এই পোস্টটি 1755 বার দেখা হয়েছে
সানির (ছদ্মনাম) বয়স ২১ বছর।
দীর্ঘদিন ধরে বিষণ্ন তায় ভুগছেন। প্রায়ই বলতেন মরে যাওয়ার কথা। কেউ তাঁর কথাকে গুরুত্ব দিত না। তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করত। একদিন সত্যি সত্যি দরজা বন্ধ করে আত্মহত্যা করলেন। রুবেল (ছদ্মনাম) ছিল হাসিখুশি একটি ছেলে। এবার এইচএসসি দিয়েছে। একদিন বাসায় মুঠোফোন ব্যবহার করা নিয়ে বাবা তাকে বেদম বকলেন। বকা দেওয়ার খানিক পরই জানা গেল রুবেল তাদের ছয় তলা বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিয়েছে।
কোনো মানসিক রোগের কারণে বা তাৎক্ষণিক আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়ে কেউ কেউ নিজের জীবনকে শেষ করে ফেলে, বেছে নেয় স্বেচ্ছা-মৃত্যুর পথ। যাকে বলা হয়, আত্মহত্যা।
আত্মহত্যা দুই ধরনের-নির্ধারিত বা পরিকল্পিত যা সাধারণত বিষণ্নতাসহ বিভিন্ন মানসিক রোগের কারণে হয়ে থাকে। এ ধরনের আত্মহত্যার ক্ষেত্রে ব্যক্তি নানাভাবে জানিয়ে দিতে থাকে যে, সে মরে যেতে চায়। তারা নানা পরিকল্পনা করে আত্মহত্যার উপকরণ সংগ্রহ করে। সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যার জন্য উপযুক্ত সময় আর স্থান বেছে নেয়।
আরেকটি ধরণ হচ্ছে ইমপালসিভ বা হঠকারী আত্মহত্যা। এটা সাধারণত আন্তব্যক্তিক সম্পর্কের টানাপোড়েন (ইন্টার পারসোনাল কনফ্লিক্ট) থেকে হয়। এ ধরনের আত্মহত্যাকারীরা পূর্বে তেমন কোনো কিছু জানান না সাময়িক আবেগের বশবর্তী হয়ে নিজেকে শেষ করে দেয়। তবে গবেষণা বলে যারাই আত্মহত্যা করে, তাদের ব্যক্তিত্বের মধ্যে কিছু ঝুঁকি থাকে-তা যে ধরনের আত্মহত্যা হোক না কেন। যুক্ত
কেন মানুষ আত্মহত্যা করে
ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডার্কহাইম তাঁর এক বিখ্যাত গবেষণায় যারা আত্মহত্যা করে বা করতে চায় তাদের চারটি ভাগে ভাগ করছে। (১) আত্মশ্লাঘায় পূর্ণ ব্যক্তি (ইগোস্টিক), যারা সব সময় নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে, সামাজিকতা পরিহার করে নিজের সবকিছু নিয়ে অহংবোধে ভোগে। (২) পরার্থবাদী (অল্ট্রুস্টিক) যাদের সামাজিক সম্পৃক্ততা খুব বেশি। (৩) আত্মপরিচয়হীন (এনোমিক) যারা সামাজিক রীতিনীতির ধার ধারে না-যাদের কোনো স্বকীয় পরিচয় নেই এবং নেই কোনো সামাজিক বন্ধন। (৪) অদৃষ্টবাদী (ফ্রাটালিস্টিক), যারা সব সময়ে অদৃষ্টের ওপর নির্ভর করে চলে এবং এর ব্যঘাত ঘটলে ক্ষুব্ধ হয়।
বিশ্ববিখ্যাত মনোবিশ্লেষক-মনোচিকিৎসক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, মানুষের মধ্যে অবচেতনে থাকে ‘মৃত্যুপ্রবৃত্তি’। পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রভাবে এটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে তখনই ‘মরিবার সাধ’ হয় তার। কবির কবিতায় আর চিত্র পরিচালকের নির্দেশনায় আত্মহত্যা কখনো হয় মহিমান্বিত যার ফল হয় ভয়াবহ।
