শিব কি ব্রহ্মার চাইতেও শ্রেষ্ঠ!

প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২১ | ৭:৩৩ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২১ | ৭:৩৫ পূর্বাহ্ণ

এই পোস্টটি 472 বার দেখা হয়েছে

শিব কি ব্রহ্মার চাইতেও শ্রেষ্ঠ!
শিব ব্রহ্মার চাইতেও শ্রেষ্ঠ হলে, ব্রহ্মা কিভাবে শিবের পিতা হলেন?

পুরীদাস দাসঃ জড় জগতের তিনটি অবস্থা সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয়। ব্রহ্মা হলেন সৃষ্টিকর্তা, বিষ্ণু হলেন পালনকর্তা, আর শম্ভু বা দেবাদিদেব মহাদেব হলেন সংহার কর্তা। সমগ্র জড় জগৎ জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সত্ত্ব গুণের অধীশ্বর হলেন বিষ্ণু। রজ গুণের অধীশ্বর হলেন ব্রহ্মা এবং তম গুণের অধীশ্বর হলেন শিব বা শম্ভু। 
‘শিব’ শব্দটির অর্থ হলো ‘মঙ্গলময়’। তা সত্ত্বেও শ্রীমদ্ভাগতের বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি ভগবান শিবের নির্মল স্বর্ণাভ দেহ ভষ্মের দ্বারা আচ্ছাদিত। তার জটাজুট শ্মশানের ধূলির প্রভাবে ধূম্র বর্ণ। তিনি সন্ধ্যাকালে ভূতগণ পরিবেষ্টিত হয়ে তাঁর বাহন বৃষভের পিঠে চড়ে ভ্রমণ করেন। অথচ ব্রহ্মার মতো মহাপুরুষেরা তাঁর শ্রীপাদপদ্মে নিবেদিত পুষ্প মস্তকে ধারণ করেন। এই প্রসঙ্গে আর একটি বিষয় উল্লেখ্য, যদিও প্রকৃত ভগবান ব্রজেন্দ্রনন্দন কৃষ্ণ, তবুও বৈদিক সাহিত্যে শিব, ব্রহ্মা বা কোন অত্যন্ত মহান ভগবদ্ভক্তের সম্বোধনেও ‘ভগবান’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু স্বতন্ত্র পরমেশ্বর একমাত্র কৃষ্ণ। বাকি সবাই তাঁর ভৃত্য।
আবার জন্মসূত্রে শিবের পিতা হলেন ব্রহ্মা। ব্রহ্মার অনুরোধ সত্ত্বেও তাঁর প্রথম মানস পুত্র চতুষ্কুমারগণ প্রজা সৃষ্টিতে লিপ্ত হতে অস্বীকার করলে ব্রহ্মার অন্তরে দুর্বিষহ ক্রোধ উৎপন্ন হয়েছিল। যা তিনি সংবরণ করার চেষ্টা করলেও তা তাঁর ভ্ররু মধ্য থেকে বেরিয়ে এসেছিল এবং নীললোহিত বর্ণের একটি শিশু উৎপন্ন হয়েছিল। জন্মের পরেই সেই শিশু ক্রন্দন বা রোদন করতে শুরু করে। ব্রহ্মা তখন বলেছিলেন “হে সুরশ্রেষ্ঠ। যেহেতু তুমি উৎকণ্ঠিত হয়ে রোদন বা ক্রন্দন করেছে তাই প্রজাসমূহ তোমাকে ‘রুদ্র’ নামে অভিহিত করবে।” এ প্রসঙ্গে অনেকে প্রশ্ন করেন শিব ব্রহ্মার চাইতেও শ্রেষ্ঠ হলে ব্রহ্মা কিভাবে শিবের পিতা হলেন? এখানে আমাদের বুঝতে হবে ব্রহ্মা হচ্ছেন জীবতত্ত্ব কিন্তু শিব হচ্ছেন শম্ভুতত্ত্ব। ভগবান যে রকমই বিষ্ণুতত্ত্ব হয়েও আত্মমায়ার প্রভাবে জন্মগ্রহণ করেন সেইভাবে শিবও ব্রহ্মার থেকে আবির্ভূত হলেও তত্ত্বত শম্ভু তত্ত্ব।

