কৃষ্ণভাবনার অমৃত আস্বাদন করুন

প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৩ | ৭:৪৬ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৩ | ৭:৪৬ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 73 বার দেখা হয়েছে

কৃষ্ণভাবনার অমৃত আস্বাদন করুন

‘লন্ডন টাইমস’ পত্রিকার সাংবাদিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে অংশবিশেষ


সাংবাদিক: আমরা লক্ষ্য করেছি যে, আগের থেকে অনেক বেশী মানুষ এখন পারমার্থিক জীবনের অন্বেষণ করছে। আপনি বলতে পারেন তার কারণটা কি?
শ্রীল প্রভুপাদ: পারমার্থিক জীবনের বাসনা সকলের একটি স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা । আমরা চিন্ময় জীবাত্মা, তাই জড় পরিবেশে আমরা সুখী হতে পারি না। আপনি যদি একটা জলের মাছকে ডাঙায় তুলে আনেন তা হলে কি সে সুখী হবে? তেমনই পারমার্থিক চেতনা ব্যতীত আমরা কখনই সুখী হতে পারি না । আজ কত মানুষ বৈজ্ঞানিক প্রগতি এবং অর্থনৈতিক উন্নতির পিছনে ধাবিত হচ্ছে, কিন্তু তারা সুখী নয়; কেননা সেগুলি মানব- জীবনের চরম লক্ষ্য নয়। বহু অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা সেটা বুঝতে পারছে এবং তাই তারা বৈষয়িক জীবন বর্জন করে পারমার্থিক জীবনের অন্বেষণ করছে। প্রকৃতপক্ষে, এটিই হচ্ছে যথার্থ অনুসন্ধান। কৃষ্ণভাবনামৃত হচ্ছে জীবনের যথার্থ লক্ষ্য । যতক্ষণ না মানুষ কৃষ্ণভাবনার অমৃত গ্রহণ করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে সুখী হতে পারে না। সেটা বাস্তব সত্য। তাই আমরা সকলকে আহ্বান জানাই এই মহান আন্দোলন সম্বন্ধে অধ্যয়ন করে সেই সম্বন্ধে অবগত হওয়ার জন্য।
সাংবাদিক: সত্যি কথা বলতে কি, যে ব্যাপারটি আমাকে বিচলিত করে তা হচ্ছে- কিছুদিন আগে একজন ভারতীয় যোগীর ইংল্যান্ডে আসার পর, যে ছিল এখানে প্রথম ‘গুরু’-হঠাৎ অসংখ্য গুরুর আমদানি হতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় যে তারা সকলে খাঁটি নয়। যে সমস্ত মানুষ পারমার্থিক জীবন সম্বন্ধে আগ্রহী, তাদের কি সাবধান করে দেওয়া উচিত যে তারা যেন যথার্থ শিক্ষালাভের জন্য যথার্থ গুরু যাচাই করে নেয়?
শ্রীল প্রভুপাদ: হ্যাঁ। গুরুর সন্ধান করা খুবই ভাল, কিন্তু আপনি যদি একজন সস্তা গুরু চান, অথবা যদি প্রতারিত হতে চান, তা হলে আপনি অনেক প্রতারক গুরু পাবেন। কিন্তু আপনি যদি ঐকান্তিক হন, তা হলে আপনি ঐকান্তিক গুরু পাবেন। যেহেতু মানুষ সবকিছুই খুব সস্তায় পেতে চায়, তাই প্রতারিত হচ্ছে। আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের অবৈধ স্ত্রী-সঙ্গ, মাংসাহার, জুয়া, পাশা ইত্যাদি খেলা এবং মাদক দ্রব্য বর্জন করতে নির্দেশ দিই। মানুষ মনে করে যে সেটা ভীষণ কঠিন-একটা অনর্থক ঝামেলা। কিন্তু কেউ এসে যদি বলে, “তোমরা যত সমস্ত অপকর্ম করে চলেছ সেগুলো সব করে যাও, কেবল আমার থেকে মন্ত্র নাও,” তা হলে মানুষ তাকে খুব পছন্দ করবে। আসল কথা হচ্ছে, মানুষ প্রতারিত হতে চায় তাই প্রতারকেরা আসে। কেউই কষ্ট স্বীকার করতে চায় না। মানব জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে কষ্ট স্বীকার করা-তপশ্চর্যা পালন, কিন্তু সেই তপশ্চর্যা পালনে কেউই প্রস্তুত নয়। তাই প্রতারকেরা এসে বলে, “তপশ্চর্যার প্রয়োজন নেই, তোমার যা ইচ্ছা তাই করে যাও। কেবল আমাকে কিছু টাকা দাও, আমি তোমাকে একটা মন্ত্র দেব, আর ছয় মাসের মধ্যে তুমি ভগবান হয়ে যাবে।” এইসব হচ্ছে, আপনি যদি এভাবে প্রতারিত হতে চান, তা হলে প্রতারকেরা আসবেই ।
সাংবাদিক: যে মানুষ ঐকান্তিকভাবে পারমার্থিক জীবনে আগ্রহী, কিন্তু ঘটনাক্রমে প্রতারক গুরুর পাল্লায় পড়েছে, তার কি হবে?
শ্রীল প্রভুপাদ: আপনি যদি সাধারণ ভিক্ষা লাভ করতে চান, তা হলে আপনাকে সেজন্য কত সময় দিতে হয়, কত পরিশ্রম, কত প্রচেষ্টা করতে হয়। তেমনই, আপনি যদি পারমার্থিক জীবন গ্রহণ করতে চান, তা হলে আপনাকে ঐকান্তিক হতে হবে। কোন মন্ত্রের প্রভাবে কোন মানুষ কিভাবে ছয় মাসের মধ্যে ভগবান হয়ে যেতে পারে? মানুষ কেন সেই ধরনের কিছু প্রত্যাশা করে? তার অর্থ হচ্ছে যে তারা প্রতারিত হতে চায়।
সাংবাদিক: মানুষ কিভাবে বুঝতে পারবে যে কে যথার্থ গুরু?
শ্রীল প্রভুপাদ: আমার কোন শিষ্য কি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে?
জনৈক শিষ্য: আমার মনে আছে একবার জন লেনন আপনাকে প্রশ্ন করেছিল, “আমি কিভাবে বুঝব কে প্রকৃত গুরু?” এবং আপনি তখন উত্তর দিয়েছিলেন, “খুঁজে দেখ কে কৃষ্ণের প্রতি সব চাইতে বেশি আসক্ত । তিনি হচ্ছেন যথার্থ গুরু।”
শ্রীল প্রভুপাদ: হ্যাঁ। যথার্থ গুরু হচ্ছেন ভগবানের প্রতিনিধি এবং তিনি ভগবানের কথা ছাড়া অন্য কিছু বলেন না। প্রকৃত গুরু হচ্ছেন তিনি, যাঁর জড়-জাগতিক কোন বিষয়ের প্রতি কোন আকর্ষণ নেই। তিনি কেবল ভগবানের প্রতি আসক্ত। সেটি যথার্থ গুরুর একটি লক্ষণ ব্রহ্মনিষ্ঠম। তিনি পরম তত্ত্বে সম্পূর্ণভাবে মগ্ন। মুণ্ডক উপনিষদে বলা হয়েছে, শ্রোত্রিয়ং ব্রহ্মনিষ্ঠম্—“প্রকৃত গুরু বৈদিক শাস্ত্র জ্ঞানে অভিজ্ঞ, এবং তিনি সর্বতোভাবে ভগবানের উপর নির্ভরশীল ।” তিনি জানেন ব্রহ্ম কি এবং কিভাবে ব্রহ্মে অধিষ্ঠিত হতে হয়। এই সমস্ত লক্ষণগুলি বৈদিক শাস্ত্রে দেওয়া হয়েছে। যে কথা আমি আগেই বলেছি, প্রকৃত গুরু হচ্ছেন ভগবানের প্রতিনিধি । তিনি ভগবানের প্রতিনিধিত্ব করেন, ঠিক যেভাবে রাষ্ট্রদূত রাজার প্রতিনিধিত্ব করেন। প্রকৃত গুরু তাঁর মনগড়া কিছু তৈরি করেন না। তিনি যা বলেন, তা সবই শাস্ত্র এবং পূর্বতন আচার্যদের বাণীর পুনরাবৃত্তি। তিনি কখনও কাউকে একটা মন্ত্র দিয়ে বলবেন না যে আপনি ছয় মাসের মধ্যে ভগবান হয়ে যাবেন। সেটা গুরুর কাজ নয়। গুরুর কাজ হচ্ছে সকলকে ভগবানের ভক্ত হতে অনুপ্রাণিত করা। সেটিই হচ্ছে গুরুর আসল কর্তব্য। প্রকৃতপক্ষে তাঁর আর কোন কাজ নেই । যার সঙ্গেই তাঁর সাক্ষাৎ হয় তাকেই তিনি বলেন, ‘দয়া করে ভগবৎ চেতনাসম্পন্ন হোন।’ তিনি যদি যে কোন ভাবে ভগবানের বাণী প্রচার করেন এবং সকলকে ভগবানের ভক্ত হতে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেন, তা হলে তিনিই হচ্ছেন যথার্থ গুরু । খ্রিস্টান, মুসলমান, হিন্দু-তিনি যাই হন না কেন, তাতে কিছু যায় আসে না। তিনি যদি কেবল ভগবানের প্রতিনিধিত্ব করেন, তা হলেই তিনি গুরু। এখানে যীশুখ্রিস্টের দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। তিনি মানুষের কাছে প্রচার করেছিলেন, “ভগবানকে ভালবাসার চেষ্টা কর।” যে কেউ—তা তিনি হিন্দু হোন, মুসলমান হোন, খ্রিস্টান হোন, তাতে কিছু যায় আসে না; তিনি যদি মানুষকে ভগবানকে ভালবাসার জন্য অনুপ্রাণিত করেন, তা হলেই তিনি গুরু। সেটিই হচ্ছে পরীক্ষা। গুরু কখনও বলেন না, “আমি ভগবান”, অথবা “আমি তোমাকে ভগবান বানিয়ে দেব।” যথার্থ গুরু বলেন, আমি ভগবানের দাস, এবং আমি তোমাকেও ভগবানের সেবকে পরিণত করব।” গুরু কি পোশাক পরে আছেন, তাতে কিছু যায় আসে না। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যে কথা বলেছেন, “যেই কৃষ্ণতত্ত্ববেত্তা সেই গুরু হয়’। যথার্থ গুরু কেবল মানুষকে ভগবানের ভক্তে, কৃষ্ণভক্তে পরিণত করার চেষ্টা করেন। এ ছাড়া তাঁর আর অন্য কোন কাজ নেই ।
সাংবাদিক: কিন্তু অসদ্ গুরু…….
শ্রীল প্রভুপাদ: ‘অসদ্ গুরু কি?
সাংবাদিক: অসদ্ গুরু হচ্ছে সে, যে টাকা এবং সম্মান চায় ।
শ্রীল প্রভুপাদ: কিন্তু সে যদি অসদ্ হয়, তা হলে সে গুরু হবে কি করে? (হাসা) লোহা কিভাবে সোনা হতে পারে? প্রকৃতপক্ষে গুরু কখনও অসদ্ হতে পারে না, কেননা কেউ যদি অসদ্ হয় তা হলে সে গুরু হতে পারে না । তাই আপনি বলতে পারেন না ‘অসদ্ গুরু’। সেটা পরস্পর বিরোধী । আপনাকে কেবল জানবার চেষ্টা করতে হবে প্রকৃত গুরু কি। প্রকৃত গুরুর লক্ষণ হচ্ছে যে তিনি কেবল ভগবানের কথা বলেন। তিনি যদি অন্য কোন অর্থহীন বিষয়ে কথা বলেন, তা হলে তিনি গুরু নন। গুরু কখনও অসদ্ হতে পারেন না। অসদ্ গুরুর কোন প্রশ্নই ওঠে না; ঠিক যেমন বলা যায় না, লাল গুরু অথবা সাদা গুরু। গুরু মানেই হচ্ছে ‘যথার্থ গুরু’ আমাদের কেবল জানতে হবে যে, প্রকৃত গুরু হচ্ছেন তিনি যিনি কেবল ভগবানের কথা বলেন এবং মানুষকে ভগবানের ভক্ত হতে অনুপ্রাণিত করেন। তিনি যদি তা করেন, তা হলে তিনিই হচ্ছেন যথার্থ গুরু ।

 

ব্যাক টু গডহেড অক্টোবর – ডিসেম্বর ২০১৮ হতে প্রকাশিত

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।