এই পোস্টটি 657 বার দেখা হয়েছে
পুরুষোত্তম নিতাই দাস
বৈষ্ণবরা প্রধানত চারটি মুখ্য বৈষ্ণবীয় বিদ্যালয় বা সম্প্রদায়কে স্বীকৃতি দেন। ব্রহ্ম, শ্রী, রুদ্র এবং কুমার সম্প্রদায়। শ্রীপাদ রামানুজাচার্য শ্রী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য। বৈষ্ণবীয় বিদ্যালয় বা বিষ্ণু পূজার সূচনা হয়েছিল ভগবান বিষ্ণুর পত্নী লক্ষ্মীদেবী বা শ্রী থেকে। তাঁর বেদান্ত ভাষ্য শঙ্করাচার্যের ভাষ্যের পরিপন্থী ছিল। মূলত দক্ষিণ ভারতের তামিল ভাষাভাষী লোকদের আজ শ্রী সম্প্রদায়-ই মূখ্য। তিনি বেদান্ত দর্শনকে বিশিষ্ঠা দ্বৈতবাদ বা বিশেষ অদ্বৈতবাদ নামে উপস্থাপিত করেছিলেন। তাঁর বেদান্তের ওপর বহু ভাষ্যের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত ভাষ্য হচ্ছে ‘শ্রীভাষ্য’, ‘ভগবদ্গীতার টিপ্পনী’, ‘বেদান্ত সার’ এবং ‘বেদার্থ সংগ্রহ’।
শ্রী রামানুজ আচার্য ১০১৭ সালে চৈত্র মাসে (এপ্রিল-মে) আবির্ভূত হয়েছিলেন। শ্রী রামানুজের পিতা কেশবাচার্য বৈদিক যাগ যজ্ঞের প্রতি অধিক মাত্রায় আগ্রহী ছিলেন। যখন রামানুজ যুবা অবস্থা প্রাপ্ত হলেন তখন তিনি বেদ, তর্কশাস্ত্র, ব্যাকরণ ইত্যাদি শিক্ষার জন্য সংস্কৃত বিদ্যালয়ে ভর্তি করেছিলেন। যদিও রামানুজ ব্রাহ্মণ বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন তথাপি তিনি গোঁড়া তামিল স্তবের মাধ্যমে ভগবান বিষ্ণুর পূজাকে প্রকাশিত করেন নি। তাঁর স্বাভাবিক ভক্তি ইতিমধ্যেই কাঞ্চীপূর্ণ নামে শ্রীযামুনাচার্যের এক অব্রাহ্মণ ভক্তের সঙ্গ করে জাগ্রত হয়েছিল এবং শ্রী রামানুজ তাঁর বাল্য অবস্থা থেকেই অত্যন্ত সদাচারী ছিলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি সনাতন ধর্মের আচার্যনিষ্ঠ শুদ্ধিকরণ পন্থাগুলি অনুশীলন করেছিলেন, তাঁর উপনয়নও হয়েছিল এবং ষোল বৎসর বয়সে বিবাহ করেন।
বিবাহের এক মাস পরে রামানুজের পিতা ঘোর ব্যাধিতে আক্রান্ত হন এবং মৃত্যু মুখে পতিত হন। তাঁর পিতার মৃত্যুর পর রামানুজ তাঁর পত্নী সহিত কাঞ্চিপুরম্ গমন করেন। সেখানে তিনি যাদব প্রকাশের নৈর্ব্যত্তিক বেদান্তবাদ সংস্কৃত বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। শ্রী রামানুজ অতি শীঘ্রই যাদব প্রকাশের সমস্ত ছাত্রের মধ্যে অতি উৎকর্ষতা লাভ করেন এবং শিক্ষকের অতি প্রিয় ছাত্রে পরিণত হন। যাদব প্রকাশ অদ্বৈতবাদের ধর্মীয় তত্ত্ব প্রকাশ করেন এবং সমস্ত মায়া প্রকৃতির উপরে আলোকপাত করেন। যেহেতু রামানুজের ভাব ভগবান বিষ্ণুর তুষ্টি বিধানের জন্য ছিল তাই এই ব্যাখ্যা তাঁর মনে বিরাগ ভাবের জন্ম দিল। তথাপি তিনি শিক্ষাগুরুর সন্মানার্থে বিতর্ক এড়িয়ে গেলেন। শীঘ্রই সেই দিন উপনীত হল যখন তিনি যাদব প্রকাশের নৈব্যক্তিক অদ্বৈতবাদকে আর সহ্য করতে পারছিলেন না।