শিবতত্ত্ব

শিব জীবতত্ত্ব নন। শিব বিষ্ণুতত্ত্বও নন। শিব হচ্ছেন বিষ্ণুতত্ত্ব ও জীবতত্ত্বের মধ্যবর্তী শিবতত্ত্ব বা শম্ভুতত্ত্ব। বিষ্ণু তত্ত্বের মধ্যে ৬০টি দিব্যগুণ প্রকাশিত হয়। শুদ্ধ জীবাত্মাদের মধ্যে সর্বাধিক ৫০টি দিব্যগুণ প্রকাশিত হয় আর শিবতত্ত্ব বা শম্ভুতত্ত্বের মধ্যে ৫৫টি দিব্যগুণ প্রকাশিত হয়। এই জড়জগত ভগবানের বহিরঙ্গা শক্তি সম্ভুত। বহিরঙ্গা শক্তি জড় হওয়ায় স্বতন্ত্র রূপে কিছু সৃষ্টি করতে সমর্থ নয়। ঠিক যেমন মাতা, পিতার সহায়তা বিনা সন্তান উৎপাদন করতে পারেন না।
ভগবান তাঁর দৃষ্টির মাধ্যমে চিদ্-জগৎ থেকে ভগবৎবিমুখ জীবাত্মাদের জড় জগতে প্রেরণ করলে, জড় জগতে সৃষ্টির সূচনা হয়। এই জড় সৃষ্টির প্রথম জীব ব্রহ্মা। এই দৃষ্টি বা ঈক্ষণ সম্বন্ধে ঐতরেয় উপনিষদে বলা হয়েছ- “স ঐক্ষত(ঐতরেয় উ. ১/১/১)স ইমাল্লোঁকান অসৃজত(ঐতরেয় উ.১/১/২)। ভগবানের এই দৃষ্টিকেই বলা হয় শম্ভু। ভগবান সরাসরি তাঁর বহিরঙ্গা শক্তির সঙ্গে সঙ্গ করেন না-এই জন্যই একে ‘বহিরঙ্গা’ বলা হয়। তাই ভগবান শিব বা শম্ভু রূপে বহিরঙ্গা প্রকৃতির সঙ্গ করেন। বহিরঙ্গা শক্তি হলেন দুর্গা দেবী। এই জন্য জড় জগতে বিচারে শিব ও দুর্গা হলেন পিতা ও মাতা। এ প্রসঙ্গে ব্রহ্মসংহিতা (৫/৯) বলা হয়েছে- “লিঙ্গযোন্যাত্মিকা মাতা ইমা মাহেশ্বরী প্রজাঃ” অর্থাৎ “এই জগতের সমস্ত মাহেশ্বরী (মহেশ্বর থেকে আগত) প্রজাই লিঙ্গযোনি স্বরূপ।” সেই কারণেই শিবলিঙ্গ রূপে শিবপূজার প্রচলন আমরা দেখতে পাই।
এখন ভগবান, শিব রূপে জীবসমূহকে জড়া প্রকৃতিতে প্রেরণ করলেও শিব পরমেশ্বর ভগবান নন। এই প্রসঙ্গে ব্রহ্মসংহিতায় (৫/৪৫) এ খুব সুন্দর একটি উপমা দেওয়া হয়েছে-

ক্ষীরং যথা দধিবিকারবিশেষযোগাৎ
সঞ্জায়তে ন হি তত পৃথগস্তি হেতোঃ।
যঃ শম্ভুতামপি তথা সমুপৈতি কার্যাদ্গো।
বিন্দমাদিপুরুষম্ তমহং ভজামি ॥