আমেরিকান ফাউন্ডেশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশনের মেডিকেল ডিরেক্টর, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হার্বার্ট হেনডিন বলেছেন, ‘নান্দনিকতার আবরণে আত্মহত্যাকে শৈল্পিক করে দর্শক বা পাঠকের জন্য আকর্ষণীয়ভাবে প্রচারমাধ্যমে প্রকাশ করা হলে তা আত্মহত্যার প্রবণতাকে বাড়িয়ে তোলে। উদাহরণস্বরূপ নিউইয়র্ক টাইমস-এর একটি প্রতিবেদনের কথা তিনি বলেন, যেখানে স্কুল পড়ুয়া দুই কিশোর-কিশোরীর আত্মহত্যাকে রোমিও জুলিয়েটের কাহিনির সঙ্গে তুলনা করে বর্ণনা করা হয়েছে। এভাবে ‘রোমান্টিক ফ্লেভার’ দেওয়ায় কিশোর-কিশোরীদের কাছে আত্মহত্যা তথাকথিত মহৎ বা অনুকরণীয় কোনো দৃষ্টান্ত বলে ভুলভাবে উপস্থাপিত হতে পারে। (সূত্র; প্রথম আলো ১২ ডিসেম্বর ২০১৮)
পারমার্থিক প্রেক্ষাপট থেকে আত্মহত্যার কারণ
গবেষকরা গবেষণার মাধ্যমে আত্মহত্যা সম্পর্কে যে উপরোক্ত ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ প্রদান করেছেন তা অনেকটা জড় স্তরেই সীমাবদ্ধ। আত্মহত্যা সমস্যার গভীর প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে এটি মূলত অন্য কারণ তুলে ধরে। পারমার্থিক শাস্ত্রে এ সম্পর্কে সূক্ষাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ রয়েছে। জাগতিকভাবে বলা হয় যে, মূল হতাশা বা অপূর্ণ বাসনা থেকেই আত্মহত্যার উৎপত্তি।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (২/৬২-৬৩) এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, যখন জীব বাসনা করে তখন সেটি নিয়ে মানসিক স্তরে ধ্যান করতে থাকে এবং একপর্যায়ে এটি তীব্র কামনাতে পর্যবসিত হলে তা যদি ব্যর্থ হয়, তখনই হত্যাশার উদয় হয়। অর্থাৎ, আরও সূক্ষ স্তরে বললে চরম আসক্তি থেকেই এই হতাশা এবং পরবর্তীতে কেউ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অবশ্য উপরে একজন গবেষক মিথ্যা অহংকারের বিষয়টি তুলে এনেছে, যেটি আরেকটি গুরত্বপূর্ণ কারণ। যদিও সেটিও জাগতিক স্তরে অগভীর ব্যাখ্যা। কিন্তু পারমার্থিক শাস্ত্রে এই বিষয়ে সবচেয়ে সুগভীর ব্যাখ্যা তুলে ধরে আত্মতত্ত্ব জ্ঞানের মাধ্যমে। জীবের স্বরূপ হল আত্মা, যা ভগবানের নিত্য অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর আত্মার প্রকৃতিই হল ভগবানের সেবা করা।
