এক ক্যান্সার আক্রান্ত ভক্ত প্রদর্শন করলেন কিভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়, তবে তাঁর পূর্বের জাগতিক জীবন ও কৃষ্ণভাবনামৃত জীবনের মধ্য দিয়ে যে দীর্ঘ অভিযান তিনি সম্পন্ন করেছেন তা সবার জন্য দৃষ্টান্তমূলক ও শিক্ষণীয়।
কুন্তীদেবী দাসী, গিরিরাজ স্বামী ও ভক্তিভৃঙ্গ গৌবিন্দ স্বামী
৯মে, ২০০০ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার কাপিন পেরিয়াতে মাতা অর্চা বিগ্রহের তিরোভাব দিবসে কুন্তীদেবী দাসী কর্তৃক স্মৃতিচারণমূলক প্রবচনের অংশ বিশেষ।
কুন্তীদেবী দাসী : আমার মন মাতা অর্চা বিগ্রহের স্মৃতিগুলোতে এতটায় আবিষ্ট যে, তাঁর সম্পর্কে আমাকে কি অনুপ্রাণিত করেছিল এবং এখনও কি অনুপ্রেরণা যোগায় ইত্যাদি বিষয়গুলো আলাদা করে বর্ণনা করাটা কঠিন। কিন্তু আমি মনে করি, তিনি দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভক্তিমূলক নীতি বা আদর্শ ধারণ করেছিলেন, ভগবানের পবিত্র নাম জপ কীর্তন এবং বৈষ্ণবদের প্রতি সেবা নিবেদন করা। তিনি এই দুটি কার্য অত্যন্ত দৃঢ়তা ও উৎসাহের সহিত সম্পাদন করেছিলেন। একজন বন্ধু হিসেবে আমি তাঁর জন্য বিরহ অনুভব করি। তিনি ছিলেন এমন একজন কৃষ্ণভাবনাময় ব্যক্তি যার সাথে আমার গভীর সম্পর্ক ছিল। তিনি আমার চেয়ে বয়সে বড় এবং অত্যন্ত অভিজ্ঞ ছিলেন। আমি তাঁর প্রশিক্ষণ, নির্দেশনা এবং সঙ্গের মাধ্যমে অনেক কিছু শিখেছিলাম। তবুও আমরা ছিলাম খুব ভাল বন্ধু এবং তাঁর মতো এরকম বন্ধু সত্যিকার অর্থে ছিল না। আমি সত্যিই তাঁর জন্য বিরহ অনুভব করি।
১৯৮৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে, শ্রীশ্রী রাধা-রাধানাথ মন্দির উদ্বোধনের সময় মাতা অৰ্চা বিগ্রহের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। আমি দুই সপ্তাহ আগে মন্দিরে চলে গিয়েছিলাম এবং সেখানে অন্যান্য ভক্তদের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে। অৰ্চা এইলীন লিপকিন বা তখন তাকে আরেকটি নামে সবাই চিনত ‘অ্যাঞ্জেল’, জোহান্সবার্গ থেকে এ উৎসবে যোগদানের জন্য এসেছিলেন।
তিনি সবসময় সুন্দরভাবে সুসজ্জিত থাকতেন। সব কাজে বেশ পারদর্শী ছিলেন। সালাদ বানানো থেকে শুরু করে ছবি আঁকা কিংবা এক টুকরো কাঠের ওপর ভাস্কর্য খোদাই এই সবকিছুই সুনিপুণভাবে সম্পাদন করতেন। আমি কখনো তাঁর মধ্যে এতটুকু অলসতা বা পিছু হওয়ার মনোভাব দেখিনি এবং এগুলোর গুণগত মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন নাছোড়বান্দা। এভাবে তাকে খুব দ্রুত পছন্দ হয়ে গেল আমার।
ছোট বেলায় ক্যান্সারে আক্রান্ত, মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর জীবনে অনেক পরিবর্তন আসে। ঐ অবস্থায় তিনি খুব, বিষন্ন হয়ে পড়েছিলেন। ছেলে মেয়েদের ভরণ-পোষণে অসমর্থ হয়ে তাঁর পিতা তাদেরকে অন্য একটি পরিবারে দিয়ে দেন। এরপর থেকে অ্যাঞ্জেল এক ক্যাথলিক মহিলার কাছে বেড়ে উঠেন। যদিও এ্যাঞ্জেল জন্মগতভাবে ইহুদি ছিলেন, এসক্লেইডার নামে ঐ মহিলা তাকে খ্রিষ্টান ধর্মে প্রশিক্ষিত করে তোলেন। কিভাবে হাত ভাঁজ করে, হাঁটু গেড়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে হয় এবং তাঁর শরণাগত হতে হয়। এভাবে একসময় অর্চা উপলব্ধি করতে পারেন যে, ভগবানের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে, যেটি তাঁর বাকি জীবনেও লক্ষ্য ছিল।
হাই স্কুল জীবন শেষ করার পর অ্যাঞ্জেল তাঁর চিত্র অংকন শিল্প খুব ভালোভাবেই অনুশীলন করেছিলেন। একসময় তাঁর বিয়ে হয় এবং তার ক্যারিয়ারের সফলতার পেছনে স্বামী লী এর ভূমিকার প্রশংসা করেন। তাঁর দুটি সন্তান হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর স্বামী হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।
তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর তাকে অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। এদিকে একসময় তার একটি চিত্রকর্ম ‘Women on a Donkey সর্বকালের অন্যতম সেরা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ঐ চিত্রকর্মটি ব্যবসায়িকভাবে বেশ সাফল্য লাভ করে। তার চিত্রকর্ম ছিল নিজের ভিতরে একটি অনুসন্ধানমূলক তাঁর পারমার্থিক ভ্রমণের একটি রোডম্যাপের মধ্যে আশির দশকে তিনি অনেক প্রধান ধর্মীয় ঐতিহ্যের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং সে সাথে অনেক দর্শনেরও। যাদের মধ্যে ছিল এন্থোপোসোফি, এজিপ্টোলোজি এবং কাবালাহ্। তিনি রাজনীশের গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন এবং ভারতের সাইবাবার সান্নিধ্যও লাভ করেছিলেন, মরুভূমিতে বেদুইনদের কাছ থেকেও অনেক কিছু শিখেছিলেন। তিনি থাই চি এবং ফোন্সিং নিজে অনুশীলন করেছিলেন এবং শিখিয়েছিলেন। তাঁর নেচারোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, আকুপাঙ্কচার এবং আয়ুর্বেদ সম্পর্কেও ভালো ধারণা ছিল কিন্তু এত সব অর্জনের পরও যেন তিনি আরো কিছু একটার অনুসন্ধান করছিলেন।
১৯৮৪ সালে ইউনিভার্সিটি অব উইটওয়াটারস্রান্ডে একটি আর্ট প্রোজেক্ট নিয়ে গবেষণার সময় এঞ্জেল হরে কৃষ্ণ ভক্তদের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। মাল্ডার্সড্রিফটে অবস্থিত হরে কৃষ্ণ মন্দিরে যেতেন এবং সেখানে প্রায়ই অবস্থান করতেন। তিনি ইতোমধ্যেই নিরামিষাশী ছিলেন এবং অধিকাংশ সময় কাঁচা সুষম খাবার খেতেন।
এভাবে কৃষ্ণভাবনার দর্শনের প্রতি তাঁর আকর্ষণ জন্মে এবং ভক্তদের জীবনধারা ও সমগ্র পারমার্থিক আবহ উভয়ই তাঁর কাছে খুবই পছন্দের হয়ে উঠে। তিনি প্রসাদ না পেয়ে, সেই প্রসাদ জোহান্সবার্গে রাস্তার দুঃস্থ গৃহহীন ছেলে-মেয়েদের মাঝে বিতরণ করতেন।
এক রবিবাসরীয় অনুষ্ঠানে এঞ্জেল শ্রীমদ্ ভক্তিচৈতন্য স্বামীর (তখন রঘুবীর দাস নামে পরিচিত ছিলেন) লীলা পুরুষোত্তম ক্লাসের মাধ্যমে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হন। তিনি সবসময়ই কৃষ্ণভাবনার দর্শনের প্রতি আগ্রহী ছিলেন এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অতীত লীলাবিলাসের কাহিনি শ্রবণের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল। এভাবে প্রথম দিকে অর্জিত সমস্ত তত্ত্ব বা জ্ঞান প্রত্যাখান করে কৃষ্ণভাবনার পথে অগ্রসর হন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, কৃষ্ণভাবনার এই প্রক্রিয়াটিই তিনি এতদিন অনুসন্ধান করেছিলেন। তিনি যখন হরেকৃষ্ণ আন্দোলনে যোগদান করেন এবং ভক্ত হন তার পূর্বেই অনেক পারমার্থিক প্রশিক্ষণ ও উপলব্ধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। প্রথমদিকে তিনি পারমার্থিক অনুশীলনের সময় কিছু কিছু ভুল করলেও যেমন, ভগবানকে কতবার প্রদীপ, ধুপকাঠি নিবেদন করতে হয় ইত্যাদি। পরবর্তীতে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, সমস্ত নিয়ম-নীতির উদ্দেশ্য হল কৃষ্ণকে স্মরণে রাখা এবং তিনি তাঁকে স্মরণ করতেন। এক্ষেত্রে যদি ছোটখাটো ভুল হয়েও থাকে তবে তাতে সমস্যা কি?
১৯৮৭ সালের ৩ মে অ্যাঞ্জেল, আমি এবং তিনজন অন্যান্য ভক্ত শ্রীমৎ গিরিরাজ স্বামীর কাছ থেকে দীক্ষা লাভ করি। আমরা ছিলাম তার প্রথম শিষ্য। ডেরেক হয়েছিল দামোদর দাস, পাওলো পত্রক দাস; এবং অদিতি – ব্রজেশ্বরী দাসী, এঞ্জেল হয়েছিলেন অর্চা বিগ্রহ দাসী। মহারাজ ব্যাখা করছিলেন যে, একজন চিত্রশিল্পী শ্রীল প্রভুপাদকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “নববিধা ভক্তিমূলক সেবার মধ্যে চিত্রকর্ম কোন পর্যায়ে পড়ে” প্রভুপাদ এর উত্তর দিয়েছিলেন, ‘অৰ্চনম’ অর্থাৎ ‘ভগবানের শ্রী অঙ্গসজ্জা’ এবং তখন থেকে ভগবানের শ্রীবিগ্রহ অংকন করাই হল অর্চার প্রধান সেবাগুলোর মধ্যে অন্যতম।