অর্থাৎ, ঠিক যেমন অম্লের প্রভাবে দুধ দই-এ পরিণত হয় কিন্তু দই নয়, সেই রকমই আমি সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে প্রণাম করি যাঁর বিশেষ কার্যের জন্য পরিবর্তিত তত্ত্ব হলেন শম্ভু, কিন্তু শম্ভু ভগবান নয়। আমরা বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেও দেখতে পাই দুধকে সহজেই দইতে পরিণত করা যায়। কিন্তু দইকে কখনই দুধে পরিণত করা যায় না। সেই রকমই ভগবান শম্ভুর উৎস কিন্তু শম্ভু কখনও ভগবান হতে পারেন না। ভগবৎ তত্ত্ব বা বিষ্ণুতত্ত্ব স¤পূর্ণরূপে জড় গুণের অতীত কিন্তু শিব কখনও জড় গুণের দ্বারা প্রভাবিত হন। এই প্রসঙ্গে শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর শ্রীমদ্ভাগবত (৪/৩/১৫) এর তাৎপর্যে শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুরের উদ্ধৃতি দিয়েছেন- “শ্রীশিব হচ্ছেন আত্মারাম বা পূর্ণাত্মা উপলদ্ধির স্তরে অবস্থিত। কিন্তু যেহেতু তিনি তম গুণের দায়িত্বভার সমন্বিত ভগবানের গুণাবতার, তাই তিনি কখনও কখনও জড় জগতে সুখ দুঃখের দ্বারা প্রভাবিত হন।”
চিদ্ জগতে শিব সদাশিব রূপে অবস্থান করেন। কখনও কখনও শিবকে বৈকুণ্ঠের দ্বাররক্ষকও বলা হয়। শিবের নিত্যধাম-মহেশধাম জড়জগৎ ও বৈকুণ্ঠ ধামের মধ্যবর্তী। এ প্রসঙ্গে ব্রহ্মসংহিতা (৫/৪৩)-এ বলা হয়েছে, “গোলোকনাম্নি নিজ ধাম্নি তলে চ তস্য দেবী-মহেশ-হরি ধামসু তেষু তেষু” এখানে দেবীধাম অর্থে জড় জগৎ এবং হরিধাম অর্থে বৈকুণ্ঠ লোক এবং মহেশ ধাম তার মধ্যবর্তী। সেই সদাশিবই জড় জগতে রুদ্র রূপে নিজেকে প্রকাশ করেন।”

