ধর্ষণ: এক দুরারোগ্য সামাজিক ব্যাধি ও তার প্রতিকার

প্রকাশ: ৪ জানুয়ারি ২০২১ | ৭:০৭ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ৪ জানুয়ারি ২০২১ | ১১:৩২ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 449 বার দেখা হয়েছে

ধর্ষণ: এক দুরারোগ্য সামাজিক ব্যাধি ও তার প্রতিকার

দীপ্তি রায়(ছদ্ম নাম) কাজ শেষ করে গার্মেন্টস থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে ঘড়িতে তখন রাতের ৮টা বাজে। বাসার কাছে আসতেই দেখতে পেল সবাই তার ছোট্ট ৫ বছরের শিশুকে ঘিরে কি নিয়ে যেন বলাবলি করছে আর হায়হুতাশ করছে। কাছে গিয়ে দেখল, তার ৫ বছরের ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে দীপিকা রায় (ছদ্ম নাম) নিথর দেহ রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পরে আছে।  দূর্বৃত্তরা ধর্ষন করে ছোট্ট মেয়েটিকে হত্যা করে পলায়ন করেছে।

প্রতিদিন খবারের কাগজ খুললে এরকম ঘটনা প্রত্যহ আমরা পরিলক্ষণ করি। সব ঘটনা তো আর পত্রিকায় আসে না। এরকম প্রতিনিয়ত কত ৫ বছরের দীপিকা রায় থেকে শুরু করে ৮০ বছরের বৃদ্ধা কেউ রেহাই পাচ্ছে না এই ভয়াবহ দুরারোগ্য ব্যাধি ধর্ষণের হাত থেকে।

ধর্ষণর বিকৃত চিত্র: পত্রিকার শিরোনাম

– ৫০ বছরের নারীকে ধর্ষণ: বাস চালকের সহকারী গ্রেফতার
– ৭ বছরের শিশুকে ধর্ষন করলেন ৮৫ বছরের বৃদ্ধা
– ৪ বছরের শিশুকে ধর্ষনের স্বীকারোক্তি ৫০ বছর বয়সী অভিযুক্তের
– কিশোরী মেয়েকে ধর্ষনের অভিযোগে বাবা গ্রেফতার
– ৫ম শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষন করলেন ৬৫ বছরের বৃদ্ধ
– চিকিৎসা করতে গিয়ে ডাক্তারের হাতে লাঞ্চিত কলেজ ছাত্রী
– বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের হাতে ধর্ষনের পর কাজের মেয়ে খুন
– ছেলে ও স্বামীর সামনে গণ ধর্ষনের স্বীকার ৩ ছেলের মা।
পত্রিকা খুললেই এইভাবে নানা শিরোনাম এরকম ধর্ষনের খবর প্রতিনিয় প্রকাশিত হচ্ছে।

বাংলাদেশে ধর্ষনের কিছু পরিসংখ্যান:

বাংলাদেশ পুলিশ: ২০১৯ এ ৫ হাজার ৪০০ নারী এবং ৮১৫টি শিশু ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়। ২০১৯ সালে ধর্ষনের কারণে ১২ জন শিশু এবং ২৬ জন নারী মারা যায়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক): আসক-এর ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সারা দেশে ধর্ষনের ঘটনা আগের চেয়ে দ্বিগুণ বেড়েছে। গত বছর সারা দেশে ধর্ষন ও গণধর্ষনের শিকার ১ হাজার ৪১৩ নারী ও শিশু। ২০১৮ সালে সংখ্যাটি ছিল ৭৩২।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন: গত বছর ৯০২ শিশু ধর্ষনের শিকার হয়। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৫৬।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম: ২০১৯ সালে প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতি মাসে গড় ৮৪টি শিশু ধর্ষনের শিকার হচ্ছে। এ ছাড়া ১ বছরে যৌন নির্যাতন বেড়েছে ৭০ শতাংশ। গত বছর যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ১ হাজার ৩৮৩ শিশু। ২০১৮ সালের চেয়ে গত বছর শিশু ধর্ষণ ৭৬ দশমিক শূণ্য ১ শতাংশ বেড়েছে।

মহিলা পরিষদ: ২০১৯ সালে, ৪ হাজার ৩২২ জন নারী ৩ কন্যা শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধর্ষনের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৭০৩ জন। ধর্ষনের চেষ্টা করা হয়েছে ২৪৫ জনকে। অপহরণে শিকার হয়েছে ১৪৭ জন। নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে ২৬৪ জন।