ঐ বছরের শেষের দিকে অর্চার দেহে ক্যান্সার ধরা পড়ে। ডাক্তার তাঁর ডান বগল (Armpit) থেকে একটি লিমফ্ নোড ( Lymph node) অপসারণ করেন এবং এর মাধ্যমে ক্যান্সারের গতিপথ পাল্টে যায়। অৰ্চা সবসময় বলতেন, জয়ানন্দ প্রভু হলেন তাঁর আদর্শ। তাঁর দৃষ্টান্ত তাকে অনুপ্রাণিত করে যেকোনোভাবে হোক নির্দিষ্ট মালা জপ সম্পন্ন করতে হবে। বৃন্দাবনে Vrindaban Institute of Higher Educaion (VIHE) এ গিরিরাজ স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত ভক্তিরসামৃতসিন্ধুর ওপর কোর্স করার সময়, তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “প্রকৃত ভক্তিরসামৃতসিন্ধু হল সেবা করে যাওয়া।” সেবা করার প্রতি তাঁর এমন রুচি ছিল যে, তিনি ষড়গোস্বামীদের মতো হতে চাইতেন এবং রাতে ঘুমানোর জন্য শোক করতেন। পরে অবশ্য বৃন্দাবনে বিগ্রহের শ্রীঅঙ্গে অংকনের সময় তিনি প্রতিদিন কদাচ ঘুমাতেন, মাঝে মাঝে সপ্তাহ অন্তরও ঘুমাতেন না।
কৃষ্ণের প্রতি অর্চার ভক্তি ছিল অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত। তিনি মাঝে মাঝে বিগ্রহদেরকে প্রসাদ নিবেদনের সময় বলতেন, “অপেক্ষা করুন প্রভু জগন্নাথ, একটু অপেক্ষা করুন। আপনার জন্য আরো কিছু রয়েছে।” এরপর রান্নাঘরে ছুটে গিয়ে, একটি আপেল কেটে এনে বেদির সম্মুখে দিতেন। তিনি জানতেন যে, সমস্ত নিবেদনের ক্ষেত্রে ভক্তিই হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং উপলব্ধি করেছিলেন যে, বিগ্রহ অর্চনের ক্ষেত্রে প্রথম নীতি হল, কৃষ্ণ যে স্বরূপে একজন ব্যক্তি তা স্মরণ করা এবং তাঁর প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করা। কোনো প্রতিবন্ধকতা আসলে তিনি চিৎকার করে ডাকতেন “কৃষ্ণ!” এবং বলতেন “আমি কৃষ্ণের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলব” । তিনি এমনভাবে কৃষ্ণের সঙ্গে কথা বলতেন যেন তিনি কোনো প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছেন। কিভাবে তাঁর এই স্বতঃস্ফূর্ততা উপলব্ধি করা যায় এ সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত ছিলাম না।
১৯৯১ সালে জোহান্সবার্গে হিলব্রো মন্দিরে নৃসিংহ চতুর্দশী দিবসে অর্চা তাঁর গলার হাঁড়ের (Collar bone) নিম্নভাগে সামান্য ব্যাথা অনুভব করতে থাকেন, তিনি জানতেন ক্যান্সার পুনরায় ফিরে এসেছে। মেডিকেল টেস্টের
যদিও তাঁর দেহের ব্যাথা ছিল চরম কিন্তু তিনি তাতে বিচলিত না হয়ে সেটিকে তাঁর শুদ্ধিকরণের জন্য কৃষ্ণের কৃপা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। যদিও ডাক্তারদের ভাষ্য অনুসারে অর্চার ক্যান্সারের ধরণটি সবচেয়ে ব্যাথাপূর্ণ। তাঁর এই সহনশীল মনোভাবের জন্য স্থানীয় ব্রজবাসীরা স্নেহভারে বলতেন “Tough English Woman” “অবিচল ইংরেজ নারী”
মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়ার পর ডাক্তাররা ঘোষণা দিলেন তিনি আর মাত্র সাত কি নয় মাস বাঁচবেন।
অৰ্চা ভেঙে পড়েছিলেন। আমরা তাঁর রান্না ঘরে বসে বসে এটি নিয়ে ভাবছিলাম। তাঁর গুরুদেবকে অবগত করালে তিনি অর্চাকে বললেন, “বৃন্দাবনে চলে যাও এবং সবকিছু শ্রীমতি রাধারাণীর ওপর ছেড়ে দাও।” অর্চা গুরু মহারাজের সেই নির্দেশ হৃদয়ে ধারণ করেন এবং নির্দেশটির প্রতি তাঁর জীবন সঁপে দেন।
তিনি নিজের আঁকা ছবি বিক্রি করে এবং অন্য কোনোভাবে বৃন্দাবনে একটি গৃহ নির্মাণ করছিলেন। আমি, অর্চা এবং তাঁর মেয়ে সারাসহ ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বরে বৃন্দাবনে আসি। তখনও গৃহটি পুরোপুরি নির্মাণ হয়নি, পরে নির্মাণ কার্য সম্পন্ন হলে মন্দিরের গেস্টহাউস থেকে ঐ গৃহে চলে আসি। সেখানে একটি ছোট গোশালা ছিল এবং শিবরাম স্বামী ও বি.বি. গোবিন্দ স্বামী একত্রে অন্য একটি গৃহে তখন অবস্থান করেছিলেন। এই গৃহটি অৰ্চা নির্মাণ করেছিলেন তাঁর গুরুদেবের প্রতি নিবেদন স্বরূপ, যাতে করে বৃন্দাবন ভ্রমণের সময় তিনি এই গৃহে অবস্থান করতে পারেন। এজন্যে তিনি তাঁর কাজকর্ম এবং সেখানে থাকা সবকিছুই নিচতলায় করতেন এবং উপরের তলাটি তাঁর গুরুদেবের জন্য সংরক্ষিত ছিল। তাঁর ভাবটি ছিল: গুরুদেব এবং কৃষ্ণকে সবকিছু নিবেদন করা।