কিন্তু সেটি না করে যখন সে এ জড় দেহকে নিজের স্বরূপ বলে মনে করে দেহের সঙ্গে সম্পর্কিত সবকিছুকে নিজের ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য মনে করে। এটিই হল মিথ্যা অহংকার, আর তখন জড় ভোগবাসনায় অতি মাত্রায় লিপ্ত হলে কোন কারণবশত কামনা-বাসনাও পূরণে ব্যর্থ হলেই জীব আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেই। এক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত মন ধ্বংসাত্মক ভূমিকা পালন করে। অধিকাংশ মানুষই মনকে নিয়ন্ত্রণ করার সুগভীর ও যথার্থ কৌশল সম্পর্কে অবগত নয়। তাই মনের দাসত্ব অবলম্বনের মাধ্যমেও জীব আত্মহত্যার পরিণতি বেছে নেয়।
সামাজিক সংস্কৃতিও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায় বর্তমান যুগে মানুষের মধ্যে যেরকম আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়, তা কিন্তু প্রাচীন বৈদিক যুগে অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে। কেননা তখনকার বৈদিক সংষ্কৃতি ছিল ধর্মীয় অনুশাসন ভিত্তিক। ভগবৎ কেন্দ্রিক সংস্কৃতি প্রতিটি জীবের আত্ম ও মানসিক স্থিতিকে ইতিবাচক প্রবণতায় গড়ে তুলত। তাই আত্মহত্যার আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হল, বর্তমান নোংরা সভ্যতার অপসংষ্কৃতি। সংষ্কৃতি যেরকম, জীবের মনোভাবও সেরকম। তাই এরকম একটি সংষ্কৃতিতে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়।
আত্মহত্যা কোন সমাধান নয়
শ্রীল প্রভুপাদ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে আত্মহত্যা যে মোটেই গ্রহণ যোগ্য নয় সে বিষয়ে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, “যদি কেউ হতাশার কারণে আত্মহত্যা করে, তবে তার মাধ্যমে তার দুঃখ দুর্দশার শেষ হয়ে যায় না। সে আত্মহত্যার মাধ্যমে নতুন আরও একটি দুঃখ দুর্দশা নিয়ে আসে। যেরকম রাষ্ট্রের আইনে যদি কেউ আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে এবং অবশেষে বিষ পান করে এবং তারপর চিকিৎসার পর যদি সে স্বাভাবিক হয়ে যায় তবে পুণরায় সে রাষ্ট্রের আইনের অধীন হবে এবং শাস্তি পাবে। সম্ভবত আপনারা এটি জানেন, বিষের প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্ত হওয়ার পর, সে রাষ্ট্রে অপরাধ কোডের অধীন হয়। “কেন তুমি আত্মহত্যা করেছ?” তদ্রুপ জড়া প্রকৃতির নিয়মের অধীনে কেউ যদি আত্মহত্যা করে, সেটি আরেকটি অপরাধমূলক কার্য সুতরাং আত্মহত্যার মাধ্যমে জীবনের দুঃখদুর্দশার অবসান করার মাধ্যমে সবকিছু থেকে মুক্ত হওয়া যায় না। (গীতা প্রবচন, ৪র্থ অধ্যায় ১৩-১৪ নিউইয়র্ক, ১ আগষ্ট, ১৯৬৬)
শ্রীল প্রভুপাদ এক সাক্ষাতকারে আরেকটি দৃষ্টান্ত প্রদান করেছেন এভাবে, “যেরকম একটি অপরাধী স্বাভাবিকভাবে জেলখানা থেকে বেরিয়ে যেতে পারে না, কিন্তু যে কোন অস্বাভাবিক উপায়ে হোক সে দেয়াল টপকাতে পারে। তারপর এর মাধ্যমে সে আবারও অপরাধীতে পরিণত হয়, জেলের বদ্ধদশার মেয়াদ আরো বেড়ে যায়। ফলে তাকে আবারও গ্রেফতার করা হবে এবং তার জেলের বদ্ধদশা বৃদ্ধি করা হবে অথবা তার জন্য আরও শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। (শ্রীল প্রভুপাদ কথোকথন, নিউইয়ক, ৪ জুলাই, ১৯৭২)