বিশ্লেষকদের ধর্ষন সম্পর্কে মতামত: সমাজের বিজ্ঞ, প্রথিতযশা, বিশ্লেষকরা ব্যাখা হিসেবে ধর্ষনের জন্য অনেকগুলো কারণকে দায়ী করেছে।

ভোগবাদী শিক্ষা ব্যবস্থা 

স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তা শুধু মাত্র ভাল করে টাকা উপার্জন করে জীবনকে কীভাবে ভাল করে উপভোগ করা যায়। তার শিক্ষা মাত্র। মানুষের জীবনকে উন্নত ভাবধারায় ভাবিত করে সুনিয়ন্ত্রিত, মূল্যবোধপরায়ণ উন্নত সৎ চরিত্রবান হওয়ার যে শিক্ষা তা বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাই লামা বলেছেন, ”We have more degrees, but less sense; more knowledge, but less judgment; tall man but short character; We have become long on quantity, but short on quality”

বর্তমানে এমন চেতনা ও ভাব ধারায় ছাত্র-ছাত্রীরা বড় হচ্ছে যে, তাদের মনোভাব হচ্ছে যত বেশি অর্থ, পদবী, সম্পদ, অনুগামী বাড়ানো যাবে, তত বেশি জীবনে সুখী হওয়া যাবে। পাশ্চাত্য দেশকে অনুকরণ করতে গিয়ে আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি,

তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাই লামা বলেছেন, ”We have more degrees, but less sense; more knowledge, but less judgment; tall man but short character; We have become long on quantity, but short on quality”

সংস্কৃতি হারিয়ে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা ভোগবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

পাশ্চাত্য সংস্কৃতি প্রভাব

বিশেষত ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইট চ্যানেল আমাদের উপকার যেমন করেছে ক্ষতি করেছে তার চেয়ে অধিক। বিশেষ গুয়া মনে করেন ছোট বেলা থেকে শিশুরা এমন সব ভিডিও, চলচ্চিত্র, অনুষ্ঠান দেখে বড় হচ্ছে। যেখানে তারা শিখছে কিভাবে নারীকে ভোগ বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। প্রত্যেকটা বিজ্ঞাপনে নারীকে উপস্থাপন করা হচ্ছে, বিভিন্ন অনুষ্ঠান যেমন ক্রিকেট, ফুটবল খেলাতে নারীদের দিয়ে নাচানো হচ্ছে। ইন্টারনেট থেকে যেকোনো কেউ অবাধে যেকোনো রকম খারাপ চলচ্চিত্র ও ভিডিও দেখতে পারছে। পাশ্চাত্য দেশীয়দের অনুকরণ করতে গিয়ে বর্তমান ছেলে-মেয়েরা অশ্লীল পোশাক, নেশা, অবাধ মেলামেশা করে নিজেদের আধুনিক বলে জাহির করার চেষ্টা করছে।

ধর্মীয় চেতনা শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাব

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রকৃত শিক্ষা হচ্ছে উন্নত চরিত্র, মূল্যবোধ ও সুনিয়ন্ত্রিত, ভদ্র জীবনশৈলী গঠনের শিক্ষা। আর এ শিক্ষা পাওয়া যায়, পরিবার সমাজ ব্যবস্থা ও ধর্মীয় অনুশাসন থেকে। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক স্রোতের জোয়ারে ভাসতে গিয়ে মানুষ জন্য এখন ধর্মকে ততটা গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করছে না। মানুষজন এখন জড় বিষয় ও জাগতিক উন্নতির চিন্তায় এত বেশি মগ্ন ও ব্যস্ত যে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে জীবনশৈলী গঠন করা তাদের নিকট চ্যালেঞ্জিং। অন্য নারীদের মা রূপে দর্শন, বোন রূপে বিবেচনা করা, সকলের কষ্টকে নিজের কষ্ট বলে মনে করা। অন্যের ক্ষতি না করা। সবাইকে দয়া করা, বিনয়, করুণা, উদারতা এ সমস্ত গুণগুলো গড়ে ওঠে যখন কেউ ধমীয় অনুশাসন গুলো যথার্থভাবে মেনে চলে। বর্তমানে এ সমস্ত শিক্ষার অভাবে, গুণগুলো আর পরিলক্ষিত হচ্ছে না তাই মানুষেরা ধর্ষন, খুন, আরাজকতা, উদ্বেগ দিচ্ছে অন্যদেরকে।