একদিন রামানুজ তাঁর গুরুদেবের পৃষ্ঠমর্দন করছিলেন তখন যাদব প্রকাশ ছান্দোগ্য উপনিষদের একটি ভাষ্যের ব্যাখ্যা করছিলেন। ভাষ্যটিতে ‘কপিশ্যম্ পুণ্ডরীকম্ এবম্ আক্ষিণী’ শব্দটি ছিল। এতে শঙ্করাচার্যের ভাষ্যকে অনুকরণ করে যাদব প্রকাশ ব্যাখ্যা করলেন যে, ‘কপি’ মানে ‘বানর’ এবং ‘আসনম’ মানে ‘গাধা’। তাঁর গুরুদেবের এই ঈশ্বরনিন্দা তাঁকে খুব ক্রুদ্ধ করেছিল এবং গভীর ক্রোধে তাঁর দুই চক্ষু দিয়ে উষ্ণ অশ্রু প্রবাহিত হয়ে তার গুরুদেবের পৃষ্ঠদেশে পতিত হলো। যাদব প্রকাশ বুঝতে পারলেন যে, তাঁর শিষ্য বিরক্ত হয়েছে এবং গুরুদেব বিরক্তির কারণ জানতে চাইলেন। যখন রামানুজ তার গুরুদেবের ব্যাখ্যার ব্যাপারটিকে তার বিরক্তির কারণ হিসাবে ব্যক্ত করলেন তখন যাদব প্রকাশ বিস্মিত হয়ে গেলেন। তিনি রামানুজের ব্যাখ্যা চাইলেন। শ্রী রামানুজ ‘কপিশ্যম’ শব্দের ব্যাখা করে বললেন, ‘যা জলাশয়ের উপর উপবিষ্ট এবং জলপানে সমৃদ্ধ হয়।’
শ্রীপাদ রামানুজাচার্য প্রায় ১২০ বৎসর কাল জীবিত ছিলেন। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় চুয়াত্তরটি শ্রী বৈষ্ণবীয় কেন্দ্র গড়ে তোলেন এবং হাজার হাজার অনুগামীও ছিল। সেই অনুগামীদের মধ্যে অনেক রাজা, জমিদার এবং ধনী ব্যক্তিও ছিল। অগণিত গৃহী ভক্ত ছাড়াও প্রায় সাতশ সন্ন্যাসী ভক্ত, বারো হাজার ব্রহ্মচারী ভক্ত এবং তিনশত মহিলা ছিলেন যারা আত্মত্যাগের অঙ্গীকার করেছিলেন। অবশেষে তিনি যখন দেখলেন যে, এই পৃথিবীতে তার সংকল্পিত কার্য সম্পাদিত হয়ে গেছে তখন তিনি তার নশ্বর দেহত্যাগ করে পরমেশ্বর ভগবানের নিকট বৈকুণ্ঠ ধামে ফিরে যাওয়ার মনস্থ করলেন। তা অবগত হয়ে তাঁর ভক্তরা অঝোর ধারায় অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন এবং গভীর ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে উঠলেন।
অন্তিম নির্দেশাবলী
তাদের কান্নার শব্দ শুনে শ্রী রামানুজাচার্য বারান্দাতে বেরিয়ে এলেন এবং তার শিষ্যদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘হে আমার প্রিয় সন্তানেরা, তোমরা অশিক্ষিত লোকের মতো কেন দুঃখে কান্নাকাটি করছ? তোমরা কি মনে করো এই দেহ চিরকাল থাকবে? আমি কি তোমাদের হৃদয়ে চিরকালের জন্য বিরাজ করব না? তাই এই নিরর্থক বিলাপ বন্ধ করে এবং ভগবানের ইচ্ছাকে উপলব্ধি করতে চেষ্টা কর।’
এতে সমস্ত শিষ্যরা বলল, ‘হে গুরুদেব যেমন আপনার নির্দেশ সর্বদাই নিখুঁত, তা সত্ত্বেও আপনার বিচ্ছেদ ব্যথা আমাদের কাছে অসহনীয় এবং যা আমাদের গভীরভাবে শোকানলে নিক্ষিপ্ত করছে।’
শ্রীরামানুজ তাদের প্রতি কৃপা করলেন এবং আরও তিনদিন অধিক অবস্থান করে নিম্নোক্ত বিষয়ের উপর ব্যাখ্যা এবং যা আমাদেরকে টিপ্পনী প্রদান করলেন-