আত্মহত্যার পর জীবের গতি কি হয় সে বিষয়ে শ্রীল প্রভুপাদ বিশ্লেষণ করেছেন, “ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে” (গীতা ২/২০)। সে হল গর্দভ। সেই এ সম্পর্কে জানে না। এই শরীর শেষ করার মাধ্যমে সে শেষ হয়ে যায় না, সেটি সম্ভব নয়। এর ফলটি হল যেহেতু সে জড়া প্রকৃতির আইন লঙ্ঘণ করেছে, তাই সে একটি ভূতের শরীর লাভ করে। সেটিই তাঁর জীবন। ভূত মানে জড় শরীর বিহীন। সে সূক্ষ্ম শরীর, মন ও বুদ্ধিতে অবস্থান করে। এজন্যে ভূত খুব দ্রুত যেখানে সেখানে যেতে পারে কেননা সে মনের মধ্যে অবস্থান করছে। মনের গতি অত্যন্ত প্রবল। এ জড় শরীর নিয়ে তুমি সে মহূর্তেই শত শত মাইল দূরে যেতে পার না। কিন্তু যদি তুমি মনের শরীরে থাক, তবে মুহূর্তেই অনেক দূরে হাজার হাজার মাইল সেকে-ের মধ্যেই যেতে পারবে। এজন্যে ভূতরা অবাক করা অনেক কিছু করতে পারে। কিন্তু এর মাধ্যমে তারা সুখী নয়, কেননা তাদের কোন স্থুল শরীর নেই। তারা উপভোগ করতে চায়।
তারা হল জড়বাদী। একজন আত্মহননকারী ব্যক্তি জড় কিছু পাওয়ার জন্য আত্মহত্যা করেছে। সে জড় বাসনা পূর্ণ করতে চায়। সে জীবদ্দশায় তা পারে নি বলেই আত্মহত্যা করছে। কিন্তু তার বাসনা তার সাথে রয়েই যায় এবং তা পূরণ করতে পারে না। সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। এজন্যে ভূত মাঝে মাঝে বিভিন্ন গলোযোগ বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।”(শ্রীমদ্ভাগবত প্রবচন, ৩/২৬/২৭ বোম্বে, জানুয়ারি ৪/১৯৭৫)
শ্রীল প্রভুপাদ আরেকটি প্রবচনে এই ভূত শরীর থেকে জীবকে পুনরায় স্থুল শরীরে প্রত্যাগমনের জন্য শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করেন। তিনি উল্লেখ করে, “শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের অর্থ হল, আমার পিতা বা আত্মীয় যদি এখনও স্থুল শরীর না পেয়ে থাকে, তবে এই শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান তাকে আরেকটি স্থুল শরীর পেতে সহায়তা করবে।” (ভক্তিরসামৃতসিন্ধ প্রবচন, বোম্বে, ১০ জানুয়ারি ১৯৭৩)
আত্মহত্যা যে কোন সমাধান হতে পারে না, সে বিষয়ে শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, “বৈদিক শাস্ত্রানুসারে আত্মহত্যা জড় জগতে বিদ্যমান কোন সমস্যার সমাধান করতে পারে না। কেননা, আত্মহননকারী ব্যক্তিকে পুনরায় একটি মরণশীল দেহে জন্ম নিতে হয়। যেহেতু আত্মহত্যা হল একটি সহজাত পাপকর্ম, তাই পুনরায় জন্ম নেওয়ার সে দুর্ভাগা ব্যক্তিকে পূর্বের চেয়ে আরো অধিক দুঃখ দুর্দশাময় পরিস্থিতিতে নিক্ষেপ করা হয়। তাই,দুঃসহ দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তি পেতে কিংবা তা হ্রাস করা পরিবর্তে ‘আত্মহত্যা’-কেবল সেটিকে আরো বৃদ্ধি করে। জড় শরীরের বিপদাপন্ন অবস্থা থেকে সত্যিকার অর্থে মুক্ত হওয়ার জন্য, জীবকে অবশ্যই সে সমস্ত বিপদের মূল উৎস সম্পর্কে উপলব্ধি করতে হবে।”
