এই পোস্টটি 230 বার দেখা হয়েছে
শ্রীমান সত্যরাজ দাস: শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামীর জীবনে যা অনেক গভীর হলেও বিরল নয় যাতে আমরা তাঁর পারমার্থিক দৃঢ়তা ও মানুষের জীবনে তাঁর ভক্তিময় প্রভাব দেখতে পাই। কৃষ্ণভাবনামৃতে একজন নবাগতভক্ত, অর্জুন ভট্টাচার্য, স্ট্রোকের পরও জয়পতাকা স্বামীর আধ্যাত্মিক শক্তি সম্পর্কে, তাঁর উপলব্ধি ব্যক্ত করে বলেন, এটি ছিল ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ। তার মাত্র এক বছর আগেই আমি কোলকাতা ইস্কনের সান্নিধ্যে এসেছি। এর পূর্বে আমার কখনও বিখ্যাত কোলকাতা রথযাত্রা দর্শনের সুযোগ হয়নি। সেই বছর আমি রথযাত্রায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। পার্ক সার্কাস থেকে আমি কিছুটা আগেভাগেই সেখানে পৌঁছাই, জানতাম না যে, শোভাযাত্রা শুরু হতে অনেক সময় লাগে। ক্রমান্বয়ে ভগবান শ্রীজগন্নাথ, শ্রীবলদের এবং সুভদ্রা মহারাণী আগমন করলেন এবং সুখভরে তাঁদের নিজ-নিজ রথে আরোহণ করলেন। দেখলাম সবচেয়ে বেশি ভিড় হয়েছে শ্রীজগন্নাথদেবের রথের সামনে। তাই এই ভেবে আমি ওখানটাতেই থাকব ঠিক করলাম যে, এতে করে আমি অনুষ্ঠানের সবচেয়ে আনন্দঘন বিষয়গুলোর কাছাকাছি থাকতে পারব।
হঠাৎ করেই সেই ভিড়ের মধ্যে যেন একটা ঢেউ আছড়ে পড়ল। আমি বুঝতে পারছিলাম যে, রথের ঠিক সামনেই কিছু একটা ঘটছে। ভক্তবৃন্দ “হরিবোল! হরিবোল!” ধ্বনিতে চিৎকার করছিলেন, বাঙ্গালী নারীরা “উলুধ্বনি” করছিলেন এবং সম্পূর্ণ পরিবেশটি ছিল অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ। রথের উপর থেকে ঘোষণাকারী ভক্তটিও খুব আবেগঘন এবং আনন্দে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। যেহেতু এই সবকিছুই আমার কাছে ছিল নতুন, তাই আমি দেখতে চেয়েছিলাম যে, আসলে হচ্ছেটা কি।
সুতরাং আমি ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেলাম। আমি ভেবেছিলাম হয়ত বিখ্যাত কোন তারকা বা মন্ত্রীকে দেখব, কিন্তু আমি দেখলাম কেউ একজন হুইলচেয়ারে বসে, পরম শ্রদ্ধাভরে ভগবান শ্রীজগন্নাথের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তাঁর চারপাশ ঘিরে লোকেরা দাঁড়িয়েছিল, এবং আক্ষরিক অর্থেই ভাববিহ্বল হয়ে তাঁরা কান্না করছিলেন। আমার কোন ধারণাই ছিল না যে, ব্যক্তিটি কে ছিলেন, কিন্তু সেই অবস্থা দেখে আমার রোমহর্ষণ হচ্ছিল। তিনি হাঁটতে পারতেন না, কথা বলতে পারতেন না, তাঁর নিজের শরীরের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাই ছিল না বললে চলে। আমি প্রায় তাঁর ঠিক পেছনেই ছিলাম। তখনকার দিনে, শোভাযাত্রা শুরু হওয়ার আগে, রথে ওঠা-নামা করতে, সেবায়েতদের জন্য একটি কাঠের মই ব্যবহার করা হতো।
আমি লক্ষ্য করলাম যে, তাঁর পাশে থাকা ভক্তেরা তাঁর হুইলচেয়ারটি মইয়ের কাছাকাছি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিলেন এবং তারপর ৫-৬ জন মানুষ রীতিমতো সংগ্রাম করছিলেন তাঁকে চেয়ার থেকে উঠিয়ে, সেই মইটির অসম্ভব সরু ধাপগুলি বেয়ে ভগবান শ্রীজগন্নাথের কাছে উঠাতে। আমার মন কেবল একটিই প্রশ্ন করছিল, “কেন?” সকলের মনোযোগ শুধুমাত্র এই একটি ব্যক্তির ওপরেই কেন? তাঁরা সবাই কেন তাঁকে, কেবলমাত্র ভগবান জগন্নাথের কাছে যাবার জন্য রথের ওপরে ঠেলে উঠাতে, এত সমস্যার মধ্যে যেতে দিচ্ছেন? আমি ভাবলাম, ওনার তো উচিত কেবল বিছানায় শুয়ে থাকা আর বিশ্রাম করা।