ধর্ষণ সমাধানে বিভিন্ন আইন, শাস্তি, কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

ধর্ষনের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হচ্ছে- মাননীয় আইনমন্ত্রী। নোয়াখালীতে কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া গণধর্ষণের অভিযোগে সারাদেশব্যাপী প্রতিবাদ সভা, মিছিল, আন্দোলন এর ঝড় বয়ে যায়। বিদ্যমান নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ৯(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ধর্ষনের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ২০২০-এর ১২ অক্টোবর মন্ত্রিসভার বৈঠকে খসরা বিলটি উপস্থাপন করা হয় এবং এতে ধর্ষনের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হিসেবে ধার্য করা হয়। এত আইন, শাস্তি, মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পরেও কি ধর্ষন বন্ধ হবে? ধর্ষন হয়েছিল, এখনো হচ্ছে। প্রতিদিনের পত্রিকায় তার প্রমাণ মিলে। যদি এভাবে ধর্ষনের সমাধান করা না যায়, তাহলে ধর্ষনের প্রকৃত সমাধান কি নেই?

আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোন থেকে ধর্ষনের কারণ ও সমাধান

ধর্ষন মানে আমরা জানি, যখন কোনো পুরুষ, বিবাহিত বা অবিবাহিত কোনো মেয়ের সাথে জোরপূর্বক যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হয় তখন তাকে বলা হয় ধর্ষন। ধর্ষণ যে করে তাকে বলা হয় ধর্ষক। কখন একজন মানুষ ধর্ষন করে? উত্তর হচ্ছে, যখন কোন পুরুষ তার যৌনবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। কাম বা যৌন বাসনা চরিতার্থ করতে উন্মত্ত হয় তখন সে বৈধ বা অবৈধভাবে সে বাসনা চরিতার্থ করতে চাই। তাহলে যারা কামের দ্বারা তাড়িত এবং কামকে দমন করতে পারছে না তারাই ধর্ষন করছে। তার মানে, ধর্ষনের মূলে রয়েছে ‘কাম’।

ধর্ষণ হল কামের উন্মত্ততার চরম প্রকাশ

ধর্ষণ কেন করে এবং এর সমাধান জানতে হলে। আগে ‘কাম কি? কাম কোথায় থাকে? কামের প্রভাব কি? কাম থেকে মুক্তির উপায় কি?’ এসব ব্যাপারে জানতে হবে।

কামের সংজ্ঞাঃ আত্মইন্দ্রিয় প্রীতিবাঞ্ছা তারে বলি কাম।
                     কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতিবাঞ্ছা ধরে প্রেম নাম॥
কৃষ্ণের প্রীতি বিধান ছাড়া বদ্ধ জীব যখন নিজের ইন্দ্রিয় তর্পনে মগ্ন হয় তখন তাকে কাম বলা হয়। যৌনবাসনা চরিতার্থ করা হচ্ছে কামের চরম প্রকাশ।

কামের আশ্রয়স্থলঃ ইন্দ্রিয়সমূহ, মন ও বুদ্ধি এই কামের আশ্রয়স্থল। এই ইন্দ্রিয় আদির দ্বারা কাম জীবের পূর্ব জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে তাকে বিভ্রান্ত্র করে। প্রকৃত জ্ঞান বা প্রকৃত স্বরূপ হচ্ছে আমরা সবাই কৃষ্ণের নিত্য দাস, কিন্তু কামের দ্বারা প্রকৃত জ্ঞান আবৃত হয়ে যায় এবং আমরা নিজেদেরকে ভোক্তা ভাবতে শুরু করি।

চিরশত্রু কামঃ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যিনি আমাদের সকলের পরম পিতা তিনি বলেছেন কাম হচ্ছে চিরশত্রু।

“কাম এষ ক্রোধ এষ রজোগুণসমুদ্ভৎ।
মহাশনো মহাপাপ্ন, বিদ্ব্যেনমিহ বৈরিণম।”

অনুবাদ: পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে অর্জুন রজোগুণ থেকে সমুদ্ভত কামই মানুষকে এই পাপে প্রবৃত্ত করে এবং এই কামই ক্রোধে পরিণত হয়। কাম সর্বগ্রাসী ও পাপাত্মক, কামকেই জীবের প্রধান শত্রু বলে জানবে।