পারমার্থিক আত্মহত্যা
জড় শরীরের অবসান ছাড়াও আরেকপ্রকার আত্মহত্যা রয়েছে, সেটি হল পারমার্থিক আত্মহত্যা। অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে গিয়ে আত্মইন্দ্রিয় তৃপ্তি করার যে পন্থা বর্তমান যুগের লোকেরা বা সভ্যতা গ্রহণ করছে তা আরো ভয়ংকর ধরনের আত্মহত্যা। এ বিষয়ে শ্রীল প্রভুপাদের একজন শিষ্য শ্রীমৎ গৌর গোবিন্দ স্বামী নিম্নক্ত বিবৃতি দিয়েছিলেন, “আজকাল সাধারণ লোকের ধারণা এই যে, পাশ্চাত্য দেশের লোকেরা অর্থাৎ আমেরিকা ও ইউরোপের লোকেরা আমাদের থেকে অধিক সভ্য ও শিক্ষিত। কারণ তারা জড় বিজ্ঞানে অধিক অগ্রগতি করে বহু কুহক অর্থাৎ যাদুবিদ্যা প্রদর্শন করছে। তারা আণবিক বোমা তৈরী করছে এবং ধ্বংস ক্রিয়ার সাহায্য করছে। যে আণবিক বোমা তৈরি করতে পারছে সে ভাবছে, তার জীবন সার্থক, সে খুব বুদ্ধিমান, সে খুব সভ্য, সে খুব শিক্ষিত। কিন্তু সে জানে না যে, তার এই শিক্ষা-সভ্যতার কিছুই মূল্য নেই। এর দ্বারা সে যে আত্মঘাতী হতে চলেছে, তা সে বুঝতে পারে না। সে যে এই জড় শরীর নয় সে দিব্য আত্মা অর্থাৎ পরমাত্মার অংশ বিশেষ যে পর্যন্ত সে এই শিক্ষা বা জ্ঞান লাভ না করছে এবং বিশেষ করে যে-পর্যন্ত সে আত্মোন্নতি বা আত্মকল্যাণের দিকে অগ্রগতি করার জন্য চেষ্টা না করছে, সে পর্যন্ত সে আত্মঘাতী হতে চলেছে বলে বুঝতে হবে। শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে-
অর্থাৎ “জীবনের সর্ব কল্যাণপ্রদ অত্যন্ত দুর্লভ মনুষ্য দেহ, প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে আপনা থেকেই লাভ হয়ে থাকে। এই মনুষ্যদেহকে অত্যন্ত সুষ্ঠুরূপে নির্মিত একখানি নৌকার সঙ্গে তুলনা করা যায়, যেখানে শ্রীগুরুদেব রয়েছেন কা-ারীরূপে এবং পরমেশ^র ভগবানের উপদেশাবলীরূপ বায়ু তাকে চলতে সহায়তা করছে, এই সমস্ত সুবিধা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি তার মনুষ্য জীবনকে ভবসমুদ্র থেকে উত্তীর্ণ হতে উপযোগ না করে, তাকে অবশ্যই আত্মঘাতী বলে মনে করতে হবে।” (ভা. ১১/২০/১৭)