শিব পরম বৈষ্ণব

শিব ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত ‘শ্রীমদ্ভাগবতের‘ চতুর্থ স্কন্ধে শিব নিজেই বলেছেন, “আমি সর্বদা ভগবান বাসুদেবকে আমার প্রণতি নিবেদন করি। কৃষ্ণচেতনাই হচ্ছে শুদ্ধ-চেতনা। যাতে বাসুদেব নামে অভিহিত পরমেশ্বর ভগবান আবরণ শূণ্য হয়ে প্রকাশিত হন।” শ্রীমদ্ভাগবতের পঞ্চম স্কন্ধের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, জম্বুদ্বীপের অন্তর্গত ইলাবৃত বর্ষের একমাত্র পুরুষ হচ্ছেন ভগবান শিব। সেখানে তিনি দেবী দুর্গা ও তাঁর অসংখ্য অনুচরীদের সঙ্গে বাস করেন। তা সত্ত্বেও শিব সর্বদা চতুর্ব্যূহের অন্যতম ভগবান সঙ্কর্ষণের ধ্যানে মগ্ন। যিনি শিবের প্রকৃত উৎস।
ভাগবতের চতুর্থ স্কন্ধে আমরা আরও দেখতে পাই শিবের দ্বারা গীত পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা যা ‘রুদ্রগীত’ নামে খ্যাত। রাজা প্রাচীন বহির্ষতের পুত্র প্রচেতাদের শিব দর্শন দিয়ে বলেছিলেন, “হে মহারাজ প্রাচীনবর্হির পুত্রগণ! তোমাদের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল হোক। আমি জানি তোমরা কি করতে চাও, তাই তোমাদের প্রতি কৃপা প্রদর্শন করাবার জন্য আমি তোমাদের গোচরীভূত হয়েছি। যে ব্যক্তি জড়া প্রকৃতি ও জীব আদি সবকিছুর পরম নিয়ন্তা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত, তিনি আমার অত্যন্ত প্রিয়।” এ কথা বলে শিব প্রচেতাদের কাছে শ্রীভগবানের গুণকীর্তন রুদ্রগীত প্রকাশ করেছিলেন।
ভক্তিতে যে চারটি বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব রয়েছে, তার একটি এসেছে মহাদেবের থেকে। তাঁর সম্প্রদায় রুদ্র সম্প্রদায় নামে বিখ্যাত। শিব সাধারণত ভূত প্রেত পরিবৃত হয়ে বাস করেন। এটি প্রকৃতপক্ষে তাঁর বিশেষ করুণার প্রকাশ। ভূত-প্রেত-পিশাচ প্রভৃতি পাপযোনিতে আবদ্ধ জীবরাশি শিবের মাধ্যমে ভক্তসঙ্গ লাভ করে এবং ধীরে ধীরে আধ্যাত্মিক উন্নতির দিকে অগ্রসর হয়। বলা হয় কখনও কখনও শিব ব্রহ্মজ্যোতিতে বিচরণকারী জীবাত্মারাও বিমল কৃষ্ণভক্তির সুযোগ লাভ করে। শ্রীমদ্ভাগবতে (১২/১৩/১৬) সূত গোস্বামী বলেছেন:

নিম্নগানাং যথা গঙ্গা দেবানামচ্যুতো যথা
বৈষ্ণবানাং যথা শম্ভুঃ পুরাণানামিদং তথা।

অর্থাৎ ঠিক যেমন সমস্ত নদীর মধ্যে গঙ্গা শ্রেষ্ঠ, সমস্ত আরাধ্য বিগ্রহদের মধ্যে অচ্যুতই পরম, বৈষ্ণবদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, তেমনি শ্রীমদ্ভাগবত হচ্ছে পুরাণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।