অর্চার অন্তিম দিনগুলোতে অনেক ভক্তই তাকে দেখতে আসতেন। ঐ সময় বি.বি. গোবিন্দ স্বামী মহারাজ অর্চার পারমার্থিক প্রদর্শক ছিলেন। তিনি আমাদেরকে ধাম পরিদর্শনে নিয়ে যেতেন। তিনি অর্চাকে গ্রন্থ পড়ে শুনাতেন। তাঁর জন্য ভজন গাইতেন, রান্না করতেন এবং তাঁর বিগ্রহগুলোকে অর্চার সান্নিধ্যে নিয়ে আসতেন। তিনি ছিলেন সর্বোত্তম বন্ধুর মতো। মাঝে মাঝে আমার সেবা কার্যে সমস্যার সম্মুখিন হলে তিনি অর্চার প্রতি শুধু ‘Love Bombs’ অর্থাৎ ‘ভালোবাসার বোমা’ ফেলতে বলেছিলেন। তাঁর অনুপ্রেরণা ও সহায়তা ছাড়া আমি কখনো অর্চার প্রতি আমার সেবা নিবেদন করতে পারতাম না।
যদিও সাউথ আফ্রিকার ডাক্তাররা একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। কিন্তু অর্চা প্রথম বছর বেশ স্বাভাবিকভাবেই ভক্তিমূলক সেবার মধ্য দিয়ে কাটিয়েছিলেন। যদিও ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসারে নারীরা বেদীর কাছে যেতে পারতেন না কিন্তু তবুও ভক্তিসিন্ধান্ত প্রভুর মাধ্যমে গোপনে প্রতি রাতে শ্রীশ্রী রাধা শ্যামসুন্দরের শ্রীঅঙ্গে তিনি অংকন করতেন। সেসময় তিনি বৃন্দাবনের প্রধান পূজারী ছিলেন এবং অর্চার শৃঙ্গারের ব্যাপারটি অনেকেরই অজানা ছিল। একইভাবে জুহু মন্দিরেও অনুরোধের ফলে অর্চা রাতে বিগ্রহের শ্রীঅঙ্গে অংকন করতো, কিন্তু কেউই জানত না। কে এত সুন্দর সেবা সম্পাদন করেছে। তাঁর এরকম নিদ্রাহীন সেবার ফলেই বোধহয় তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। খেতেনও খুবই সামান্য। যখন সেবায় মনোনিবেশ করতেন তখন আহার নিদ্রার কথা পুরোপুরি ভুলে যেতেন।
এক সময় রাধাকুণ্ডে একজন গৌড়িয় বৈষ্ণব চেয়েছিলেন যে, শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর ভজন কুঠিরের জন্য নতুন একটি পোট্রেট কেউ আঁকবেন, তবে সেটি অবিকল পুরানো সেই ছবির মতো হতে হবে এবং অবশ্যই কোনো বিদেশী বা নারীর দ্বারা হবে না। সেই চিত্রপটটি সেখানে বিগ্রহের ন্যায় অভিন্নভাবে পূজিত হবে, যেখানে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী পরিদর্শন করে থাকে। কিন্তু ভুরিজন এবং তার পত্নী গোপনে অর্চা বিগ্রহকে সেটি আঁকতে বলেন, যাতে কে এঁকেছে সেটির কোনো চিহ্ন থাকবে না। পরে যখন সেই অংকিত ছবি উন্মোচিত হয় সবাই এর সৌন্দর্যতা দেখে অবাক হয়। পরে তা জানাজানি হলে স্থানীয় বাবাজীরা খুবই খুশি হন এবং বলেন জীব গোস্বামীর ছবিও অংকনের জন্য। এখনও রাধাকুণ্ডে তাঁর সেই দুটি চিত্রকর্ম পূজিত হচ্ছে।
বৃন্দাবনে আসার পূর্বে তিনি কোনো কেমোথেরাপি বা প্রথাগত ক্যান্সার চিকিৎসা গ্রহণ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি শেষ পর্যন্ত আয়ুর্বেদ চিকিৎসা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। শুরুর দিকে সুইজারল্যান্ডের একটি পরিচিত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ সরাসরি টিউমারের মধ্যে প্রবেশ করাতেন। তবে চিকিৎসা যাই হোক না কেন, তিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত শুদ্ধ চেতনার স্তর বজায় রাখতে চেয়েছিলেন।
১৯৯২ সালের দিকে হেপাটাইটিস্, নিউমোনিয়াসহ অনেক দুরারোগ্য ব্যাধির সম্মুখীন হন যা ক্যান্সারের সাথে দেহের জন্য এক সংগ্রামে রূপ নেয়। তাই তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। তবুও তিনি ছবি আঁকা বন্ধ করেন নি। তিনি এই শ্লোকের নুকম্পাং সু সমিক্ষামানো’ তাৎপর্য থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করেছিলেন যে, যে দুর্দশাই আসুক না সেটি কৃষ্ণের কৃপা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। সহনশীল হতে হবে এবং কৃষ্ণভাবনার প্রতি আরো একনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করতে হবে। এভাবে কেউ ভগবদ্ধামে প্রবেশের যোগ্যতা লাভ করতে পারে।