১) প্রত্যহ বৈষ্ণব পূজা কর এবং সানন্দে তাদের সঙ্গ কর যেমন নিজ গুরুদেবকে পূজা করা হয় এবং তাদের সেবাতে নিবিড় বিশ্বাস রাখ।
২) শাস্ত্র অধ্যয়ন কর এবং উৎসাহী একনিষ্ঠ ব্যক্তিকে শিক্ষা দাও।
৩) গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে ভগবানের দিব্য নাম জপ কর এবং ভগবানের দিব্য পরম ভাবকে অনুভব কর।
রামানুজাচার্য মহারাজের তিরোধান
যখন রামানুজাচার্য তাঁর প্রবচন সমাপ্ত করলেন, দাশরথী, গোবিন্দ, অন্ধ্রপূর্ণ এবং আরও কতিপয় প্রধান শিষ্যগণ অগ্রসর হয়ে নিবেদন করলেন যে, ‘আপনার দেহ যা সদাসর্বদাই ভগবানের নিত্য সেবাতে লেগেছে, তা কখনো জড় বস্তু হতে পারে না। তাই আমাদের নিবেদন যেন আমরা কখনোই আপনার অপ্রাকৃত অবয়ব দর্শন থেকে বঞ্চিত না হই।’ তাদের প্রতি পরম প্রীত হয়ে রামানুজাচার্য তাদের নিবেদন গ্রহণ করলেন এবং একদল সুদক্ষ ভাস্করকে তার একটি শিলামূর্তি গঠনের নির্দেশ দিলেন। তিন দিন পরে সেই মূর্তি গঠনের কার্য সম্পন্ন হলো। শ্রীপাদ রামানুজাচার্য ধীরগতিতে মূর্তিটির কাছে এলেন এবং তার মস্তকে শ্বাস প্রশ্বাস দ্বারা সমস্ত শক্তি তাতে প্রতিস্থাপিত করলেন। শিষ্যদের দিকে ফিরে বললেন, ‘এটি আমার দ্বিতীয় সত্তা। যখন আমি, আমার এই দেহ ত্যাগ করবো, তখন তোমরা আমার পরিবর্তে এই মূর্তি পূজা করতে পারো।’
তিনি তারপর গোবিন্দের কোলে মাথা, অন্ধ্রপূর্ণের কোলে পা এবং তার পরম গুরুদেবের খড়মের উপর দৃষ্টিনিবদ্ধ করে শুয়ে পড়লেন এবং শ্রীরামানুজাচার্য তাঁর দেহত্যাগ করে ভগবান বিষ্ণুর পরমধাম বৈকুন্ঠে চলে গেলেন। এর কিছুদিন পর রামানুজের ভাইপো এবং সর্বক্ষণের সঙ্গী গোবিন্দ এই জগৎ ত্যাগ করলেন।
অন্যান্য ভক্তরা কুরেশা পুত্র শ্রীপরাশর ভট্টের অধীনে থেকে গেলেন এবং চেষ্টা করতে লাগলেন তাদের গুরুদেবের প্রদর্শিত পথে ভগবান নারায়ণের নিরবিচ্ছিন্ন সেবা করতে। পরাশর রামানুজাচার্যের লক্ষ্য বৈষ্ণব মতবাদের সঠিক প্রচারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকলেন। একটি বিতর্ক সভাতে তিনি বৈদান্তিক মাধব দাসকে পরাজিত করেন যিনি নৈর্ব্যক্তিকবাদের পণ্ডিত ছিলেন। তিনি তাকে ভক্ততেও পরিণত করেন। অনেকদিন পর পরাশরের তিরোধানের পর এই মাধব দাস শ্রীবৈষ্ণবদের আচার্য হন।
এটি মহান বৈষ্ণব আচার্যদেবদের অপ্রাকৃত চিন্ময়লীলার সিন্ধুর এক বিন্দু মাত্র।
(সূত্র: এই অনুচ্ছেদটি শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের রচনাবলী থেকে গৃহীত)
লেখক পরিচিতি: পুরুষোত্তম নিতাই দাস ইস্কন কোলকাতার ভক্তিবৃক্ষের একজন সদস্য। বর্তমানে তিনি টেক মহিন্দ্রায় কর্মরত।
জানুয়ারি-মার্চ ২০১৯ সালে প্রকাশিত ।। ১ম বর্ষ ।। সংখ্যা ১।