কামের প্রভাব, কাম কিভাবে সর্বগ্রাসী

কাম চরিতার্থ হলে লোভ আসে। কাম চরিতার্থ না হলে ক্রোধ আসে। কামের অন্যতম একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটা চিরঅতৃপ্ত। উপভোগ করে কখনো কামবাসনা নিঃশেষ করা যায় না। তাই শ্রীমদ্ভাগবতে (৯/১৮/১৪) বলা হয়েছেঃ ”অগ্নিতে ঘি ঢালার ফলে যেমন সেই আগুন কখনো নেভানো যায় না, পক্ষান্তরে তা ক্রমশ বর্ধিত হতে থাকে। ঠিক তেমনই কাম্য বস্তুর উপভোগের দ্বারা কখনও কামনার নিবৃত্তি সাধন করা যায় না। প্রকৃতপক্ষে স্বেচ্ছায় ভোগবাসনা ত্যাগ করতে হবে।”
কাম চিরঅতৃপ্ত, তাতে কেউ তৃপ্ত হতে পারে না। তা পুরুষের দুর্দমনীয় শত্রু। তাই কামান্ধ পুরুষ উন্মত্ত, পাগল। তাকে জয় করার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন “জহি শত্রুং, কামরূপং দূরাসদম।” অর্থ্যাৎ কামরূপ দুর্জয় শত্রুকে জয় করা। শ্রীমদ্ভাগবতে (৫/৫/৭) ভগবান ঋষভদেব তার পুত্রদেরকে বলেছেন- “অর্থাৎ জ্ঞানবান হওয়া সত্ত্বেও জীব যতক্ষণ ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের চেষ্টাকে অনর্থ বলে উপলব্ধি না করে, ততক্ষণ তার স্বরূপ বিস্মৃতির ফলে সে মৈথুন সুখপ্রধান গৃহের প্রতি আসক্ত থাকে।” এবং নানা প্রকার দুঃখ-দুর্দশা ভোগ করে, তার অবস্থা একটি মূর্খ পশুর থেকে কোন অংশে শ্রেয় নয়। পুনরায় তিনি (৫/৫/৪) বলেছেন, ”অর্থাৎ জীব যখন ইন্দ্রিয় সুখ ভোগকেই জীবনের চরম লক্ষ্য বলে বিবেচনা করে তখন সে অবশ্যই জড়-জাগতিক জীবনের প্রতি উন্মত্তের মতো আসক্ত হয়ে নানা প্রকার পাপকর্মে প্রমত্ত হয়।”

জড় জগতে বন্ধনের মূল কাম

এই জড় জগতের অনেক নাম রয়েছে, তার মধ্যে ১টি নাম হচ্ছে মৈথুনাগার। এ জগতে বন্ধনের মূল কারন হচ্ছে, মৈথুন বা যৌন বাসনা, তাই ভাগবতে (৫/৫/৮) বলা হয়েছে, ”স্ত্রী ও পুরুষের পরস্পরের প্রতি আকর্ষন জড় জাগতিক জীবনের ভিত্তি, এই ভ্রান্ত আসক্তিই স্ত্রী পুরুষের পরস্পরের হৃদয়গ্রন্থি স্বরূপ এবং তার ফলেই জীবের দেহ, গৃহ সম্পত্তি, সন্তান, আত্মীয়-স্বজন ও ধন সম্পদাদিতে আমি এবং আমার বুদ্ধিরূপ মোহ উৎপন্ন হয়।”