যদিও তাঁর দেহের ব্যাথা ছিল চরম কিন্তু তিনি তাতে বিচলিত না হয়ে সেটিকে তাঁর শুদ্ধিকরণের জন্য কৃষ্ণের কৃপা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। যদিও ডাক্তারদের ভাষ্য অনুসারে অর্চার ক্যান্সারের ধরণটি সবচেয়ে ব্যাথাপূর্ণ। তাঁর এই সহনশীল মনোভাবের জন্য স্থানীয় ব্রজবাসীরা স্নেহভরে বলতেন “Tough English Woman” “অবিচল ইংরেজ নারী” এবং তারা বলতেন, অর্চা পূর্ব জীবনে একজন যোগী ছিলেন। অনেকে তাকে ধনী বংশজাত বলে অনুমান করে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ছবি বিক্রি করে গৃহস্থালী এবং মেডিকেল খরচ চালাতেন।
অর্চা ধীরে ধীরে তাঁর জড় আসক্তি পরিত্যাগ করতে শুরু করলেন। সর্বশেষ আসক্তি ছিল রঙের ওপরও। সারা জীবনের সঞ্চিত ধারণা বা আসক্তিসমূহ কিভাবে হৃদয়ে ছাপ হিসেবে ছিল তা সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন এবং অন্তিম সময়ে এর সব কিছু পরিত্যাগ করছিলেন।
ক্রমান্বয়ে অনেক চিকিৎসা নেওয়ার পর একসময় বৃন্দাবনে তিনি আরো বেশি কৃষ্ণভাবনাময় হন ৷
শ্রীমৎ তমাল কৃষ্ণ গোস্বামী, শ্রীমৎ নারায়ণ স্বামী, ভুরিজন প্রভু, শ্রীমৎ শিবরাম স্বামী, শ্রীমৎ কেশব ভারতী মহারাজসহ অনেক ভক্ত এসে তাঁকে পারমার্থিক সান্নিধ্য প্রদান করেন। ১৯৯৪ সালে গৌর পূর্ণিমার সময় অর্চা কিছুই খেতে পারছিলেন না। টিউমার তাঁর খাদ্যনালীর ওপর চাপ প্রয়োগ করছিল এবং তার ফলে কোনো কিছু গিলতে পারছিলেন না। আয়ুর্বেদ ঔষধও নিতে পারছিলেন না এবং ধীরে ধীরে ডিহাইড্রেশন বৃদ্ধি পেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েন। আমরা ভেবেছিলাম তিনি হয়তো কোমায় চলে গেছেন। তখন গোপস্বামী প্রভু নামে এক ডাক্তার এসে অর্চার দেহকে চেতনাস্থ করে রাখেন। তখন তাঁর শরীরে প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভূত হচ্ছিল এবং শরীরটি কঙ্কালসার হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ঐ অবস্থায়ও তিনি শ্রীকৃষ্ণের অতীত লীলাবিলাস শ্রবণ করছিলেন। আর তা শ্রবণ করে মাঝে মাঝে হাসতেন আর কাঁদতেন।
অৰ্চা সবসময় বলতেন, তাঁর দেহত্যাগের সময় শুধুমাত্র পাঁচ জন ভক্ত থাকবেন। দেহত্যাগের পূর্বের রাতে সারা রাত কীর্তন চলেছিল। পরদিন সকালে ১৮ মে, জাহ্নু সপ্তমীর দিনে শুধুমাত্র শ্রীমৎ গিরিরাজ স্বামী, নাম চিন্তামণি, রসিকানন্দ, কৃষ্ণ কুমারী (এখন কৃষ্ণ মাধুরী) এবং আমি উপস্থিত ছিলাম। দুপুরের দিকে অর্চা কয়েকবার গভীরভাবে শ্বাস নিলেন। তার ডান হাতটি পেছন দিকে ঝুলে পড়ে এবং তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর ডান চোখের কোনা বেয়ে পড়ে এক বিন্দু চোখের জল। তাঁর জিহ্বা ও কপালে তুলসী পত্র ছিল এবং চারপাশে বিভিন্ন পবিত্র বস্তু রাখা হয়েছিল। গিরিরাজ মহারাজ জপ করছিলেন এবং ঐ কক্ষে শ্রীল প্রভুপাদের রেকর্ড করা কীর্তন চলছিল । অর্চা তার গুরুদেবের নির্দেশ সম্পূর্ণরূপে হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন। গুরুদেবের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস এবং বৃন্দাবনের প্রতি ভালোবাসা তাঁকে জয়ী করেছিল এবং এর মাধ্যমে কোনো সন্দেহই নেই যে, তিনি রাধাকৃষ্ণের নিত্যলীলায় প্রবিষ্ট হয়েছিলেন।
একজন উন্নত ও দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী বৈষ্ণবী
(জুন, ১৯৯৪, জোহান্সবার্গে গিরিরাজ স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত প্রবচনের অংশ বিশেষ)
