আপনি কী সন্তানদের জোর করেন?

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২১ | ১১:২২ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ৩১ মে ২০২১ | ১১:২২ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 203 বার দেখা হয়েছে

আপনি কী সন্তানদের জোর করেন?

দৃষ্টান্ত প্রদর্শন কিংবা কৃষ্ণভাবনার সংস্পর্শের মাধ্যমে আপনা আপনিই তারা বিকশিত হবে।

উর্মিলা দেবী দাসী

আমরা কলকাতা বিমানবন্দরে ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করছিলাম কখন উড্ডয়ন করতে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে তিন ঘণ্টা দেরী হয়ে গেছে। ওপরে সিলিংয়ের সাথে ঝুলানো ফ্যানগুলো ঘুরছে কিন্তু তাতেও সতেজ বাতাস পাওয়াটা যথেষ্ট নয়, সে সাথে ধূমপান আর শত শত মানুষের ভীড়ের কারণে পরিবেশটি ধূষিত হয়ে পড়েছে। আমি ও আমার দশ বছর বয়সী ছেলে একটি দরজার পাশে বসেছিলাম। আমি নীল শাড়ি পরা একজন মঠবাসিনীর সঙ্গে কথা বলছিলাম, তিনি আমাদের সফল পারমার্থিক ভ্রমণের জন্য শুভ কামনা করলেন। তারপর এক দম্পতির সঙ্গে কথা বলছিলাম যিনি ইউরোপীয়ান ও আমেরিকান বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের তত্ত্বাবধান করে থাকেন। তখন একজন ভারতীয় ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন,
“এটি কী আপনার ছেলে?”
“হ্যাঁ, আমার ১৭ বছরের ছেলে ও ১৩ বছরের একটি কন্যাও রয়েছে।”
“তারাও কী হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র অনুশীলন করছে?”
“হ্যাঁ।”
“তাদেরকে কী আপনি এ ব্যাপারে জোর করেন?” বোতল থেকে শেষবারের মত জল পান করে কিছুটা সামশের দিকে ঝুঁকে পড়লাম।
জোর করা। সবাই জানতে চায় আমরা কী তাদের জোর করি? ভক্তরা মায়াপুরে এ বিষয় নিয়ে আমার সাথে গভীরভাবে আলোচনা করেছিল এবং আবার এই একই বিষয় নিয়ে এখানে কথা বলছি। আমাদের তিন সন্তান নিশ্চিতভাবে এ বিষয়টিকে জোর করা হচ্ছে বলে অনুভব করে না। তবুও আমরা আশা করি, পারমার্থিক জীবনে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং কার্যকরীভাবে অংশগ্রহণ করুক, বিশেষত হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করার ক্ষেত্রে। কিন্তু কীভাবে কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণের ইচ্ছা অর্জন করতে পারে?
আমি এ বিষয়টি অনেকবার ব্যাখ্যা করেছিলাম এবং আবারও ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি যে, তিনি আমাকে বুদ্ধিমত্তা প্রদান করেন এবং চারপাশের এই টোবাকোর ধোঁয়া অগ্রাহ্য করার সামর্থ প্রদান করেন। আমি তাকে অবশেষে বললাম “আমি ‘জোর’ শব্দটি পছন্দ করি না। মা-বাবারা কী তাদের সন্তানদের দাঁত মাজার জন্য এবং কাপড় চোপড় পরিষ্কারের জন্য ‘জোর’ করে না? তখন সেক্ষেত্রে মা-বাবা কিংবা সন্তানরা কেউই এ বিষয়টি জোর হিসেবে দেখে না। সেটি কেন হয়?”
“বেশ, এই দাঁত মাজার কারণগুলো আমরা তাদের ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করি।”
“হ্যাঁ, এবং আমরা সে সাথে নিজেরাও দাঁত মেঝে তাদের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করি। সেটি প্রতিদিন অভ্যাস করি।”
“হ্যাঁ, তদ্রুপ আমরা সন্তানদের মধ্যে পারমার্থিক অভ্যাস গড়ে তুলতে চেষ্টা করি। অবশ্যই, পারমার্থিক জীবন এবং কৃষ্ণের নামের প্রতি ভালোবাসা হল আত্মার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। তাই এই সমস্ত বিষয়গুলো অভ্যাসের মাধ্যমে বাহ্যিকভাবে চাপিয়ে দিতে হয় না। কিন্তু সন্তানদের মধ্যে অভ্যাস গড়ে তোলার ব্যাপারটি তাদের জন্য যেটি প্রাকৃতিক সেটিকে প্রাকৃতিক বা স্বভাবজাত (nature) হিসেবে গ্রহণ করতে।
“যেরকম আপনি সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেন, তাই না?
“হ্যাঁ, তিনটা তিরিশ মিনিটে। তাই আমার সন্তানদের জন্য ঐ সময়টি ঘুম থেকে উঠার একটি স্বাভাবিক সময়। তারা সকাল ৬ টায় ঘুম থেকে ওঠার বিষয়টি দেরী হিসেবে দেখে। তদ্রুপ, একজন স্বাভাবিক ব্যক্তি সতেজ বায়ু ও স্বচ্ছ ফুসফুস পছন্দ করে।”