যযাতি মহারাজের নিষ্কপট স্বীকারোক্তি

যযাতি মহারাজ শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানীকে বিবাহ করেছিলেন। বিবাহের পর বহু বছর যাবৎ দেবযানীকে তিনি উপভোগ করেছিলেন। একসময় দেবযানী যখন জানতে পারলেন যযাতি মহারাজ, দাসী শর্মিষ্ঠার গর্ভে পুত্র উৎপাদন করেছেন তখন সে যযাতি মহারাজকে ত্যাগ করে বাপে বাড়ি চলে যায়। ঘটনা শুনে শুক্রাচার্য যযাতি মহারাজকে অভিশাপ দেন যে তিনি বৃদ্ধ জরাগ্রস্থ হবেন। পরে আবার যযাতি ক্ষমা চাইলে শুক্রাচার্য বলল তার কোনো ছেলে যদি তার সাথে যৌবন বিনিময় করে তাহলে সে আবার যৌন সুখ উপভোগ করতে পারবে। যযাতি সব ছেলেকে যৌবন দিতে বললো কিন্তু কেউ দিতে রাজি হল না। শেষে তার এক ছেলে বাবার জরা অবস্থা গ্রহণ করার পর তার নিজের যৌবন বাবাকে দান করল। যযাতি মহারাজ যৌবন ফিরে পেয়ে আরো অনেক বছর যাবৎ যৌন সুখ উপভোগ করার পরও তৃপ্ত হতে পারল না তাই তিনি পরে বুঝতে পেরে উপদেশ দিয়েছেন। শ্রীমদ্ভাগবত (৯/১৯/১৬) ”যারা ভৌতিক সুখ সম্ভোগের প্রতি অত্যন্ত আসক্ত, তাদের পক্ষে ইন্দ্রিয়সুখ পরিত্যাগ করা অত্যন্ত কঠিন, এমন কি ব্যক্তি বদ্ধাবস্থা প্রাপ্ত হয়ে অকর্মন্য হয়ে গেলেও সে এই ইন্দ্রিয় সুখ কামনা পরিত্যাগ করতে পারে না। তাই যিনি প্রকৃতই সুখাভিলাষী, তাঁর অবশ্য কর্তব্য সমস্ত দুঃখ দুর্দশার কারণ স্বরূপ এই সমস্ত অতৃপ্ত বাসনা ত্যাগ করা।”

পুরুরবার পাগলামো

পুরুরবার ছিলেন সসাগরা পৃথিবীর একচ্ছত্র সার্বভৌম সম্রাট, যদিও তিনি অত্যন্ত যশস্বী সার্বভৌম সম্রাট ছিলেন, তবুও তিনি কামরূপ এই দুর্জয় শত্রুর বশীভূত হয়েছিলেন। যার ফলে তিনি স্বর্গের অপ্সরা উর্বশীর সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ঘটনাটি হল এই যে, একদিন দেবরাজ ইন্দ্রের সভায় দেবর্ষি নারদের মুখে পুরুরবার রূপ, গুণ, যশ, বিক্রমাদির কথা শ্রবণ করে উর্বশী কামবানে পীড়িতা হয়ে স্বর্গ হতে নেমে এসে তাঁর কাছে গিয়েছিলেন এবং তাঁকে মোহিত করে নিজের বশীভূত করেছিলেন। যশস্বী সম্রাট পুরুরবা উর্বশীর হাতের ক্রীড়ামৃগে পরিণত হয়ে শতশত বছর ধরে তাকে উপভোগ করেছিলেন। তবুও তিনি তৃপ্ত হতে পারেন নি। তিনি যে ১ জন মহান সম্রাট, একজন বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন, তাও বিস্মৃত হয়েছিলেন। যখন উর্বশী তাকেঁ পরিত্যাগ করে চলে যাচ্ছিল, তখন পুরুরবা নির্লজ্জ হয়ে নগ্ন অবস্থায় একজন পাগলের মতো ক্রন্দন করতে করতে তার পিছনে ধাবিত হয়েছিলেন। এমনকি তিনি যে বিবস্ত্র অবস্থায় ছিলেন তাও তিনি জানতেন না। তিনি সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় উর্বশীর পিছু পিছু অত্যন্ত বিষন্ন বদনে অনুসরণ পূর্বক ক্রন্দন করতে করতে বললেন, ”হে প্রিয় পত্নী উর্বশী, অনুগ্রহ করে আমাকে ছেড়ে যেও না, আমাকে ত্যাগ করা তোমার উচিত নয়।” পরবর্তীতে তিনি যখন আত্মসচেতন হলেন তখন তিনি স্বয়ং ব্যক্ত করেছিলেন (১১/২৬/৭-৯)।
”হায়! আমি কত গভীর মোহে আচ্ছন্ন হয়েছিলাম। এই দেবী আমায় আলিঙ্গন করে আমার গলদেশ তার কবলে রেখেছিল। আমার হৃদয় কামবাসনার দ্বারা এতই কলুষিত হয়েছিল যে, কীভাবে আমার জীবন অতিবাহিত হচ্ছে সে সম্বন্ধে কোন ধারনাই ছিলো না। সেই রমনী আমাকে এমনইভাবে প্রভাবিত করেছে। যে আমি সূর্যোদয় অথবা সূর্যাস্ত ও লক্ষ্য করিনি। হায়! বহু বছর ধরে আমি আমার দিনগুলি বৃথা অতিবাহিত করেছি। হায়! আমি একজন মহান সম্রাট, বিশ্বের সমস্ত রাজাদের মুকুটমনি হয়েও মোহ আমাকে কীভাবে রমনীর হাতের ক্রীড়ামৃগে পরিণত করছিল।”