সমস্ত কঠিন প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও যদি কেউ একনিষ্ঠ হয় এবং গুরু ও কৃষ্ণের সেবা ব্যতীত অন্য কোন বাসনা না থাকে এবং চারটি বিধিনিষেধ অনুসরণ করে ষোল মালা জপ করে এবং পূর্ণভাবে ভক্তিমূলক সেবায় নিয়োজিত থাকে তবে তিনি ভগবদ্ধাম লাভ করতে পারেন। অর্চা বিগ্রহ তাঁর অত্যুজ্বল দৃষ্টান্ত ।
তিনি সর্বদা রাধাকৃষ্ণের ভাবনায় ভাবিষ্ট থাকতেন। দেহত্যাগের এক সপ্তাহ পূর্বে আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, “আপনি কি শ্রীমতি রাধারাণীর ভাবনায় অধিষ্ঠিত আছেন? তিনি উত্তর দিলেন, ‘ওহ, হ্যাঁ’, সব সময়, সব সময়ই”। দেহত্যাগের তিন দিন পূর্বে তিনি চরম ব্যাথা অনুভব করছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছিলেন, তিনি শুধু তাঁর মনকে একটি মাত্র বিষয়ে নিবিষ্ট করতে চান, যেটি ছিল শ্রীমতি রাধারাণীর প্রতি রঘুনাথ দাস গোস্বামীর প্রার্থনা: “আমি তোমার, আমি তোমার, আমি তোমা বিনা জীবনধারণ করতে পারি না এটি উপলব্ধি করে, অনুগ্রহপূর্বক আমাকে আপনার শ্রীপাদপদ্মে আশ্রয় দিন।” (বিলাপ-কুসুমঞ্চলী ৯৬)
প্রকৃতপক্ষে যখন কেউ প্রেমস্তরে উপনীত হয়, তখন তাঁর এই শরীরটি আর ধারণ করতে হয় না। কারো মধ্যে কৃষ্ণপ্রেম আবির্ভূত হলে তার লক্ষণ হবে এই জড়দেহটির ভার বহন করাটিই তখন অত্যন্ত দুরুহ হয়ে পড়ে। ঐ স্তরে সে দেহস্থ চেতনা বা শরীরটি ত্যাগ করে শ্রীকৃষ্ণের অতীত লীলাবিলাসে প্রবেশ করে। শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর মাধুর্য কাদম্বিনীতে এই বিষয়টি বর্ণনা করেছেন। সাধারণত এই জগতে বা এই দেহের মধ্যে আমরা শুধুমাত্র ভাবস্তর পর্যন্ত উপনীত হতে পারি। ভাব ভক্তির মানে হল যে, কেউ এখনও বর্তমান শরীরে অবস্থান করছে এবং মাঝে মাঝে কৃষ্ণ এবং তাঁর অতীত লীলাবিলাস দর্শন করেন। আবার মাঝে তিনি নিজেকে এ জড়জগতের চেতন জীব হিসেবে দর্শন করেন। অর্চা বিগ্রহের ক্ষেত্রে, অনেক লক্ষণ রয়েছে যে, তিনি মৃত্যুর সময় রাধারাণী ও কৃষ্ণভাবনায় আবিষ্ট ছিলেন এবং তাঁদের নিত্যসেবা প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
যদি মৃত্যুর সময় কেউ কৃষ্ণলীলা স্মরণ করেন তখন তিনি কৃষ্ণের অতীত লীলাবিলাসে প্রত্যাগমন করতে পারেন। কিন্তু যদি আমরা কৃষ্ণভাবনায় অগ্রসর না হই, তবে মৃত্যুর সময় কৃষ্ণের লীলাবিলাস স্মরণ করতে পারব না। এমনকি যখন আমরা জপ করি, তখন আমাদের মন অন্য কিছুর চিন্তায় ভাবিত হয়। এক্ষেত্রে মূখ্য হল চেতনা। শুধু ঠোঁট আর জিহ্বা নাড়ানো নয়। তাই যদি আমরা জপ করি এবং সে সাথে অন্য কিছুর চিন্তা করি এবং তারপর মৃত্যুবরণ করি তবে আমাদের ভাবনার দ্বারা আমাদের গতি নির্ধারিত হবে। যান্ত্রিক জপের মাধ্যমে নয়। যান্ত্রিক জপ’ মানে হল রুটিন মাফিক জপ। সেই জপ সত্যিকার অর্থে আমরা শ্রবণ করি না।
মনকে শুধুমাত্র শ্রীকৃষ্ণে নিবিষ্ট করতে হবে
(১৯৯৬ সালের ২৫ এপ্রিল, মরিশাসের ফোনিক্সে হরেকৃষ্ণ ল্যান্ডে মাতা অর্চা বিগ্রহের তিরোভাব দিবসে ভক্তিশৃঙ্গ গোবিন্দ স্বামীর প্রবচনের অংশবিশেষ।)
আমি অর্চার পাশের গৃহেরই প্রতিবেশী ছিলাম এবং প্রতিদিন সকালে প্রায় আটটার দিকে তাকে দেখতে যেতাম। ১৯৯৩ সালে কার্তিক মাসের পূর্ব পর্যন্ত তিনি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতেন। কিন্তু এক সন্ধ্যায় আটটা নাগাদ আমি তাঁর গৃহে গেলে তাকে বিষন্ন অবস্থায় দেখি। তিনি তাঁর বিছানায় শুয়ে কাঁদছিলেন। আমি তাঁকে ইতোপূর্বে কখনো কাঁদতে দেখিনি। তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে বললেন, “এই ব্যাথাটি দিন দিন শুধু বেড়েই যাচ্ছে। আমি জানি না কি করতে হবে।”
আমি বললাম, “আপনি কি নিশ্চিত যে চিকিৎসার জন্য দিল্লিতে যাবেন না।”?