অসুরেরা সাধারণত শিবভক্ত

সাধারণত দেখা যায় জগৎপালক বিষ্ণু সকল ঐশ্বর্যের অধিকারী। অথচ দেবাদিদেব শিব দারিদ্রের মধ্যে বাস করেন। অন্যদিকে বিষ্ণুভক্তগণ সাধারণত দারিদ্রক্লিষ্ট হয়ে থাকেন। আর শিবভক্তগণ প্রচুর সম্পদ লাভ করেন। এই বিষয়টি পরীক্ষিৎ মহারাজ শুকদেব গোস্বামীকে ব্যাখ্যা করতে অনুরোধ করেছিলেন। উত্তরে শুকদেব গোস্বামী বলেন, প্রকৃতির তিনটি গুণ অনুসারে দেবাদিদেব শিব ত্রিবিধ অহঙ্কার রূপে প্রকাশিত। এই অহঙ্কার থেকে পঞ্চভূত ও জড়া প্রকৃতির অন্যান্য বিকারগুলি উৎপন্ন হয়ে মোট ষোলটি বিকার পদার্থ উৎপন্ন হয়েছে।
যখন শিবভক্ত এই সমস্ত পদার্থের মধ্যে তাঁর অভিপ্রকাশের অর্চনা করেন, তখন সেই ভক্ত তদনুরূপ উপভোগ্য সকল প্রকারের ঐশ্বর্য লাভ করেন। কিন্তু যেহেতু ভগবান শ্রীহরি জড়া প্রকৃতির গুণাবলীর অতীত, তাই তাঁর ভক্তবৃন্দও অপ্রাকৃত গুণসম্পন্ন হয়ে ওঠেন। ভগবান হরি তাঁর অনুগৃহীত ভক্তদের জড় সম্পদ হরণ করে তাঁদের আরও দৃঢ়ভাবে হরি, গুরু ও বৈষ্ণবদের শরণ নিতে উৎসাহিত করেন। শিবভক্তরা সাধারণত আসুরিক প্রবৃত্তি সম্পন্ন হয়ে থাকে কারণ তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য জড় জাগতিক ভোগ সামগ্রী লাভ করা। এইভাবে আমরা দেখতে পাই রাবণ, বাণাসুর, কুম্ভকর্ণ প্রমুখ অসুরেরা শিবের বরেই প্রভূত জড়জাগতিক ক্ষমতা লাভ করে ভগবানের বিরোধিতা করেছিল। শিব সাধারণত খুব তাড়াতাড়ি তাঁর ভক্তদের প্রতি সন্তুষ্ট হন। এই জন্য তাঁকে ‘আশুতোষ’ বলা হয়। আর দ্রুত জড়জাগতিক স্বাচ্ছন্দ্য লাভের জন্য, ভোগবৃত্তি সম্পন্ন ব্যক্তিরা শিবের শরণাগত হয়।
প্রায়শই দেখা যায়, তথাকথিত শিবভক্তরা ভাঙ, গাঁজা ইত্যাদি নেশার প্রতি আসক্ত। তারা দাবী করে এগুলি শিবের প্রসাদ। কিন্তু পরম বৈষ্ণব শিব কখনই এগুলি গ্রহণ করেন না। পার্বতী শিবের স্ত্রী, গণেশ শিবের পুত্র। কিন্তু আমরা কখনই পার্বতী বা গণেশকে গাঁজা বা ভাঙ গ্রহণ করতে দেখি না। পক্ষান্তরে পার্বতী ও গণেশ, শিবের মতোই মহান ভগবদ্ভক্ত। তাই তথাকথিত শিবের ভক্তরা না শিবের ভক্ত না ভগবদদ্ভক্ত। প্রকৃতপক্ষে তারা জড়সুখের ভক্ত।
এখান থেকে আমাদের শিক্ষণীয় যে, আমাদের জড় সুখ ভোগের জন্য বিভিন্ন দেবতাদের কাছে কাছে প্রার্থনা করা উচিত নয়। আমাদের কেবল পরমেশ্বর ভগবানের প্রীতির উদ্দেশ্যে তাঁর উপাসনা করা উচিত। এই প্রসঙ্গে গীতায় (৭/২২-২৩) ভগবান বলেছেন- অর্থাৎ- “সেই ব্যক্তি শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে সেই দেবতাদের আরাধনা করেন এবং সেই দেবতাদের কাছ থেকে আমারই দ্বারা বিহিত কাম্য বস্তু লাভ করে। অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিদের আরাধনালব্ধ সেই ফল অস্থায়ী। দেবোপাসকগণ দেবলোক প্রাপ্ত হন, কিন্তু আমার ভক্তরা আমার পরমধাম প্রাপ্ত হন।”