কামরূপ দুর্জয় শত্রুকে সমাধানের উপায়

ভগবান গীতায় (৩/৪৩) শ্লোকে বলেছেন, ”হে মহাবীর অর্জুন! নিজেকে জড় ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধির অতীত জেনে নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধির দ্বারা মনকে স্থির কর এবং এভাবেই চিৎ শক্তির দ্বারা কামরূপ দুর্জয় শক্রকে জয় কর।”

জেনে, শুনে, দেখে ও পাপ কর কেন?

চোর জানে, চুরি করলে জেলে যেতে হবে। সে শুনেছে, সে দেখেছে যারা চুরি করছে তারা জেলে গিয়ে শাস্তি পেয়েছে। চোর নিজে চুরিতে ধরা খেয়ে মার খাওয়ার পরও আবার চুরি করে তার কারণ কি? তার অন্তরটা শুদ্ধ নয়। তার হৃদয় কলুষে ভরা। তাই হাজার হাজার নিয়ম কানুন আর আইন বিধি শাস্তি দিয়ে হৃদয় শোধরানো যাবে না। ঠিক যেমন বাচ্চা শিশুর মতো। মা-বাবা প্রতিদিন বলছেন, বাছা, এটা করোনা। ওটা দুষ্টমি। কিন্তু তবুও সে তাই করে, ঠিক কুকুরের মতো, পশুর মতো। কারণ, অন্তরটা তাদের শুদ্ধ নয়। সে শুদ্ধ গুনটুকু তাদের অন্তরে নেই।

হস্তীস্নানের কি মূল্য!

হাতি নদীতে গিয়ে স্নান করে এসে। আবার ধূলোতে গড়াগড়ি করে। তাহলে স্নানের মূল্যটা রইল কি? একইভাবে পাপের শাস্তি, প্রায়শ্চিও করার পর আবার আমরা পাপকার্যে লিপ্ত হচ্ছি তাহলে এই প্রায়শ্চিত্তের শাস্তির মূল্যটা কই?

হৃদয়ের পরিশুদ্ধি আসল সমাধান

শ্রীমদ্ভাগবতে (৬/১/১৫) বলা হয়েছে, ”সেই সব বিরল শুদ্ধ ভক্তরা যাঁরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অহৈতুকী ভক্তিমূলক সেবায় নিযুক্ত হয়েছেন, কেবল তাঁরাই তাঁদের সমস্ত পাপ-বাসনাকে এমনভাবে নির্মূল করতে সক্ষম যে, তাদের আর পুনর্জাগরিত হওয়া সম্ভাবনা থাকে না। শুধুমাত্র ভক্তিমূলক সেবা সম্পাদনের মাধ্যমেই তিনি তা করতে পারেন, ঠিক যেমন সূর্য তার রশ্মিচ্ছটায় তৎক্ষণাৎ কুয়াশাকে দূর করতে পারে।”
কেবল ভক্তিই সকল রূপ ও পাপ বাসনাকে সম্পূর্ণরূপে ধংস করে। তাই অন্তর পরিশোধন করার একমাত্র পন্থা হল কৃষ্ণভাবনামৃত। একজন সৎ মানুষ এবং একজন অপরাধীর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে যে, একজনের হৃদয় পবিত্র এবং অন্যজনের হৃদয় কলুষিত। হৃদয়ে অদম্য কাম এবং লোভ, যা ১টি রোগের মতো তা আজকাল মানুষের মধ্যে ক্রমেই বেড়ে চলেছে এবং তাই অপরাধও বেড়ে চলেছে। মানুষ যখন এই সমস্ত কলুষ থেকে মুক্ত হয় তখন আর অপরাধ থাকে না। পবিত্র হওয়ার সবচাইতে সহজ পন্থা হচ্ছে সমবেতভাবে ভগবানের নাম কীর্তন করা। তাকে বলা হয় সংকীর্তন এবং সেটিই হচ্ছে আমাদের কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনের ভিত্তি। ভগবানের দিব্য নামের এই সংকীর্তন সকলের হৃদয়ের সমস্ত কলুষ দূর করে। তখন আর কোন অপরাধ থাকবে না।

