথাই শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে-
নিদ্রয়া হ্রিয়তে নর্ক্ত ব্যবায়েন চ বা বয়ঃ। দিবা চার্থেহয়া রাজন্ কুটুম্বভরণেন বা ॥
এ সমস্ত মায়াবদ্ধ জীবেরা নিদ্রামগ্ন হয়ে অথবা রতিক্রিয়ায় তাদের রাত্রি অতিবাহিত করে এবং আত্মীয় স্বজনদের প্রতিপালনের জন্য অর্থ উপার্জনের চেষ্টায় দিবাভাগের অপচয় করে । (ভা.-২/১/৩)
কর্মীরা যখন নিদ্রামগ্ন হয়ে অথবা রতিক্রিয়ায় মগ্ন হয়ে তাদের রাত্রি অতিবাহিত করে এবং অর্থ সঞ্চয়ের চেষ্টায় কঠোর পরিশ্রম করে তাদের জড় জাগতিক জীবনের মান উন্নত করার চেষ্টা করে, তখন তা দুর্লভ মনুষ্য জীবনের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয় । তাই শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর গেয়েছেন দেহ গেহ-কলত্রাদি-চিন্তা অবিরত।জাগিছে হৃদয়ে মোর বুদ্ধি করি হত॥
যাদের বুদ্ধি নষ্ট হয়েছে, তাদের সব সময় তার দেহ, পরিবার, পরিজন আত্মীয় স্বজন ইত্যাদির চিন্তায় সব সময় মগ্ন। ভগবদ্গীতায় ভগবান বলেছেন-
ধ্যায়তো বিষয়ান্ পুংসঃ সঙ্গস্তেষূপজায়তে।
সঙ্গাৎ সঞ্জায়তে কামঃ কামাৎ ক্রোধোহভিজায়তে ॥
ক্রোধাদ ভবতি সম্মোহঃ সম্মোহাৎ স্মৃতিবিভ্রম।
স্মৃতিভ্রংশাদ বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি ॥
এই বুদ্ধি নাশ তখনই যখন কেউ তার অনিত্য বস্তুর মোহে মোহিত হয়। তিনি আরো বলছেন যে,
গর্দভের মতো আমি করি পরিশ্রম। কা’র লাগি’এত করি, না ঘুচিল ভ্রম ॥
তাই শাস্ত্রে এ সমস্ত ব্যক্তিদের বলা হচ্ছে গর্দভ অর্থাৎ ভার বহনকারী পশু। কিসের ভার, সেটা বলা হচ্ছে-
দেহাপত্যকলত্রাদিস্বাত্মসৈন্যেস্বসৎস্বপি। তেষাং প্রমত্তো নিধনং পশ্যন্নপি ন পশ্যতি ॥ (ভা.-২/১/৪)
সেই পশু তার দেহ. দেহ সম্পর্কিত গৃহ, পুত্র. কন্যা, স্ত্রী, স্বজনদের প্রতিপালনের ভার বা বোঝা বহন করে । যদিও তার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও, সেই তার ‘নিধনম্’ অর্থাৎ তার প্রায় সম্পর্কে বিনাশ দর্শন করে না। জীবন হচ্ছে মৃত্যু প্রদানকারী প্রকৃতির বিরুদ্ধে এক প্রকার সংগ্রাম। মনুষ্য জীবন পাওয়ার ফলে জীব এই জীবন সংগ্রামের তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করার যোগ্যতা অর্জন করে; কিন্তু পরিবার, সমাজ, দেশ ইত্যাদির প্রতি অত্যন্ত অাসক্ত হয়ে সে তার দৈহিক শক্তি পুত্র, পত্নী, আত্মীয় স্বজন ইত্যাদির সাহায্যে অপরাজেয় জড়া প্রকৃতিকে জয় করতে চায় । তার পূর্ব পুরুষদের দেহাবসান দর্শন করার মাধ্যমে এই বিষয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করা সত্ত্বেও সে বুঝতে চায় না যে, তার পুত্র, আত্মীয়-স্বজন, সমাজ, দেশবাসী ইত্যাদি সকলেই এই মহাযুদ্ধে অসহায় সৈনিক মাত্র। এ সমস্ত ব্যক্তিদের শ্ববিড়ররাহোষ্ট্রখরৈঃ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বিশেষ করে এ শ্লোকে সে ব্যক্তিদের কুকুর, শূকর, উট এবং গর্দভের সমপর্যায়ভুক্ত করা হয়েছে। যেমন অধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলি শিক্ষা দিচ্ছে কুকুরোচিত মনোভাব অর্জন করে একজন প্রভুর সেবা স্বকিার করার। তথাকথিত শিক্ষা শেষ করে, বিদ্বান ব্যক্তি একশটি চাকরির আশায় কুকুরের মতো দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায় এবং অধিকাংশ চাকরী খালি নেই বলে তাদের দুর দুর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয় । কুকুর যেমন এক টুকরো রুটির জন্য প্রভুর দসত্ব করে, তেমনই সেই সমস্ত মানুষেরা উপযুক্ত পারিশ্রমিক ব্যতীত বিশ্বস্থভাবে তাদের প্রভুর সেবা করে।