এই পোস্টটি 80 বার দেখা হয়েছে
সনাতন গোপাল দাস
শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী বলেছেন-
“এক অদ্ভুত-সমকালে দোঁহার প্রকাশ।
আর অদ্ভুত-চিত্তগুহার তমঃ করে এই দুই ভাই একই সময়ে নাশ ॥”
সূর্য-চন্দ্রের মতো প্রকাশিত। তা পরম আশ্চর্যজনক। আর তাঁরা আমাদের হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশে অজ্ঞান-অন্ধকার দূর করে বাস্তব জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত করেন, তাও অত্যন্ত আশ্চর্যজনক।
শুনিলে খণ্ডিবে চিত্তের অজ্ঞানাদি দোষ।
কৃষ্ণে গাঢ় প্রেম হবে, পাইবে সন্তোষ ॥
কেবলমাত্র বিনীতভাবে তা শ্রবণ করলেই অজ্ঞানতাজনিত হৃদয়ের সমস্ত দোষ খণ্ডন হবে এবং শ্রীকৃষ্ণের প্রতি গভীর অনুরাগ লাভ হবে। এটিই হচ্ছে শান্তি লাভের প্রকৃষ্ট পন্থা। অজ্ঞানতা বলতে আমাদের স্বরূপের অজ্ঞানতা। আমরা যে শ্রীভগবানের সচ্চিদানন্দময় অংশকণা আত্মা, যার বৃত্তি হচ্ছে ভগবৎ-সেবায় অধিষ্ঠিত থাকা সেটিই বুঝতে না পারাকে বলে অজ্ঞানতা। পাঁচ রকমের এই অজ্ঞানতা রয়েছে।
প্রথমত, এই জড় দেহটিকে নিজের স্বরূপ বলে মনে করা। জড় দেহে ‘আমিত্ব’ বুদ্ধি। যদিও এই দেহটি কয়েক দিনের জন্য আমরা পেয়েছি। নিত্য আত্মার দেহ ধারণ করাকে জন্ম বলে, দেহ ত্যাগ করাকে মৃত্যু বলে। ‘আমি’ বলতে আত্মাকেই বোঝায়। তাই ‘আমি দেহ’ এরকম বলি না, ‘আমার দেহ’ বলি। পোশাক গ্রহণ বা পরিত্যাগ করার মতো জীবাত্মা জড় দেহ গ্রহণ ও পরিত্যাগ করে। পোশাক জীর্ণ হলে তাকে আর পরা যায় না, তেমনি দেহ জরাজীর্ণ হয়ে গেলে তাকে ত্যাগ করে নতুন দেহ ধারণ করতে হয়। কিন্তু দেহাত্মবুদ্ধি লোক মনে করে এই দেহ ত্যাগ করলে আর জীবন বলে কিছু নেই। এটি হচ্ছে স্বরূপের অজ্ঞতা।
দ্বিতীয়ত, জড় ইন্দ্রিয় তর্পণকে আনন্দ লাভের উপায় বলে মনে করা। একটা শূকর আহার-নিদ্রা- মৈথুনাদি ইন্দ্রিয় তর্পণ সুখ অনায়াসে যে পরিমাণ লাভ করতে পারে, একটা মানুষ তার চেয়েও অল্প সুখ লাভের জন্য বহু বহু পরিমাণে কষ্ট করতে বাধ্য হয়। ইন্দ্রিয় তর্পণ সুখের জন্য তাকে দুঃখই বয়ে বেড়াতে হয়। আনন্দময় সত্তার সন্ধান না করে এই দুঃখময়, জরা-ব্যাধিময় জগতে সুখ খোঁজার চেষ্টা করছে। জন্ম-মৃত্যুময় জড় জগতে সে ইন্দ্রিয় তর্পণের মাধ্যমে সুখী হওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে।
তৃতীয়ত, জড় জাগতিক আসক্তিজনিত উৎকণ্ঠা। যদি পরীক্ষায় না পাশ হই, যদি চাকরী না পাই, যদি আমাকে না ভালোবাসে, যদি আমি কেসে হেরে যাই, যদি আমাকে না গ্রহণ করে, তবে আমার আর বাঁচার উপায় থাকবে না। আমার জীবন সম্পূর্ণ বৃথা হয়ে যাবে। আমার অমুকের কি হলো, আমার তমুকের কি হলো। এইভাবে দিন দিন নানা উৎকণ্ঠায় যাপিত হয়। উৎকণ্ঠার বিপরীত জগতের কোনও চিন্তাই করতে পারে না।
চতুর্থত, শোক। প্রিয় ব্যক্তি বা প্রিয় বস্তু হারানোর জন্য চিত্তের বৈকল্য। এই জগতে কোন কিছুই আমি নিয়ে আসি নি, কোনও কিছুর সৃষ্টিকর্তাও আমি নই। যা কিছু পেয়েছি সেইগুলি নিয়ে রয়েছি। যা পেয়েছি তা চিরদিনের জন্য থাকবে ও না। কেননা এই জগতের বস্তু চিরন্তন নয়। তা না বুঝে সেই সবই চিরকাল নিয়ে থাকব- এই মনে করি, কিন্তু অবশ্যম্ভাবী নিয়মে সেইসব হারিয়ে যায়, তখন অনর্থক শোকাচ্ছন্ন হয়ে মুহ্যমান হই।
পঞ্চমত, পরম তত্ত্বের অতীত কিছু আছে। বলে মনে করা। এই ধরনের লোক মনে করে-ভগবান আছে কি নেই, তাতে যায় আসে না। ভগবানকে নিয়ে আমার কোনও কাজও নেই। আমাকেই সব কিছু করতে হবে। আমাকেই আমার সংসার দেখতে হবে। আমার ব্যাপার আমাকেই বুঝতে হবে। ভগবান ওসব বোঝে না। আমি কি করছি না করছি, ভগবানও জানে না। কিংবা আমার মতো পরমেশ্বর ভগবানও প্রকৃতির
অধীন। এই রকম অজ্ঞানতা চলছে। কলিযুগের মানুষ ‘সুমন্দ-মতয়া’ বা দুর্বুদ্ধি সম্পন্ন। কলিযুগের ধর্ম হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ নাম সংকীর্তন। কলির কলহমতিপরায়ন মানুষ যদি কৃষ্ণনাম করতে থাকে তাহলে কলুষিত হৃদয় মার্জিত হবে, তখন তার অজ্ঞানতা দূর হবে। তখন সে বুঝতে পারবে এই মনুষ্য জীবন কি এবং কেন? তখন সে বুঝবে কৃষ্ণভাবনামৃতই একমাত্র নিত্য সুন্দর স্বপ্তিময় জীবনের পন্থা। আর সেই পন্থা প্রদানের জন্যই শ্রীশ্রীগৌর-নিত্যানন্দ প্রভু এই জগতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা এই পাঁচ প্রকার অজ্ঞানতাকে দূরীভূত করে। আমরা যা কিছু দেখি অথবা যে সমস্ত অভিজ্ঞতা লাভ করি, সেই সবই পরমেশ্বর ভগবানের শক্তির প্রদর্শন বলে জানতে হবে।