হলাহল কণ্ঠে ধারণ

শিবের অপর নাম নীলকণ্ঠ। সমুদ্র মন্থনে উত্থিত হলাহলের প্রভাব যখন সমগ্র সৃষ্টিতে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন দেবতাগণ শিবের শরণ গ্রহণ করেছিলেন। দেবতাদের বিনীত প্রার্থনায় খুশি হয়ে করুণাবশতঃ শিব দেবতাদের সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। তিনি তাঁর নিত্যশক্তি ভবানীর প্রতি আলোচনার সুরে বলেছিলেন, “হে সাধ্বী ভাবানী, কেউ যখন পরোপকার করে, তখন ভগবান শ্রীহরি অত্যন্ত প্রসন্ন হন, তখন আমিও অন্যান্য প্রাণীসহ প্রসন্ন হই। তাই আমি এই বিষ পান করব। আমার দ্বারা সকলের মঙ্গল সাধন হোক।” এই কথা বলে শিব সেই বিষ করতলে গ্রহণ করে পান করেছিলেন। ক্ষীর সমুদ্র থেকে উৎপন্ন সেই বিষ মহাদেবের কণ্ঠে একটি নীল রেখা উৎপন্ন করেছিল। সেই রেখাটিকে মহাদেবের ভূষণ বলে মনে করা হয়। শিবের হলাহল পানের এই দৃষ্টান্ত থেকে আমরা বেশ কয়েকটি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।
প্রথমত, দুটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক, সমস্ত কর্মের মাধ্যমে ভগবানকে প্রসন্ন করা এবং দুই, আমাদের প্রাণ, অর্থ, বুদ্ধি, বাকশক্তি প্রভৃতির সাহায্যে সর্বদা পরোপকারের চেষ্টা করা। এখন মায়ামুগ্ধ জীবেদের ভগবদ্ভক্তি প্রদানের মাধ্যমে দুটি উদ্দেশ্যই সর্বোত্তম রূপে সাধিত হয়। এই কারণেই ভগবান ভগবদ্গীতায় বলেছেন যাঁরা এই গোপনীয় জ্ঞান ভক্তদের নিকট প্রচার করেন তাদের মতো প্রিয় ভগবানের আর কেউ নেই আর ভবিষ্যতেও কেউ হবেন না।
দ্বিতীয়ত, হলাহল পান করার পূর্বে শিব তাঁর স্ত্রী ভবানীর সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। এখান থেকে শিক্ষনীয় যে, আদর্শ গৃহস্থের কর্তব্য কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে পত্নীর সঙ্গে আলোচনা করা। এই কারণে পত্নীকে বলা হয় অর্ধাঙ্গিনী।
তৃতীয়তঃ সাধারণতঃ ভক্তসঙ্গের মধ্যে বৈষ্ণব-নিন্দাকে হলাহলের সঙ্গে তুলনা করা হয়। প্রকৃত ভক্তদের কর্তব্য কখনও বৈষ্ণব-নিন্দা দ্বারা প্রভাবিত না হওয়া এবং একই সঙ্গে অন্য কারোর কাছে সেই নিন্দা-বাক্য প্রকাশ না করা। তবে শুধুমাত্র পরিস্থিতির উন্নতির জন্য বা সংশ্লিষ্ট ভক্তের আধ্যাত্মিক প্রগতির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কাছে তা প্রকাশ করা যেতে পারে।