বর্তমানে সমস্ত প্রকার বৈজ্ঞানিক উন্নতি (অর্থাৎ জড় বিজ্ঞানের উন্নতি) সত্ত্বেও সে জন্ম-মৃত্যু চক্র থেকে নিজেকে উদ্ধার করতে পারেনি। মৃত্যুর কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারিনি। সে কিরূপে রক্ষা পাবে এই জ্ঞান তার নেই। তাই সে মৃত্যু বা ধ্বংস ক্রিয়াকে কেবল অগ্রগতি করাচ্ছে (আণবিক বোমা তৈরী করে)। জন্ম, মৃত্যু, জরা ও ব্যাধি এটাই মুখ্য সমস্যা। কোন বৈজ্ঞানিক এই সমস্যার সমাধান করেছে কি, বল তো দেখি? বৈজ্ঞানিকগণ এই মুখ্য সমস্যাটা তারা এড়িয়ে কতকগুলি গৌণ সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু মনে রাখবেন, এই সমস্যাটা এড়াতে তারা পারবে না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সকলের সম্মুখে এই সমস্যাগুলি উপস্থাপন করেছেন-
“জন্ম-মৃত্যু-জরা ব্যাধি দুঃখ দোষানুদর্শনম্।” যিনি প্রকৃত দ্রষ্টা তিনিই কেবল এই সমস্যাগুলি দেখতে পাবেন। কিন্তু বৈজ্ঞানিকগণ এই সমস্যার সমাধান সম্বন্ধে কিছু করতে পারেনি কিংবা করতে পারবে না। যে আণবিক বোমা সে অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক তৈরী করছে, সেই বোমা ব্যবহার করে সে যে কেবল অন্যকে ধ্বংস করবে তাই নয়, সে নিজেও ধ্বংস হবে।
প্রকৃত সমাধান
মনে রাখবেন, নিম্ন লিখিত তিনটি কথা বুঝতে পারলে সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। প্রথম কথা হল ভগবান হচ্ছেন সবকিছুর মালিক। দ্বিতীয় কথা তিনিই হচ্ছেন একমাত্র উপভোগকারী অর্থাৎ তিনি ব্যতীত আর কেউ উপভোগকারী নন। গীতায় ৯/২৪ তিনি বলেছেন “অহংহি সর্বযজ্ঞানাং ভোক্তা চ প্রভুরেব চ।” “অর্থাৎ আমিই একমাত্র উপভোগকারী ও প্রভু।” আর তৃতীয় কথাটি হল তিনি হচ্ছেন সকলের একমাত্র শুভাকাঙ্খী বন্ধু। “সুহৃদং সর্বভূতানাং” (গীতা ৫/২৯)।
প্রকৃতপক্ষে জাগতিক ও পারমার্থিক দুই প্রকার আত্মহত্যার বিষয়ে প্রকৃত সমাধান হল ভগবদ্্ কথা শ্রবণ। ভগবদ্্ কথা শ্রবণ ব্যতীত ভগবানের অংশ জীবাত্মার নিজ স্বরূপের পুনঃ উন্মেষের অন্য পন্থা নেই। “অপ্রাকৃত বস্তু নহে প্রাকৃত-গোচর।” (চৈ.চ.ম. ৯/১৯৬)
তাই অপ্রাকৃত ভগবদ্ ভক্তের মুখ থেকে হরিকথা শ্রবণ করা উচিত। তা হলে আত্মার স্বাভাবিক বৃত্তির উদয় তথা সচ্চিদানন্দ অনুভূতি লাভ সম্ভবপর হয়। সর্বশ্বরেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সম্বন্ধ-জ্ঞানশূণ্য বদ্ধজীব ভক্তি-উন্মুখী সুকৃতি প্রভাবে সৎসঙ্গ প্রাপ্ত হলে এবং সাধুর কৃপায় চিদ্বল প্রাপ্ত হলে আচ্ছাদিত ও সঙ্কুচিত চেতনাবস্থা থেকে ক্রমশ মুকুলিত, বিকশিত কিংবা পূর্ণ বিকশিত চেতনাবস্থা প্রাপ্ত হয়। সেজন্য বলা হয়েছে “লবমাত্র সাধু-সঙ্গে সর্ব্বসিদ্ধি হয়।” (চৈ.চ.ম ২২/৫৪)
সাধু সঙ্গে ভক্তিময়ী বৃত্তির স্ফূরণ ও শ্রদ্ধা সহকারে শ্রবণ কীর্তনের ফলে ভজনীয় বস্তুর দর্শন হয়। অতঃপর এর মাধ্যমে আত্মহত্যার মত প্রবণতা সমাজ থেকে দূর হওয়া তখন সময়ের ব্যাপার হবে মাত্র। কেননা, এভাবে প্রতিটি জীবাত্মার চেতনা শুদ্ধ হলে তারা জীবন সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। হরেকৃষ্ণ!