এই সব চিন্তা আমার মনকে আচ্ছন্ন করে ছিল। তাঁকে রথের ওপরে ওঠানোর জন্য ব্যাপক চেষ্টা করা হচ্ছিল। তাঁর দেহের ওপর বাস্তবে তার কোন নিয়ন্ত্রণই ছিল না। তিনি এমনকি নিজে নিজে এক কদমও হাঁটতে পারতেন না। তাঁর আকৃতি ছিল বিশাল, আর ভগবান জগন্নাথের কাছে পৌঁছানোর পথটি ছিল অত্যন্ত কঠিন।
অকস্মাৎ, আমি আমার উত্তর পেয়ে গেলাম। তাঁরা সবাই মিলে যাঁকে ঠেলছেন, আসলে তিনি নিজেই ভগবান শ্রীজগন্নাথের কাছে যেতে প্রবলভাবে দৃঢ়সংকল্প ছিলেন। তিনি ভগবানের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে আরতি ও প্রার্থনা নিবেদন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, ঠিক যেমনটি তিনি এর আগের প্রতিটি বছরই করেছেন। সমবেত জনসাধারণকে এটি দেখাতে তিনি দৃঢ়সংকল্প ছিলেন যে, তিনি এখনও বেঁচে আছেন, তাঁর দেহের ওপর দিয়ে যাওয়া সমস্ত অগ্নিপরীক্ষা তিনি পেরিয়ে এসেছেন এবং তিনি ভালই আছেন। তিনি এদিকটায় ঘুরলেন। প্রথমবারের মতো আমি তাঁর মুখমণ্ডল দেখতে পেলাম। মুখ খোলা, একটি চোখ খোলা, এবং নিশ্চিতভাবেই তিনি বহু কষ্টের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন।
আমার পাশে দাঁড়ানো একজন ব্যক্তি কাঁদছিলেন এবং খুব উচ্চস্বরে বাংলায় বলতে লাগলেন, “এ সবই আপনার লীলা!”
আমার গায়ে রোমহর্ষণ হচ্ছিল। উপস্থিত জনতা শীঘ্রই নীরব হয়ে গেলেন। কেউ একজন আপাতদৃষ্টিতে সেই অক্ষম মানুষটির সামনে, তাঁকে কথা বলার জন্য উৎসাহিত করে, একটি মাইক্রোফোন ধরলেন। তিনি ছিলেন শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী।
সেটি ছিল তাঁর স্ট্রোকের পর, কোন গুরুত্বপূর্ণ বিশাল জনসমাবেশের সামনে প্রথম আবির্ভাব এবং সমস্ত জায়গা থেকে লোকেরা তাঁকে দেখতে এসেছিলেন। তিনি প্রভুপাদের প্রণাম মন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে শুরু করলেন, তারপর পঞ্চতত্ত্ব মন্ত্র এবং তারপর ‘হরেকৃষ্ণ’ মহামন্ত্র গাইতে লাগলেন। সমবেত জনতা হাতে তালি দিয়ে তাঁর সঙ্গে কীর্তনে যোগ দিলেন। তিনি ধীরে ধীরে, অনেক প্রচেষ্টা সহকারে প্রভুপাদের মহিমা কীর্তন করলেন, অতঃপর ভগবানের পবিত্র নামের মহিমা কীর্তন করলেন। শ্রীল প্রভুপাদ তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন কোলকাতা রথযাত্রাকে বিশাল, প্রকাণ্ড আকার করতে। অতএব তিনি নিজে কোনদিন একবারও কোলকাতা রথযাত্রা বাদ দেননি এবং সেই দৃঢ়তা থেকেই তিনি গুরুতর শারীরিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও এখানে এসেছেন শুধুমাত্র তাঁর গুরুদেবকে সন্তুষ্ট করতে। এই ছিল তাঁর দৃঢ়সংকল্প।
আমি অনুভব করলাম যে, আমার গাল বেয়েও অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আমার মনে হলো, আমার উচিত ওনার আশীর্বাদ গ্রহণ করা। এরপর শীঘ্রই, আমি আবারও দেখলাম যে, ভক্তরা তাঁকে অনেক কষ্ট করে রথ থেকে নামাচ্ছেন। আমি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় ছিলাম, যেকোন সময় যেকোন কিছু ঘটতে পারে। কিন্তু এটি ছিল ভগবান শ্রীজগন্নাথের রথ। যখন ভগবান কাউকে রক্ষা করেন, তখন কোন খারাপ কিছুই ঘটতে পারে না। ভক্তগণ তাঁকে নিয়ে এসে তাঁর হুইল চেয়ারে বসালেন এবং দ্রুত তাঁকে নিয়ে চলে গেলেন। যেকোনো ভাবেই হোক, আমি তাঁকে আমার দৃষ্টিপথের আড়াল হতে দিইনি। আমি কাছেই দাঁড়িয়েছিলাম, তাঁকে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, “ওহ্ কৃষ্ণ, তুমি কিভাবে পারো তোমার এত প্রিয়জন কাউকে এত বেশি ভোগান্তি দিতে?” কিন্তু এই ব্যক্তিটিকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি সত্যিই অনেক সুখী ছিলেন, গভীর আনন্দে মগ্ন ছিলেন, এবং তাঁর চারপাশে থাকা প্রত্যেকেই যেন তেমন ছিলেন।