মোহিনী মূর্তির শিব বিমোহন

সমুদ্র মন্থনের সময় ভগবানের মোহিনীমূর্তি অবতারের বিষয়ে শ্রবণ করে শিব ভগবানের সেই রূপ দর্শন করবার ইচ্ছা করেছিলেন। স্বীয় শক্তি পার্বতী এবং ভূত-প্রেতদের সঙ্গে পরমেশ্বর ভগবানের কাছে এসে তিনি সেই ইচ্ছা নিবেদন করেছিলেন। শিবের অনুরোধে সম্মত হয়ে ভগবান তাঁর মোহিনীরূপ প্রকট করেছিলেন। মোহিনী মূর্তিকে দর্শন করে মহাদেবের ইন্দ্রিয় অত্যন্ত বিচলিত হয়েছিল এবং কামান্ধ হস্তী যেভাবে হস্তিনীর প্রতি ধাবিত হয়, মহাদেবও সেইভাবে সেই সুন্দরীর প্রতি ধাবিত হয়েছিলেন। মহাদেবের বীর্য সম্পূর্ণরূপে স্খলিত হলে, তিনি বুঝেছিলেন কিভাবে তিনি ভগবানের মায়ায় বশীভূত হয়েছেন। তখন তিনি সেই মোহ থেকে নিবৃত্ত হয়েছিলেন।
এইভাবে শিব নিজের এবং অনন্ত শক্তিমান ভগবানের স্থিতি উপলব্ধি করেতে পেরেছিলেন। ভগবান শ্রীবিষ্ণুর মোহিনী শক্তি যে তাঁকে এইভাবে মোহিত করেছিল তাতে তিনি একটুও বিচলিত বা লজ্জিত হননি, যা দেখে ভগবান মধুসূদন অত্যন্ত প্রসন্ন হয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে শ্রীল প্রভুপাদ তাঁর তাৎপর্যে লিখেছেন যে, শিব ভগবানের কাছে এইভাবে পরাজিত হয়ে গর্বিতই হয়েছিলেন। কারণ শিব যদিও পরাজিত হয়েছিলেন কিন্তু তিনি পরাজিত হয়েছিলেন তাঁর নিজেরই প্রভু অনন্ত শক্তিসম্পন্ন পরমেশ^র ভগবানের কাছে। এইভাবে আমরা দেখতে পাই, প্রকৃত ভগবদ্ভক্তের সন্তোষ তাঁর প্রভু পরমেশ্বর ভগবানের গুণকীর্তনে, তাঁর ব্যক্তিগত সাফল্যের কারণে নয়।
আমরা দেখতে পাই, শিব ও বিষ্ণুকে নিয়ে সাধারণতঃ জনমানসে বিভ্রান্তি রয়েছে। অনেকে মনে করেন শিব পরমেশ্বর ভগবান এবং অনেকে মনে করেন বিষ্ণু পরমেশ্বর ভগবান। কিন্তু আমরা যখন শ্রুতি, স্মৃতি, পুরাণ প্রভৃতি সমস্ত শাস্ত্রের আধারে বিচার করি তখন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, বিষ্ণুই পরমেশ্বর ভগবান।
শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণিত শিব কর্তৃক বৃকাসুরকে বর প্রদান করার কাহিনী, বানাসুরকে রক্ষা করার জন্য শিব ও কৃষ্ণের যুদ্ধের কাহিনী প্রভৃতি আরও অনেক উপাখ্যান থেকে এটি সন্দেহাতীত ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় যে, বিষ্ণুই পরমেশ্বর ভগবান, পক্ষান্তরে সমগ্র পুরাণ ও ইতিহাসে, এমনকি শিব পুরাণেও, এমন একটিও উদাহরণ নেই যেখানে বিষ্ণু শিবের দ্বারা পরাজিত হয়েছেন।
তাই পদ্মপুরাণে শিব নিজেই পার্বতীকে বলেছেন-

আরাধনানাং সর্বেষাং বিষ্ণোরারাধনাং পরম
তস্মাৎ পরতরং দেবি তদীয়ানাং সমর্চনম্ঃ

অর্থাৎ সমস্ত রকমের উপাসনার মধ্যে বিষ্ণুর উপাসনা শ্রেষ্ঠ এবং তাঁর চেয়েও শ্রেষ্ঠ বিষ্ণুভক্তদের উপাসনা করা। এই জন্য আমাদের কর্তব্য স্বতন্ত্র ঈশ^ররূপে শিবপূজা না করে, ভগবানের ভক্ত রূপে, বৈষ্ণব রূপে শিবের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা।

সম্পর্কিত পোস্ট

‘ চৈতন্য সন্দেশ’ হল ইস্‌কন বাংলাদেশের প্রথম ও সর্বাধিক পঠিত সংবাদপত্র। csbtg.org ‘ মাসিক চৈতন্য সন্দেশ’ এর ওয়েবসাইট।
আমাদের উদ্দেশ্য
■ সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা।
■ জড়বাদের দোষগুলি উন্মুক্ত করা।
■ বৈদিক পদ্ধতিতে পারমার্থিক পথ নির্দেশ করা
■ বৈদিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
■ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ অনুসারে ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তন করা ।
■ সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।