কামকে কৃষ্ণপ্রেমে রূপান্তর

শ্রীমদ্ভাগবতে (৪/২২/৩৯) বলা হয়েছে, ”যে সমস্ত ভক্তরা নিরন্তর ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের অঙ্গুষ্ঠির সেবায় যুক্ত হয়েছেন, তাঁরা অনায়াসে সকাম কর্মের বাসনাস্বরূপ গ্রন্থির বন্ধন থেকে মুক্ত হন। যেহেতু তা অত্যন্ত দুঃসাধ্য, তাই জ্ঞানী ও যোগী আদি অভক্তরা ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের বৃত্তি রোধ করার কঠোর চেষ্টা করা সত্ত্বেও সফল হতে পারে না। তাই আপনাকে উপদেশ দেওয়া হচ্ছে, বসুদেবের তনয় শ্রীকৃষ্ণের প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত হোক।”
তাই এই কামকে জয় করার একমাত্র উপায় হচ্ছে দিন-রাত ২৪ ঘন্টা কায়-মনো-বাক্যে এবং সমস্ত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত হওয়া।

গোপীদের পদাঙ্ক অনুসরণ

গোপীদের ইন্দ্রিয় সুখভোগের বাসনাজাত কোন রকম কাম ভাব ছিল না। তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল দিনরাত ২৪ ঘন্টা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রীতি সাধন করা।

সর্বত্যাগ করে কৃষ্ণের ভজন
কৃষ্ণ সুখহেতু করে প্রেম-সেবন
ইহাকে কহিয়ে কৃষ্ণে দৃঢ় অনুরাগ
স্বচ্ছ ধৌতবস্ত্রে যৈছে নাহি কোন ত্যাগ
অতএব গোপীগণের নাহি কামগন্ধ
কৃষ্ণসুখ লাগি মাত্র, কৃষ্ণ সে সম্বন্ধ,
আত্ম সুখ-দুঃখে গোপীর নাহিক বিচার
কৃষ্ণ সুখ হেতু চেষ্টা মনো ব্যবহার
কৃষ্ণ লাগি আর সব করে পরিত্যাগ
কৃত্য সুখ হেতু করে শুদ্ধ অনুরাগ।

 যারা গোপীকাদের মত কৃষ্ণকে শরণ গ্রহণ করতে পারবেন তারাই একমাত্র এই দুর্জয় শত্রু কামকে জয় করতে পারবেন।

ধর্ষনের চির বিদায়

এইভাবে সাধুসঙ্গ, কৃষ্ণ কথা শ্রবণ, কৃষ্ণ নাম জপ, ইন্দ্রিয় দিয়ে কৃষ্ণের সেবা করা। কৃষ্ণের প্রীতি বিধানার্থে কেউ যদি সবকিছু সম্পাদন করে তাহলে শুধু ধর্ষণ কেন? সমস্ত অপরাধ, খুন, চুরি, যুদ্ধ, মারামারি, লোভ সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কেউ যখন প্রকৃতই ভক্তি যাজন করবে তিনি তখন হৃদয়ের সমস্ত কলুষ থেকে মুক্ত হচ্ছেন এবং তিনি সর্বদা এমন কার্য করতে ব্রতী হবেন যা সকলের জন্য মঙ্গলদায়ক। তাই, বেশি করে কৃষ্ণভাবনামৃতের প্রচার, প্রসার, গ্রন্থ বিতরণ, হরিনাম সংকীর্তন, প্রসাদ বিতরণ, মন্দিরে গিয়ে বিগ্রহ দর্শন, নাম সংকীর্তনে অংশগ্রহণ করবে। যার মাধ্যমে জনগণকে যত ভগবদ্মুখী করা যাবে ততই সমাজ থেকে ধর্ষনের মত দুরারোগ্য সমস্ত ব্যাধি দূরীভূত হবে

মাসিক চৈতন্য সন্দেশ ডিসেম্বর ২০২০ সংখ্যা

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।