তিনি বললেন, “না, আমি ওভাবে যেতে চাই না, আমি আমার চেতনাকে বিচলিত করতে চাই না।” আমি এ নিয়ে তার সঙ্গে তর্ক করলাম। কেননা আমি হলাম সেই ধরনের ব্যক্তি যার খানিকটা মাথাব্যাথা হলেই তাড়াতাড়ি এসপিরিন খেয়ে ফেলি। তাঁর সেটি পছন্দ না। তিনি ছিলেন অবিচল (Tough)। আমি এতে আপত্তি জানালেও শেষ পর্যন্ত নিঃশেষ হয়ে যেতাম। তিনি কাঁদছিলেন আর কাঁদছিলেন। এই ব্যাথার মাধ্যমে যে কি হচ্ছে আমি জানি না এবং এসময় কী করতে হবে বুঝতে পারছিলাম না।
তখন আমি উপলব্ধি করলাম ঐসময় একটি জিনিস করা যায় তা হল কৃষ্ণ কথা বলা। তাই আমি কৃষ্ণ গ্রন্থ বের করলাম এবং বৃন্দাবনের অতীত লীলাবিলাস পড়তে শুরু করলাম। আমি বললাম, ‘মাতাজী, এর ওপর আর কোনো ঔষধ নেই, তাই আপনি শুধু আপনার মনকে কৃষ্ণের অতীত লীলাবিলাসের ধ্যানে নিমগ্ন করুন।” আমি পড়তে শুরু করলাম, আর আশ্চর্য হয়ে গেলাম। যে মানুষটি পাঁচ মিনিট পূর্বেও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন, সেই তিনি ধীরভাবে তার মনকে কৃষ্ণকথা শ্রবণে নিবদ্ধ করলেন। তিনি শিল্পীমনা ব্যক্তি ছিলেন এবং যখনই কৃষ্ণের সুন্দর বর্ণনা শ্রবণ করতেন তা তাঁর মনে গেঁথে যেত। তিনি মনের মধ্যে সমগ্র দৃশ্যটি এঁকে ফেলতেন এবং মনকে সেই দৃশ্যে নিবদ্ধ রাখতেন।
একসময় আমি শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কান্না করতে শুরু করলেন, তিনি তখন চিন্ময় স্তরে ছিলেন। পরদিন সকালে অর্চা-বিগ্রহ বলছিলেন, “যখন আমি জপ করছিলাম, আপনি কৃষ্ণগ্রন্থে যা পড়েছিলেন তার স্মরণ হচ্ছিল। এটি ছিল আমার সারাজীবনের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম জপ। কারণ আমি কৃষ্ণের পবিত্র নাম জপ করছি এবং একই সময়ে কৃষ্ণকে স্মরণ করছিলাম।” এর মাধ্যমে আমার মনে পড়ে গেল, যখন শ্রীল প্রভুপাদ দেহত্যাগ করার জন্য বৃন্দাবনে এসেছিলেন, তিনি বলেছিলেন, “আমার খাদ্য হল চরণামৃত এবং আমার ঔষধ হল হরিনাম।” ঐ একই নীতি ও প্রক্রিয়া অর্চা বিগ্রহেরও ছিল। তাঁর খাদ্য বাস্তবিকভাবে কোন কিছুই ছিল না এবং তাঁর ঔষধ হয়ে ছিল কৃষ্ণের পবিত্র নাম ও অতীত লীলাবিলাস।
সে সময় অৰ্চা বিগ্রহকে দেখার জন্য অনেক ভক্ত আসতেন এবং তারা সুশৃঙ্খলভাবে লাইন ধরে দেখার জন্য অপেক্ষা করতেন। তিনি প্রত্যেককে আমন্ত্রণ জানাতেন এবং তাদের কথা শুনতেন। ব্রজবিহারী দাস, শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত থেকে পড়তেন আর আমি লীলা পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীমদ্ভাগবত থেকে অধ্যয়ন করতাম। সবাই অর্চার জন্য পড়তে চাইত কেননা তাঁর মানসিকতা ছিল, “আমার মনকে কৃষ্ণের ধ্যানে নিবিষ্ট করতে হবে। কৃষ্ণের ধ্যানে অর্থাৎ কৃষ্ণের অতীত লীলাবিলাসের ধ্যানে।” তিনি শুধু শ্রবণ করতে চাইতেন। তিনি কৃষ্ণ কথা শ্রবণের জন্য অত্যন্ত লোভী ও উৎসাহী হয়ে পড়েছিলেন।
১৯৯৪ সালে আমি বৃন্দাবন থেকে বিদেশে প্রচারের জন্য যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তখন তিনি বলছিলেন “আমার গুরু মহারাজ এই সময়ে আসতে পারবেন না। আমি সত্যিই উদ্বিগ্ন যে হয়তো শীঘ্রই আমি মৃত্যুবরণ করতে পারি এবং মৃত্যুর সময়ে আমি আমার কোনো একজন পারমার্থিক কর্তৃপক্ষের সান্নিধ্য পেতে অভিলাষ করি। অনুগ্রহ করে আপনি প্রচার ভ্রমণে যাবেন না।” আমি ঐ অবস্থায় কি করব বুঝতে পারছিলাম না। সবকিছুই প্রস্তুত ছিল। শুধু প্লেনে উঠব বলে। তাই অনেক মতামতের পর সিদ্ধান্ত নিলাম আমার উচিত অৰ্চা বিগ্রহকে সাহায্য করা।
একসময় গিরিরাজ মহারাজ তাঁকে জিজ্ঞেস করেন। “কেমন আছেন?”
তিনি উত্তর দেন, “সবকিছুই ভাল আছে। জাগতিক অবস্থা আশাহীন, কিন্তু পারমার্থিকভাবে সবকিছু ঠিক আছে। আমি আমার মনকে স্থির করছি। আমি ভগবদ্ধামে প্রত্যাগমন করছি।”
গিরিরাজ মহারাজ তাঁর শিষ্যার কাছ থেকে এরকম সাহসী মনোভাব শুনেছিলেন। এ বিষয়ে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলে, আমি বলি, “হ্যা। আমিও মনে করি, তিনি ভগবদ্ধামে প্রত্যাবর্তন করবেন। আপনি কি তা মনে করেন না?”