আমার দু’জনই তখন পেছন দিকে হেলান দিয়ে বসলাম এবং আমার পুত্র কেশব তখন মালায় হরিনাম জপ করছিল।
সে বলে উঠল, “মা, আমি এ স্থান থেকে বের হয়ে বাইরে হাঁটতে চাই । ভারতের বেসনগরে ঐতিহাসিক হেলিওডোরাস স্তম্ভ “নিশ্চয়ই”
আমি ভদ্রলোকটির দিকে ফিরলাম। “মাঝে মাঝে এমন হয় যে, সন্তানদের কাছ থেকে আমরা এ বিষয়গুলো দাবি করি। কিন্তু এক্ষেত্রে উদ্দেশ্যটি হল কৃষ্ণের প্রতি তাদের সহজাত আকর্ষণ জাগরিত করা। এটি ঠিক সন্তানদের দাঁত মাজার প্রশিক্ষণ প্রদানের মতো। কেননা তা না করলে তারা অপরিষ্কার মুখের জন্য অস্বস্তি অনুভব করবে।”
কীভাবে আমার সন্তানদেরকে পারমার্থিক জীবনের প্রতি ভালোবাসা জাগরিত করতে পারি? প্রথমত, আমাদের উচিত তাদেরকে পারমার্থিক কার্যক্রমের সাথে সংযুক্ত রাখা, বিশেষত হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করা এবং রজো ও তমোগুণ থেকে রক্ষা করার সমস্ত সুযোগ-সুবিধা বর্ধিত করা। এই বিষয়ে সাবধানতাসমূহ সন্তানদের সুরক্ষা করে। তাদেরকে পরিচ্ছন গৃহে রাখা এবং কাপড় চোপড়, মেঝে ও ফার্নিচার ময়লা না রাখা ইত্যাদি পরিবেশ তাদের জন্য সৃষ্টি করতে হবে। সন্তানদের ময়লা আবর্জনার মধ্যে রাখলে তারা পরিশীলিত হয় না।
যখন আমরা জপ করি তখন সন্তানদেরকেও পাশে বসিয়ে জপ করার প্রত্যাশা করি। যেরকম আমরা তাদের কাপড়-চোপড়গুলো ড্রয়ারে রাখি এবং প্রত্যাশা করি, তারা সেগুলো পরবে। আমরা সন্তানদের হরেকৃষ্ণ মন্ত্র শেখায় এবং তাদেরকে দেখার কীভাবে মালায় জপ করতে হয়। সে সাথে বৈদিক বাদ্যযন্ত্র কীভাবে বাজাতে হয় তা শিখাই। আমরা প্রতিদিন নজর রাখি তারা যাতে নির্দিষ্ট আবহাওয়ার দিবসে নির্দিষ্ট পোশাক পড়ছে কিনা কিংবা তাদের ব্যক্তিগত কার্যগুলো সম্পাদন করেছে কিনা?
বাহ্যিক বিষয়গুলো শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারটি সহজসাধ্য কিন্তু আভ্যন্তরীণ অনভূতি জাত বিষয়গুলো শিক্ষা দেওয়া কী সহজসাধ্য? বাহ্যিক শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে আমরা শক্তিশালী অর্থাৎ সূক্ষ্ম বার্তা প্রদান করতে পারি: “এটি গুরুত্বপূর্ণ।” দৃষ্টান্তস্বরূপ যখন একজন মা নিজের জপের সময় তার ছোট সন্তানকে বিরক্ত না করার জন্য বাইরে খেলতে বলে, তার মাধ্যমে সন্তানটি বুঝতে পারে তার মা যে জপ করছে সেটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তখন সন্তানটি স্বাভাবিকভাবেই মাকে অনুকরণ করবে।
এসবের ঊর্ধ্বে, কেউ ভ্রমণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে যার মাধ্যমে পারমার্থিক সিদ্ধি লাভের প্রতি গভীর দৃঢ়তা প্রকাশিত হয়। সন্তানদের এটি দেখা উচিত আনন্দময় দৃঢ়তা হিসেবে, যেখানে কোনো ভণ্ডামী ও স্বার্থপর মনোভাব নেই। নিয়মিত কৃষ্ণকথা শ্রবণ করানোর মাধ্যমে তাদেরকে অনুপ্রাণিত করা প্রয়োজন এবং সর্বশেষ, আমরা কৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করতে পারি। যেন তিনি তার মহিমা তাদের হৃদয়ে প্রকাশিত করেন। কৃষ্ণ আমার সন্তানদের হৃদয়ে রয়েছেন। এরূপ কার্যকলাপ ও ভগবান কৃষ্ণের কৃপার মাধ্যমে যখন আমাদের সন্তানরা পরিপক্ক হয়ে উঠবে তখন সেচ্ছায় তারা পরম মূল্যবান সম্পদ ভগবৎপ্রেম অর্জনের পথে পরিচালিত হবে।


ড. এডিথ ই .বেস্ট (উর্মিলা দেবী দাসী) আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনা ইউনিভার্সিটি থেকে এডুকেশনাল লিডারশীপ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি শ্রীল প্রভুপাদের শিষ্যা। তিনি বর্তমানে আন্তর্জাতিক ব্যাক টু গডহেড ম্যাগাজিনের সহ সম্পাদক রূপে সেবা করছেন। এছাড়াও তিনি ইস্কন শিক্ষা বিভাগের উন্নয়নে নিরলস কাজ করে চলেছেন।


 

 

ত্রৈমাসিক ব্যাক টু গডহেড, জুলাই – সেপ্টেম্বর ২০১৪

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।