তিনি বলেন, “কিন্তু আমি শুনেছি যে মাধবেন্দ্রপুরী, রূপ গোস্বামী, রঘুনাথ দাস গোস্বামী ভগবদ্ধামে প্রত্যাবর্তনের বিপরীতে শুধু রাধাকৃষ্ণ সেবা লাভ করার আশা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি জপ করছেন আর শ্রবণ করছেন, অথচ অনুমান করছেন যে, তিনি ভগবদ্ধামে যাচ্ছেন। তাঁর সঠিক ভাবটি নেই মনে হয়।”
আমি বললাম, “বেশ, আমি মনে করি প্রতিটি ভক্তের ওপর কৃষ্ণের বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা যারা পশ্চিমা দেশ থেকে কৃষ্ণভাবনা গ্রহণ করেছি এবং শ্রীল প্রভুপাদের পদাঙ্ক ও তাঁর নির্দেশাবলী অনুসরণ করছি, আমাদের উচিত নিরবচ্ছিন্নভাবে কৃষ্ণকথা শ্রবণ করা। আমার মনে হয় কৃষ্ণ অৰ্চা বিগ্রহকে ভগবদ্ধামে নেওয়ার জন্য বিশেষ কিছুর আয়োজন করবেন।”
মহারাজ এই আলোচনার পর অনেক মূল্যবান সময় অৰ্চা বিগ্রহকে দিয়েছিলেন। আমরা শ্রীল রূপ গোস্বামী রচিত ললিত মাধব নাটকটি তাঁর সম্মুখে নাটকের মত অভিনয় করে পাঠ করেছিলাম। আমাদের মধ্যে ছিলেন গিরিরাজ স্বামী, তমাল কৃষ্ণ গোস্বামী, শিবরাম স্বামী, কেশব ভারতী স্বামী। আমরা পুরো নাটকটি পাঠ করেছিলাম, আর সেটি ছিল অদ্ভুত কিছু ৷
একসময় তাঁর ব্যাথা আরো বেড়ে গেলে তাঁর কণ্ঠ অবরুদ্ধ হতে শুরু করে। আসলে তাঁর জীবন অবসানের জন্য ক্যান্সারের চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল ডিহাইড্রেশন। আমরা তখন ছোট এক টুকরো বরফ তার মুখে রাখতাম আর সেটি গলে গলে তাঁর কণ্ঠ দিয়ে যেত। দেহত্যাগের আগের দিন কিছু ভক্ত সারা রাত ধরে কীর্তন করে। পরদিন সকালে শুনি অর্চা বিগ্রহের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। যখন আমি সেখানে পৌছায় তখন দেখি গিরিরাজ মহারাজ জপ করছে আর অর্চা বিগ্রহের নিথর দেহ পড়ে আছে। তিনি দেহত্যাগ করেছেন।
অর্চার ক্ষেত্রে দুটি জিনিস আমাকে নাড়া দিয়েছিল :
এক: কিভাবে তিনি সবার প্রতি সেবা নিবেদন করতেন এবং এবং নিজের জন্য কখনো ভাবেন নি।
দুই: তিনি কত সৌভাগ্যবান যে, বৃন্দাবনে দেহত্যাগ করেছিলেন এবং নিবিড়ভাবে কৃষ্ণকথা শ্রবণ করেছিলেন। যখন শ্রীল প্রভুপাদ বৃন্দাবনে দেহত্যাগের জন্য এসেছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন, “বৃন্দাবনে জন্ম নেওয়া ভাল, বাস করাটি উত্তম, কিন্তু দেহত্যাগ করাটি সর্বশ্রেষ্ঠ।”
তাই আমি মনে করি, অর্চা অত্যন্ত সৌভাগ্যবতী ছিলেন। তিনি বৃন্দাবনে জন্ম নেননি, কিন্তু তাঁর জীবনের অন্তিম সময় কৃষ্ণ তাকে বৃন্দাবনে বাস করার ও দেহত্যাগ করার সুযোগ প্রদান করেছিলেন। তিনি সর্বদা অন্যদের সহায়তা করার প্রয়াস করতেন এবং অন্তিমে কৃষ্ণ তাঁর গুরুদেবকে তাঁর সঙ্গে অবস্থান করানোর মাধ্যমে তাঁকে সহায়তা করার জন্য অনুমোদন করেছিলেন। এটি ছিল অত্যন্ত সুন্দর একটি ব্যবস্থাপনা এবং তিনি ছিলেন সুন্দর একজন ব্যক্তি।
এই দিনে আমাদের অর্চা বিগ্রহকে স্মরণ করা উচিত এবং তাঁর কৃপা প্রার্থনা করা উচিত, যাতে আমরা সর্বদা অন্যদের সহায়তা করতে সমর্থ হওয়ার গুণাবলী অর্জন করতে পারি এবং কৃষ্ণনাম ও তাঁর অতীত লীলাবিলাসের প্রতি সুদৃঢ় বিশ্বাস অর্জন করতে পারি।
লেখক পরিচিতি : কুন্তীদেবী দাসী শ্রীমৎ গিরিরাজ স্বামী মহারাজের শিষ্যা। শ্রীমৎ গিরিরাজ স্বামী ও শ্রীমৎ ভক্তিবৃঙ্গ গোবিন্দ স্বামী উভয়েই শ্রীল প্রভুপাদের শিষ্য। গিরিরাজ স্বামী বোস্টনের ব্রান্ডিস বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় শ্রীল প্রভুপাদের সাথে পাঁচ মিনিটের সাক্ষাৎকারে যে জ্ঞান লাভ করেছিলেন তা তার বিশ বছরের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকেও অনেক বেশী মূল্যবান ছিল বলে মন্তব্য করেন। গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করার পর দীক্ষাপ্রাপ্ত হন। ১৯৭২ সালে প্রভুপাদ তাকে ইসকন বোম্বের প্রেসিডেন্ট পদে নিযুক্ত করেন। এমনকি তিনি ভক্তিবেদান্ত বুক ট্রাস্টের ট্রাস্টি হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি বোম্বে, মরিশাস, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন, পর্তুগাল, শ্রীলংকা ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচার করেন।
শ্রীমৎ ভক্তিবৃঙ্গ গৌবিন্দ স্বামী আমেরিকার মেমফিস টিনেসীতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি ইস্কনে যোগদান করেন। সারা বিশ্বে তার পাঁচশরও অধিক শিষ্য/শিষ্যা রয়েছে। ২০০০ সালে তিনি জিবিসি সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হন এবং সম্প্রতি সিআইএস, ইরাজ, লেবানন, ও সিরিয়ার জোনাল সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। তিনি মরিশাস, কাজাখিস্তান, কিরগিজস্থান, তোজিকিস্থান, তুর্কমেনিস্থান এবং উজবেকিস্থানে কো-জোনাল সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। তিনি একজন বিখ্যাত কীর্তনশিল্পী। বর্তমানে সারা বিশ্বে তিনি তার সুললিত কীর্তনের মাধ্যমে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র প্রচার করে চলেছেন।